যখন বৃষ্টিতে ভিজতে চেয়েছি
আষাঢ়, শ্রাবণ আমার দুই প্রেমিক
কথা দিয়েছিল, বৃষ্টিতে সাজিয়ে দেবে হাত।
সে আমার সকাল বেলার গল্প
তারপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে
বৃষ্টিতে ভেজা হয়নি আর।
এক তীব্র মধাহ্নে
আকাশ আবৃত করে জমেছিল মেঘ
নেমে এসে ছিল আদিম দেবতা আকোটাংকা।
কিন্তু সূর্যদেব আমন-রা এসে
বাড়িয়ে দিলেন সুপ্রাচীন বর্শা।
আকোটাংকা সেই যে চলে গেল, আর ফেরেনি।
আমি যখনি বৃষ্টিতে ভিজতে চেয়েছি
রোদ্দুর বিছিয়ে দিয়েছে তার ঝলমলে চাদর
মেঘবালকের দল ফিরে গেছে মুখ ভার করে।
আহা, বলছি তো, রোদ্দুরকে ভালোবাসি আমি
তাই বলে একদিনও বৃষ্টিতে পাখা ছড়িয়ে দেবো না
তা কি হয়।
ওলো শ্যাম
ওলো শ্যাম তোর কপাল ভালো
আমি আগের রাধা নই গো,
আমি শিবের মাথায় জটা হয়েছি
বষণভূষণ ত্যাগ করেছি
ছাই মেখেছি অঙ্গে
মন পবন আকাশে রেখে
দশ দুয়ারে কপাট মেরে
চিত্ত নাই আর রঙে।
ওলো শ্যাম, তুই চন্দ্রাবলীর ঘরে যা
কমলবনে আসিস না।
বাসনার বাসা ভেঙে
ভুজঙ্গীরে সাধিস না।
দিব্যি গেলে বলছি তোরে
আগের রাই যদি হতেম
তোর যোগীর ভড়ং ছিন্ন করে
দাসখত লিখিয়ে নিতেম।
নূপুর কাঁকন ছুঁড়ে ফেলে
মাতঙ্গী বেশ ধরেছি রে
তোর মোহন বাঁশি যতই বাজাস
ওই তালে আর নাচবো না।
ওলো শ্যাম তোর পরাণ বাঁচা
এদিক পানে তাকাস না।
না ভাসাইয়ো জলে
লখিন্দর দিয়েছিল প্রথম চুম্বন
আদিম কুমারী নাগিনীর ওষ্ঠপুটে।
কথা ছিল পাড়ি দিব দূর রেলপথ
পাহাড় চূড়ায় গড়ে নেবো নিজস্ব নগর
তাহিতির নীল জলে ঝিনুক প্রাসাদ
আফ্রিকার উপকূলে অরণ্য বসতি
কথা ছিল হাতের মুঠোয় পুরে নেবো
নৈনিতাল, বারানসী, আগ্রার মহল।
মৃত মাছ হয়ে ভেসে ওঠে সব গোপন বাসনা
বারো হাত কাকুঁড়ের জীবন খাঁচায়
শ্বাসরুদ্ধ আমাদের বিস্মৃত কামনা।
আগামি জন্মের জন্য তুলে রাখি এসো
যৌথ বৃষ্টি স্নান, কালো ড্রাগনের ঘর
মেঘমগ্ন নিবিড় দুপুর, সীতাহার,
আশ্বিনের ভোরবেলা, সেতার সংলাপ।
এক জীবনের যাবতীয় ঋণ শোধ করে
মৃত্যু অভিমুখে হেঁটে চলে নিষাদ কাফেলা।
মৃত্যু নয় চূড়ান্ত কখনো
মৃত্যু নয় বিচ্ছেদ নগর
দেখা হবে অন্য কোনো গ্রহে
অন্য কোনো সময়ের বাঁকে।
না হয় আরেক বার ধরা যাবে হাত
শোনা যাবে নাবিকের জাহাজী সংগীত
দেখা হবে রেশমপথের ধারে
দীপজ্বলা সরাইখানায়, ভক্তপুরে, সিয়ান নগরে।
এ জন্মের মতো শেষ হোক রাসলীলা
শেষ হোক পূর্ণিমার মোহন উৎসব
ক্লান্ত চোখে নেমে এসো ঘুম, এসো প্রেম,
এসো মৃত্যু, মৃন্ময় আবাস, আচ্ছাদন
সর্বশেষ আলিঙ্গনে বিদায় সুপ্রিয়।
ক্যামাক স্ট্রিটে এক সন্ধ্যা
শীতের কুয়াশায় আবৃত কলকাতা
হিমের হুডিতে মুখ লুকালো ক্যামাক স্ট্রিটের গলি ।
একুশ শতক নাকি ঊনবিংশ সাল?
দীপজ্বলা ছোট্ট ক্যাফে বসে আছে কার্ল
সুর তোলে স্প্যানিশ গিটার।
মোমের নরম আলো, বিষণ্ন গঙ্গার ঘাট
বন্দরে ভিড়েছে আজ
অতলান্ত পাড়ি দেয়া বাষ্পীয় জাহাজ।
জুড়ি গাড়ি এক
রাজসিক ছন্দে চলে গেল প্রেয়সী বিলাসে।
হ্যারিসন কার্ল প্রাসাদ নগরীতে
রেখে যাবে নিজস্ব রক্তের ধারা।
আজকের এই ক্যাফে ভীষণ অচেনা
আলো আঁধারির অর্গ্যান বাজায়
সেন্ট পলস পাঠায় ইশারা
ঘন্টাধ্বনি তরঙ্গিত মদিরার গ্লাসে।
একুশ শতক তার চেনা হাসি হাসে
সকালের বাস্তব রোদ্দুরে
সে ক্যাফের ঠিকানা মেলে না।
ঘুড়িজন্ম
ছোটবেলাতেই আমাকেপাখি-পড়া করে শেখানো
হয়েছিল আমি একটা রঙিন ঘুড়ি। আমার মা
ছিলেন নেহাতই সাদাকালো ঘুড়ি। তিনি আমাকে
বাতাসে ভেসে বেড়ানো আর ঘুড়িসমাজের বিশেষ
কায়দাকানুন শিখিয়েছিলেন। কখন মাঞ্জা দিতে
হয় আর কখন বা অন্য ঘুড়ির যাবতীয় অহংকার
ভোঁকাট্টা করতে হয় তা শিখতে দেরি হয়নি
মোটেই। মা বলতেন, ‘মনে রাখবি, তুই কিন্তু পাখি
নস। যত উঁচুতেই উড়িস, ডানা নেই তোর। সুতো
ছাড়া ওড়ার জো নেই।’
মনে আছে একবার একটা সুতোছেঁড়া ঘুড়িকে
আকাশে স্বাধীন ভেসে বেড়াতে দেখে আমারও
মন হুহু করে উঠেছিল। কিন্তু মা কড়া ধমকে
বলেছিলেন, ‘ওসব সুতোছেঁড়া ঘুড়িদের না আছে
মানমর্যাদা, না শরমলজ্জা, ছিঃ কি ঘেন্না।’
মধ্যদুপুরে আমার পাখি হতে সাধ জেগেছিল। সে
ছিল এক বালিহাঁস। তার সঙ্গে উড়তে উড়তে
উড়তে ভুলেই গিয়েছিলাম আমি পাখি নই। কিন্তু
সুতোতে টান পড়লো। নেমে আসতে হলো। একটা
জীবন নাটাই-বাঁধা হয়েই কেটে গেল।
ভাবছেন পরের জন্মে আমি পাখি হতে চাইব?
মোটেই না। পরের জন্মে আমি মানুষ হবো।
আমার হাতেই থাকবে নাটাই।