আল মাহমুদ
নব্বইয়ের কবিতা। সম্পাদক : মাহবুব কবির। প্রকাশকাল : বইমেলা ১৯৯৯। প্রকাশক : লোক প্রকাশনা ৭৯-৮০ আজিজ সুপার মার্কেট শাহবাগ ঢাকা-১০০০। প্রচ্ছদ: আমানউল্লাহ। মূল্য: ১২৫ টাকা। পৃষ্ঠা: ১৪৪।
নব্বইয়ের কবিতা : অন্য আকাশ। সম্পাদক : সাজ্জাদ বিপ্লব। প্রকাশকাল: বইমেলা ২০০১। প্রকাশক: সৈকত ইসলাম। পুন্ড্রনগর লিটলম্যাগ লাইব্রেরি নামাজগড় ক্রসলেন, বগুড়া-৫৮০০। প্রচ্ছদ: শেখ আনোয়ার। মূল্য: ৬০ টাকা। পৃষ্ঠা : ৮৬।
আমি বেশকিছুকাল যাবৎ বাংলাদেশের কবিতা নিয়ে পারতপক্ষে কোন মন্তব্য করতে চাইনি। এর মানে এ নয় যে আমার পরবর্তী দশকগুলোর কবিদের ব্যাপারে আমার কোন বক্তব্য নেই। আমিতো সব সময়-ই কবিতার মঞ্চগুলোতে সমকালীন কবিতার উপর কিছু না কিছু বলে থাকি। তবে আমার মতো বয়স্ক কবির পক্ষে লিখিতভাবে কবিতার উপর কোন বিবেচনাকে স্থায়ী করতে চাইনি। কারণ পঞ্চাশ দশকের পরবর্তী ষাট-সত্তর পর্যন্ত আমি নিজেই সক্রিয়ভাবে কবিতা লিখে গেছি। এই সময়ের মধ্যে আমার দশকের কবিরা নিজেদের নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগেছেন। আমি নিজে এখনো কবিতা লিখে চলেছি। আমার মতো লোকেরা যারা নিজের দশকের কবিদের সম্বন্ধেই বিচার বিবেচনা করে কিছু লেখার সাহস পায়নি তারা একবিংশ শতাব্দীতে এসে এখন আর কী বলবে? তাদের হাত কাঁপছে। বয়সের ভারে চিন্তা সুস্থির থাকছে না। তবু এ অবস্থায় যখন সর্বশেষ সময়ের কোন কাব্য সঙ্কলন কেউ এসে হাতে ধরিয়ে দেয় তখন বিব্রতকর অবস্থায় পরলেও বইটি উল্টে পাল্টে দেখতে হয়। সম্প্রতি তরুণ কবি ও লিটলম্যাগ সম্পাদক সাজ্জাদ বিপ্লব তার সম্পাদিত নব্বই দশকের একটি ক্ষীণকায় সঙ্কলন আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি আমার চিরকালের অভ্যেসের বশে এ বইটিতে সঙ্কলিত কবিদের কবিতা পড়ার চেষ্টা করেছি। এ কথা আমার বলতে দ্বিধা নেই যারা এ বইয়ে সঙ্কলিত হয়েছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ কিছু উত্তেজক লাইনের সাথে তাদের অন্তরস্থপ্রবল কবিত্ব শক্তির পরিচয় দিয়েছেন।
পৃথিবীর প্রকৃতি নিচয়ের নিসর্গরাজির মধ্যে দৃশ্যমান সবকিছুরই পরিচয় আমরা পাই কিছু কিছ লক্ষণ দ্বারা। আমার চোখ যেহেতু এখন আর সেই অবস্থাতে নেই যাতে ফুল বা ফল দেখে গাছটিকে চিনবো। তবু বিনয়ের সাথে জানাই যে, অন্ধেরও স্পর্শ ইন্দ্রিয় কখনো কখনো চোখের কাজ করে। আমার শ্রবণেন্দ্রিয় এবং স্পর্শ শক্তি এখনো কোন কিছুকে সনাক্ত করনে আমাকে আগের মতই সহায়তা দিচ্ছে।
আমি নব্বই দশকের এই ক্ষুদ্র সঙ্কলনটি স্পর্শে, ঘ্রাণে ও অস্পষ্ট দৃষ্টি শক্তি নিয়েই পাঠ করার চেষ্টা করেছি। এবং অকপটে এ কথা স্বীকার করি যে, নব্বই দশকের এই সঙ্কলনটিতে এমন সব কবি রয়েছেন যাদের উপেক্ষা করা যায় না। এখানে একটি কথা পাঠকদের জ্ঞাতার্থে বলে রাখাই ভালো, নব্বই দশকের এটি-ই প্রথম সঙ্কলন নয়। এর আগে মাহবুব কবির এর সম্পাদনায় নব্বই দশকের নব্বই জন কবির একটি সঙ্কলন আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো। তখন আমার চোখের দৃষ্টি এতোটা অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় পৌঁছেনি। সেখানেও শক্তিমান কবিদের আবির্ভাব আভাসে ইঙ্গিতে নিজেদের প্রতিভার স্বতঃস্ফূর্ততায় জানান দিয়েছিলো। প্রথম সঙ্কলনটির নাম ‘নব্বইয়ের কবিতা’, দ্বিতীয়টি ‘নব্বইয়ের কবিতা: অন্য আকাশ’।
দুটি বই পড়েই আমার ধারণা হয়েছে আকাশটা খুব একটা বদলায়নি। আকাশ আগের মতই রহস্যময় নীলিমা নিয়ে ভুপৃষ্ঠের দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু বদলে গেছে পৃথিবীর প্রাণ ধারনের বেদনা। যারা আগে পৃথিবীতে কবি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন তারা তাদের সময়কার পরিবেশ ও প্রকৃতির কথা, তাদের প্রেম ও পরিণয়ের কথা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তাদের মধ্যে যারা সত্যিই ছিলেন প্রতিভাবান তাদের কিছু পংক্তি আমরা আমাদের সমাজে আমাদের পরিবেশে নিজেদের কবি প্রতিভাবকে মহিমান্বিত করতে শোষণ করে নিয়েছি। নব্বইয়ের কবিতা আমাকে বিস্মিত করে– একথা বলার আগে আমি বলতে চাই নব্বই দশকে এতো কবির আবির্ভাব বাংলা ভাষার জন্যে সত্যিই বিস্ময়কর।
নব্বই দশকের প্রায় সোয়াশত কবি বাংলা ভাষার সর্বশেষ স্টাইল বা আঙ্গিকরীতি আয়ত্ব করতে চাইছেন। এখন পর্যন্ত ধরে নিতে হবে এরা সবাই কবি। যেহেতু নব্বই দশকের কোন কবিরই বয়স পঞ্চাশ পেরোয়নি কিন্তু প্রায় সকলের নামাঙ্কিত কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে বাজারে শোভা পাচ্ছে সে কারণে একটু আগে হলেও তাদের উপর বিশেষ করে তাদের কবিতার উপর আলোচনা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। আগে আমরা বলতাম যার কবিতার বই প্রকাশিত হয়নি তাকে আলোচনার আওতায় আনা যায় না। কিন্তু নব্বই দশকের ব্যাপারে এ অজুহাত খাটবে না। তারা প্রকাশিত এবং প্রকটিত হয়ে উঠেছেন। এখন তাদের উপর সাহিত্যিক অর্থে বিশ্লেষণী মন্তব্য প্রকাশ দরকার হয়ে পড়েছে। এই শতাধিক কবির সবাই যে কবি একথা বলার দুঃসাহস আমার নেই। তবে তারা যদি সত্যি সকলই কবি হয়ে থাকেন তাহলে তাদের অস্বীকার করার যুক্তিও আমি খুঁজে পাই না। এখানে আরো একটি কথা উল্লেখযোগ্য বলে বিবেচনা করি। সেটা হলো, নিষ্ফলা বাংলা একাডেমী ‘তরুণ লেখক প্রকল্প’ বলে আকস্মিক একটি সৃজনশীল পরিকল্পনা একদা গ্রহণ করেছিলো। এতে দেশের তরুণতম কবি ও কথাশিল্পী যাদের প্রায় অনেকেই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাদের উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য এবং আর্থিক সহায়তা দেওয়ার সদিচ্ছায় লেখালেখির ব্যাপারে প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছিলো। লেখকদের প্রশিক্ষণ কথাটা যদিও শুনতে হাস্যকর লাগে তবু বিষয়টির বাস্তবরূপ দেখে কেউ যে খুব হাসাহাসি করেছিলো তেমন মনে পরে না। তখন মনে হয়েছিলো লেখকদের প্রশিক্ষণ ব্যাপারটা অতটা অবাস্তব নয়। ঐ সব ক্লাসে অগ্রজ কবি কথাসাহিত্যিক যারা নিজেদের সাহিত্য জীবনের প্রবক্তা হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন আমিও তাদের দলভুক্ত ছিলাম। দেখা গেল এই ক্লাসগুলো বেশ জমে উঠেছে। আমার মনে আছে আমি যে কয়েকটি ক্লাসে অংশগ্রহণ করেছিলাম তাতে উপস্থিতি বেশ ঘন ছিলো। এবং বক্তার বক্তৃতার পর ক্লাসগুলো বেশ কলরব মুখর হয়ে উঠতো। পরে অবশ্য তরুণ লেখকদের দ্বারা বাংলা একাডেমী বেশ সরব হয়ে উঠেছে দেখে বিষয়টি কারো কারো অপছন্দ হয়। তারা তখন রাজনৈতিক পক্ষপাতের সুযোগে বাংলা একাডেমীর ঘাড়ে চড়ে বসে আছে। বারো হাত কাকুড়ের তেরো হাত বিচি দেখে তারা ভয় পেয়ে যান। বাংলা একাডেমীর তৎকালীন সভাপতি প্রকল্পটি যাতে আর চালু না থাকে সে ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিলে তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তরুণ কবি এবং লেখক কথাশিল্পীদের প্রথম বইয়ের পাণ্ডুলিপি তখন প্রেসে চলে গেছে। এ দোটানা অবস্থায় শেষ পর্যন্ত কয়েকটি বই বেরিয়েও আসে। যাতে নব্বই দশকের কবিতা ও কথাশিল্পের ভিত্তিভূমিটি সবার অজান্তে পাকাপোক্ত হয়ে যায়। এখান থেকেই নব্বই দশকের শুরু। প্রকল্প প্রকাশিত যেসব বই এ ভিত্তিভূমিটি সুদৃঢ় করতে সাহায্য করেছিলো তাদের মধ্যে গদ্য পদ্য মিলিয়ে যাদের নাম উল্লেখযোগ্য তারা হলেন: মুজিব ইরম, শোয়াইব জিবরান, ইশারফ হোসেন, জেনিস মাহমুন, চঞ্চল আশরাফ, মুহম্মদ আবদুল বাতেন, মতিন রায়হান, শান্তা মারিয়া, খুরশীদ আলম বাবু, তপন বাগচী, অনু হোসেন, ফকরুল চৌধুরী, রফিক মুহাম্মদ, আরিফ বিল্লাহ মিঠু, আতিক হেলাল, মাসুদার রহমান প্রমুখ।
নব্বইয়ের কবিতা সম্বন্ধে দুটি সঙ্কলনের দুজন সম্পাদক দুটি অনাড়ম্বর ভূমিকা ফেঁদেছেন। তাদের কবিতা কেন তাদের ধারণা অনুযায়ী আমাদের পাঠযোগ্য তার একটা ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন। সম্পাদকদ্বয়ের ইঙ্গিত অনুযায়ী নব্বই দশকের কবিদের কবিতার স্বাদ গ্রহণ করতে গেলে বেশ একটু অসুবিধায় পরতে হবে বলে আমার ধারনা। প্রথম সঙ্কলনটির সম্পাদক মাহবুব কবির এবং দ্বিতীয় সঙ্কলনটির সম্পাদক সাজ্জাদ বিপ্লব এই সঙ্কলন দুটি প্রকাশের ব্যাপারে যত তাগাদা অনুভব করেছেন ততোটা বিচার বিশ্লেষণ ও বাছাই প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করেননি। কারো কারো মনে হতে পারে সম্পাদকদ্বয় নব্বই দশকের সংখ্যা বৃদ্ধির দিকেই সবিশেষ মনযোগী ছিলেন। নব্বই দশকে লেখা আরম্ভ করলেই তিনি সে দশকের কবি বা কথাশিল্পী এটাতো মানা যায় না। কথাশিল্পের কথা আপাতত থাক। যেহেতু এরা দুজন কবিদেরই সঙ্কলনে মনোনীত করতে চেয়েছেন সে জন্য আমি কবিতা নিয়েই অগ্রসর হতে চাই। আমি অকপটে স্বীকার করি নব্বই দশকে প্রকৃত কবির সংখ্যা আমাকে বেশ কার্যকরভাবে আলোড়িত করেছে। কবিতার যে ধারাবাহিকতার জন্য এককালে চল্লিশ দশক থেকে শুরু করে ষাট-সত্তর দশক পর্যন্ত এক ধরনের ব্যাকুলতা আমাদের আকাঙ্খাকে স্তিমিত করে রাখতো সম্ভবত নব্বই দশকে এসে তার অবসান ঘটতে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে নব্বই দশক আমাদেরই কবিতা প্রয়াসের উজ্জ্বল শস্য। এর মানে এ নয় যে নব্বই দশকের কবিরা পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর দশকের মতই কবিতা লিখেছেন। এদের কারো কারো রচনায় নিজস্ব অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিগত কাব্যরুচি এবং স্বতন্ত্র অধ্যয়ন ও বিচরণের চিহ্নাদি উজ্জ্বল আনন্দ নিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে। সন্দেহ নেই নব্বই দশকের কবিতা বাংলা সাহিত্যের– বিশেষ করে কবিতার– স্বতন্ত্র নদীর মতো। এই নদীতে তরঙ্গ আছে উষ্ণ অন্তস্রোত আছে এবং পাড় ভাঙ্গার মতো প্রবল আঘাত করারও ক্ষমতা আছে। সবই আছে আপাতদৃষ্টিতে সমন্বিতভাবে। স্বভাবতই আশা করা যায় এ সমন্বয় প্রস্তুতি পর্বের। এই প্রস্তুতিপর্বের অবসানে কবির যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র নিজকে আলাদা আত্মপরিচয়ের মহিমা দেয় তা বিকশিত হয়ে উঠবে। এখন পর্যন্ত এর নাম নব্বই দশক মাত্র। সংখ্যার দিক দিয়ে এদের উপস্থিতির আধিক্য এই মূহুর্তে আমাদের জন্যে আনন্দের হলেও এরা কবি ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজের স্বাতন্ত্র চিহ্নিত না করা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করতে পারি। আমরা অপেক্ষা করবো আনন্দে, উত্তেজনায়, আশায়।
নব্বই দশকের কবিতার প্রতি আমার মতো বৃদ্ধ প্রায়ান্ধ লোকের উৎসাহ সৃষ্টির প্রথম কারণ হলো ঐ দশকের শতাধিক কবির প্রায় সকলেরই রচনায় এ বিষয়টি প্রতীয়মান হয়েছে যে কবিতা কোন এলেবেলে শিল্প নয়। ছেলেখেলার বিষয়ও নয়। এদের প্রায় সকলই কবিতাকে মানব হৃদয়ের নিগূঢ় রসায়ন হিসেবে ভাষারূপ দিতে চেষ্টা করেছেন। এই অভিজ্ঞতা তারা পেয়েছেন– আমার বিশ্বাস– পঞ্চাশ দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত প্রতিভাবান অভিজ্ঞ কবিদের কাছ থেকে। কবিকে যে হতে হয় তার নিজের জাতির সবচেয়ে অভিজ্ঞ, অপরাজিত ও দায়িত্বজ্ঞাসম্পন্ন মানুষ। যা তারা সম্ভবত সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছেন। ছন্দ পাগল পদ্য রচয়িতা হিসেবে নব্বই দশকের কবিরা নিজেদের সঠিক ভাবতে চান না। তবে এরাও ছন্দ জানেন। ছন্দ যে কবির বক্তব্যকে দীর্ঘস্থায়ী করে এই বোধ তাদের আছে। এখন পর্যন্ত প্রেম ও প্রকৃতি-ই নব্বই দশকের প্রধান বিষয় এবং এর সাথে যুক্ত তাদের আত্মবিশ্বাস। মূলত এ নিয়েই এরা এখন পর্যন্ত কাব্য রচনা করে চলেছেন। সেখানে যাদি হয়েছে অভিজ্ঞতা তাদের বর্তমান আন্তর্জাতিক কাব্যসূত্রগুলো অনুসন্ধানের প্রেরণা দেয় তাহলে একজন কবি হিসেবে আমার আনন্দের সীমা থাকবে না। কবিতার ব্যাপারে একথা ঠিক নয় যে, যার হয় না পঁচিশ বছরে তার হবে না পঞ্চাশ বছরেও। কবি সত্তরে পৌঁছেও কবিতার জগতে কেবল নিজের প্রতিভার দ্বারা ভূমিকম্প সৃষ্টি করে দিতে পারেন।
আমিতো আগেই বলেছি, আমরা অপেক্ষা করবো আশায় এবং আস্থায়। নব্বই দশকের কবিতা আমার দৃঢ় বিশ্বাস বাংলাকবিতার আঙ্গিরীতির মোড় ফেরার কবিতা। আর আঙ্গিক বদল হয় তখনি যখন কবিতায় নতুন বক্তব্য আসতে থাকে। উপমার ঢঙ বদলে যায় এবং ছন্দের আস্তরণ বাক্যকে মহিমা দেয়। এখানে আমি নব্বই দশকের কয়েকজন কবির কবিতা থেকে কিছু পংক্তি উদ্ধৃত করে আমাদের পাঠকদের সচকিত করতে চাই যে, নতুন ভাবনার উদয় হয়েছে এদের মধ্যে। উদয় হয়েছে পুরনো বিষয়কে ঘিরেই। দেশর মাটি-পানি-মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের রক্ত-মাংস অভ্যেস-আচরণ তাৎক্ষণিকভাবে ভাষা পেয়েছে এদের কবিতায়। বোঝা যাচ্ছে এটা আঙ্গিক বদলের সময়। সেই অর্থে এমনও হতে পারে যে নব্বই দশকের কবিরা একবিংশ শতাব্দীর যুগসন্ধির কবি। তাদের গায়ে বিংশ শতাব্দীর পোষাক কিন্তু তাদের মগজে কাজ করছে একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে কর্মক্ষম জটিল কম্পিউটার। তারা তাদের কম্পিউটারের মেমোরিতে খোলনলচেসহ ঢুকিয়ে দিয়েছেন আস্ত একটি বাংলাদেশকে। সবকিছু ছাপিয়ে উঠেছে তাদের কবিতায় তাদের উপমা-উৎপ্রেক্ষায় নারীর প্রতি আসঙ্গলিপ্সা। যেন নারী রহস্যের এই কবিদের কাছে কোন কূলকিনারা নেই। লেহনে-পেষনে এবং উপভোগে পরিপূর্ণ তৃপ্তি পাচ্ছেন না তারা। আবার নারী রহস্যকে ত্যাগও করতে পারছেন না। এ এক জটিল মর্মজ্বালা সন্দেহ নেই। এখানে আমি এই দুটি সঙ্কলন থেকে আপাতত তিনজন কবির তিনটি কবিতা উদ্ধৃত করে আমার বক্তব্যকে বিশদ করতে চাই। এই তিনজন হলেন: নয়ন আহমেদ, সরকার আমিন ও মুজিব ইরম।
আজ হাটবার। বাবা হাটে যাবেন। নুন দেয়া আনন্দ কিনবেন
তিনি। আর কিনবেন এককেজি সাধ। এই ব্যাগ নিন বাবা। আজ
পরিপূর্ণ করে আনবেন সহ্য ও সাধনা। বহুদিন খাওয়া হয়নি
মধ্যবিত্ত আগুন, ফুরফুরে বাতাসের ডগা। বেদনা খেয়ে খেয়ে পেট
খারাপ করেছে। নৈরাশ্য দিয়ে উদরপূর্তি আর করবো না। বাবা,
সূর্যের উত্তাপে মোড়া এককেজি প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসবেন।
সকালের নাশতায় রুগ্ন ওম ক্যানো খাবো? লাল মোরগের
পাখনার মতো ভোর আনবেন। কিছু বিনীত বিকেল আনবেন,
আর আনবেন সেলাই করা রাত। দেখবেন- দর্জি বোতাম লাগিয়ে
দিয়েছে কিনা। শেষে, কামনা যখন কিনবেন– নিশ্চয়ই পরখ
করে দেখবেন পুষ্টিকর কিনা।
আজ হাটবার। বাবা কিনবেন জৈবনিক তাপ।
(আজ হাটবার, নয়ন আহমেদ; ‘নব্বইয়ের কবিতা: অন্য আকাশ’ পৃ: ৩৫]
শিশুদের বেঁধে রেখে মা রান্না করছেন পাথর
শিশুদের ছেড়ে দিন গোধূলিতে
সূর্যাস্তের লালরক্ত আকাশে
তারা মেঘের ভিতর থেকে কেড়ে নিক আহার
দিগন্তের স্তন থেকে চুষে নিক শিশুকাল
সূর্যের লালা থেকে খুঁজে নিক লবণ
মা শিশুদের বাঁধন খুলে দিন
তারা তারাদের সাথে খেলা করুক
দু’হাতে ধরে চাঁদ লটকে পড়ুক মহাশূন্যে
ভাসুক সমুদ্রের মস্তিষ্কে রেখে আশ্চর্য পা
মা শিশুদের অপেক্ষায় বসিয়ে রেখে
ভাজছেন পাথরের মাছ
পাথরের আনাজ, পাথরের সালুন
মাগো, শিশুরা যদিবা খায় সেদ্ধ পাথর
অসীম রান্নার খবর কিভাবে থাকবে গোপন?
[গোপন রান্না, সরকার আমিন; ‘নব্বইয়ের কবিতা’ পৃ: ১২৯]
পাশের বাড়ির মেয়ে চোখ দিলো জন্মের পর। সেই থেকে প্রতিভোরে মা খাওয়াতের নজরের
পানি। অসংখ্য সুরায় ভরে দিতেন গলায় ঝোলানো কালো সুতোর তাগা। লাল মোরগটা নিয়ে
যেতো বৃদ্ধ ফকির। তার সাথে বদচোখের বিষ।
এখনও নজর এড়াতে মা আমার পাঠ করেন সমস্ত বিশ্বাস। নিয়ে আসেন– নুনপড়া, পানিপড়া,
কুমারের ঘর।
আমি কি শিশু মাগো– নজরে দেইনি মুখ স্তনের বোঁটায়? ক্যানো তবে এই ভয়? আমাকে
দিয়েছে সেতো অন্য নজর, যে নজরে হরদম হৃদয় পোড়ায়।
[নজর, মুজিব ইরম; ‘নব্বইয়ের কবিতা’ পৃ: ৯৫।]
এই তিনটি কবিতায় কবি তিন জনের অন্তরের তিন ঝলক দৃশ্যের প্রক্ষেপ আমরা মুহুর্তের জন্যে দেখে ফেলি। কোন কবিতাতেই কবি মনের ইঙ্গিতগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। তবে পাঠকের মনে কৌতূহল জাগাবার ক্ষমতা এদের আছে। নয়ন আহমেদ হাট থেকে তার বাবা যেসব জিনিস কিনে আনার ফর্দ তৈরী করেছেন তা এ যুগের কোন কবিরই অপূর্ণ আকাঙ্খা মাত্র। এখানে নয়ন হাটের কথাটি উল্লেখ করলেন কেন? তিনি তার বাবাকে মহানগরীর কোন মার্কেটিং প্লেসে পাঠাননি। ব্যাগ তুলে দিচ্ছেন গ্রাম্য হাটে যাওয়ার জন্য। হাট-ই কবির অভাবপূরণের ফর্দটি সুলভ জিনিসে ভরে দিতে পারে। এই গ্রাম প্রবণতা আধুনিকতার সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে গিয়ে একটা চিত্রকল্পের ধারণা দিচ্ছে। এই ধারণাই হলো সমগ্র নব্বই দশকের বৈশিষ্ট্য। তারা প্রকৃত গ্রামের দিকে সরে গিয়ে তাদের মানসের আধুনিকতম চিত্রকল্প বিন্যস্ত করতে চাইছে। নয়ন আহমেদ তার কবিতাটিতে যেসব বেদনার কথা উল্লেখ করেছেন কিম্বা বাবা আনবেন বলে যে সব বাজার দ্রব্য নির্দিষ্ট করেছেন আমরা সেসব মালমসলাকে একালের কবিদের হৃদয়ের আকাঙ্খা হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। হাট থেকে এমন কি কামনা বাসনাও বাবা কিনে আনবেন বলে ফর্দ তৈরী করছেন। এই ফর্দটি উত্তর আধুনিকতার ফর্দ।
এরপর যে কবির কথা আমি উল্লেখ করবো তিনি বেশ কিছুকাল আগেই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলেন। সরকার আমিনের উপরোল্লিখিত কবিতাটিতে যে হৃদয়গ্রাহী চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে সেখানেও দেখা যায় তিনি নয়ন আহমেদের মতই দাবী উত্থাপন করছেন এমন একজনের কাছে যিনি সবকিছু দিতে পারেন। তিনি সম্বোধন করছেন তাকে ‘মা’ বলে। নয়ন আহমেদ যেমন বাবাকে হাটে পাঠাবার চিত্রকল্প আনতে চেয়েছেন তেমিন সরকার আমিনও এক মাকে বেছে নিয়েছি। যিনি তার সমস্ত শিশুদের বেধে রেখে পাথর রান্না করছেন। কাঠিন্যকে চুলায় বসিয়ে দিয়ে তাকে সিদ্ধ করার এই উপমাটি অভিনব। নব্বই দশকের নতুনত্ব এই কবিতাটিতে এর সমস্ত জটিলতা নিয়ে আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করছে। একদিকে পাথর সিদ্ধ হচ্ছে খাদ্যে রূপ নেওয়ার জন্য অন্যদিকে গোধূলিবেলায় কবি অনুরোধ করছেন তার মাকে ক্ষুধার্ত শিশুদের মুক্ত করে দিতে। যাতে তারা পাথরের বদলে পৃথিবীর দিগন্ত থেকে সূর্য থেকে সমস্ত দৃশ্যপট থেকে খাদ্য আহরণ করতে পারে। কি কি খেতে হবে তারও একটি ফর্দ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা খাবে মেঘের ভিতর থেকে তাদের আহার্য রাশি। দিগন্তের স্তন থেকে শিশুকাল চুষে নিতে প্ররোচনা দেওয়া হচ্ছে। সূর্যের লালা থেকে তাদের নুন চেখে নিতে বলা হচ্ছে। এই চিত্রকল্পগুলো অভাবনীয়। ক্ষুধার্ত বাংলাদেশের ক্ষুধা অনুভব করছেন এই কবি অত্যন্ত আন্তরিক স্বপ্ন সৃষ্টি করে। একে আমরা আমাদের কবিতায় নতুন ধারণা বলতে পারি। এই ধারণা মূলত পরাবাস্তব বিষয় হিসেবে আসেনি। এসেছে স্বপ্ন রঞ্জিত এক ধরনের বাস্তবতা। আমরা একে বাংলাভাষার আধুনিকত্তোর নতুন উপমার ইঙ্গিত হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। যে ধারণা আমরা পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর এবং আশি পর্যন্ত স্পষ্টভাবে দেখতে পাইনি।
তৃতীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা যার কথা উল্লেখ করতে যাচ্ছি তিনি মুজিব ইরম। যদিও তার চিত্রকল্পগুলো বুঝতে কোন কষ্ট হয় না এবং মূলত অত্যন্ত সরল। তবু এর মধ্যে উপরোক্ত দুজনের মতোই শক্তিশালী কবিত্ব ধারণার ইঙ্গিত রয়েছে। মুজিব ইরমের কবিতায় গ্রাম্য নজর লাগার বিশ্বাসটি প্রতিফতিলত হয়েছে। তিনি বলেছেন, তার মা পাশের বাড়ির মেয়েটির ‘নজর’ লাগবে বলে তাকে ‘নজরের পানি’ নিত্য পান করাতেন। এখানেও মা-ই হলেন অভিভাবক। এই মা-বাপরা আমাদের কবিতায় এতোদিন কোথায় ছিলেন?
ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী যে রোমান্টিকতা বাংলা কবিতাকে গ্রাস করে ফেলেছিলো নয়ন আহমেদ, সরকার আমিন এবং মুজিব ইরম তার থেকে বেরিয়ে আসার প্রথম আঘাতটি বেশ আড়ম্বরের সাথেই শুরু করেছেন বলে মনে হয়। নব্বই দশকের অন্যান্য কবিরা একই সঙ্গে উল্লেখযোগ্য হলেও আমি কেবল তিনটি স্বরচিত দৃশ্যকল্প দিয়ে তাদের প্রয়াসের অর্থাৎ বেরিয়ে আসার চেষ্টার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করলাম। পাঠকের এ ব্যাপারে এ ধারণা যেন না হয় যে নব্বই দশকের শতাধিক কবির মধ্যে এই তিনজন-ই উল্লেখযোগ্য। বরং এদের সকলের কবিতাতেই এ ধরনের কোন না কোন বৈশিষ্ট্য লুকায়িত আছে। আমি মাত্র তিনজন থেকে এই বৈশিষ্ট্যের দিকটি উল্লেখ করতে প্রয়াসী হয়েছি। তবে অন্তত আরো কয়েকজনের কবিতায় নব্বই দশকের যে কবি লক্ষণ আমাকে চৈতন্যদয়ে সাহায্য করেছে তাদের কথাও উল্লেখ করতে চাই। সবার কবিতার উদ্ধৃতি দেওয়া এ প্রবন্ধে প্রাসঙ্গিক হবে না। অন্তত আরো যে বেশ কয়েকজন কবি নব্বই দশকে নতুন বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন : বায়তুল্লাহ কাদেরী, খৈয়াম কাদের, মিহির মুসাকী, কামরুজ্জামান কামু, চঞ্চল আশরাফ, সায়ীদ আবুবকর, টোকন ঠাকুর, ব্রাত্য রাইসু, ইশারফ হোসেন, রহমান হেনরী, শাকিল রিয়াজ, মুজিব মেহদী, মহিবুর রহিম, রওশন ঝুনু, শান্তা মারিয়া, কবির হুমায়ুন, আল হাফিজ, জাফর আহমদ রাশেদ, কামাল আহসান, আলফ্রেড খোকন, সাজ্জাদ বিপ্লব, মাতিয়ার রাফায়েল, ওমর বিশ্বাস, মৃধা আলাউদ্দিন প্রমুখ তাদের মধ্যে অন্যতম। নব্বই দশকের মতো বিশাল একটি কবি সম্প্রদায়ের সকলের নাম উল্লেখ করা আমার জন্য একটু দুরূহ কাজ। তবে একথাও সত্য যে উল্লেখিত কবিরা ছাড়াও নানারকম ব্যক্তি বৈশিষ্ট্য এবং বিচিত্রকর্ম তৎপরতায় আমাদের কবিতাকে অলঙ্কৃত করে চলেছেন এই দশকের শতাধিক কবি। ব্যক্তি বৈশিষ্ট্যের কথা এ জন্য বললাম এদের মধ্যে কেউ কেউ আমার সাথে ব্যক্তিগত ভাবে পরিচিত। বিচিত্র তাদের সাজ পোশাক। বিচিত্র তাদেও পেশা।
যেমন নব্বই দশকের কবি সায়ীদ আবুবকরের সাথে আমার পরিচয়ের পর্বটি আমি কখনো ভুলিনি। ফর্সা ছিপছিপে ধরনের একজন তরুণ মাথায় পাগড়ি ও লম্বা আলখেল্লা পরে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলো। যখন জানলাম তিনি ইংরেজী সাহিত্যের একজন সফলকাম ছাত্র এবং শিক্ষকতা করেন ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজে। তখন বেশ বিস্মিত হয়েছিলাম। তাকে দেখে আমার একটি তুর্কি কবিতার ইংরেজী সঙ্কলনের কথা মনে হলো। সেখানে সঙ্কলনের সম্পাদক আক্ষেপ করে লিখেছিলেন যে, তুরস্কের তরুণতম কবিদের একটা বড় অংশ মৌলবাদী। যাদের বয়স বিশ থেকে পঁচিশের মধ্যে। তারা যে খুব জনপ্রিয় এ কথাও সম্পাদক উল্লেখ করেছিলেন। পাগড়ি ও আলখেল্লা পরা সায়ীদ আবুবকরকে দেখে আমি প্রথমেই জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি মৌলানা? একথায় তার ফর্সা মুখে হাসি ছড়িয়ে পরেছিলো। আজ্ঞে না। আমি কবিতা লিখি ও ইংরেজী পড়াই।
তেমনি আজিজ মার্কেটে একদিন নব্বই দশকের এক কবির সাথে পরিচিত হয়ে আমি চমকে উঠেছিলাম। তার নাম রওশন ঝুনু। প্রথম দৃষ্টিতে তাকে আমার নারীবাদী বলে সন্দেহ হয়েছিলো। সার্ট প্যান্ট পরা ববকাট চুল সিগ্রেট ফুকতে ফুকতে আমার দিকে এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে বললো, নারীবাদী নই, আমি কবি। এই নিন আমার বই। বইটা উল্টেপাল্টে দেখতে গিয়ে বিস্মিত হয়ে দেখলাম সময় সম্বন্ধে কান খাড়া করে রাখা হরিণির মতো তার পংক্তি বয়নের কৌশল। মূহুর্তে আমার কাছে বিজ্ঞপিত হলো এ পুরুষের ছদ্মবেশের আড়ালে দুর্দম কৌতূহলে উচ্চকিত এক কিশোরী কবি। যার চোখের সামনে প্রতিবাদ। চোখের পেছনেও প্রতিবাদ। মনে হলো তার ছদ্মবেশটি কবি হয়ে ওঠার জন্যে।
অন্য দৃষ্টান্তটি আমার বিচরণশীল কৌতূহলের সাথে সম্পৃক্ত। আমি একস্থানে স্থানু হয়ে থাকতে পারি না। সারা বছরই বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও সফর করে বেড়াই। একবার বগুড়ায় গিয়ে এক তরুণ কবির সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিলো। আমার জানা ছিলো না যে তিনি নব্বই দশকের কবি। কিন্তু তার সম্পাদিত একটি পত্রিকা হাতে তুলে দিলে আমি চমকে যাই। দেখি এখানে সাহিত্যের এক কেন্দ্রচ্যুত প্রতিবাদের আগুন। দেখতে ছোটখাটো এই তরুণটি ঘুম ঘুম চোখে আমার দিকে তাকিয়ে যখন বেশ দীপ্ত কণ্ঠে জানালো যে, শুধু ঢাকাতেই সাহিত্য হবে এটা তিনি মানেন না। সাহিত্যকে বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব যারা নিয়ে বিভিন্ন মফস্বল শহরে কাজ করছেন তিনি তাদের একজন। তখন পত্রিকাটি উল্টে প্রথমে তার কবিতা পড়তে চেষ্টা করলাম—
প্রতিদিন। প্রত্যুষে। মা’কে দেখি
ঘর পরিষ্কার করতে
মা আপনি কি ঝাড়ু দেন?
বিগত দুঃখ, যাবতীয় রোগ-শোক-ব্যর্থতা
অনাগত দুঃস্বপ্ন…
[মন্তাজ-১, সাজ্জাদ বিপ্লব, ‘নব্বইয়ের কবিতা: অন্য আকাশ পৃ: ৭৩]
এতে আমার চৈতন্যে সহসাই যেন একটা কলিংবেলের শব্দ বেজে উঠলো। যে সহজতা উত্তর আধুনিক কবিকূলের গন্তব্য এ কবি যেন মায়ের পেট থেকেই তা আয়ত্ব করে এসেছে। এখানেও কেন মায়ের-ই চিত্রকল্প– তা আমি এখনো ভাবি।
সায়ীদ আবুবকর, রওশন ঝুনু বা সাজ্জাদ বিপ্লব মনে হয় যেন একই মাতৃউদর থেকে বাংলাদেশের সাইর গ্রামে-বন্দরে নোঙর ফেলে বসে আছে। এই সব ব্যক্তি বৈশিষ্ট্য আমি হলফ করে বলতে পারি পঞ্চাশ দশকে ছিল না। তখনকার কবিরা গ্রাম থেকে যাত্রা করে ঢাকায় আসতে চেয়েছিলেন। আর এদের অর্থাৎ উপরোক্ত তিনজনের কোন কেন্দ্র বা রাজধানী নেই। এরা কেন্দ্রিকতার উল্টো স্রোত বলে আমার মনে হয়েছে। তবে এরাও ভাটি থেকে উজানে যেতে চায়। এদের শরীর বাইম মাছের মতো পিচ্ছিল। গতি দুর্দমনীয়। ভাষা সহজ এবং আচরণ সহজিয়া। মনে হয় বাংলাদেশ এদের মধ্যেই বা এদের মাধ্যমে আবার নিজের লোকজ স্বরূপে আবির্ভূতা হবেন।
কবিতা আলোচনা করতে গিয়ে ব্যক্তি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করলাম এ জন্য যে আজকাল পশ্চিমে যারা কাব্য আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন তাদের প্রায় সকলেই কবিতার সাথে কবিকেও আলোচনা করছেন। কবির জীবন, বিচরণ, বাসস্থান, এমনকি যৌন জীবনও। আমি অবশ্য অতোটা গভীরে যাওয়ার শক্তি রাখি না। কিন্তু একজন কবির সাথে ব্যক্তি পরিচয় এবং তার কবিতা পাশাপাশি রেখে সৃজনশীলতার পেছনের দৃশ্যপট যতটা দেখা যায় তা ব্যক্ত করতে চেষ্টা করেছি। হয়তো এতে কবিতা সম্বন্ধে বিমুখ পাঠকেরও মনযোগ আকৃষ্ট হতে পারে। যেমন এখন পশ্চিমে শুরু হয়েছে একই সাথে কবি ও কবিতাকে পাঠ করার উদ্যোম। এ ধরনের পাঠে পাঠক মাত্রই উজ্জীবিত বোধ করছেন। এটা সারাবিশ্বের কবিতার জন্যই আশার কথা।
পাগড়ি পরা ইংরেজী সাহিত্যের শিক্ষক সায়ীদ আবুবকরের একটি কবিতায় স্বামী ঘাতিনি এক নারীর আর্তি ব্যক্ত হয় এভাবে–
‘কোথায় সে নারী আছে, সইতে পারে এ-ও–
ক্ষিপ্ত তার ভাতারের পুরুষাঙ্গ নিয়ে
তারই গৃহে কামক্রীড়া খেলতেছে কেউ
তারই খাটে শুয়ে শুয়ে, পা ছড়িয়ে দিয়ে?
যে পারে সে পারুকগে, কঠিন সে পারা–
আমি হীনা, তা পারি না; চলে না কখনও,
শুধু জানি, প্রেমক্ষেত্রে ভাগবাটোয়ারা,
বেচাকেনা, ধারকর্জ, কুটুম্বিতা কোনো।’
[ঘাতিকা বধূর প্রেমকথা, সায়ীদ আবুবকর; ‘নব্বইয়ের কবিতা: অন্য আকাশ’ পৃ: ৭৭]
ব্যক্তিসত্তার বৈচিত্র কবিদের সাজসজ্জা এবং কবিতা এমন বৈপরীত্যে উচ্চকিত হয়ে উঠেছে যা বাংলা কবিতার বাঁক ফেরার ব্যাপারেও কোন সন্দেহের অবকাশ রাখে না।
আমি আগেই বলেছি নব্বই দশকের সব প্রতিভাবান কবিদের রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তাদের প্রতিভাকে সনাক্ত করা আমার মতো অপরিচ্ছন্ন দৃষ্টির সমালোচকের কাজ হতে পারে না। তবু এদের অগ্রবর্তী কবি হিসেবে এই বাঁক ফেরার বিষয়টি আমি যে উপলব্ধি করতে পেরেছি তা অকপটে স্বীকার করার জন্যই এই প্রবন্ধটির আয়োজন।
ব্রাত্য রাইসু ‘নব্বইয়ের কবিতা’য় ‘স্তন’ শীর্ষক একটি কবিতা লিখেছেন। লেখাটি বারবার পড়েও এর থেকে গভীরে গ্রাহ্য করার মতো চিত্রকল্প আমি নিজের কাছে স্পষ্ট করতে পারিনি। অথচ ‘স্তন’ শব্দের অর্থ আমি জানি। ‘স্তন’ হলো কোন কিছুর শব্দ করে ওঠা। জানান দেওয়া। কিন্তু ব্রাত্য রাইসু এই অসাধারণ নারী অঙ্গকে একটি দুরূহ দার্শনিক বলয়ে পরিণত করতে চান।
‘ঐ স্তন ঘিরে ঘুরে আসছে মারাত্মক ভাবুক প্রজাতি। ভয়ে ও বিনয়ে নুয়ে পড়ছেন অধ্যাপক–
বিশুদ্ধ জ্যামিতি। ঐ স্তন ঘিরে গড়ে উঠছে সংক্রামক নগর সভ্যতা; ফেটে পড়ছে ত্রিকোণ
গোলক—’’
[স্তন, ব্রাত্য রাইসু; ‘নব্বইয়ের কবিতা’ পৃ: ৭৩]
আমার মনে হয় দার্শনিকতা কবির উদ্ভাবন ও মূল চিত্রকল্পকে দুর্বোধ্য করে দেয়। নব্বই দশকের সবগুলো লক্ষণ থাকা সত্তেও রাইসু দুরূহতার দিকে পা বাড়িয়েছে। তাকে উপদেশ দিয়ে ফেরানো যাবে না।
এখানে আরও কয়েকজনের পংক্তি উল্লেখ করতে চাই—
‘আমার পায়ের নীচে কত মৃত পা
মৃত পায়ে কত কত শিড়দাঁড়া, তবু
কোথাও দাঁড়াতে পারি না।’
[পা, আলফ্রেড খোকন; ‘নব্বইয়ের কবিতা’ পৃ: ৩২]
‘একদিন পৃথিবীবাসীর কাছে
আত্মজিজ্ঞাসার লোভে ছুটে আসি
আর এতো আলো বিচ্ছুরণ দেখে
আমরা ভয়ে ও বিস্ময়ে মরে গেলাম।’
[ধাত্রী, কামরুজ্জামান কামু; ঐ, পৃ: ৪৭]
‘এসে তো গেলাম, অনন্তের ঝাপসা লাল
দিগন্ত রেখায়;
ঘূর্ণিত জলের তোড়ে ভুলে গেছি
বৃক্ষ ও পাখিদের হলুদ প্রার্থনা :
কোথায় পাতাল বলো, কোথায় মোহনা’
[প্লাবন, চঞ্চল আশরাফ, ঐ, পৃ: ৫৩]
‘যতদূর যাওয়া যায়
যেন তার অধিক গিয়েছি আমি–’
[সংশয়, টোকন ঠাকুর, ঐ, পৃ: ৬১]
‘আমার আনন্দবৃক্ষ অকাতর হেঁটে যায়
হাজার বছর–
গায়ে তার চিরন্তর ছন্দের নূপুর
এই তার ব্রজবুলি,
এই তার যোগ্য প্রতিবেশ।’
(আনন্দবৃক্ষ, তপন বাগচী, ঐ, পৃ: ৬৫।
আমি নব্বই দশকের কবিদের কবিতা থেকে উপরোক্ত পংক্তিগুলো উদ্ধৃত করলাম শুধু আমার বক্তব্য স্পষ্ট করার জন্য। আমি আমার সুবিধে মতো এই পংক্তিগুলো চয়ন করেছি। অথচ একথা আমার জানা আছে যে, আমার মতো পাঠকের মুখ চেয়ে নব্বই দশকের বিশাল কবিগোষ্ঠি কাব্যরচনায় প্রবৃত্ত হননি। আমি স্বীকার করি যে এদেরও মেধা অসাধারণ। ধীশক্তি সুতীক্ষ্ম। এবং অন্তর্দৃষ্টি কবিত্বময়। কিন্তু দূরদৃষ্টি একরকম নেই বললেই চলে। তারা আমার জন্যে লেখেননি কিন্তু কারো না কারো জন্য তো নিশ্চয় লিখেছেন। তাদের কবিতা তো আর হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর দুষ্পাঠ্য লিপি কৌশল নয়। নিশ্চয় এই কবিগোষ্ঠির কাব্যসুধা পান করার মতো পাঠক তাদের নিজেদের মধ্যেই রয়ে গেছে। তারা কি পরিতৃপ্ত? তারা যদি তাদের নিজেদের কবিগোষ্ঠির রচনা পাঠ করে অপরিতৃপ্ত থেকে থাকেন তবে আমার মতো বৃদ্ধ প্রায়ান্ধ কবি এই পংক্তি নিচয় হাড়তে কি আর খুঁজে পাবে? আমি অসাধারণ পাঠক নই একথা মেনে নিলেও সাধারণ পাঠক হিসেবে নিশ্চয় তারা আমাকে গণ্য করবেন। যেটুকু অন্তুত কম্যুনিকেট যোগ্য আমি সে পংক্তিগুলোই উদ্ধৃত করেছি। চিত্রকল্প না হোক এদের কবিতায় আমি দৃশ্যকল্প হাতড়ে বেরিয়েছি। না তেমন ফটোগ্রাফিও তারা আমাদের সামনে হাজির করতে পারেননি। এদের কথার ধার আছে কিন্তু কোন দিক নির্দেশনা নেই। তারা বলতে পারেন যে দিকনির্দেশনা দেওয়া কবির কাজ নয়। আমি বলবো পাঠককে দিকভ্রান্ত করাও কবির কাজ নয়। চল্লিশ দশকের শেষের দিকে মার্কসবাদী কবিরা এই গোলক ধাঁধার সৃষ্টি করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। তারা মৃগাঙ্ক রায়কে এই গোলক ধাঁধার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে উপস্থিত করেছিলেন। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু তা স্বীকার করেননি। ফলে চল্লিশ দশকের শেষের দিকে গদ্য কবিতার ঝড়ের মধ্যে কিছু অকবি এসে ঢুকে পড়ার উপক্রম করেছিলো। কিন্তু কাল ও কবিতার নিয়মে তারা বাংলা সাহিত্য থেকে অন্তর্হিত হয়েছেন। আমি একথা বলছি না যে গদ্যে রচিত হলেই তা কবিতা হবে না। তাহলে তো সমর সেন কল্কে পেতেন না। এবং রবীন্দ্রনাথের শেষের দিকের কবিতা– যা নিরাভরণ গদ্যে রচিত– সেগুলোও মহাকবির অন্তর্লোক আমাদের কাছে উদ্ভাসিত করতো না। আমি নিজেও প্রচুর গদ্য কবিতা লিখে থাকি। আমি এগুলোকে গদ্য কবিতা হিসেবে বিবেচনা করে লিখিনি। আমি ভাবি আমি ঐ সব রচনায় সমিল পংক্তি বয়নের প্রয়োজন বোধ করিনি। নব্বই দশকের কবিদের একটি গুণকে আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা নিয়ে বিবেচনা করি। সেটা হলো তারা গদ্য কবিতার প্রয়াসী নন। তারা একটি গদ্য- পদ্য মিশ্রিত আঙ্গিক খুঁজে বের করতে চেয়েছেন। এদের পরিশ্রমেই আমার ধারণা প্রচলিত আঙ্গিকের বাঁধুনীতে চর চর শব্দে চিড় ধরে যাচ্ছে। কারণ এদের বিষয় অত্যন্ত নতুন। নতুন জিনিস সব সময় অর্থবহ হয় না। তবে প্রচলিত আঙ্গিক বদলে যায়। আমার মনে হয় সবার অজ্ঞাতে নব্বই দশকের শতাধিক কবি একযোগে বাংলা কবিতার বাঁধুনী ভেঙ্গে দিচ্ছেন। তাদের ভাষা গূঢ়ার্থব্যঞ্জক। সব অর্থই গ্রহণ করা যাবে এটা আমিও মনে করি না। তবে তারা যদি অনুগ্রহ করে পাঠকদের জন্য কম্যুনিকেট করার মতো কিছু অর্থ রেখে দেন তাহলে কবিতা তাদের মতো শুধু মেধাবীদের পাঠ্য বিষয় হিসেবেই বিবেচিত হবে না। সাধারণ পাঠক– যারা কবিতা নিজেদের শিক্ষিত করতে সচরাচর পড়ে থাকেন– তাদের রুচিবোধ তৈরীতে সহায়ক হবে।
আমি নব্বই দশকের দুটি সঙ্কলনকে আলাদা আলাদাভাবে আলোচনা করতে চাইনি। কিন্তু যেহেতু এদের মধ্যেও ঐকমত্য সৃষ্টি হয়নি সে কারণে সম্ভবত অপর সঙ্কলনটি ‘নব্বইয়ের কবিতা: অন্য আকাশ’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। তাদের মতদ্বৈততা কি– তা স্বভাবতই আমার জানা আছে। প্রথম সঙ্কলনটির সম্পাদক মাহবুব কবির কি কারণে তাদের সঙ্কলনে ‘অন্য আকাশ’ এর কবিদের গ্রহণ করতে পারেননি তা একটু ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে।
‘কবিতা বা মহৎ শিল্প রাষ্ট্র-রাজনীতির সীমানায় অনুরুদ্ধ নয়, সর্বকালের চিরন্তন উত্তরাধিকার’– এ কথা ভূমিকায় সম্পাদক মাহবুব কবির উল্লেখ করলেও এদের চিন্তা-চেতনা এবং কাব্যবিশ্বাস ধর্মের ব্যাপারে অবরুদ্ধ এবং অনুদার। যদিও ভূমিকায় ধর্মের উল্লেখও তিনি করেছেন।
নব্বই দশকের পরবর্তী সঙ্কলনটি যা সাজ্জাদ বিপ্লব সম্পাদনা করেছেন তাদের কাছে ধর্ম একটি বড় বিশ্বাস জাগানিয়া অফুরন্ত বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এখানে বিশেষ কোন ধর্মের কথা উল্লেখ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। অদৃশ্যে বিশ্বাস যে পরবর্তী সঙ্কলনটির কবিদের উপজীব্য– তাতে দুর্বাভনার কিছু আছে বলে আমার মনে হয়নি। কালচক্রের বিশেষ মন্থনে সাজ্জাদ বিপ্লব এবং মাহবুব কবির– কে কোথায় আশ্রয় নেবেন সম্ভবত তা তারা নিজেরাও জানেন না। আপাতত আমরা ধরে নিচ্ছি যে, কবিতা নির্বাচনে এদের বাছ-বিচার বর্তমান সময়ে অগ্রাহ্য করলেও চলে। আমি এদের সদিচ্ছাটুকুই সাহিত্যের স্বার্থে উল্লেখযোগ্য বলে মনে করি। দুজন সম্পাদককেই আমি স্মরণ করে দিতে চাই যে, কাজী নজরুল ইসলাম ভারত বিভাগে বিশ্বাসী ছিলেন না। কিন্তু এ বিভক্তি বাঙালি মুসলমানদের জন্য অপরিসীম সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত করেছে। এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্যও। কারণ দেশবিভাগের পর আরো একটি ঘটনা ঘটেছে– তা হলো বাংলাদেশের অভ্যুদয়। এখানে কাজী নজরুল ইসলাম জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে বা ভারতে আজকাল কেউ আর তার নামও উচ্চারণ করেন না। অথচ তিনি ছিলেন হিন্দু-মুসলমান মিলনের অগ্রদূত। তার কালে তিনি বাংলা ভাষাভাষী এক মহাজাতিগোষ্ঠিকে প্রবলভাবে আলোড়িত করতে পেরেছিলেন। তার আবির্ভাব না ঘটলে ‘কল্লোল’ কালের নাক উঁচু কবির দল এবং তিরিশের কেতাদুরস্থ কবিদের বাকস্ফূর্তি সহজ হতো না। বলাবাহুল্য, নজরুল অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন বলেই তাকে সবচেয়ে বেশী সাম্প্রদায়িক ঘৃণা হজম করতে হয়েছিলো। আমি নব্বইয়ের কবিতার আলোচনায় এসব কথা উত্থাপন করলাম এ জন্য যে, সাহিত্যে যারা অযথা বিভক্তি তৈরী করেন সাহিত্যের ইতিহাসে তাদের নাম লেখা থাকে না। তিনি যদি নিজে কবি হন তবে তার উল্লেখযোগ্য লাইনগুলোই পরবর্তীকালে উৎসাহ যোগাতে পারে মাত্র। আমি এ সতর্কবাণী উভয় সম্পাদকের জন্যই একান্ত জরুরী বলে মনে করি।
এবার আসা যাক ‘নব্বইয়ের কবিতা: অন্যআকাশ’-এ। এই সঙ্কলনটি অপেক্ষাকৃত ছোট। কবির সংখ্যাও মাত্র তেইশ জন। এদের কাব্যের মানস মানচিত্রটি মাহবুব কবির সম্পাদিত সঙ্কলনটির কবিদের মতোই দুটি রঙে রঞ্জিত। এই রঙ দুটির নাম হলো: সহজতা ও কাঠিন্য। কবিতা যে পাঠকের মনে দ্রুত সঞ্চারিত হতে হবে এইসব কবিরা তা কেউ কেউ বিশ্বাস করলেও এদের প্রায় সব কবিই মনে করেন তারা অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং বিদ্বান। বুদ্ধি ও বিদ্যা কবিতা লেখার আজকাল একটি শর্ত হয়ে উঠেছে বটে কিন্তু বুদ্ধি-বিদ্যা-মেধা ইত্যাদি কবিতা লেখার আনুসঙ্গিক গুণ মাত্র। কবিতা লিখতে হয় যে জিনিস দিয়ে তার নাম হলো হৃদয়। হৃদয়ানুভূতির অন্য নাম আবেগ। এই আবেগেরও একটা পরিমিতি বোধ থাকতে হয়। সেটাও কবির মস্তিষ্ক নির্ধারণ করে না। করে মন। যা হৃদয়েরই জুরিগাড়ি। দ্বিতীয় সঙ্কলনটির কবিদের কবিতাতেও সোনার ডিমের মতো একটি পূর্ণ কবিতা লেখার প্রয়াস আছে বলে আমার মনে হয়। হয়তো আছে কিন্তু তা বিমূর্তভাবে। যা মূর্ত হয়ে উঠেছে তা হলো হীরের ধারের মতো কয়েকটি পংক্তি ও উপমা। তবে আগের সঙ্কলনটির চেয়ে এদের গন্তব্য আমার কাছে স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে। এদের সাথে হয়তো বা খুব ভালো করে পরীক্ষা করলে আদি বাংলা কবিতার একটা মিলও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। এরাও প্রতীকী ভাষা ব্যবহারে পারদর্শী। এরা ভাবেন এই ভাষা পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন। কারণ এরা পাঠক বলতে তাদের সমধর্মী কবিদেরই বোঝেন।
কিন্তু সমধর্মী ও সহমর্মী কবিরা ছাড়াও কবিতা যে কোন কোন সময় সাধারণ মানুষও পাঠ করেন একথা এরা হয়তো ঠিক মতো বুঝতে পারেন না। এরা কবিতা লিখেছেন তাদের মতো কবিদের জন্য। অথচ তাদের মতো কবিরা নিজেদের গণ্ডীর বাইরে অন্য একটি ঐতিহ্যগত জগৎ আছে তা সাদা চোখে দেখতে পাচ্ছেন না।
এখানে পঞ্চাশ দশকের কবিদের একটি তথ্য এদের জন্য বর্ণনা করতে চাই। পঞ্চাশ দশকে ধরে নেওয়া হতো যে অমুক অমুক কবি খুবই বিদ্বান এবং বুদ্ধিমান। সেজন্যই তাদের কবিতা পাঠক সমাজের কাছে সুবোধ্য ছিলো না। কিন্তু আজ তাদের সেসব কবিতা পরীক্ষা করে বোঝা যাচ্ছে যে তারা তাদের জগৎ সম্বন্ধেই ছিলেন একই সাথে মূর্খ ও উদাসীন। অন্তত তাদের কবিতা থেকে তারা যে অনেক লেখাপড়া করেছিলেন এমন কোন দৃষ্টান্ত খুঁজে বের করা যাচ্ছে না। এমনকি তাদের সময়কার বিশ্বসাহিত্য সম্বন্ধেও তাদের বিদ্যা বুদ্ধির দৌড় ছিলো একমুখি। তারা মার্কসবাদ বুঝতেন (বুঝতেন কি?) এবং শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব কায়েমের জন্য নিজের দেশে সাহিত্যিক লড়াই জারি রেখেছিলেন। আজ তারা গৌণ কবি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। এটা নব্বই দশকের উভয় সঙ্কলনে অন্তর্ভূক্ত কবিদের জন্য আমার মতো একজন অন্ধ ও জরাজীর্ণ ভবিষ্যতদ্রষ্টার একটি সতর্কবাণী। আমি আগেই উল্লেখ করেছি নব্বই দশকের শতাধিক কবি পুরুষই কবিত্ব শক্তি নিয়ে জন্মেছেন। এই কবিত্বশক্তির আরো একটি নাম আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন সেমিনার সিম্পোজিয়ামে ঘন ঘন উচ্চারিত হয়। আমি ঐসব সেমিনার সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহন করি বলেই একথা জানি। সে নামটি হলো মনুষ্যত্ব। কবিতা যে মনুষ্য স্বভাবেরই বিবরণ তা সাম্প্রতিককালের ভাবুকগণ বিচার করে দেখছেন। আমার দৃঢ় ধারণা তারা মানবজাতির কবিত্বশক্তি যে শেষ পর্যন্ত মনুষ্যত্বেরই একটি সৃজনক্রিয়া তা মেনে নেবেন। নব্বই দশকের নীলিমার দিকে এবার একটু দৃকপাত করা যাক—
‘যে শহরে আমি নেই, তুমি তাকে বোলো না শহর।…’
[ যে শহরে আমি নেই, আল হাফিজ; ‘নব্বইয়ের কবিতা: অন্য আকাশ’ পৃ: ১৩।
‘ঘড়িটা হারিয়ে গেলে তোমাকে খুঁজে পাই না
তুমি হারিয়ে গেলে, ঘড়িটা–’
[ইতিহাসের শরীর, ইশারফ হোসেন; ঐ পৃ: ১৮]
‘নিপুণ বয়নশিল্পী এক
সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সেলাই করে
….
আসলে কি সেলাই করে লোকটি
মানুষের সুখ না দুঃখ
[ড্রাই ক্লিনার্স, কামরুজ্জামান; ঐ পৃ: ২৪)
‘রঙ করা প্রভাষণ ছেড়ে মায়ের চিঠিতে আমি
সুরারোপ করি,
বৃক্ষের বাকলে
লিখি শষ্য কবিদের নাম।’
[লাঙ্গলের খেয়া ভাঙ্গে জীবনের গতি, খৈয়াম কাদের; ঐ পৃ: ২৯]
‘নিজের জমিন ফেলে ভূমিহীন স্বপ্নের রাতে দুঃখের দানা খায় আত্মার কবুতরগুলো’
[পরস্পর, মহিবুর রহিম; ঐ পৃ: ৫২।
‘কৃষ্ণপক্ষে ডেকে আনি চাঁদ
স্বপ্নকে শুকোতে বিছিয়ে দিলাম মেঘে
…
ঘাসও পেরেক হয়ে বিঁধে যায় পায়ে।’
[ফসিল ও জলতমা, মুহম্মদ আবদুল বাতেন; ঐ পৃ: ৫৯।
‘এখন হাঁসটার প্রচন্ড ইচ্ছে হচ্ছে– সে ভাজা ডিম পারে
অথচ পৃথিবীর ভয়ে সে তার ইচ্ছাকে পূরণ করতে পারছে না’
[কষ্টের হাঁসগুলি, মৃধা আলাউদ্দিন; ঐ পৃ: ৬২]
‘শৃঙ্গার শেখাবে বলে পুরো সন্ধ্যা আমাকে শাসালে
বললে গভীর হোক রাত…।
জানালায় চুম্বনের দাগ নড়ে ওঠে সেদিকে তাকিয়ে তুমি নিরিবিলি খুলে দিলে গিট সেইতো আমার যতিচিহ্ন চেনা।…’
[প্রণয়ের সম্ভাবনা, শাকিল রিয়াজ; ঐ পৃ: ৬৬]
এই হলো নব্বই দশকের অন্য আকাশ। দূর থেকে অসংখ্য তারার টিপটিপ আয় আয় শব্দ কাছে গেলে উল্কার মতো নিজের পুচ্ছ পুড়িয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
কবিতা অক্ষরে লিখিত হলেও তা মৌমাছির মতো অক্ষরের মৌচাক ছেড়ে পাঠকের মনে গুঞ্জরিত হয়। আমরা আমাদের প্রিয় কবিদের নাম যখনই কোথাও উচ্চারণ করি তখন শুধু ঐ নামটিতেই তিনি অবস্থান করেন না। আমাদের সত্তায় গ্রোথিত তারই রচিত কয়েকটি কবিতায় বিবর্তিত হয়ে যান। আমরা কবিকে ও তার কবিতাকে একসাথে মনের মধ্যে মিশ্রিতভাবে অনুভব করতে থাকি। তখন কবি জীবনানন্দ দাশ আর ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি রচনা আর রচয়িতা হিসেবে পৃথক থাকেন না। আমরা আর আলাদা করতে পারি না। কবির চেহারা আমরা ভুলে যাই। পাঠকের মানস মণ্ডলে তখন একটি বা দুটি কবিতাই কবির প্রতিকৃতি হয়ে যায়। শুধু একটি বা দুটি কবিতা নয় একাধিক কবিতাও হতে পারে কিম্বা একটি আস্ত বই। আমার মনে হয় নব্বই দশকের দ্বিতীয় সঙ্কলনের কবিদের এই বাছাইকরা সঙ্কলনটিতে তাদের সম্পূর্ণ চেহারা পাঠকের কাছে মূর্ত হয়ে ওঠার অপেক্ষায় আছে। বলাবাহুল্য যে, এরা সবাই বয়সে তরুণ। তাদের জন্য ভবিষ্যৎ আছে। আমি সমালোচক হিসেবে শুধু এটুকু বলতে পারি এদের প্রত্যেকেই সেই ভবিষ্যতে প্রবেশের জন্য যে প্রয়োজনীয় কাব্যগুণ নিজের কবিতায় সঞ্চারিত করা একান্ত দরকার তা সঞ্চয় করেছেন। অর্থাৎ ভবিষ্যতের ছাড়পত্র এখন তাদেও পোশাকের গুপ্ত পকেটে উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। তাদেও চোখে ও দৃষ্টিতে স্বপ্নের মায়াকাজল।
নব্বইয়ের কবিদেরও আরম্ভ কোন প্রতিষ্ঠিত বহুল প্রচারিত দৈনিকের সাময়িকীতে নয়। এরা ক্ষুদ্রপত্রিকা তথা লিটল ম্যাগাজিনের স্পর্শকাতর পৃষ্ঠার সচকিত কবির দল। বড় পত্রিকায় তরুণতম কবিদের আত্মসমর্পনের যে অভ্যেস গড়ে ওঠে তাতে আরম্ভেই কবিকে নানারূপ হুকুম তামিল করে চলতে হয়। কারণ অধিকাংশ দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পৃষ্ঠা সম্পাদনা করেন এমনসব ব্যক্তি যারা সবই বোঝেন কিন্তু প্রকৃত কবিতা তাদের মাথায় ঢোকে না। এরা কবিকে দিয়ে নিজের স্বার্থ ও মর্যাদা বৃদ্ধি করতে চান। নিজের প্রশংসাগীত গাওয়াতে চান। রাজনীতি ও দলীয় পক্ষপাত গলাধঃকরণ করাতে চান। অর্থাৎ তরুণতম কবির আত্মবিশ্বাস দুমড়ে মুচড়ে অকেজো করে রাখতে চান। বড় পত্রিকার সাহিত্য পৃষ্ঠাগুলো সৃজনশীল সাহিত্যের মুক্তাঙ্গন নয়। পীর মুরীদির ব্যবসার মতো। কিছু হাদিয়া দিয়ে সেখানে ঢুকতে হয়। এবং খড়ের গম্বুজকে সালাম করে কবিখ্যাতির ভাগীদার হতে হয়। সে তুলনায় লিটলম্যাগ একালের সৃজনপ্রতিভার শস্যক্ষেত্র। বাছাইয়ের কাজটি সব সাহিত্যেরই কাল নির্ধারণ করে। নব্বই দশকের ঝাড়াই বাছাইয়ের কাজটিও সকলের অজ্ঞাতে সময়ই নির্ধারণ করবে। একথাও সত্য যে লিটলম্যাগের জগতেও গোষ্ঠি প্রীতি আছে। তবু সব কিছু ছাপিয়ে ওঠে এদের পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিপাত, অনুসন্ধিৎসা, সমালোচনা এবং শ্রদ্ধাবোধ। কালের অক্ষর যারা রচনা করেন তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবেই। তবে গুপ্ত হত্যা ও নিম খুন না থাকুক এটাই আমাদের কাম্য।
নব্বই দশকের প্রথম সঙ্কলনটির সম্পাদক মাহবুব কবির দশকওয়ারী সঙ্কলনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তার পূর্বসুরী আশির দশকের কতগুলো গুণপনার কথা আমাদের কাছে ব্যক্ত করতে চেয়েছেন। সম্পাদক বলেছেন: “আশির দশক বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে ঝঞ্ঝামুখর ঘূর্ণাবর্তে চঞ্চল। এ্যানার্কিজমের বিরুদ্ধে, জনতার সামরিক শাসন উৎখাত, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বাক-শিল্প স্বাধীনতার উদ্ধার বিলোড়ন। স্বাধীনতা উত্তর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের হাজারো টানাপোড়েন, সেনানিবাসে পাইকারি খুন, গুপ্ত হত্যা, প্রহসনের বিচার, পাকিস্তানপন্থী সাম্প্রদায়িকতা ও রাজাকার পুনর্বাসন, অন্তর্ঘাত ও অরাজকতায় বিপন্ন বিধ্বস্ত দেশ-জাতি-তখনই রচিত হয় গণজাগরণের শ্রেষ্ঠপংক্তি– ‘গণতন্ত্র মুক্তিপাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’।” মাহবুব কবির উল্লেখিত এই বিবরণ অসত্য এবং অতিরঞ্জিত। আশির দশকের প্রতিনিধিত্বশীল কোন কবির হাতেই এমন কবিতা আমি দেখতে পাইনি যাতে তাদের সময়ের উপরোক্ত আক্ষেপগুলোর বিরুদ্ধে অন্তত একটি পূর্ণ পংক্তি রচনা করেছেন। আশির দশকের খোন্দকার আশরাফ হোসেন, আবদুল হাই শিকদার, রেজাউদ্দিন স্টালিন, সাজ্জাদ শরিফ, সরকার মাসুদ, বুলবুল সরওয়ার, তমিজউদ্দিন লোদী, রিফাত চৌধুরী, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, মাসুদ খান, মজিদ মাহমুদ প্রমুখ নিঃসন্দেহে কবি। তাদের কালের বাংলা ভাষার অন্যান্য কবিদের মধ্যে এরাই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার কালের ঘূর্ণাবর্তে এত সব ঘটনা ঘটে গেল কত প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানচিত্রকে উলোট-পালট করলো অথচ এরা প্রগতিবাদী বা প্রতিক্রিয়াশীল হোন– তাদের কলমে নারীস্তুতি ছাড়া কিছুই বেরিয়ে এলো না। আমি একথা বলছি না যে মানবীঅর্চনা তাদের কবিতাকে কোন মহিমা দেয়নি। আমি শুধু বলতে চাইছি– না এরা প্রগতিবাদী না মৌলবাদী। এমনকি তাদের দুর্বোধ্য প্রিয়তমাদের থেকে তারা প্রকৃতির দিকেও মুখ ফেরাতে পারেননি। হতে পারে এটা আশির দশকের কবিদের লক্ষণ বিচারের একটি মৌল উপাদান। কিন্তু স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তারা কোথাও কিছু লিখেছিলেন অন্তত– ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’- এ ধরনের স্লোগানও লিখেছেন তাদের বই থেকে এর কোন দৃষ্টান্ত পেশ করা যাবে না। তারা তাদের দশকে নিঃসন্দেহে প্রতিভাবান কবিত্বশক্তি। তবে ঐ শক্তি তারা উপুড় করে ঢেলে দিয়েছিলেন তাদের নারী অর্চনায়। আমি মনে করি তারা ঠিকই করেছিলেন। তারা এতটুকু অগ্রসর হয়েছিলেন বলেই নব্বই দশকের কবিতায় প্রেমকে বিশুদ্ধ ও বিবরণমুখর করার প্রতিশ্রুতি নতুন মাত্রায় ব্যক্ত হয়েছে। আমি যেহেতু আশির দশকের কবিদের নিয়ে এই প্রবন্ধ আলোচনায় উৎসাহী নই সে কারণে তাদের ব্যাপারে আমার বক্তব্য হলো– তারা কবি, প্রগতীবাদী বা প্রতিক্রিয়াশীল কিছুই নন। বরং মাহবুব কবির সম্পাদিত নব্বই দশকের কবির তালিকায় এমন কয়েকজন কবি আছেন যাদের রচনায় তাদের অন্তস্থ রাজনৈতিক দীপ্তি অর্থাৎ প্রগতিশীল এবং বিজ্ঞানমনষ্কতার চিহ্নসমূহ আবিষ্কার করা যাবে। আমি অবশ্য আমার আলোচনায় তাদের রাজনীতিকে গুরুত্ব দিইনি। বরং রাজনীতি সমাজনীতি এবং সমসাময়িক কালের গর্জনের ভেতরেও তাদের মৌলিক কবিত্বশক্তির যেটুকু পরিচয় পাওয়া গেছে তা বলতে চেষ্টা করেছি। একথা অবশ্য সাজ্জাদ বিপ্লবের সঙ্কলনটি সম্বন্ধেও বলা যায়। তবে তাদের গন্তব্যটি আমি যে স্পষ্ট বলে উল্লেখ করেছি এবার তার পক্ষে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো সঙ্গত মনে করি।
নয়ন আহমেদ, সায়ীদ আবুবকর, খৈয়াম কাদেরের কবিতায় দৃশ্যের চালচিত্রের ফুটো দিয়ে একটি অদৃশ্য জগতের আভাস আমরা পাই। সেই অদৃশ্য জগৎ সম্বন্ধে যে প্রত্যয়বোধ এইসব কবিরা উত্থাপন করতে চেয়েছেন তা তাদের ভবিষৎ গন্তব্যেরই দিক নির্দেশনা। কেউ এতে বিশ্বাস করতে পারেন, নাও করতে পারেন। আমি একথা বলি না যে, দ্বিতীয় সঙ্কলনটির কবিকুল অদৃশ্যে আস্থা রেখেছেন বলেই আমি খুশিতে আটখানা হয়ে গেছি। বরং আমার কাছে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো তৃতীয় বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশে যেখানে প্রগতিশীলতাই হলো কবি হিসেবে গ্রাহ্য হওয়ার শর্ত সেখানে সাজ্জাদ বিপ্লব সঙ্কলিত প্রায় সব কবিই ঐ শর্ত ভঙ্গ করে অনিশ্চয়তার দিকে পা বাড়াতে সাহসী হয়েছেন। এটাও সমকালীন আন্তর্জাতিক কবি দৃষ্টিভঙ্গীর একটি লক্ষণ বলে গণ্য হতে পারে। শুধু পারে বললে ঠিকমতো বলা হয় না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিচরণ করে এবং শত কবির সান্নিধ্যে এসে আমার এ ধারণা হয়েছে যে এটাই উত্তর আধুনিক কবিত্ব শক্তির প্রাথমিক লক্ষণ।
নব্বইয়ের কবিদের একটা পূর্ণ তদন্ত এই লেখাটির মধ্যে পেলাম। বৈচিত্র্যময় সৃষ্টির সম্ভারে ৯০ পূর্ণ। তাই ৫০ থেকে আশির দশকও ৯০ এর বৈশিষ্ট্য সমন্বিত। সহজ এবং অনবদ্য লেখাটি প্রত্যেকের পাঠ করা দরকার।
এই বয়সেও এতটা বিস্তৃত ও আন্তরিক আলোচনা করেছেন যা ভাবা যায় না । কবিতার উদ্ধৃতিগুলো থেকে কয়েকটি আশ্চর্যজনক ঔজ্জ্বল্য দেখা গেল ।
নব্বইয়ের বাংলাদেশের কবিদের নিয়ে একজন প্রতিষ্ঠিত অগ্রজ কবির এরকম আন্তরিক আলোচনা এবাংলায় আমরা কল্পনা করতে পারিনা। আমাদের সত্তর দশকের কবিরা এখনও নিজেদের দশকের ঢাক বাজাতেই ব্যস্ত ।আল মাহমুদ যে কবিদের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, পরবর্তী কালে তাঁদের অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ কবি হয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু কবির লেখনীর গুণে এই কবিদের কবিতা সম্পর্কে পাঠকের আগ্রহ তৈরি হয়। তবে আশির দশকের কবিদের কবিতা নিয়ে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সবটা সহমত হতে পারলাম না। আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের আশির দশকের কবিরা অনেক বেশি বলিষ্ঠ এবং গুরুত্ব পূর্ণ। নব্বইয়ের দশকের তুলনায়। এবাংলার ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটাই সত্য।
একবার “দৈনিক যুগান্তর” –
কয়েক জনের নাম ও আলোচনা বাদ দিয়ে ছেপেছিল কবি আল মাহমুদের এই প্রবন্ধটি।
এটি মূলত প্রথম ছাপা হয় কবি সাজ্জাদ বিপ্লব সম্পাদিত লিটলম্যাগ “স্বল্পদৈর্ঘ্য” পত্রিকায়।
কিন্তু যুগান্তর -কর্তৃপক্ষ কোনো তথ্যস্বীকার বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনি।
তারা সুবিধামতো লেখাটি অতি সংক্ষেপ করে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে।
এ ছিলো তাদের হীনম্মন্যতা। সাহিত্যে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
এ নিয়ে কিংবদন্তিতুল্য কবি ও কথাশিল্পী আল মাহমুদ ভাই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।