তৈমুর খান
ভীরু তপস্যার নিভৃতি চারণা থেকে কবিতাকে আত্মপ্রকাশের ধ্বনিঝংকারে সুস্পষ্ট বাকপ্রত্যয়ী করে তুলেছেন নব্বই দশকের কবি মন্দাক্রান্তা সেন। নিজেই নিজের প্রেরণা হয়ে নিজের সংশয় আর দোলাচলে চাওয়া-পাওয়ার সীমানায় দাঁড়িয়ে আত্মমুক্তির ঘোষণায় তারুণ্যের দীপ্তি এনে দিয়েছেন কবিতায়। তসলিমা নাসরিন যখন শুধু নারীবাদ, যৌনবাদ এবং মৌলবাদের বিরোধিতাকে তাঁর কবিতার বিষয় করে তুলেছেন, মন্দাক্রান্তা তখন শরীরী উত্তাপে চিরন্তন যৌবনের গান রচনা করেছেন। এই যৌবন শুধু দেহের নয়, মনের, প্রকৃতির, শব্দের এবং যাবতীয় আকাঙ্ক্ষার। বিদ্রোহিনী হয়ে নয়, সাহসিনী হয়েই তাঁর আগমন। বাংলা কবিতায় যে ছান্দিক সরসতায় গতি সঞ্চার হয়েছিল, তার প্রাকমুহূর্তকে মন্দাক্রান্তা-ই শানিত করে তুলেছিলেন। সংস্কারাবদ্ধ শরীরের মন তিনিই প্রথম জাগিয়ে ছিলেন। তিনিই প্রথম দেখিয়েছিলেন শব্দেরও চোখ আছে। তিনিই প্রথম বোঝাতে পেরেছিলেন সম্পর্কের ঘর্ষণে আগুন জ্বলে ওঠে। তাঁর প্রত্নপ্রবৃত্তির জাগরণে এক তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের উন্মুখ লীলা খেলা করে—যা তসলিমার মতো উগ্র নয়, যা যৌনাচারের বিসর্পিল যাত্রায় কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে ওঠে না। নিজস্ব স্বপ্নের কুঠুরিতে তার জন্ম, সুতরাং অবদমিত নয়, তাকে একটা দূরত্বের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে মানবের অবারিত উঠোনে তাকে চলাফেরার সুযোগ দেওয়া। তার শরীরী ঘ্রাণকে সমাদর করা, তার ঘাম, অশ্রু, লালাসিক্ত চুম্বনে নিষিক্ত হওয়া সবই প্রবৃত্তিমুখীন এই মানব-রসায়ন। আর এই প্রবৃত্তিকেই প্রকৃতির মধ্যে ছেড়ে দেওয়া—যা মেঘ, নদী, জল, গাছ হয়ে আমাদের সর্বদা যৌবন-বাউলের একতারা হয়ে ওঠে। হোক তারা আমাদেরই রূপক, আমাদেরই শরীরী যাপন, তবু তাদের মধ্যে ব্যাপক যৌবনের বিস্তার, আত্মবিক্ষেপ চিত্রকল্পকে প্রাণ দেয়, কথা বলায়, মানুষ করে তোলে। সুতরাং প্রকৃতিও সংরাগের বিপুল সম্ভার, ভাষালিপি এবং অমোঘ চরিত্র লাভ করে। মন্দাক্রান্তা এখানেই সার্থক।
মন্দাক্রান্তার প্রেম আমাদের মরমের মাটিতে তার শিকড় রেখে জেগে উঠতে চেয়েছে, সুতরাং সেই প্রেমের ফসলেও নিষ্ঠা আছে, শ্রম আছে, স্বপ্নের মাধুর্য আছে:
‘রক্তজবার গোড়ায় ঢালছি জল
জলের মতন সমতল হোক প্রাণ’ (বাগানী)
রক্তজবা যে যুবক, জল যে স্নেহমমতা; নিজেকে জলের মতোই সমতল করে একটি সুন্দর সম্পর্কের খোঁজ করেন কবি, যেখানে গাছ-মানুষের পৃথিবী, যৌবন-সম্মানের আনন্দ বয়ে আনে। কবিতা যে শুধু সাময়িকের, শুধু মুহূর্তের নশ্বর বন্দনা নয়, একটা সারস্বত সাধনার অনবদ্য মানবজীবনের কমনীয় প্রেমিকাসত্তায় মাতৃত্বও প্রবেশ করে তা কবিতাটির এই শেষ দুই পংক্তিতে ধরা পড়ে:
‘মাটি খুঁড়ে যাই, জল ঢেলে যাই আমি,
আমার বালক আমার যুবক হোক।’
নারী-পুরুষের সম্পর্ক তখন যৌন সম্পর্কের পরিধি অতিক্রম করে জৈব সম্পর্কের ভেতর ভালোবাসায় সৌন্দর্যের স্বপ্ন যোগ হয়ে যায়।
যতই হৃদয় অবাধ্য হোক, মন্দাক্রান্তা অবাধ্য হয়ে উঠুন, কিন্তু সভ্যতার প্রবহমান আদিমতা যে আমরাই বয়ে চলেছি তাকে কখনোই অস্বীকার করেননি। শস্যের গন্ধ, জলের গন্ধ, ছাতিমের চেনা বাস, রোদের গন্ধ, রোদ-বৃষ্টিতে ভেজার লোভ, নোনতা জ্যোৎস্নার স্বাদ, মাছ হয়ে যাওয়া পায়ের পাতা, শিকার গল্প, উষ্ণ ঝাউবন—সবই ভিড় করে আসে। এখনো আমাদের প্রলুব্ধ করে। এসব গুহাচিত্র নয়; মানুষও তথা প্রেমিকও গুহাচিত্র নয়; শিয়রে মেঘের ধ্বংসস্তূপ হয়ে বিমর্ষ শুষ্ক জলবাহী হয়ে যায়—প্রবৃত্তিঘ্রাণ, অবদমিত আকাক্ষার বাহিত উত্তরাধিকার যেন। যেন প্রতিটি মানুষই এই আবহাওয়ায় অঙ্কুরিত হতে চায়। পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকে, সুপ্ত থাকে।
কবি তারই টের পান:
‘তোমার কপাল জুড়ে
সমতলে শস্যের গন্ধ
লোভনীয় ঝলসানো পশু, পাখি, সৎ উপার্জন কিছু নেই, ছিল শুধু, দীর্ঘ সে অতীত,
চোখের সমস্ত জল চলে গেছে সিন্ধু ও নীলে।’ (গুহাচিত্র নও)
মানুষ-ও পৃথিবী হয়ে যায়, তার চোখের জল-ও সিন্ধু ও নীলনদে চলে যায়। এখানেই আদিচেতনার বসত। সৃষ্টি-ধ্বংস অথবা ধ্বংস-সৃষ্টি নিবিড় ভাবে এর প্রক্রিয়াকরণ চলে আসছে। মানুষের ভিতরে মানুষ ঢুকে যাচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে, কিন্তু আদিসত্তার কোনও পরিবর্তন নেই। মেঘ, রোদ, ঘাস, ধুলো, জমি আমাদের আকাঙ্ক্ষার কথা বলে, আমাদের তাপ, ভাপ, কাঁপ জাগায়। বোতামহীন পাঞ্জাবি ভিজে যায় বর্ষাদিনে। জলকে ভালোবাসা, জলাশয়কে ভালোবাসার মধ্যেও এসে যায় এই মননের সংবাদ। কারণ জলাশয়ের নারীরূপ আছে, স্বচ্ছতা আছে, ঢেউ তোলা আছে, সব ছাপিয়ে স্নান করানো স্পর্শে ভালোলাগা জড়ানোর প্রকাশ আছে। সেই রূপকের কথা না শোনালেও জলাশয়ের মন খারাপ কবি দ্যাখেন। তার চোখের কোলে মাটি ধরা পড়ে। তখন জিজ্ঞাসা করেন:
‘জলাশয়, তোমার অসুখ কি গভীরে?’
জলাশয়কে ‘তোমার’ সম্বোধনের মধ্যে দিয়ে কবি যে ব্যক্তিত্বের আরোপ করেন তা আমাদের চেনা মানুষীর মতো হয়ে যায়। যার চোখের কোলে মাটি, যে তাকাতে পারে না। জল-মাটি-চাঁদও মানুষের সম্পর্ক চায়। যে সম্পর্ক পরস্পরকে দেখার, প্রেমে পড়ার। আবার যুবকের প্রেমে নারীও নদী হয়ে যায়। অর্থাৎ মন্দাক্রান্তার কাছে মানুষও যেমন প্রকৃতি, প্রকৃতিও তেমনি মানুষ। শুধু ব্যক্তিগত বিকেলের মন খারাপ কখনো কখনো নিক্ষিপ্ত হয়, তেমনি ব্যক্তিগত ভালো থাকাও আত্মনিবেদনের ভাষা পেয়ে যায়। যৌবনের চপলতা, রহস্যময়তায় টিভির বিজ্ঞাপন, দেওয়ালের বিজ্ঞাপনও কথা বলায়, বাসের সিটে অচেনা যাত্রীর পাশে বসে শরীরী ওম অনুভূত হয়, মনে পড়ে প্রিয়, যুবককে, একটু স্পর্শের জন্য কখনো ব্যাকুলতা বাড়ে, নিজের বিবাহিত স্বামীকে আড়ালে রেখেও পরকীয়ার চোরাটানে ফিরে ফিরে চায়। পর্যটকের শরীর নিয়ে যেমন ময়ূরাক্ষী নদী খেলা করে, তেমনি নারী হৃদয়ও চায়, একসঙ্গে হাঁটার, শরীর ছেঁড়ার টানও জেগে ওঠে। দশ বছরের ছোটো অনুরাধাদির ছেলেকে পড়াতে বসে নারী পুরুষের মৌলিক টানেই হৃদয়ের আবেদন বেরিয়ে আসে। স্বপ্নের পুরুষ মন থেকে সরে গিয়ে ছাত্রটি তখন উঁকি মারে:
‘কেউ কিছু ভাবছে না, বয়সের দারুণ অমিল আমি শুধু তোকে ভাবি, চিবুকের ডানদিকে তিল
কোনও দিনও দেখিস না, তোর নাম লিখেছি মলাটে
বুধবার বিকেলের অপেক্ষায় সারাহপ্তা কাটে’ (কাল থেকে আসব না)
কিন্তু যতোই অপেক্ষা গাঢ় হোক তা পাপ পর্যন্ত গড়ায় না, কারণ— ‘আমি তোর মাসি হই, তোর সঙ্গে করব না পাপ’। অনুরাধাদির প্রতি তার কৃতজ্ঞতা আছে, তখন লোডশেডিং হলেও অন্ধকারে যেতে পারবে বলে ছাত্রের হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে। প্রেম ততক্ষণই তার মাধুর্য বজায় রাখতে পারে যতক্ষণ তা প্রেম থাকে। শরীরে, যৌনতায় প্রেমের ঘোষণা শোনা গেলেও ‘পাপ’ শব্দটিকেও পাশাপাশি মন্দাক্রান্তা নিয়ে আসেন। উরু, জঙ্ঘা প্রেমের মৌচাক সাজালেও সেখানে তিনি মধু খোঁজেননি, নদীতে সাঁতার কাটার আহ্বান জানালেও তা পূর্ণতা পায়নি। সবই মনের সীমানায় ঘোষণা, সাহসী প্রকাশ, বুকে হাত রেখে বুকের নিলাম। তাই মন্দাক্রান্তাকে বলতে শুনি:
‘তাপ দ্যাখেনি আকাশ পাতাল
পাপ দ্যাখেনি আমার চোখ
ঘরের পুরুষ অন্যঘরে
আমার পুরুষ অন্যলোক।’
(ব্যাভিচারিণী)
ঝড় হোক, আগুন হোক, নদী হোক কিংবা তরুণী মেঘ হোক—যে আহ্বানে তসলিমা নগ্ন হতে পারেন, মন্দাক্রান্তা সেখানে শালীনতায় নিজেকে ধরে রাখেন। বাসস্টপের ছেলের সঙ্গে তার প্রেমের বাসনা জাগলেও শেষপর্যন্ত সামনে থাকে বিজ্ঞাপনের পোস্টার:
‘ফাঁকা বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে আমি
প্রেম করছি পোস্টারের সঙ্গে।’
(বারান্দার নিচে)
অসম পরকীয়া এখানেও, যে পরকীয়ায় ইন্দ্রকাকু প্রেমিক হয়ে উঠেছিল, যার চুমু খাওয়া সিঁড়িতে নামার মুহূর্তে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে:
‘ঝেড়ো শ্বাস, সিঁড়ির আড়ালে
অতর্কিতে বিছে কামড়ালে
রক্তময় জ্বালা অনর্গল’
(একটি অসম পরকীয়া)….
কিন্তু এই চুমুর জ্বালায়ও প্রেম থাকে, কেননা শরীরের ভূগোল সেখানে বিধ্বস্ত হয় না, মননের মাটিও বিষাক্ত হয় না, চাওয়া-পাওয়ারও চূড়ান্ত পরিধি নির্ণীত হয় না। এই প্রেমই যখন শরীরী সীমানায় নেমে আসে, তখনই বোঝা যায় জলতরুণীর জলেও কেমন আগুন জ্বলে ওঠে। তখনই আসে বদ্ধতা ও বিষাদ, গতানুগতিকতা ও নিস্পৃহতা। তখনই জ্বর আসে, শরীর জুড়ে তাত, কানের ঝুটো মুক্তোও ভারী হয়ে যায়। প্রেম তখন শরীরে রূপান্তরিত:
‘পায়ের পাতা মাছ হয়েছে, গভীর জলে ঝাঁপ, খেলছে হাঁটু, উরুর দিকে চাপ
উঠছে, কোমর, এবার তোমার দান
তারপরে আর দান ফেলিনি, উপুড় হল ছক নিজেই খেলা খেললে মারাত্মক
এই বুঝি সেই দুপুরবেলার চান?’
(ভালবাসার পরে)
ভালোবাসার পরে এই মারাত্মক খেলা চলতে থাকে যা প্রেম নয়, শুধু কাম, গলিত কাম; রতির পাঁক ঘেঁটে তখন আর কিছুই পাওয়া যায় না। ঘুম চায়, ঘুমের ঠান্ডা হাত এসে ঘুম পাড়াক। যান্ত্রিক সভ্যতার যৌনতারও একসময় ক্লান্তি আসে:
‘সমুদ্র শুষেছ ওষ্ঠে, তোমার কপাল জুড়ে ঘাম দাও, ঐটুকু দাও, পান করি, পরিশ্রান্ত লাগে কতটা জীবন ছিল এই শেষ আদরের আগে’
(শেষ আদরের পর)
শেষ আদরের আগের জীবন ও পরের জীবনে অনেক তফাত। আগের জীবন ছিল চঞ্চল তারুণ্যের উদ্যমে আসক্তিতে স্বপ্নাচ্ছন্ন যা অনন্ত তৃষ্ণায় সমুদ্রও ওষ্ঠে শুষে নিতে পারত, কিন্তু শেষ আদরের পর জীবন হয়েছে একটা মুহূর্ত-চুলের নিঃসঙ্গ স্মৃতিময় অনুধ্যান:
‘ছোঁও, আরও একটু ছোঁও, মুহূর্তে উজাড় হোক প্রাণ
প্রিয় পুরুষের কাছে চেয়ে নেব নিভৃত সন্তান’
(শেষ আদরের পর)
এই নিভৃত সন্তানই শেষ পর্যন্ত নিজেদের মুখোমুখি বসে থাকে। যার কাছে কবি কিছুটা শান্তি পেতে পারেন, যার হাতে নিজেকে তুলে দিতে পারেন। প্রেম যে অসার, শরীরও যে তখন আর শরীরকে ডাকে না, এমন একটা সময়ে পৌঁছে গেছেন সকলেই। ‘যদি প্রেম দিলে না প্রাণে’ নামে একটা প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে মন্দাক্রান্তা জানালেন, ‘কিন্তু আপাতত প্রেম এমন এক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে সবদিক থেকেই তার চেহারাটা অত্যন্ত নিঃস্ব। একে নিয়ে আর যেন বেশি কথা কিছু বলারই নেই।’ সুতরাং স্তব্ধতাই তখন বেশি, নিভৃতই তখন একমাত্র কাম্য। আত্মসমাহিত সময়ের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া।
মন্দাক্রান্তাকে শরীরবাদী কবি বলা হলেও তাঁর শরীরীঘ্রাণের অন্তরালে এক বেদনারও নিবিড় জগৎ আছে যার হৃদয়স্পন্দনে গভীর মানবতাবোধের অনুশীলন হয়। যৌনতার ফোড়ন কিংবা প্রেমের বস্তাপচা কচকচানি সরে গিয়ে সেখানে নতুন ভোরের আলো পড়ে। স্বপ্নদৃশ্যে মিশে যায় জীবনের সংলাপ। আর কল্যাণেরই বন্দনায় মানুষের জন্যই তিনি সৃষ্টিকে চালিত করেন বিরামবিহীন। প্রতিনিয়ত।