তৌফিক জহুর
প্রাককথন : গত শতাব্দীর অস্তমিত সূর্যের শেষ দশকটা পৃথিবীর জন্য সবদিক মিলিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, মুক্তবাজার অর্থনীতি, বিজ্ঞান চর্চার ব্যাপকতা, ইন্টারনেট, মুঠোফোন, স্বাস্থ্যসেবার যুগান্তকারী ঘটনা এবং সাহিত্যের আঙিনায় বৈশাখের ঝড়ে আম পরার মতো অনেক কিছু একসাথে একযোগে ফসফরাসের আলোর বৃষ্টি হতে থাকে। পৃথিবীর এই ব্যাপক পরিবর্তনের সময় নব্বই দশকের কবিতার আকাশে যাঁরা ডানা মেলেন, তাঁদের কবিতায় পাওয়া যায় অসংখ্য বিষয়। নতুন সব দৃষ্টি নিয়ে তাঁদের কবিতা ঘুড়ির মতো উড়তে থাকে। দৃষ্টিনন্দন এসব ঘুড়ি পাঠকের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। বিষয়ের বৈচিত্র্যময় আয়োজন, নতুন উপমায় সাজুগুজু করে এসব ঘুড়ি জানান দেয় তাঁদের নিজস্বতা। নব্বই দশকের কবিতা জার্ণিতে পশ্চিমবঙ্গের যে ট্রেনটি স্টেশন ছাড়ে সেখানে অসংখ্য কবি যশপ্রার্থী ছিলেন। যাঁরা শুরুতেই তাঁদের নিজস্ব জাত চিনিয়েছেন কলমের ডগায় অক্ষরের বন্যা বইয়ে দিয়ে। সেই নব্বই দশকের ট্রেনে একজন কবি ছিলেন। যাঁর কবিতা নিয়ে আজ আমরা পাঠ পরবর্তী বয়ান করতে যাচ্ছি। তিনি তৃষ্ণা বসাক।
কবিতার আঙিনায় নানা রঙের পাখি :
নব্বই দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবি তৃষ্ণা বসাক সাহিত্য কে দেখছেন অনেক বড়ো ক্যানভাস থেকে।সাহিত্যের বিকাশ, প্রকাশ ও ভিত্তিস্তর নির্মাণের জন্য তিনি জীবন ও সৃষ্টি কে একবিন্দুতে স্থাপন করে একটা ধ্যানের মধ্যে দিয়ে লিখে চলেছেন। যেহেতু এখানে কবি তৃষ্ণা বসাক এর ” যে কোথাও ফেরেনা ” কাব্যগ্রন্থ নিয়ে কথা বলছি সমালোচকের দৃষ্টিতে, তাই এখানে আমি একাগ্র, সজাগ, দায়িত্বশীল, রুচিনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ অনুসন্ধানে মত্ত থাকতে চাই। যেকোনো সৃষ্টিই একটা খরস্রোতা নদী।যার সৌন্দর্যে চক্ষু শীতল হয়। আত্মার আরাম হয়। সেই সৃষ্টি কে যথোপযুক্তভাবে আবিষ্কার করাই হলো সমালোচনা সাহিত্যের একমাত্র কাজ। কথাগুলো এজন্যই লিখলাম কারণ, প্রকৃতি, সমাজ, রাষ্ট্র, ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রেম, সংস্কৃতি, যাপিতজীবন এবং ছন্দ যা কবিতার শরীরে হিরে মানিক জহরত এর মতো সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে- এতোসব বিষয় নিয়ে এই কাব্যগ্রন্থের আগমন। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পৃষ্ঠা ওল্টাতে হচ্ছে। কারণ, নব্বই দশকের কবি তৃষ্ণা বসাক এই কাব্য গ্রন্থে ত্রিশ বছরের লিখে যাওয়া কবিতার ডালি সাজিয়েছেন। যা বিস্মিত করেছে।কারণ কবিতাগুলো বাঁকে বাঁকে বাঁক বদল করেছে নিজের অবয়ব ও চিন্তা। তিনি আত্মসর্বস্ব ও স্মৃতিচারী হয়েছেন, অবচেতনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এসবের মধ্যে যখন কবিতা সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে কাহিনির সূত্র, চিন্তার পারম্পর্য ও ব্যাকরণের চমৎকার শৃঙ্খলা মেনে চেতন- মনের সৃষ্টি ক্ষমতাই প্রকাশ করেছেন। তাঁর এই গ্রন্থের কবিতাগুলো পাঠ করতে যেয়ে বারবার মনে হয়েছে তিনি বাস্তব জগতের বিষয়কেই নিজের সত্তার সঙ্গে মিলিয়ে কবিতার পংক্তি সৃষ্টি করেছেন। বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিশুদ্ধ স্মৃতি নিয়ে মানুষ বসবাস করতে পারেনা। যতই ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করে অন্তর্জগতের মধ্যে বিলীন হবার চেষ্টা করা যাক না কেনো,আমাদের অজ্ঞাতেই প্রতিদিনের জাগ্রত জীবন স্মৃতির কাঠামো বদলে দেয়। নতুন অভিজ্ঞতা ও অতীত স্মৃতি প্রতিদিন কবিকে জীবন্ত ও সমৃদ্ধ করে তোলে। আমরা তৃষ্ণা বসাকের কয়েকটি কবিতার মধ্যে এর সত্যতা খুঁজি।
১.
হলুদ না গোলাপি
রঙটাই ঠিকঠাক মনে পড়ছে না
ষাটখানা জানলা-দরজা
শেষ গিয়েছিলাম ১৬ মার্চ,
আর একদিন ২০ মে সন্ধ্যেবেলা উঠোন পর্যন্ত
যেখানে মাকে শোয়ানো হয়েছিল
সেই শরীর মাড়িয়ে ভেতরে যাওয়া হয়নি,
ওখানেই আমার প্রবেশ থেমে আছে
থেমে আছে দেওয়ালে পেনসিলের আঁকিঝুঁকি,
( যে কোথাও ফেরেনা : যে কোথাও ফেরেনা, পৃষ্ঠা -৭৬)
২.
বুকের মেঝেতে কারা যেন পেরেক পুঁতেছে,
রাস্তায় ছড়িয়ে গেছে অসংখ্য শোকমগ্ন খই,
দিয়েছে হরিধ্বনি,
তবুও কি আত্মা ফিরে যায়?
তোমার শরীর ছাড়িয়ে আত্মা আরো বড়ো হয়ে ওঠে
আরো বেশি দাবী করে
বলে ‘ শুধু পিন্ড নয়,হৃদয়ের রক্তপিন্ড দাও’
বলে’শুধু অশ্রু কেন,অনুতপ্ত প্রেম এনে দাও,
কেন শুধু গীতা কেন?
শব্দ আনো,তোমাদের নিজস্ব শব্দ,
পৃথিবীর বুকের জিনিস!
জন্মদিন থেমে যায়,মৃত্যুদিন বড় হয়ে ওঠে,
লেখো লেখো,আমি প্রতিদিন বেঁচে উঠি,
বেড়ে চলি,
ক্ষিতি-অপ-তেজ-ব্যেম- মরুত শরীর থেকে ধূলো ঝেড়ে
আবার নতুন ভ্রূণে যাই,
মাতৃগর্ভে খেলা করি….’
(যে কোথাও ফেরেনা : পিতৃতর্পণ, পৃষ্ঠা -১১,১২)
৩.
সীমান্তে দুপুর হলো,সাঁজোয়া বাহিনী
গরুর লেজের নিচে হাতড়ায় সোনার বিস্কুট
আর এরা সাতবোন, চুলের চুল্লিতে
গুঁজে রাখে মনস্তাপ, চিরুনির মতো
ফুলনদী আজ যদি ঠাকুরপুকুরে
তার চুল উঠে গেছে, চিরুনির দাঁড়া
অশ্রুমতি ঘিলু বেয়ে নেমেছে গলায়
এদেশে গরাস আর ভিনদেশে থালা!
ভাতছড়া, গড়িয়ার, ময়মনসিংহের
ঢাকা নবাবপুর থেকে টালা চন্দ্রনাথ
নোনা ইলিশের স্বাদ জিভে পুঁতে রেখে
কিউসেক গীতিকা শেখে নদীভগিনীরা..
(যে কোথাও ফেরেনাঃ কিউসেক গীতিকা, পৃষ্ঠা-৯৭)
চিত্রকল্পের বাগানে বসে আছে প্রজাপতি :
চিত্রকল্প,রূপকল্প এবং উপমা আমরা প্রতিদিনের কথাবার্তায় প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করি। কয়েক হাজার বছর ধরে এ সমাজে উপমা ব্যবহার হয়ে আসছে। সেজন্যই উপমা কখনোই অস্বাভাবিক ও দৃষ্টিকটু বলে মনে হয় না। সেজন্যই উপমা কবিতার সবচেয়ে স্বাভাবিক অলংকার। হাজার হাজার বছর ধরে ক্রমাগতই উপমা ব্যবহৃত হয়েছে, হচ্ছে, হবে।ফলে উপমা কবিদের অত্যন্ত নিকটতম বন্ধু। তৃষ্ণা বসাক চিত্রকল্পের বাগানে উপমা এমনভাবে সাজিয়েছেন যা আমাদের চমকে দেয়। বিচিত্র বিষয়ের বৈচিত্র্যময় আয়োজনে তিনি সময়ের কাছে ভূগোল, ইতিহাস, বিজ্ঞান এর মধ্যে দিয়ে নিরন্তর একটা সময়কে উপস্থাপন করে চলেছেন। যে সময়ে প্রেম আছে, যন্ত্রণা আছে। এসবের মধ্যে তাঁর শিল্পপ্রেরণা, জীবনচেতনা দুটোকেই এমনভাবে ক্যানভাসে এঁকেছেন যা তাঁর সময়ে মহৎকর্ম হিসেবে ধরে নেয়া যায়। তাঁর নিজস্ব প্যাটার্নের মধ্যে একটা জগৎ তৈরি করতে পেরেছেন। তাঁর চিত্রকল্পের আঙিনায় পা দিলে বোঝা যায়, এ শব্দের বাগানের স্রষ্টা কে? নব্বই দশকে বাংলাদেশ ও ভারতে অল্প কয়েকজন কবি স্বতন্ত্র পথ নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তৃষ্ণা বসাক তাঁদের একজন।
জীবনানন্দ দাশ, ” কবিতার কথা” প্রবন্ধে লিখেছেন, ” কবিতা জীবনের নানারকম সমস্যার উদঘাটন ;কিন্তু উদঘাটন দার্শনিকের মতো নয়; যা উদঘাটিত হল তা যে কোনো জঠরের থেকেই হোক আসবে সৌন্দর্য রূপে, আমার কল্পনাকে তৃপ্তি দেবে;যদি তা না দেয় তা হলে উদঘাটিত সিদ্ধান্ত হয়তো পুরনো চিন্তার নতুন আবৃত্তি, কিংবা হয়তো নতুন কোনো চিন্তাও( যা হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে), কিন্তু তবুও তা কবিতা হলোনা,হল কেবলমাত্র মনোবীজরাশি।কিন্তু সেই উদঘাটন – পুরনোর ভিতরে সেই নতুন কিংবা সেই সজীব নতুন যদি আমার কল্পনাকে তৃপ্ত করতে পারে, আমার সৌন্দর্যবোধকে আনন্দ দিতে পারে, তাহলে তার কবিতাগত মূল্য পাওয়া গেল; আরো নানারকম মূল্য -যে সবের কথা আগে আমি বলেছি,তার থাকতে পারে, আমার জীবনের ভিতর তা আরও খানিকটা জ্ঞানবীজের মতো ছড়াতে পারে,আমার অনুভূতির পরিধি বাড়িয়ে দিতে পারে, আমার দৃষ্টি স্থূলতাকে উঁচু মঠের মতো যেন একটা মৌন সূক্ষ্মশীর্ষ আমোদের আস্বাদ দিতে পারে ; এবং কল্পনার আভায় আলোকিত হয়ে এসমস্ত জিনিস যত বিশাল ও গভীরভাবে সে নিয়ে আসবে কবিতার প্রাচীন প্রদীপ- ততই নক্ষত্রের নূতনতম কক্ষ পরিবর্তনের স্বীকৃতি ও আবেগের মতো জ্বলতে থাকবে ( পৃষ্ঠা -১৫)।”
তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা আমাদের কল্পনার আভায় ঝাঁকুনি দেয়। আমাদের চিন্তার এন্টেনায় দ্যুতি ছড়ায়। আমাদের ভাবতে বাধ্য করে তাঁর কবিতার সৌন্দর্য জগতের ঠাসবুননি। তৃষ্ণা বসাক কবিতায় চিত্রকল্প আঁকতে যেয়ে এমনভাবে শব্দের আদর প্রয়োগ করেছেন যা পাঠে আমাদের আত্মা আরাম বোধ করে। দুটি কবিতা লক্ষ্য করি:
” ভোর এসে কাজের মাসীর মতো
অধৈর্য হাতে ডোরবেল টিপে যেতেই
গোলাপজামের রেণু চোখেমুখে ঢুকে যায়
আর আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে আসে ভোর
নিজেই চা করে লোড়ো বিস্কুট ডুবিয়ে ডুবিয়ে খায়,
বারান্দায় জমা গতরাতের দুঃস্বপ্ন ঝাঁট দিয়ে বাইরে ফেলে
গ্রিলের প্রতিটি জটিল নকশা রোদ দিয়ে ধুয়ে দ্যায়
তারপর আরও দশ বিশ সহস্র বাড়ি সারবে বলে
চটি ফটফটিয়ে বেরিয়ে পড়ে! “
(যে কোথাও ফেরেনা : ভোর, পৃষ্ঠা -২৫)
” রক্ত চাঁদের মতো সকাল
ধীরে ধীরে নদীর পাড় বেয়ে উঠে আসে,
নদীতে পা ডুবিয়ে যে রমণীরা
তাদের গতরাতের
ব্যর্থতা,সাফল্যের গল্প বলছিল,
তারা ক্ষণিকের জন্য বাক্যহারা!
তাদের গলায় রক্তবীজের মালা,সৃতনে নখরক্ষত
একটি হারানো নূপুরের জন্য
তারা সারা পৃথিবী তোলপাড় করতে পারে!
কিন্তু এমন সকাল তারা কখনও দেখেনি,
চেরিফুলের ফাঁক দিয়ে
রক্ত চাঁদের মতো সকাল
রাঢ়ভূমিতে এই প্রথম। “
(যে কোথাও ফেরেনা : রক্ত চাঁদের মতো সকাল ও রাঢ়ভূমিী রমণীরা, পৃষ্ঠা -৯৪)
কবিতার পাঠক চিরকালই স্বল্প। সাম্প্রতিক কবিতায় ধোঁয়াটে, দুর্বোধ্য কলাকৌশল, অর্থহীন বাক্যবিন্যাসের দ্বারা কবিতার শরীরে যে মেঘলা আকাশ সৃষ্টি করা হচ্ছে, তা অশনি সংকেত। অল্প পাঠকের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও গুরুত্বপূর্ণ শাখায় যদি হালফিল অবস্থা এমন করুণ হয়,তাহলে ভবিষ্যতে বাংলা কবিতার জায়গা কোথায় যাবে, তা আন্দাজ করলে গা শিউরে ওঠে। কবি তৃষ্ণা বসাকের কবিতার আকাশ মেঘযুক্ত নয়।ঝরঝরে সুনীল রৌদ্রময় আকাশ। যা পাঠে পাঠকের আত্মা আরাম পায়। কবির হৃদয়ের ঝড়কে তিনি উপমার নান্দনিকতায় সৃষ্টি করেছেন কবিতায়। জগতের অনেক বিষয় তিনি তাঁর কবিতার শরীরে গেঁথেছেন। ফলে রূপের মাঝে অপরূপের সম্মোহন ঘটেছে। প্রকৃতির মাঝে তৃষ্ণা খুঁজে ফেরেন বিচিত্র আলপনা। যা তাঁর উপমা, চিত্রকল্প, রূপকের মধ্যে দিয়ে বাক্যের সুললিত ধ্বনিতে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আনন্দ ছড়ায়।
তৃষ্ণা‘র কবিতার রঙধনু :
” যে কোথাও ফেরেনা ” কাব্যগ্রন্থ নিয়ে কথা বলছি। আমরা তৃষ্ণার কবিতায় শব্দ চয়ন ও বাক্য বিন্যাসে সমাজমনস্কতা, বিজ্ঞান চেতনা, বিশ্বাসের জায়গা, ধর্মীয় মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা নিয়ে কথা বলে এ লেখার পরিসমাপ্তি টানবো। তৃষ্ণা বসাকের কবিতায় বাস্তব রস ও অন্তরের নিগূঢ় রসের সমন্বয় আমাদের বিস্মিত করে। অন্তরের তাগিদে শিল্প সৃষ্টির প্রয়াসে তৃষ্ণা বসাক অনিবার্যভাবে মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহসে বলিয়ান। গত শতাব্দীর অস্তমিত সূর্যের শেষ রশ্মির নাম নব্বই দশক। শতাব্দীর শেষ দেশীয় আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন, যা তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে। যেখানে সংশয়, সন্দেহ, জীবনের পদে পদে জিজ্ঞাসা রয়েছে। যুক্তি, গণতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ, মুক্তবাজার অর্থনীতির স্বপ্নস্বর্গের সিঁড়ি নির্মাণ শুরু। সেই সময়ের কবিদের মানসিক বিকাশটা হয়েছে সম্পূর্ণ মননধর্মী। সমসাময়িক বন্ধুদের আত্মবিরোধ, অনিকেত মনোভাব ডিঙিয়ে তিনি সৃষ্টির মাঝেই আকন্ঠ ডুবে ছিলেন। তিনি তাঁর এ কাব্য গ্রন্থের চল্লিশ পৃষ্ঠায় ” এ পৃথিবী, জেনে রেখো,শুধু পথিকের”…. কবিতায় যখন বলছেন, ” পথও সরল নয়,আঁকাবাঁকা এবং বন্ধুর/ স্থানে স্থানে পথরেখা মুছে গেছে, অথচ যেতে হবে বহুদূর,/ বাঁকে বাঁকে পথবন্ধু,জলছত্র, সবুজ সুপেয়/ পেছনের রাস্তাগুলো যতটা সম্ভব ভুলে যেও”… নিষ্ঠুর এবং যান্ত্রিক নগর সভ্যতার বাইরে বিচাল এক ব্যাপ্তির জন্য কবি আকুল।তাঁর জীবনের নোঙর এত শক্ত যে তাঁর দিগন্ত পিপাসা মিটছে না।সম্ভবনার নোঙর কোথায় সে সম্বন্ধে তিনি জানেননা, শুধু এগোতে চান। বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে। আধুনিক কাব্যের প্রধান লক্ষ্যণ বাকরীতি ও কাব্যরীতির মিলন, সেটি তৃষ্ণা বসাকের কবিতায় দেখা যায় মাঝে মাঝে, তবে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থেকে সচেতনভাবে বাহুল্য বর্জন করে বাক্যগঠনে মিতব্যয়ী তিনি স্বদেশ, মৃত্তিকায় কাব্যের বিস্তার ঘটিয়েছেন। একদিকে তিনি আন্তর্জাতিক আঙিনার গোলাপের সৌরভ গ্রহণ করেও প্রয়োগ করেছেন স্বদেশের গোলাপ অন্যদিকে মানবিক বিষয়ে মানবাত্মার জন্য বেদনা, জীবনের কুৎসিত, নিষ্ঠুর,দুঃখ দৈন্যময় রূপ সম্বন্ধে মানুষকে জাগানোর জন্য তাঁর কবিতায় চিত্র এঁকেছেন। তৃষ্ণা বসাকের অন্তরে ভাবাবেগ যথেষ্ট প্রখর, কিন্তু বাক্য গঠনে বাগবাহুল্য নেই, সেখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত বাষ্পোচ্ছাস। এজন্যই তাঁর কবিতা নজরকাড়ে। যেহেতু কবিতার প্রথম পাঠই হলো আসল পাঠ,তার পরে এমন এক বিশ্বাসে আমরা নিজেদের আচ্ছন্ন করে ফেলি,আমরা মনে করি আমাদের অনুভূতি, উপলব্ধির বারবার আগমন ঘটছে। কবিতা হলো প্রতিবার এক নতুন অভিজ্ঞতা। একটি কবিতা প্রতিবার পড়ার সময় এই অভিজ্ঞতা হয়। তৃষ্ণা বসাক নব্বই দশকের কবি। এ সময়ের কবিদের শুরুর কবিতাগুলোয় অনেকের মাঝে জীবনানন্দ দাশের প্রবল ছায়া লক্ষ্য করা যায়। একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে এ সময়ের কবিদের পথচলা। কিন্তু তৃষ্ণা বসাক এ পথে হেঁটে যাননি। আশ্চর্য হয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো প্রভাব মেলেনি। বরং নতুন চিন্তার ছাতা মেলে দিয়েছেন কবিতায়। কোনো কোনো কবি তপস্যা করেন একটি উৎকৃষ্ট কবিতা সৃষ্টির জন্য। যে কবিতাকে আমরা সিগনেচার পোয়েট্রি বলি।তৃষ্ণা বসাক বেশ কয়েকটি সিগনেচার পোয়েট্রি সৃষ্টি করেছেন। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। কবিতার শিরোনাম, “যদি”। ” যদি আমার বেড়ালের নাম মজন্তালি হয়,/ কিংবা আমার কুকুর পুষতে ভালো লাগে,/অথবা ধরুন আমার কোনো পোষ্যই নেই /যদি আমার নাকটা ঠিক আপনার মতো না হয়/যদি আমার স্তন থাকে কিংবা না থাকে/ আর আমি একজোড়া সুডৌল স্তন নির্মাণের স্বপ্ন দেখি,/যদি আমি এমন একটা ভাষায় কথা বলি যা আপনি জানেননা,/ কিংবা আমার কোনো ভাষাই না থাকে,তো?/যদি আমাদের পাড়ার সব বাড়ি রামধনু রঙের হয়,/ যদি আমরা মাঝে মাঝে প্রথম পাতে তেতো না খেয়ে শেষ পাতে খাই,/ যদি আমার বোন কাঁথা না বুনে দিনরাত আঁক কষে/আর আমার মা ছাদে উঠে হঠাৎ হঠাৎ / ঝুলঝাড়ু দিয়ে দু চারটে তারা পেড়ে আনে/ আমরা খেলব বলে/ যদি আমার কোনো বাপ মা নাই থাকে / ল্যাবপ্রসূত আমাকে যদি একটা সন্কেত দেয়া হয়/ আর যদি সেই নম্বরটা আপনার মামাশ্বশুরের পছন্দ না হয় / যদি/ যদি/ যদি/ যদি/ যদি… ( যদি, পৃষ্ঠা -১৪৮)।
এখানে কবিতা নিজেই নিজেকে নির্মাণ করেছে। যেহেতু কবিতা হলো শৈল্পিক বুননে একত্রিত শব্দগুচ্ছের মধ্যে দিয়ে সুন্দরের প্রকাশ। কবিতাকে আমরা এভাবেই চিনি।কবিতাকে আমরা সংজ্ঞায়িত করতে পারিনা সঠিকভাবে। যেমন আমরা সংজ্ঞায়িত করতে পারিনা কফির স্বাদ, চুম্বনের স্বাদ কিংবা ক্রোধ, ভালোবাসা, ঘৃণার অর্থ, সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের অর্থ। আবার দেশের প্রতি ভালোবাসার কোনো মাপযন্ত্র নেই । এই জিনিসগুলো এতই গভীর যে সেগুলোকে কেবল সাধারণ প্রতীকের দ্বারাই প্রকাশ করা যায়। আমরা কেবল, কবিতা পাঠ করে খুঁজে পাই কবিতার স্পর্শকে, কাব্যের সেই বিশেষ অনুরণনকে অনুভব করি। যে কবি যত বেশি স্বতন্ত্র ও অভিনব তিনি তত বেশি নিঃসঙ্গ। আর নিঃসঙ্গতায় ধ্যানে মশগুল হওয়া যায়। সৃষ্টির অভিনবত্বের খোঁজ মেলে। তৃষ্ণা বসাক কবিতায় নিজের স্বর প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন।