এলিয়েন
কারাগার থেকে বেরুতে বেরুতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো
সূর্য়ের ত্বর সইছিলো না,
সে বাতাসে ভাসতে ভাসতে আকাশ পেরিয়ে
পাঁচশ মিলিয়ন দূরে ডুবে গেলো।
ঝিঁঝির চিৎকারে ছায়াচ্ছন্ন সময়, চারপাশ। স্টেশন পেরিয়ে
আমাকে দুশ্চিন্তার গুহায় ছুঁড়ে মেরে গেছে ডিটেনশন সেন্টারের গাড়ি,
লোমালিন্ডা টানতে থাকে তার মরুময় প্রাকারের ঘেরাটোপে
সে আমার সময় আর অচেনা প্রকৃতি বিশ্বাসের কুহকে সেঁধিয়ে যায়।
আমার সঙ্গীরাও কারামুক্ত কয়েদি।
তাদের ভেতরে জন্ম নিতে থাকে আনন্দের গাছপালা!
এবং
ফ্যাসিবাদ মানুষকে কয়েদির পোশাক পরাতে ভালোবাসে এবং
তাদের জীবন ইতিহাসে ঘূর্ণির বলয়ে চক্কর খাচ্ছে,
আর সেই চক্রের ডানার পরতে পরতে
নোট লেখে—- এলিয়েন, এলিয়েন।
আমি মানুষ নই, ওই খাদকের চোখের মণিতে শুয়ে থাকা প্রাণী এক
আমি মানুষ নই, সাম্রাজ্যবাদি দখলদার লুটেরার চোখে,
তাদের মনে ও প্রাণে মানুষ নামটি নেই,
ফ্যাসিস্ট নগরে বয়ে চলা অগণন চিন্তার কথ্যবুলি— এলিয়েন,
তাদের চেতনায় আমি মানুষ নই।
সেখানকার ক্যাকটাস-ঠাসা বাগানগুলোও চেনে আমাদের—
আমরা এলিয়েন।
ট্রেনের গন্ধও পাই না । আমি নাক টেনে শ্বাস নিই।
সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বুঝি
পৃথিবী কতোই না সবুজ আর ঘ্রাণময় সুন্দর।
ফুলের গোলাপি শোভার মতোই লাস্যময় যেন মহানগরগুলো
আর নিউ ইয়র্ক তো তর্কে বোনা ভাপা-পিঠা,
হারিয়ে যাওয়া পরীদের জঙ্গল এখন সন্ত্রাসী আর বাণিজ্যের অধিপতিদের লোভের শেকড়ে ঠাসা!
এলিয়েনের লোভও সেখানে বিভ্রান্ত।
আমাদের বাংলা গাঁয়ের মানুষ
ঠাটারিওয়ালার ক্ষুধার কাছে সে নগর পর-নারীর মতোই লোভাতুর,
তার কাছে
বারো শিক কোনো কারাগার নয়, তার কাছে পেটের দায়ই বড়,
আমি প্রতিদিন একটি স্বপ্নিল প্রেমের বাহুতে কাৎ হয়ে শুয়ে থাকা প্রেমিক এলিয়েন,
কেন না সে আমাকে চেনে না, বোঝে না। সে তো অন্ধ প্রেমিক এক
ইতিহাসের নরক থেকে বেরিয়ে আসা পৃথিবীর নব্য ইতিহাস,
সে তো ফ্যাসিস্ট এক, তার কোনো হৃদয় নেই।
আমার সঙ্গীরা, উদগ্রীব ট্রেনের কামরার জন্য,
বাতাসও ঘন হয়ে আসছে— আমি দেখতে পাচ্ছি।
একটি অফুরন্ত ধ্বনির বেগে ক্যাব
তার রতিক্লান্ত চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে।
আমি তাকে তিনশ ডলার হাঁকলাম।
সে এখনি উড়াল দেবে লস এঞ্জেলেসের অরণ্যময় চৌহদ্দির দিকে।
সন্ধ্যার মদালস লালিম জড়ানো স্বর শুনলাম—আমি শিখ।
আমি দেখতে পেলাম তার কচি তৈলাক্ত মুখে মৃদু হাসির বিদ্যুৎ।
তার মাথায় শিখদের টোপর।
কেন না, সে তার ভাড়ার চেয়েও বেশি হেঁকেছে এবং আমরা জেলফেরৎ যাত্রী আলোর জগতে ঢুকতে যাচ্ছি।
আমি তার সেলুলার থেকে কল করলাম আমার বন্ধুকে— আসছি?
মানুষকে অপরিচিত বিবেচনা করাই তার রাজনৈতিক সামাজিকতা, তার অহং, তার পচনশীলতার নমুনা, তার অমানবিকতা ও মানুষকে এলিয়েন হিসেবে রং মেরে, ছবি তুলে নিয়ে আসে ডিটেনশন সেন্টারে। তারপর তার সব পোশাক খুলে নিয়ে নেংটো করে ফ্যালে সভ্যতা, নতুন কয়েদির পোশাক পরানো হয়। তিনটি হাফ প্যান্ট, তিনটি হাফহাতা টি-শার্ট, তিন জোড়া মোজা ও সুন্দর, হালকা কাপড়ে তৈরি খয়াটে রংয়ের এক জোড়া জুতা।
মানুষের মতো দেখতে কিন্তু মানুষ নয়,—এলিয়েন।
২.
আমার চোখ বুজে যাচ্ছিলো আলোর বন্যায়।
সবুজের ভেতর দিয়ে ফ্রি-ওয়ের প্রতিবেশিগণ সোৎসাহে উঁকিঝুকি মেরে আমাদের দেখছিলো।
এরা কারা চেনা ও জানার আকাঙ্খা তাদের।
আমি হাত নেড়ে রাজনৈতিক নেতাদের ঢঙে বললাম এলিয়েন।
তারা বিস্মিত হলো।
আমাদের মানব দেহ তাদের চোখে এলিয়েন ছিলো না। কিন্তু রাষ্ট্রের চোখে আমরা দূরবর্তী কোনো তারা জগতের প্রাণী। তাই এলিয়েন। তাদের সমাজের না হলেই তারা এলিয়েন। এবং লোমালিন্ডার ডিটেনশন সেন্টারে একজনও শাদা চামড়ার মার্কিনি দেখিনি আমি। কেউ মেক্সিক্যান, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো থেকে যারা এসেছিলো তারা লাল-শাদা মেশোনো গায়ের রঙের মানুষ হলেও মার্কিনি চোখে এলিয়েন। এশিয়ানদের পীত ও কালো যাকে আমরা বলি শ্যামবর্ণা, তারা তো পুরোপুরিই এলিয়েন।
আমরা যখন লস এঞ্জেলেসের একটি গ্যাস স্টেশনে নামলাম,বর্ণাঢ্য আলো নাচতে নাচতে বলতে থাকলো এলিয়েন এলিয়েন। আর স্টেশনের মিহিকানোরা ভাবলো আমরা মানুষ।
কি যে রোমাঞ্চকর বোধ আমার আত্মায় সঙ্গীতের মূর্ছনা তুললো। সেই সঙ্গীতের ওপরে দাঁড়িয়েছিলো কয়েকটি তরুণ, সন্ধ্যার রহস্য আর স্বপ্নের বাগান রচনার জন্য তাদের আঙুলে ছিলো আগুনের মতো রঙের তুলি।
মানো কিংবা না মানো তারাও ছিলো এলিয়েন থেকে বেঁচে যাওয়া উত্তরিত মানুষ।
তারা আমাদের সাদরে বরণ না করলেও কিছুটা সহজ মনে সেবা দিতে তৈরি হলো।
আমার কারা-ফেরা বন্ধুরা বিদায় নিয়ে চলে গেলে সন্ধ্যা নগ্ন নারীর মতো একা হয়ে গেলো।
সেই নারীর চোখে এ-মহানগর ছিলো অনেকটাই চেনা।
কেবল আমি এক দুঃসাহসী পৌঢ় এশিয়ান ভাষার গৌরব নিয়ে একা একা দাঁড়িয়ে রইলাম যুবতীর শরীরসৌষ্ঠবে ভরা রাতের দুনিয়ায়।
১০/০৪/২৩