spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধইসলাম প্রশ্নে ঔপনিবেশিক পাণ্ডিত্যের রাজনৈতিক চেহারা : শেষ পর্ব

লিখেছেন : মুসা আল হাফিজ

ইসলাম প্রশ্নে ঔপনিবেশিক পাণ্ডিত্যের রাজনৈতিক চেহারা : শেষ পর্ব

মুসা আল হাফিজ

নয়.

 একই চিত্র ও চরিত্র আমরা দেখবো   , হোরেস হ্যামেন উইলসন (১৭৮৬-১৮৬০) এর কাজে। তিনি ছিলেন এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলের সেক্রেটারী। ১৮১১ থেকে নিয়ে ১৮৩২ সাল অবধি অল্পবিরতিসহ তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন বরিত। ১৮৩৭ সাল থেকে রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন মৃত্যুঅবধি।বহুমাত্রিক বিশেষজ্ঞ ছিলেন তিনি।   প্রাচ্যবিদ, লেখক, মুদ্রা বিশারদ, অক্সফোর্ডের অধ্যাপক এবং ইন্ডিয়া অফিসের গ্রন্থাগারিক। লন্ডনের সোহো স্কয়ার ও সেন্ট টমাস হাসপাতালে শিক্ষাপ্রাপ্ত হোরেস হ্যামেন উইলসন ১৮০৮ সালে কলকাতায় আগমন করেন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মেডিক্যাল সার্ভিসে যোগদান করেন। কিন্তু অচিরেই তিনি চিকিৎসা পেশা ত্যাগ করে কলকাতা টাকশালে মুদ্রা-ধাতু পরীক্ষক (Assay Master) হিসেবে যোগদান করেন। ১৮৩২ সালে ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন। সেই অবধি তিনি নিয়োজিত ছিলেন এ কাজে।

 উইলকিন্স ও কোলব্রুকের সংস্পর্শে তিনি প্রাচ্যতত্ত্বের প্রতি হন আগ্রহী। সংস্কৃত অধ্যয়ন করেন। অনুবাদ করেন কালিদাসের  মেঘদূত (১৮১৩)। তার শ্রেষ্ঠ রচনাকর্ম্   Sanskrit English Dictionary (১৮১৯) ও Theatre of the Hindus (১৮২০) ।  Religious Sects of the Hindus গ্রন্থে তিনি হিন্দুদের সামাজিক ক্রিয়াকর্ম, রীতিনীতি ও সামাজিক বিধিবিধান হাজির করেছেন। ১৮৩২ সালে যোগ দেয়ার পরে অক্সফোর্ডে তিনি Lectures on the Religious and Philosophical Systems of the Hindus (১৮৪০), Ariana Aqtinua (সংস্কৃত ব্যাকরণ) এবং A Historical Account of the Burmese War সহ বেশ কিছুসংখ্যক মৌলিক রচনা প্রকাশ করেন। উইলসন কর্তৃক সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে মিলের History of British India-র দ্বিতীয় সংস্করণ এবং ম্যাকনাটেন রচিত Hindu Law-এর দ্বিতীয় সংস্করণ।  উইলসন ভালোভাবেই শিখেছিলেন বাংলা, ফারসি, আরবি ও ভারতীয়  বিভিন্ন  ভাষা। ভারতের বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের আইন-কানুন ও প্রথা-পদ্ধতি নিয়ে লিখেন অসামান্য গ্রন্থ Glossary of Judicial and Revenue Terms যা এখনো এ বিষয়ে গবেষক, প্রশাসক ও আইনজীবিদের রেফারেন্সবুক হিসেবে বরেণ্য।  তার এসব রচনায় ভারতের জীবন ও সংস্কৃতি প্রতিফলিত।

 তিনি যে ভারতকে উপস্থাপন করেন, সেটা মূলত এক হিন্দুভারত। যে হিন্দুদের মধ্যে প্রবল একটি শ্রেণী ব্রিটিশ শাসনকে আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করেছিলো। তাদের প্রতি বাড়িয়ে দিয়েছিলো সহযোগিতার হাত।

 উইলসনের  ভারতের সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাসে মুসলিমরা কেবল পার্শ্ব্টীকার জায়গা পায়। যে মুসলিমরা  ভারতবর্ষের উপর নিজেদের দাবি ত্যাগ করছিলো না। ব্রিটিশদের শাসনে প্রতিদিন, প্রতিরাতে  বিঘ্ন তৈরী করছিলো। তারা ভারতের স্বাধীনতা দাবি করছিলো। তাদেরকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করা যাচ্ছিলো না। উপনিবেশের প্রয়োজন ছিলো তাদেরকে ভারতের পার্শ্বটীকায় পরিণত করা। ভারতের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, শিক্ষা ও অর্থনীতিতে তাদেরকে ক্রমাগত গৌণ করে তোলা। এবং তাদের প্রতিবেশি সম্প্রদায়কে অধিকতরো মহিমান্বিত এবং সুবিধামণ্ডিত করা।

এশিয়াটিক সোসাইটির পণ্ডিতরf পরবর্তিতে আরো সরাসরি ভারতের জনসমাজকে বিভক্ত করেছেন। কাউকে হারিয়ে দিয়েছেন, কারো হাতে তুলে দিয়েছেন সবকিছুর মালিকানা। ইতিহাসকে এমনভাবে উল্লেখ করেছেন, যা আসলে ইতিহাস নয়। বস্তুত ইতিহাসের নামে সাজানো ও পরিকল্পিত গালগল্প তারা ফেঁদেছেন। যেন মুসলিমরা হয় দাগী আসামী। যেন হিন্দু বুঝে, তার শত্রু দখলদার ব্রিটিশ নয়। তার আদি ও অকৃত্রিম শত্রু হচ্ছে, প্রতিবেশি মুসলমান। তারা ইতিহাস লিখেন এবং পুরনো ভাষ্যকে কবর দেন। তারা জ্ঞানকর্ম্ সম্পন্ন করেন এবং এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমা দখলদারির প্রয়োজন পূরণ করেন। ভারত উপমহাদেশে দখলদার পশ্চিমাদের প্রয়োজন ছিলো হিন্দু-মুসলিম বিভাজন। নতুবা শাসন এখানে নিরাপদ হচ্ছিলো না। 

  এমন কাজের ভালো নমুনা স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম (১৮১৪-১৮৯৩) । তিনি ছিলেন প্রত্নতত্ত্ববীদ, ইঞ্জিনিয়ার, নগরতত্ত্ববীদ, লিপিবিশেষজ্ঞ,  মুদ্রাবিশেষজ্ঞ, সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল, আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠিাতা পরিচালক এবং একজন অসামান্য গ্রন্থকার। ভারতে এসেছিলেন ১৮৩১ সালের ৯ জুন। সেনাবাহিনীতে দায়িত্বরত ছিলেন ১৮৬১ সালের ৩০ জুন অবধি।সেখান থেকে অবসরে গিয়ে শুরু করেন নতুন কর্মযজ্ঞ। তারে প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ সরকার হাতে নেয় ভারতে প্রত্নতত্ত্ব অনুসন্ধানের নতুন কার্যক্রম।

১৮৬১ থেকে নিয়ে  ১৮৮৫ সাল অবধি তিনি ছিলেন এর প্রধান।এ সময়ে তিনি অসংখ্য মুদ্রা, উৎকীর্ণ লিপি, ভাস্কর্য ও স্থাপত্য নিদর্শন আবিষ্কার করেন। এ কাজের মাধ্যমে তিনি প্রাচীন ভারতের প্রকৃত ইতিহাসের ভিত্তি এবং ভারতীয় লিপিতত্ত্ব, মুদ্রাতত্ত্ব, শিল্পকলা ও স্থাপত্যশিল্প চর্চার নতুন ধারা প্রতিষ্ঠা করেন।এ ক্ষেত্রে পরবর্তী সকল গবেষকের পথপ্রদর্শক ছিলেন তিনি।  প্রাচীন নগর আবিষ্কার থেকে নিয়ে স্থাপত্য, লিপিকলাসহ বিচিত্র বিষয়ে তার বক্তব্য হয়ে উঠে চূড়ান্ত প্রমাণ। পরবর্তীপ্রজন্মের যে কেউ গবেষণার জন্য প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের যে কোনো শাখাই সে বেছে নিক না কেন, কানিংহামের কাছে তাকে যেতেই হবে। তার রচনাবলীর  সাহায্য ছাড়া কাজকে এগিয়ে নেয়া প্রায় অসম্ভব।  তিনি যে The Ancient Geography of India লিখেছিলেন, সেটা লিখেছিলেন গোটা ভারত ভ্রমণ করেই। প্রতিটি অঞ্চল ও জনপদকে তিনি পাখির চোখে পর্যবেক্ষণ করেন, সফর করেন ভারতময়, বছরের পর বছর ধরে নেন প্রস্তুতি। শেষ অবধি তিনি হয়ে উঠেন ভারতের প্রাচীন লিপি বা মুদ্রার মতোই ভারতের ভূগোল সম্পর্কে বক্তব্য রাখার সবচে’ নির্ভরযোগ্য পণ্ডিত। বস্তুত এসব বিষয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় তার একচ্ছত্র অধিকার।

ভারতীয় মুসলিমরা তার মনোযোগ লাভ করেনি, তা নয়। তিনি একাধিকবার এসেছেন বাংলায়। গিয়েছেন সোনার গাঁয়ে, সংগ্রহ করেছেন বারোটি মুসলিমলিপি। গিয়েছেন পরিবিবির মাজারে, বাবা আদম শহীদের মাজারে, পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদে, মুসলিম বাংলার রাজধানী গৌড়ে। কিন্তু সোনার গাঁয়ে তিনি আসেন সুবর্ননগরের খোঁজে,  গৌড়ে গিয়ে মূলত তালাশ করেন প্রাচীন পুন্ড্রনগর।     

কানিংহামের ব্যাপ্তি যেখানে এতো ব্যাপক, অবদান যেখানে এতো বিস্তৃত, গ্রহণীয়তা যেখানে এতো প্রবল, সেখানে মুসলিম ইতিহাস উপস্থাপনে তিনি ছিলেন একান্তই ভিত্তিহীন গল্পলেখক।তার ‘হিস্ট্রি অফ শিকস‘ এ ধারার এক নমুনা। মুসলিমদের বহিরাগত হিসেবে দেখানো, মুসলিম শাসকদের নিপীড়ক হিসেবে চিত্রিত করা, হিন্দু অতীতকে রং চড়িয়ে বীরত্বময় করা, মুসলিম বিরোধী হিন্দু প্রচেষ্টাগুলোকে জাতীয় উত্থানের মহিমা দেয়া এবং  মুসলিবৈরিতাকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের অংশ বানানোর প্রচেষ্টাকে কোলে উঠিয়ে দুগ্ধ পান করায়  তার বিবিধ বই ।  কিন্তু কানিংহাম একা ছিলেন না।
আলেকজান্ডার ডাফ (১৮০৬ – ১৮৭৮) এর ‘হিস্ট্রি অফ মারাঠাজ’ (১৮২৬) এবং জেমস টড(১৭৮২-১৮৩৫) এর  ‘অ্যানালস এ্যান্ড অ্যান্টিকুইজ অব রাজস্থান ( ‘১৮২৯) এ ধারার   বিশেষ উল্লেখযোগ্য বই। যাতে বারুদভর্তি কেচ্ছা-কাহিনীর এমন সঞ্চয় আছে, যা পরবর্তী ভারতকে হিংসা ও রক্তে লেলিহান করার ব্যাপারে ছিলো ক্ষমতাবান।এগুলো ছিলো এমনই কল্পনানির্ভর,  যাকে ঐতিহাসিক যাদুনাথ সরকার এর ভাষায়   ‘আফিমখোর গালগল্প’ বলে অভিহিত করা যায়।  

 পশ্চিমবঙ্গের গবেষক ডঃ নজরুল ইসলাম  দেখিয়েছেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামরিক কর্মচারী লে: কর্নেল জেমস টড   ১৮১৮ থেকে ১৮২৯ সাল পর্যন্ত পশ্চিমা রাজপুত রাজ্যগুলির রাজনৈতিক অনুচর হিসেবে কীভাবে কলম দিয়ে রচনা করেন ভারতের সাম্প্রদায়িক বিভাজনসূত্র। সেটা হয় ইতিহাসবিকৃতির মধ্য দিয়ে।তিনি  রাজনুপতনায় প্রচলিত চারণ কবিদের চারণগীতি এবং বিভিন্ন কাল্পনিক গালগল্পের উপর পা রেখে   রচনা করেন  ‘অ্যানালস এ্যান্ড অ্যান্টিকুইজ অব রাজস্থান’। ইতহাস কী বলে, তা তিনি শুনতে চাননি। । রাজপুত জাতির পুরো ইতিহাস লিখেননি তিনি। তার উপজীব্য ছিলো মুসলমান আক্রমণের বিরুদ্ধে রাজপুত রাজাদের, বিশেষ করে মেবারের রানা প্রতাপের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কাহিনী। সেটা ব্যক্ত করেন বিশেষ লক্ষ্য থেকে, যার মধ্যে ঐতিহাসিক সত্যের কোনো জায়গা ছিলো না। তিনি পরিচালিত হন সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্খা দ্বারা।   ১৮২৯  থেকে  ১৯৩২ -এর মধ্যে লন্ডন থেকে গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে দেখা গেলো, বইটির  প্রথম খন্ড সম্রাট চতুর্দশ কে উৎসর্গ করে টড লিখেছেন- “ব্রিটিশ শক্তির জয়লাভ দ্বারা সৌভাগ্যক্রমে উচ্ছৃংখল অত্যাচারের থেকে রক্ষা পেতে রাজপুত রাজকুমারেরা এখন মহানুভব আপনার বিশাল সাম্রাজ্যে অত্যন্ত পরোক্ষ করদাতা।”ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা দেখাবার চেষ্টা করেন, মুসলিম দখলদারিত্ব থেকে ব্রিটিশরা মুক্তি দিয়েছে তাদের। ব্রিটিশরা তাদের জন্য আশীর্বাদ, শত্রু থাকলে ছিলো ও আছে মুসলিমরা। এই স্বার্থবুদ্ধির হাত দিয়ে তারা সাজিয়েছেন অতীত ইতিহাসের ঘটনাচক্রকে।

দশ.

এর ফলাফল ছিলো অবধারিত এবং হিন্দুত্ববাদের পথ রচনা করলো।  এর অভিঘাতে অচিরেই হিন্দুত্ববাদ সাম্প্রদায়িক চেহারা নিয়ে বিকশিত হতে থাকলো। প্রথমে তা ঘটলো ইতিহাসভাবনা ও ইতিহাস বয়ানে।১৪২৪ খ্রিস্টাব্দে বিজয়নগরের সত্যমঙ্গল তাম্রলিপ্তে প্রথম হিন্দু শব্দটি একটি ধর্ম এর নাম হিসাবে বর্ণিত আছে। সেই শব্দকে ব্রিটিশরা নিয়ে গেলো একটি  রাজনৈতিক মতবাদে, যার নাম হিন্দুত্ব। রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা ইতিহাসকে সাজাতে লাগলো নিজের লক্ষ্য ও প্রকল্পের আলোকে।   রাজেন্দ্রলাল মিত্র, (১৮২২ –  ১৮৯১) রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকর, (১৮৩৭ –  ১৯২৫) ,বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়(১৮৩৮ –  ১৮৯৪)  , রমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯) রজনীকান্ত গুপ্ত (১৮৪৯ –১৯০০)নিখিলনাথ রায় ( ১৮৬৫ – ১৯৩২)  হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩ –  ১৯৩১) সতীশচন্দ্র মিত্র (১৮৭২ –  ১৯৩১) রমাপ্রসাদ চন্দ্র (১৮৭৩ –  ১৯৪২)কে,পি, জয়সওয়াল (১৮৮১-১৯৩৬) ,  রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় (১৮৮৫ –  ১৯৩০) যদুনাথ সরকার (  ১৮৭০ –  ১৯৬৮)অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় (১৮৬১ — ১৯৩০)  রমেশচন্দ্র মজুমদার  (১৮৮৮- ১৯৮০) প্রমুখের ইতিহাসভাষ্য ও ইতিহাসদৃষ্টি হিন্দু জাতীয়তাবাদের এমন এক পাঠাতন তৈরী করলো, যা মুসলিমদের বহিরাগত দুশমন ও নিষ্ঠুর নিপীড়ক  প্রতিপন্ন করার প্রয়াসে নিবেদিত।  ।


  ব্রিটিশদের তৈরী  উদ্দেশ্যমূলক  গালগল্প   বর্ণহিন্দু লেখকদের হাত দিয়ে নবায়িত হয়। বিদ্বেষবিষাক্ত উপস্থাপন জারি হয় গল্পে, কবিতায়, নাটকে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে।   মুসলমান  শাসনামলে হিন্দুদের করুণ অবস্থার কল্পিত ছবি অঙ্কিত হতে থাকে। মুসলিমদের উপর এমন নিপীড়নমূলক প্রতিশোধের বয়ান সামনে আসতে থাকলো, যার ফলে মুসলিমরা নিজেদের পরিচয় ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এর নজির হিসেবে বঙ্কিমের ভাষ্য হাজির করা যায়। তার গল্প তার স্বপ্নকে চিত্রায়িত করছে-

“সেই এক রাত্রের মধ্যে গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে মহাকোলাহল পড়িয়া গেল। সকলে বলিল, “মুসলমান পরাভূত হইয়াছে, দেশ আবার হিন্দুর হইয়াছে। সকলে একবার মুক্তকণ্ঠে হরি হরি বল |” গ্রাম্য লোকেরা মুসলমান দেখিলেই তাড়াইয়া মারিতে যায়। কেহ কেহ সেই রাত্রে দলবদ্ধ হইয়া মুসলমানদিগের পাড়ায় গিয়া তাহাদের ঘরে আগুন দিয়া সর্বস্ব লুঠিয়া লইতে লাগিল। অনেক যবন নিহত হইল, অনেক মুসলমান দাড়ি ফেলিয়া গায়ে মৃত্তিকা মাখিয়া হরিনাম করিতে আরম্ভ করিল, জিজ্ঞাসা করিলে বলিতে লাগিল, “মুই হেঁদু ” ।“
[আনন্দমঠ, চতুর্থ খণ্ড, প্রথম পরিচ্ছেদ, ৭৯]

বঙ্কিম একা নন। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮২৭-১৮৮৭) পদ্মিনী উপাখ্যানে (১৮৫৮ ) স্বাধীনতার কামনা, পরাধীনতার বেদনা, দেশপ্রীতি এবং বিদেশাগত মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষের ভাব প্রকাশিত হয়েছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৭৯ সালে প্রকাশিত অশ্রুমতী
নাটক উৎসর্গ করেন অনুজ রবীন্দ্রনাথকে। এবং উক্ত নাটক ছিল মুসলিম বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। এ নাটকের সৈন্যগণ বলছেন আজ আমরা
যুদ্ধে প্রাণ দেব,চিতোরের গৌরব রক্ষা করব,মুসলমান রক্তে আমাদের অসির জ্বলন্ত পিপাসা শান্ত করব (অশ্রুমতী : জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নাটক সমগ্র, সাহিত্য সংসদ,২০০২, পৃষ্ঠা ১১৩।)

 দীনবন্ধু মিত্র (১৮২৯-৭৩), হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৩৫-১৯০৩),  বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-৯৫), গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪-১৯১২), নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯), যোগীন্দ্রনাথ বসু  ( ১৮৫৭-১৯২৭), দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩),  প্রমুখের  গান,নাটক, কবিতায মুসলিম বিদ্বেষের আগুন ছড়াতে থাকে। এ বিদ্বেষকে সঙ্গী করে  হিন্দু পুনরুজ্জীবনপ্রয়াস  সামনে এগুতে থাকে। এ প্রয়াসের সারথী বহু কবি-সাহিত্যিকের রচনায়  মুসলমানদের  ম্লেচ্ছ, যবন, নেড়ে, পাষন্ড, পাপিষ্ঠ, পাপাত্মা, দুরাত্মা, দুরাশয়, নরাধম, নরপিশাচ, পাতকী, বানর, এঁড়ে, দেড়ে, ধেড়ে, অজ্ঞান, অকৃতজ্ঞ, ইতর ইত্যাদি গালি দিয়ে ব্যক্ত করা হয়েছে।   হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যাযয়ের ‘বীরবাহু’তে এমন আক্রমণের নজির লক্ষ্য করুন।  মুসলিমদের সম্বোধন করে তিনি লিখেন,  ‘আরে রে নিষ্ঠুর জাতি পাষণ্ড বর্বর পুরাব যবন-রক্তে শমন-খর্পর’।

   হেমচন্দ্রের  ‘দশমহাবিদ্যা’ ও ‘বৃত্রসংহার কাব্য’ বঙ্কিমচন্দ্রের‘মৃণালীনী’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘রাজ সিংহ’  ‘কবিতা পুস্তক’ ‘আনন্দমঠ’ ‘দেবী চৌধুরানী’ ও ‘সীতারাম’ দামোদর মুখোপাধ্যয়ের ‘প্রতাপসিংহ’ যজ্ঞেশ্বর মুখোপাধ্যয়ের বঙ্গানুবাদিত ‘রাজস্থান’ দীন বন্ধু মিত্রের ‘জামাই বারিক’    গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘অভিমুন্য বদ’ ‘সংকরাচার্য’ নবীনচন্দ্র সেনের ‘কুরুক্ষেত্র’ ‘প্রভাস’ ইত্যাদিতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে  শব্দ ও বাক্যের মধ্য দিয়ে  ঘৃণার হিংস্র প্রকাশের নজির লক্ষ্য করা যেতে পারে। ইসলামবিদ্বেষের এমন প্রকাশ এতে রয়েছে, যার প্রতিফলন কর্মে ঘটাতে গেলে মুসলিম গণনিধন ও বিতাড়ন অনিবার্য্ হয়ে ওঠে!

কিন্তু হিন্দু জাগরণের আগে এর চর্চা ছিলো না, বলার সুযোগ নেই। পলাশীর বিপরযয়ের পরেই এর ধারা ক্রমপ্রসারিত হতে শুরু করে। যে ভারতচন্দ্র নবাবী আমলে মুসলিমপ্রভাবে জারিত ছিলেন, পলাশীর পরে রচিত তার অন্নদামঙ্গল কাব্যে মুসলিমদের বিবরণ মহিমামণ্ডিত থাকেনি আর!

বিজয়ীর প্রতি সহজাত সমীহ এবং পরাজিতের প্রতি অপমানবোধ সেখানে যেভাবে কাজ করেছে, তেমনি কাজ করেছে ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রভাব!

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ