ড. মাহবুব হাসান
ষাটের কবিদের মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দের সঙ্গে আমার সখ্যতা ছিলো বেশি। আমি আর আবিদ আজাদ সত্তরের গোড়া থেকেই তার গ্রীন রোডের বাসায় প্রায় নিয়মিতই যেতাম আড্ডা দিতে। মান্নান ভাই আমাদের দেখেই একটা হাফ হাতা শার্ট পরে বেরিয়ে আসতেন। আমরা তার বাসার কাছেরই একটা রেস্তোরাঁয় বসতাম। তিনি সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতেন। আমরা শুনতাম। কখনো কখনো সায় দিতাম তার কথায় কিংবা প্রশ্ন করতাম কেন তিনি এমনটা ভাবছেন? রোববারের আড্ডা হতো দীর্ঘ, দুপুরের খাবার সময় পর্যন্ত। কোনো কোনো দিন আমরা রেস্তোরাঁয় খেয়ে-দেয়ে আসতাম।
সময়টা ছিলো উত্তাল, স্বাধীনতাউত্তরকালের অস্থিরতা ছিলো সমাজে, আমাদের টগবগে মনে-মজ্জায়ও ছিলো। এ-সবেরও বয়স হলো অনেক, ৩৭/৩৮ বছর। আমরাও তারুণ্য হারিয়ে, অস্থিরতাকে বিদায় করে অনেকটাই স্থিরচিত্ত হয়েছি। যুবক আবদুল মান্নান সৈয়দ বৃদ্ধ হয়ে এখন স্মৃতির আধারে নিমজ্জিত, শুয়ে আছেন মগ্নচৈতন্যের ডালপালায়। আবিদ আজাদ আমাদেও ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে আরও অনেক আগে। ওর তখন মরার বয়সও হয়নি। আর আমি প্রবীণের শাদা চুল আর প্রেম-প্রজ্ঞার নিশিতে শায়িতপ্রায়। আমি দাবি করি, আমরা অনেকটাই যুবকাক্রান্ত রয়ে গেছি যুগ-সময় পাল্টে যাওয়া সত্ত্বেও। মান্নান সৈয়দ প্রবীণ-বৃদ্ধ হয়েও তারুণ্যের ঔজ্জ্বল্যের আলোতে ভাসমান ছিলেন। তার মতোই তার কবিতাও। বিশেষ করে আমি তার কবিতার কথাই বলবো– ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ সেই আলোকপিণ্ড, যার রূপ সবুজ আর প্রাকৃতিক। জ্যোৎস্না তার প্রিয় শব্দ এবং এই জ্যোৎস্নার বহুরুপি ব্যবহারও আছে তার কবিতায়। ২০০১ সালে প্রকাশিত তার নির্বাচিত কবিতার আলোচনায় আমি লিখেছি– ‘টানা গদ্যে–সম্পূর্ণ নতুন ; এর আগে পাঁচ ও ছয়-এর অন্য কেউ এমন টানা গদ্যে কবিতা লিখেছেন, এমনটা আমার চোখে পড়ে না। [আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতাগুলো গদ্যের ধাঁচে হলেও মান্নান সৈয়দের কবিতার মতো বিচিত্র ও উদ্ভট চিত্র আর চিত্রকল্পে ঠাসা নয়।] জ্যোৎস্না পাঠ করলে বোঝা যায় আবদুল মান্নান সৈয়দ কেন কবিতার ব্যাকরণ ভেঙে নিজের চেতনার পাটাতন এমন অসমতল করেছিলেন।’ সেই অসমতল চিন্তার ভাঁজ থেকে এক টুকরো কবিতা তুলে নেয়া যাক–
‘ জ্যোৎস্না কী? –না, জ্যোৎস্না জল্লাদের ডিমের মতো চুলহীন জলবায়ুহীন মুণ্ডু’
এই মান্নান সৈয়দকে তার সময়ের পাঠকরা ঠিক মতো চিনতেই পারেনি। শুধু কিছু কবি, কিছু শিক্ষিত মানুষ উপলব্ধি করতে পারছিলেন এই কবি নতুন চিন্তার ঝাঁপিটা খুলে দিচ্ছেন, যার পোশাকি নাম সুররিআলিজম। বাংলায় অনেকে একে বলে অধি-বাস্তব, কেউ বা বলেন অতি-বাস্তব এবং প্রচলিত শব্দ হচ্ছে পরাবাস্তব। আজ এটা কবি-সাহিত্যিকদের কাছে সু-পরিচিত। কিন্তু ষাটের গোড়ায় বা মধ্য ষাটের এই পরাবাস্তব শব্দটি ততটা প্রচলিত ছিলো না। ষাটের দশকে যখন মান্নান সৈয়দ এ-সব কবিতা রচনা করছেন, ছাপছেন নিজেদের লিটল ম্যাগে, কণ্ঠস্বর, স্বাক্ষরসহ আরো কিছু লিটল ম্যাগে তখন প্রতিষ্ঠিতরা এ-সব কবিতা অনুমোদন দেননি। শুধু পাঁচের দশকের কয়েকজনমাত্র উপলব্ধি করতে পারছিলেন, এ-কবি নতুন বোধসত্তা নিয়ে আসছেন বা এসেছেন। তার সমকালীনদের মধ্যে অগ্রজপ্রতিম আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাকে ছায়া দিয়েছেন। তিনি এক অনন্যসাধারন রিভিউ লিখেছিলেন মান্নান সৈয়দের জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছের।
আমার চোখে পড়েনি, মান্নান সৈয়দের কবিতাগুলো কেন জন্মান্ধ, সেই প্রশ্নের কোনো বিশ্লেষণ করেছেন কেউ। আবার যারা করেছেন তাদের কেউ কেউ ধরতেই পারেননি এ-কবিতার ধারাটি কি? পরাবাস্তবতা, ইউরোপে অনেক আগেই শিল্পের চেতনায় হানা দিয়ে কবিতার খোল-নলচেতে নতুন কিছু রূপারূপ যোগ করেছে। সেই হাওয়া বাংলা কবিতায়, জীবনানন্দের কবিতায় এমন লোকজ ভঙিতে লেপ্টে গেছে যে তাতে পরাচৈনিক মালা পরাতে হয় না। এমনিতেই সেই কবিতা রুপসী বাংলার নিত্যবাস্তবতার সঙ্গে মিশে গেছে। লোকবাংলা আমাদের বাস্তবজীবনের ঘেরে এমন পলির মতো লেগে আছে যে এ-কে আলাদা করা যায় না, তার প্রয়োজনও নেই। আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতায়ও সেই রকম পরাচেতনা মিশে আছে তারই রক্তপ্রবাহের মতো।
আমি বলেছি মান্নান সৈয়দের প্রিয় শব্দ জ্যোৎস্নাকে নিয়ে নানানরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা তিনি করেছেন। কখনো তিনি ‘জ্যোৎস্না’কে রূপক হিসেবে, কখনো প্রতীক হিসেবে, কখনো উপমা হিসেবে, তুলনা হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তার শব্দ ব্যবহারের বহুমাত্রিকতাই প্রমাণ করে তার মানস সরোবর কি দিয়ে ঠাসা। যেমন কবির শব্দ ব্যবহার দেখে তার মনন-মেধা আর মানসিক প্যাটার্ন চেনা যায়। ‘জ্যোৎস্না ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে দরোজায়, সব দরোজায়,’ এ-রকম পঙক্তি পাঠককে বিস্ময়ের খাদে ফেলে দেয়। জ্যোৎস্না কি ভূতের মতো হতে পারে? ভূত কি জ্যোৎস্নার মতো? ভূত কি সব সময় কিংবা কৃষ্ণ পক্ষে মানুষের দুয়ারের সামনে দাড়িয়ে থাকে? এ-রকম আরও বহু প্রশ্নই তোলা যায়। মান্নান সৈয়দ পাঠকের বোধে ধাক্কা দিতে চেয়েছেন বিসদৃশ দৃশ্য রচনার মাধ্যমে। ভূত কি জ্যোৎস্নার মতো? ভূত আসলে কেমন তা কি আমরা জানি? না, জানি না। আবার বলতে পারি, জানি। কারণ আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি শিখিয়েছে ভূত অশরীরী এক আত্মা, যারা মানুষের ক্ষতি করে। ভূত কখনো কারো ক্ষতি করেছে এমনটা জানা অসম্ভব নয়। লোকসমাজে ভূতের উৎপাত আছে, আধুনিক জীবনেও আছে ভূতের বাড়িঘর, দালান কোঠা ইত্যাদি। নিউইয়র্ক শহরেও আছে ভূতের বাড়ি। তাহলে বাংলাদেশের মানুষ যদি ভূত বিশ্বাস করে, তাতে অবাক না হওয়াই উচিৎ। তো, সেই ভূত বাংলাদেশে কালো কিম্ভূতকিমাকার, আমাদের বিশ্বাসেও এটাই আছে। সেখানে মান্নান সৈয়দ যদি ভূতকে জ্যোৎস্নার মতো বলেন, তাতে তার রংয়ের পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করবো, কিন্তু রুপের পরিবর্তন আমরা দেখি না সেখানে। তিনিও ভূতকে কিম্ভূতকিমাতার ও রহস্যভরাই রেখেছেন। এই যে একটুখানি বাড়তি কাজ তিনি করেছেন, এটাই সুররিআলিজমের কাজ। বাস্তবকে একটু পরাবাস্তবতায় নিয়ে যাওয়া, পাল্টে দেয়া, প্রচলিত বোধসত্তাকে ভেঙে নতুন ছবি তৈরি করা, এটাই পরাবাস্তব চেতনার কাজ। শাদা চোখে মনে হবে, এ-কাজ তো সোজা বা সহজ কাজ, কিন্তু করতে গেলেই মাথাখারাপ হবার জোগাড়। মান্নান সৈয়দ সেই একটু কঠিন কাজটি করতে পেরেছেন তার প্রখর পরা- চৈতন্যের সহায়তায়। চিন্তাশীল এবং সৃজনশীল মননের এই খেলা বাস্তবতার সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ওতপ্রোতভাবে জানাশোনো থাকলেই কেবলমাত্র সে কাজ করা সম্ভব। আর এই সম্ভবের বরপুত্র ছিলেন আমাদের আবদুল মান্নান সৈয়দ।
২.
চটজলদি কোনো কিছু লেখা আবদুল মান্নান সৈয়দকে নিয়ে, কিছুটা কঠিন, অন্তত আমার তেমনটাই মনে হয়। কতো বিচিত্র বিষয়ে তিনি কাজ করছেন নিরলসভাবে। নিজের মনোভাবনার সঙ্গে মিলেমিশে তিনি প্রকল্পনা আঁকতেন। আর যেহেতু তিনি একই সঙ্গে চতুর্মুখি কাজে পারদর্শী ছিলেন, তাই প্রত্যাশারও শেষ ছিলো না তার কাছে। তিনি নাম কিনেছিলেন ‘জীবনানন্দ দাশ : শুদ্ধতম কবি’ এই বইটি লিখে। কোনো কবিকে শুদ্ধতম বলা যায় মান্নান সৈয়দের আগে কেউ ভেবেছিলেন, লিখেছিলেন, এমনটা আমার জানা নেই। জীবনানন্দের মতো লোকজ ঐতিহ্যের কবিকে এ-ভাবে চিত্রিত করার পেছনে তার মননের জোর ছিলো প্রবল। তিনি গৃহীত হয়েছিলেন পাঠকদের কাছে। এই জনপ্রিয়তা তাকে কিন্তু জীবনানন্দে আটকে রাখতে পারেনি। বরং আমরা দেখি তার গবেষণামূলক কাজগুলো মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম পর্যন্ত –এসে একটা ধাপে শেষ হয়েছে। তার দ্বিতীয় ধাপটি হয়েছে কুড়ির দশকের জসীম উদদীন এবং তার অগ্রজ-অনুজ মুসলিম কবিদের নিয়ে। তাদের পুনর্জীবন দানের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুসলিম মানসের পুনর্জাগরণের সুতোটি তিনি রেখে গেছেন। আমাদের উচিৎ আবদুল মান্নান সৈয়দ-উত্তর গবেষক প্রজন্ম যেন এই দিকনির্দেশনাটি পায় যে তাদের পায়ের নিচেকার জায়গাটি কোথায়। জসীম-উত্তর বাঙালি মুসলিম কবিদের সামগ্রিক রচনার মান তেমনভাবে উঠে আসেনি। তবে, উত্তরণের প্রথম ধাপটি লক্ষ্য করা যায় চল্লিশি ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, সিকান্দার আবু জাফরের কবিতায়। আর এদেরই উত্তরসূরী পাঁচের দশকের কবিরা। শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক, ফজল শাহাবুদ্দীন, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আবুবকর সিদ্দিক, আবু হেনা মোস্তফা কামালসহ গোটা পাঁচের দশকটিই নতুন চিন্তা আর আধুনিকতার ফুল ফুটিয়ে বাংলা কবিতাকে নতুন মাত্রায় সজ্জিত করে দিলেন। শুধু তাই নয়, এরা পশ্চিম বাংলর তিরিশি চল্লিশের এবং অবশ্যই পাঁচের দশকের কবিদের থেকে আলাদা ভাব-ভাষা, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক-প্রতীক ও লোকজ সংস্কৃতির পূর্ববাংলার গরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস ও আচার-ব্যবহারকে কবিতায় প্রধান্য দিয়ে। পশ্চিম বাংলার কবিতার চেয়ে আমাদের কবিতা সৃজনীশক্তিতে ভালো। এভাবেই বাংলা কবিতার প্রবাহ আলাদা হয়ে গেছে। আমাদের ভাষা-ভঙির সঙ্গে ওদের ভাষা-ভঙিতে পার্থক্য লক্ষ্য করলেও এটা উপলব্ধি করা যায়। আবদুল মান্নান সৈয়দ এদেরই উত্তরাধিকার বহন করেছেন, তবে সেখানে তিনি যোগ করেছেন সুররিআলিজমসহ পশ্চিমা শিল্প-মতবাদের প্রায় সব ধারাই।
সুররিআলিজমের সূচনা জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ দিয়ে আর ‘জ্যোৎস্না রৌদ্রের চিকিৎসা’ [১৯৬৯] পর্যন্ত এর রেশ ছিলো প্রবল। এর পর তিনি অনেকটাই সাধারণ ও প্রচল ধারায় প্রত্যাবর্তন করেন, ‘ও সংবেদন ও জলতরঙ্গ’ কাব্যগ্রন্থে। কিন্তু তার মানসপ্যাটার্ন তাকে সুররিআলিস্টিক ভূমি থেকে উৎপাটন করতে দেয়নি। ‘কারফ্যুশাসিত চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে আছি আমি/কিন্তু আমার আত্মা পাখি হয়ে উড়ছে/ তার পাতলা ঠোঁটে রাজদণ্ডের মতো ধরে আছে আমার স্বপ্নের এ্যানটেনা’–এ-রকম বাকচিত্র তার কবিতার ভাঁজে ভাঁজে আছে নিয়মিত বিরতিতে।
কবিতা নিয়ে তার মনোবেদনা ছিলো। কারণ তিনি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পারদর্শিতা দেখিয়ে বিপুল সম্মান অর্জন করলেও কবিতাই ছিলো তার প্রধান প্রেম। ‘দয়িতা কবিতা’ কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেছেন ‘কবিতাকে নিয়ে সামাজিক চলাফেরা হলো না আমার’। কেন তিনি এ-কথা উচ্চারণ করলেন? তিনি তো সারা জীবনই কবিতার সংসারে ছিলেন। তাহলে? তিনি বলতে চেয়েছেন কবিতার সামাজিকতা নিয়ে। তার কবিতা সামাজিক নয়। তাহলে নিশ্চয় তা অসামাজিক! আর কে না জানে অসামাজিক মানে দাঁড়ায় অবৈধ। সমাজ যা অনুমোদন করে না, তাই অবৈধ। সামাজিক কবিতা আর সুররিআলিস্টিক কবিতা, দুই দিগন্তের বাসিন্দা। সুররিআলিস্টিক কবিতা সামাজিকতার বাইরে নাক-মুখ-চোখ গলিয়ে দিতে অভ্যস্ত।
ভয়াবহ সব সামাজিক বাঘের ভেতর থেকে
ভিখারি সব দায়িত্বের হাত থেকে
কবিতাকে নিয়ে হঠাৎ পালিয়ে যাই একদিন
ছুটতে ছুটতে ওকে নিয়ে উঠি একমাত্র স্টেশন-ছাড়া চলিষ্ণু রেলগাড়িতে
নেমে পড়ি দুপুর বেলায় ঝিঁ ঝিঁ ডাকা কোন এক
অচেনা গ্রহের মতো
নাম না জানা ছোট্ট স্টেশনে।
[ দয়িতা কবিতা]
তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন তার দয়িতাকে নিয়ে, নেমেছিলেন অচেনা, নাম না জানা ছোটো রেল স্টেশনেও, কিন্তু সামাজিক জীবন এমনই যে তাতে সেই নির্জন জীবনে বাস করতে দেবে না। সামাজিক জীবনের চাহিদা তাকে আবার প্রত্যাবর্তনের লজ্জায় ফেলে দিয়ে ফিরিয়ে এনেছে। এই যে বেদনা, একান্তভাবে বাস করতে না পারার বেদনা, তা-কি কোনো সামাজিক মানুষ শোধ করতে পারবে? না, পারবে না। কারণ, সামাজিক মানুষ তার কবিতারই বর্ণনার মতো—-
এখানে কবিতা বানানো হয়।/সব ধরনের কবিতা।/রাজনীতিক কবিতা, সামাজিক কবিতা।/আধ্যাত্মিক কবিতা, পার্থিব কবিতা।/নাগরিক কবিতা, গ্রামীণ কবিতা।/ প্রেমের কবিতা, শরীরের কবিতা।/স্বপ্নের কবিতা, বাস্তবের কবিতা।/চল্লিশের কবিতা, পঞ্চাশের কবিতা।/ষাটের কবিতা, সত্তরের কবিতা।/ আশির কবিতাও আমরা বাজারে ছাড়ছি শিগগিরই’।
এই তির্যকতার মানে হচ্ছে সামাজিক কবিতার দুর্দশা। রাজনীতিকদের দুুর্বিনীত আধিপত্য, লুটেরা ও লুম্পেন চরিত্র, আর তাতে গা ভাসানো থেকে মান্নান সৈয়দ তিতিবিরক্ত হয়েই শ্লেষময় বর্ণনাত্মাক এ-কবিতাটি নির্মাণ করছেন। আমি এ-কে নির্মাণই বলবো, সৃষ্টি বলবো না। এই কবিতা ‘কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড’ নামের বইয়ে আছে। বইয়ের নামও আমাদের বলে দেয় একজন পরাবাস্তব চারিত্রের কবি কেন এই রকম একটি সামাজিক নাম রেখেছেন বইয়ের।
‘পরাবাস্তব কবিতা’ ১৯৮২ সালে বেরিয়েছে। তারপর প্রতি বছরই তার কবিতার বই বেরিয়েছে। ‘পার্কস্ট্রিটে একরাত্রি’ [১৯৮৩], ‘মাছ সিরিজ’ [১৯৮৪], ‘চতুর্দশপদী’ [১৯৮৭], আমার সনেট [১৯৮৭], সকল প্রশংসা তার [১৯৯৩], নীরবতা গভীরতা দুই বোন কথা বলে [১৯৯৭], লোরকার কবিতা [১৯৮৪], মাতাল মানচিত্র [১৯৭০], শার্শিকাঁচ [ অগ্রন্থিত, কিন্তু নির্বাচিত কবিতার বইয়ে গ্রন্থিত]। ২০০১ সালের পরও তার নতুন কবিতার বই বেরিয়েছে। আমি ওই সনে প্রকাশিত নির্বাচিত কবিতা গ্রন্থ থেকে নামগুলো তুলে দিলাম।
আমি মনে করি আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতার বিশ্লেষণ হওয়াটাই হবে তার প্রতি প্রকৃত সম্মান-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা দেখানো। আমরা চাই এই জ্যোৎস্নাক্রান্ত মানুষটির প্রকৃত সৃষ্টিশীলতা যেন পাঠকের বোধের সীমায় পৌছাতে পারে।
[রচনাকাল ২০১০]