আবু তাহের সরফরাজ
ঈদের চাঁদ দ্যাখা গেছে আব্বু, ওই যে মাইকে বলছে।
কাল পবিত্র ঈদুল ফিতর। মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিচ্ছে। ঘোষণা শুনে আমার দশ বছরের মেয়েটা ফড়িঙের মতো নেচে উঠলো। ওর আনন্দ দেখে আমারও আনন্দ হলো। ল্যাপটপে ছেড়ে দিলাম কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গীত :
ও মন, রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই, আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।
তোর, সোনাদানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে, যাকাত, মূর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ।
আজ, পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে,
যে, ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।
আজ, ভুলে যা তোর দোস্ত দুশমন, হাত মেলাও হাতে
তোর, প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।
যারা, জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী
সেই ,গরিব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ।
ঢাল, হৃদয়ের তশতরীতে শিরনি তৌহিদের
তোর, দাওয়াত কবুল করবেন হযরত মনে হয় উম্মীদ।
তোরে, মারল ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা
সেই, পাথর দিয়ে তোল রে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ।
ল্যাপটপের আওয়াজ ছাপিয়ে এবার মাইকের আওয়াজ শুনতে পেলাম, ও মন, রমজানের ওই রোজার শেষে…। রিকশায় মাইক নিয়ে বেরিয়েছে কাল ঈদ, এই আনন্দবার্তা ছড়িয়ে দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে নজরুলের সঙ্গীতটি। ছায়াবীথি বেলুন ফুলিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে সারা ঘর সাজাচ্ছে। ওর উচ্ছ্বাস দেখে আমার শৈশবে ফিরে গেলাম। টুকরো টুকরো কত যে ছবি মনের পরদায় ভেসে উঠল। আহা ঈদ!
নজরুলের এই গানটি ঈদের আগের রাতে যখন মাইকে বাজতো, আমার কী যে আনন্দ! ঠিক এখন যেমন ছায়াবীথি শ্যামলিমার আনন্দ। এই গানটি এখন বেজে চলেছে বাংলার ঘরে ঘরে, বাজারে, শপিংমলে, চায়ের টঙ দোকানে। বাঙালি মুসলমানের কানে বারবার সুরের মূর্ছনায় ছড়িয়ে দিচ্ছে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার আসমানি তাগিদ।
কাল ঈদ। বাংলার ঘরে ঘরে আনন্দ। এই আনন্দটা আসলে যে কী, তা না বুঝেই আমাদের আনন্দ হয়। ঈদের দিনটা আমাদের কী রকম যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ঈদের যে আনন্দ, সেই আনন্দকে তো একটু ছুঁয়ে দ্যাখা হলো না। ঈদের পরদিন ঘুম থেকে উঠে মনে পড়ে, আজ ঈদের পরদিন। ঈদ চলে গেছে। কিন্তু আনন্দকে তো কোথাও খুঁজে পেলাম না। ছায়াবীথি যেমন ঈদের আনন্দে বেলুন দিয়ে ঘর সাজিয়েছে। আমি কিন্তু তার মতো ঈদের আনন্দে বেলুন দিয়ে মনের ঘর সাজাতে পারিনি। পারিনি বলেই, ঈদের আনন্দকে ছুঁতে পারিনি। আমি যখন ছায়াবীথির মতো ছোট ছিলাম, তখন পেরেছিলাম। এখন পারি না। কারণ, এখন আমি বড়ো হয়ে গেছি। মানুষ যখন শৈশব পেরিয়ে আসে, সে তখন আসলে তার জীবনকে পেরিয়ে আসে। এরপর সামাজিক মানুষের মতো চিন্তা-ভাবনা, তাদের মতো করে সবকিছু করা… এভাবেই মানুষ ক্লান্ত হতে হতে বুড়িয়ে যায়, মরে যায়।
তাহলে কি ঈদের আনন্দ শিশুতোষ? না, তা কেন হবে? ঈদ তো সর্বজনীন। ঈদের আনন্দে ছোট-বড় কোনোই ভেদাভেদ নেই। ভেদাভেদ থাকলে ‘ও মন, রমাজেরন ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ কানে বেঝে ওঠার সাথে সাথেই আমাদের মনটা নেচে উঠতো না। মাইকে যখন বলছে, ‘ও মন’, ঠিক তখনই আমার নিজের মনটাও সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে নেচে উঠছে। মানে, এই যে রে, আবার ঈদ এসেছে! আনন্দ আর আনন্দ! কিন্তু সেই আনন্দকে শৈশবের মতো আমরা আর ছুঁতে পারি না। সেই অনুভূতি কোথায় যে চাপা পড়ে গেছে! আহা শৈশব, রঙ-বেরঙের বেলুনে সাজানো সোনালি শৈশব! ঈদের আনন্দকে বড়রাও যেন ছুঁতে পারে, সেই উপায় বাতলে দেয়া আছে নজরুলের এই সঙ্গীতে।
কেন ঈদ, ঈদের আনন্দের স্বরূপ কী, কোরআন ও হাদিসের আলোকে সেসব প্রশ্নের নির্দেশিকা দেয়া আছে সঙ্গীতটির পুরো শরীরে। এটা কি সত্যিই সঙ্গীত? এটার গঠনশৈলী ও অবয়ব পুরোপুরি কবিতার। কেবল সুরের দোলায় বসিয়ে কথাগুলো গাওয়ায়, কবিতাটি সঙ্গীত হয়ে গেছে। বাংলা সঙ্গীতের এটাই ঐতিহ্যবাহী ধারা। রবীন্দ্রনাথ, ডি.এল. রায়, অতুলপ্রসাদসহ অনেকের নামই করা যায়। আজকাল সঙ্গীতের নামে যা হচ্ছে, সে বিষয়ে কথা বলতেও আমার রুচিতে বাঁধে। সেই রকম কথা, সেই রকম সুর, এখন আর সৃষ্টি হয় না। এখন ডিজে, টিকটক, ইয়ার্কি, বেহায়াপনা— এসবই গান। যে প্রজন্ম এসব করছে আর যারা দেখছে ও শুনছে, তারা অস্থির। জীবনবোধ বলতে কিছু নেই। হাওয়ার ওপর হাওয়ার বাড়িতে বইসা আছি, এমন হাবভাব। আমরা প্রত্যেকেই এতবার ‘ও মন, রমজানের ঐ রোজার শেষে’ গানটি শুনেছি, অথচ কখনো গানের কথাগুলো নিয়ে ভেবে দেখেছি? মনকে ডাক দিয়ে নজরুল আহ্বান করছেন, খুশির ঈদ এসেছে। কেন খুশি, কিসের খুশি, সেসব কী একবারও ভেবেছি? আজ একটু ভেবে দেখা যাক।
নজরুল মনকে আহ্বান করে বলছেন, রমজানের রোজার শেষে খুশির ঈদ এসেছে। আরবি সিয়াম শব্দের বাংলা সংযম। রমজানে মুসলমানরা রোজা রাখে, মানে সংযম পালন করে। কী রকম সংযম তারা পালন করে, তার এক টুকরো ছবি আমরা এবার দেখে নেব। করোনা মহামারির সময়। রোজার মাস। আবাসিক এলাকার একটি ভ্যারাইটিজ স্টোর। ইফতারের ঘণ্টাখানেক আগে বয়স্ক একজন মানুষ এসে ঢুকলেন। দোকানিকে বললেন, আমাকে দুধ দেন। ক’প্যাকেট আছে, দ্যাখেন তো।
দোকানি ফ্রিজ খুলে দেখে বলল, পাঁচ প্যাকেট।
ভদ্রলোক বললেন, সবগুলোই আমাকে দিয়ে দ্যান।
ঠিক এই সময় মাঝবয়েসি একজন মানুষ এসে দোকানে ঢুকলো। দোকানিকে বলল, ভাই, আমাকেও দুই প্যাকেট দেন।
দুধের প্যাকেট ক্রেতার হাতে তুলে দিতে দিতে দোকানি বলল, সরি দাদা, এই যে পাঁচ প্যাকেট ছিল, এই চাচা নিয়ে গেলেন। আজ দু’দিন কোম্পানির গাড়ি আসে না। আপনি আমার রেগুলার ক্রেতা। কী আর বলবো আপনাকে!
লোকটি জিগেশ করল, আশপাশের দোকানগুলোতে পাব না?
দোকানি বলল, নাও পেতে পারেন। একই কোম্পানির গাড়ি থেকেই এখানকার সব দোকানে দুধ সাপ্লাই হয়।
লোকটির মুখ গভীর বিষাদে ছেয়ে গেল। নিরুপায় গলায় সে বলল, বাচ্চাটার দুধ শেষ হয়ে গেছে। দুধ ছাড়া আর কিছু ও এখনো খায় না। কী যে করি!
দোকানি বলল, আপনি দ্যাখেন এখন, চাচা যদি আপনার কাছে এক প্যাকেট বেঁচে।
লোকটি করুণ স্বরে বলল, চাচা, সবই তো শুনলেন। কিছু মনে না নিলে আমাকে একটা প্যাকেট দ্যান। আমি আপনাকে দাম দিয়ে দিচ্ছি।
চাচা বললেন, সেহরিতে দুধ না খেলে আমি রোজা রাখতে পারি না। আবার কবে পাই কী না-পাই! এই বলে চাচা বেরিয়ে গেলেন।
তার রাখা রোজায় সংযমের কোনো আলামত আছে কি? রমজান মাস এলেই বাজারে জিনিসের দাম বেড়ে যায়। ভাবখানা এমন, দাম বেড়ে যাবে এটাই নীতি। যানবাহনের ভাড়া বেড়ে যায়। রাস্তাঘাটে, অফিসে, বাজারঘাটে অসংখ্য রোজাদার দেখতে পাওয়া যায়। তারা কী সংযমী মানুষ? তাদের জীবনযাত্রায় সংযমের নমুনা কই? প্রত্যেকেই প্রত্যেককে ঠকাচ্ছে। নানা রকম পাপ করছে, আবার রোজাও রাখছে।
রমজান মাস এলেই পরহেজগারি বেড়ে যায়। হযরত মুহম্মদ (স.) বলেন, রোজা রেখেও যে মানুষ অশ্লীল কাজ ও পাপাচার ছাড়তে পারলো না, পানাহার না করার কোনো কারণ তার নেই। যেহেতু কারণ নেই, সেহেতু পানাহার সে করতেই পারে। কিন্তু সে পানাহার করছে না, আবার পাপ করাও ছাড়ছে না। ভ্যারাইটিজ স্টোরের ওই চাচা যদি যথার্থ সংযমী হতেন তাহলে অন্তত দুই প্যাকেট দুধ লোকটিকে দিতেন। কিন্তু দিলেন না কারণ, দুধ না খেলে তিনি রোজা রাখতে পারেন না। তিনি রোজা রাখবেন আর একটি দুগ্ধপোষ্য শিশু দুধ পাবে না, এটাই কি সিয়ামের শিক্ষা?
সৃষ্টিকর্তা নির্ধারিত রীতিবদ্ধ কিছু আনুষ্ঠানিকতা আমাদেরকে পালন করতেই হয়। এতে আমাদের আত্মার ওপর থেকে কালিমা মুছে যায়। হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, “প্রত্যেক মানব-শিশুই তার স্বভাবজাত ধর্ম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।” সৃষ্টিকর্তার স্বভাব থেকেই মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম পাওয়া। জন্মের সময় মানুষের আত্মা থাকে শাদা কাগজের মতো। এরপর যত সে প্রকৃতিবিরুদ্ধ কর্মগুলো করতে থাকে, তত বেশি আত্মারূপ শাদা খাতার ওপর কালিমা পড়তে থাকে। রমজান মাস এলে সিয়াম মানে সংযম পালন এরকম একটি আনুষ্ঠানিকতা। শরীর খাবার না পেয়ে দুর্বল হয়ে ওঠে। ফলে এই সময়ে আত্মার অনুভূতি মানুষ লাভ করতে পারে। আত্মার কালিমাগুলো উপলব্ধি করতে পারে। উপলব্ধির পর অনুতপ্ত হয়ে মানুষ যেন আত্মার শুদ্ধতাচর্চা করে, সিয়াম-সাধনার আসল উদ্দেশ্য এটাই।
এর মধ্যদিয়ে মানুষ যে মহিমা অর্জন করে সেই মহিমাই আসলে প্রকৃতির সন্তান হিসেবে মানুষের শক্তি। ইসলামি পরিভাষায় যাকে মুত্তাকি বলে।
পূর্ণ ঈমান ও হিসাব-নিকাশ করে যে রমজানের সিয়াম পালন করবে, আল্লাহ তার আগের-পরের সকল গোনাহ মাফ করে দেন। রমজান মাস পেয়েও নিজের গোনাহ যে মাফ করাতে পারলো না, সে ধ্বংস হোক। রাসূল (স.) যার ধ্বংস কামনা করেছেন, সে কিভাবে ঈদের খুশিকে ছুঁয়ে দেখবে? যে সংযমী সকলের কল্যাণে সে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের চারপাশে যেসব রোজাদার দেখি তাদের ভেতর কি এই উপলব্ধি আছে? কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয়, নেই। আসমান থেকে আল্লাহ তাগিদ দিচ্ছেন নিজেকে বিলিয়ে সকলের কল্যাণের। তাগিদ আরবি শব্দ। মানে, বারবার অনুরোধ করা। প্রতি বছর রমজান মাস আসে। আসে ঈদ। প্রতি রমজানে আল্লাহ আমাদের বারবার অনুরোধ করতে থাকেন, নিজের থেকে পরের কল্যাণকে বড় করে দ্যাখো। প্রতি রমজানে আমরা বারবার আল্লাহর অনুরোধ উপেক্ষা করে পরের থেকে নিজের কল্যাণকে বড় করে দেখছি। আবার, রোজাও রাখছি।
নিজের মনকে তাই ডাক দিয়ে নজরুল বলছেন, তোর সোনাদানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ।
মানে, তোমার সহায়-সম্পত্তি ও বিলাস আয়োজন সবকিছু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করো। মৃত মুসলিমের ঘুম ভাঙাতে নজরুল যাকাত দিতে বলছেন। মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে যাকাত একটি সুশৃঙ্খল চক্র। এই চক্রে সমাজের প্রত্যেক মানুষের হাতেই টাকা থাকবে। ফলে, সমাজে থাকবে অর্থনৈতিক ভারসাম্য। যে ভারসাম্য ছিল খোলাফায়ে রাশেদিনের সময়ে। ছিল ইসলামি খিলাফতের বিভিন্ন রাষ্ট্রে। আজকাল যাকাত দেয়া হয় লোক দেখানো। শিল্পপতিরা সম্পদের প্রকৃত পরিমাণের ওপর যাকাত দেন না। কারণ, ওই পরিমাণ ব্যাংকের হিসাবে উল্লেখ থাকলে সরকারি কর বেড়ে যাবে। গরুর মাংসের কেজি সাতশো টাকা। এমন অনেক মুসলিম পরিবার আছে যে বাড়িতে ঈদের দিনেও গরুর মাংস রান্না হয় না। দেশি মুরগি কেনারও সামর্থ্য নেই। ব্রয়লার মুরগির মাংস দিয়েই কারো কারো ঈদ উদযাপিত হয়। যাকাতের যথার্থ বণ্টন হচ্ছে না বলেই মুসলমানদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড আগের মতো দৃঢ় আর নেই। ভেঙে গেছে। তাই তারা এখন মৃত। এই ঘুম থেকে তাদেরকে জাগিয়ে তুলতে হবে সমাজের প্রত্যেক মানুষের ভেতর অর্থনৈতিক ভারসাম্য রাখতে হবে। নজরুল মনকে ডেকে বলছেন, কোরআন ও হাদিসের বিধি অনুযায়ী যাকাত বণ্টন করে এসব মূর্দা মুসলমানের ঘুম ভাঙিয়ে দাও। তাদের ভেতর ফিরিয়ে আনো সুস্থজীবনের স্বাভাবিক গতিধারা। মানুষের সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট। বাজার ব্যবস্থা আরও প্রকট। এই অর্থনৈতিক সিস্টেম কোনোভাবেই সুস্থ নয়।
এরপর নজরুল মনকে ডাক দিয়ে বলছেন,
‘আজ, পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে,
যে, ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।’
মুসলিমদের দ্বিগ্বিজয়ের সোনালি সেই ইতিহাস আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন নজরুল। তৌহিদের বাণী সারা পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে দিতে জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে লাখ লাখ মুসলিম। সেই ময়দানে কেউ হয়েছে শহিদ, কেউ গাজি। রক্তাক্ত সেই ময়দানই এখন আমাদের এই ঈদগাহ। সেই ঈদগাহে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ পড়তে পড়তে আমাদের কি একবারও মনে পড়ে মুসলিমদের গৌরবের সেই দিনগুলো? জ্ঞান-বিজ্ঞানে যখন জগৎজুড়ে মুসলিমদের জয়জয়াকার। সেই গৌরব বোধ করে আমাদের মৃত অবস্থাটা আমরা একবারও ভেবে দেখি না। কিন্তু নজরুল সেই ভাবনা আমাদের ভেতর উস্কে দিচ্ছেন। গ্লানিবোধ থেকে আমরা যেন জেগে উঠি, সেই কাতরতা নজরুলের আহ্বানে।
আজ, ভুলে যা তোর দোস্ত দুশমন, হাত মেলাও হাতে
তোর, প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।
ঈদের আনন্দ এমনই এক আনন্দ, যে আনন্দে বন্ধু-শত্রু ভুলে যেতে হয়। ঈদগাহে নামাজ শেষ করে বন্ধুর সাথে আমরা কোলাকুলি করি। হাতে হাত মেলাই। ঈদ মোবারক বিনিময় করি। কোনো শত্রুর সাথে কি এরকম করি আমরা? আজকাল তো ঈদগাহে কোলাকুলিও তেমন একটা দেখা যায় না। ঈদের সর্বজনীন বার্তা বিনিময় হয় না। যে প্রেম দিয়ে একটা সময়ে মুসলিমরা গোটা বিশ্বকে ইসলামের অনুসারী করেছিল, সেই প্রেম দিয়ে আবারও বিশ্বকে ইসলামের মুরিদ বানাতে মনকে উৎসাহ দিচ্ছেন কবি কাজী নজরুল। কী রকম এই প্রেম? সাহাবিদের সাথে বসে আছেন নবিজি (স.)। একজন সাহাবি কয়েকটি পাখির ছানা হাতে সেখানে এসে দাঁড়ালো। তার মাথার ওপর দিয়ে একটু দূরে কিচিরমিচির করছে মা পাখিটা। এই দেখে নবিজির (স.) দু’চোখ ছলোছলো করে উঠলো। তিনি বললেন, যেখান থেকে ছানাদের এনেছো সেখানেই রেখে এসো। নবির (স.) আদেশ শুনে সাহাবি পা বাড়ালেন। একেই বলে প্রেম। জীবজগতের প্রতি প্রেম। প্রকৃতির সবকিছুর সঙ্গে গভীর আত্মিক যোগাযোগ। মাওলানা রুমি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন। মাঝামাঝি একটা কুকুর শুয়ে আছে। চলার পথটা এতই ছোট যে, তিনি কুকুরকে ডিঙোতে পারছেন না। আবার, কুকুরটাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে চলে যাবেন, তাও গেলেন না। দাঁড়িয়ে রইলেন। এক লোক তাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিগেশ করলো, আপনি কী করছেন ওখানে দাঁড়িয়ে? রুমি জবাব দিলেন, রাস্তা পেরোবো। লোকটি বললো, কুকুরটাকে তুলে দিন। তাহলেই তো আপনি রাস্তা পেরোতে পারবেন। রুমি জবাব দিলেন, ঘুম ভেঙে গেলে কুকুরটার কষ্ট হবে। তাই দাঁড়িয়ে আছি।
এই রকম প্রেম বুকের ভেতর লালন করে কি আমরা ঈদগাহে নামাজে দাঁড়াই? তা কিন্তু দাঁড়াই না। এ কারণেই ইসলামের সর্বজনীন কল্যাণের বাণী সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া যাচ্ছে না। সকলকে ইসলামের অনুসারী করা যাচ্ছে না। রোজাদারকে মুসলিম বলা যাচ্ছে না। নামাজিকে মুসলিম বলা যাচ্ছে না। কারণ, নামাজ তো কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়। নামাজ সিয়ামের মতোই সৃষ্টিকর্তার বিধিবদ্ধ রীতি। যা মুসলিমের আত্মাকে কলুষতা মুক্ত রাখবে। আমাদের সমাজে মসজিদে মসজিদে কত নামাজি। তারা কি কলুষতা মুক্ত?
যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী
সেই গরিব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ।
একটা মাস আমরা রোজা রেখেছি। কিন্তু আমাদের সমাজে চারপাশে অনেক মানুষ আছে যারা জীবন ভরেই রোজা রাখছে। সেই গরিব মিসকিনদের উপবাস রেখে আমরা কোন মুসলিম হয়ে ঈদগাহে নামাজে দাঁড়াই? নজরুল মনকে ডাক দিয়ে বলছেন, তুমি ধনী হলে অভাবীদেরকে দরকারি জিনিসপত্র দিয়ে এরপর ঈদগাহে আসো। এখনকার বাস্তবতা হচ্ছে, ঈদের দিনেও অনেক মুসলিম না খেয়ে থাকে। আকাশ-পাতাল এই বৈষম্য মুসলিমের পরিচয় নয়। তৌহিদের সূত্রে একজন মুসলিম আরেকজন মুসলিমের ভাই। নজরুল মনকে আহ্বান করছেন, হৃদয়ের পিরিচে তৌহিদের বাণী হচ্ছে শিরনি। বিশেষ ধরনের খাদ্য হচ্ছে শিরনি যা ধর্মীয় কোনো উদ্দেশ্য পূরণে সকলের মাঝে বিতরণ করা হয়। তৌহিদ সেই রকম এক প্রকার শিরনি, যা সকল মুসলিমের হৃদয়ের পিরিচে থাকা জরুরি। কিন্তু বাস্তবতা অনুযায়ী, আমাদের কয়জনের হৃদয়ে সেই তৌহিদ রয়েছে? নজরুল মনকে বলছেন, তৌহিদের এই শিরনি সকলের হৃদয়ের তশতরিতে বিতরণ করলেই তোর প্রার্থনা হযরত কবুল করবেন। উম্মীদ মানে বিজয়ী। তৌহিদের সূত্রে সকল মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হলেই তারা বিজয়ী হবে। নজরুল মনকে বলছেন, সারা জীবন যারা তোকে ইট পাথর মেরেছে, সেই পাথর দিয়েই এবার গড়ে তোল প্রেমের মসজিদ। প্রেমের মসজিদে দাঁড়িয়ে নামাজ যখন পড়বো তখন সেই নামাজ প্রতিষ্ঠা পাবে সমাজে। সকলের প্রতি প্রেমবোধ যখন উপলব্ধি করতে পারব, তখনই সার্থক হবে রোজার মাসে সিয়াম পালন। সিয়াম সাধনা সার্থক হলেই আমরা ঈদের আনন্দকে ছুঁতে পারবো। সমাজের সকল মুসলিম পরিবার ঈদের দিনে গরুর মাংস কিনে খেতে পারবে। মানুষের ভেতর থেকে হিংসা, দ্বেষ, বিভেদ, অহঙ্কার ইত্যকার কলুষতা বিলীন হয়ে যাবে। তা হচ্ছে না বলেই ঈদের আনন্দ আমরা উপলব্ধি করতে পারছি না। মুসলিমরা এখনো মৃত হয়ে ঘুমিয়ে আছে।