ম তি ন রা য় হা ন
ড. ইসরাইল খান। এক নিবেদিতপ্রাণ গবেষক। গত পড়শু সন্ধ্যায় হঠাৎ ফোন করে কুশলাদি বিনিময়ের পর বললেন, ‘সেভেনে পড়া একটি কবিতার কয়েকটি লাইন শুনুন।’ তিনি লাইনগুলো পাঠ করে শোনালেন। তারপর বললেন, ‘বর্তমান করোনাকালে এই লাইনগুলো হতে পারে আমাদের জন্যে সান্ত্বনা কিংবা আশাবাদের উপলক্ষ্য। যদি সম্ভব হয়, তাহলে আমার রেফারেন্স দিয়ে ফেসবুকে এই লাইনগুলো উদ্ধৃত করে একটি স্ট্যাটাস দিন। আমি ফেসবুকে বাংলা কম্পোজ করতে পারি না।’
আমি বললাম, ‘কার কবিতার অংশ এগুলো?’
তিনি বললেন, ‘সম্ভবত শেখ ফজলল করিমের।’
আমি বললাম, ‘সম্ভবত বললে হবে না! সঠিকভাবে জেনে তবেই স্ট্যাটাস দিতে হবে। তা না হলে পাঠকের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হবে। আর এতে আমাদের দুজনকেই নিন্দামন্দ শুনতে হবে!’
তারপর তিনি বললেন, ‘আচ্ছা খুঁজে দেখি কার কবিতার লাইন।’
আমি বললাম, ‘আমিও চেষ্টা করে দেখি খুঁজে বের করতে পারি কি না।’
তারপর ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে একটি লাইন লিখে গুগলে সার্চ দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে একটি সূত্র বের হয়ে এলো। তারপর আবার সার্চ দিলাম। এভাবে দু’তিনবার সার্চ দিয়ে পেয়ে গেলাম কবিতাটি। মজার ব্যাপার হলো, কবিতাটির স্ক্যান করা পৃষ্ঠাটিও পেয়ে গেলাম। তারপর পুরো কবিতাটি লিখে নিলাম খাতায়। স্ক্যান করা পৃষ্ঠার নিচের দিকে ছোটো করে লেখা ‘শিলার’ আর কবিতার শিরোনামের উপরে লেখা ‘তীর্থরেণু’। তারপর ‘তীর্থরেণু’ লিখে সার্চ দিয়ে পেয়ে গেলাম সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের নাম। কিন্তু কবিতাটির ছন্দের সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথের কবিতার মেজাজ মেলে না। কবিতাটির নিচে ছোট্ট করে ‘শিলার’ লেখা কেন, সেটাও ধরতে পারছি না।
সঙ্গে সঙ্গে ইসরাইল ভাইকে ফোন দিলাম। বললাম, ‘পুরো কবিতাটি খুঁজে পেয়েছি। তবে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হচ্ছে ‘সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত’, ‘তীর্থরেণু’ ও ‘শিলার’। এই তিনটির রহস্য উদ্ধার করা গেলে হয়তো আমাদের কৌতূহলের সমাধান মিলবে।
ইসরাইল ভাই বললেন, ‘আমাকে একটু সময় দেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রচনাবলি আমার সংগ্রহে আছে। দেখি কোনো সূত্র পাই কি না।’
আবারও ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলো।
প্রায় পনেরো মিনিট পর ইসরাইল ভাইয়ের ফোন।
বললেন, ‘তীর্থরেণু কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ। অনুবাদ হিসেবে দ্বিতীয় সংকলন। কবি তাঁর জীবিতকালে (১৮৮২-১৯২২) তীর্থরেণুর প্রথম সংস্করণ (১৯১০) দেখে যেতে পেরেছিলেন। এই গ্রন্থের কিছু কবিতা ভারতী ও প্রবাসীতে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘
তারপর তিনি বললেন, ‘শিলার সম্ভবত মূল কবি। ইংরেজি ভাষার কবি হতে পারেন।’
আমি বললাম, ‘এবার আমাকে সময় দিন। চেষ্টা করে দেখি ‘শিলার’ কে এবং কোন্ ভাষার কবি উদ্ধার করতে পারি কি না।’
আবারও টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলো।
অতঃপর গুগলের শরণ নিলাম। Shiler লিখে সার্চ দিতেই মোবাইলের স্ত্রিনে ভেসে উঠলো বেশ কিছু সাজেশন। তারপর Schiller লিখে সার্চ দিতেই রহস্যের খানিকটা কিনারা পেলাম, এমনটাই মনে হলো। তারপর ইমেজে সার্চ দিলাম। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো এক নায়কোচিত পুরুষের ছবি। ছবির নিচে লেখা Johann Cristoph Friedrich Von Schiller।
ডেসক্রিপশনে গিয়ে দেখি তিনি জার্মানির কবি। আরও লেখা Philosopher, Physician, Historian and Playwright। তাঁর জন্ম ১৭৫৯ সালের ১০ই নভেম্বর জার্মানির Marbach am Neckar-এ। আর মৃত্যু ১৮০৫ সালের ৯ই মে জার্মানির Weimar-এ।
যেহেতু জার্মান নাম সেহেতু নামটির সঠিক উচ্চারণ লেখা সম্ভব হবে কি না জানি না; তবে বাংলা উচ্চারণে এরকম লেখা যেতে পারে : জন ক্রিস্তফ ফ্রেডরিখ ভন শিলার। তবে Friedrich Schiller নামেই সমধিক পরিচিত। এরকমই দেখা গেল নেটে।
তারপর এই কবি সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য পড়লাম নেটে। তিনি নন্দনতত্ত্ববিদও। বোঝা গেল, কবিতাটি ফ্রেডরিখ শিলারের। যেহেতু ‘তীর্থরেণু’ অনুবাদ কাব্য এবং কবিতাটি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনূদিত; তাই সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের নিজের কবিতার মেজাজের সঙ্গে না মেলাই স্বাভাবিক।
রীতিমতো রহস্য উদ্ধারের উচ্ছ্বাসে আমি আপ্লুত। ইসরাইল ভাইকে ফোন দিয়ে সব জানাবো যখন ভাবছি, ঠিক এমন সময় তাঁরই ফোন। কবিতাটির উৎস সন্ধানের জার্নিটা সবিস্তারে তাঁকে জানালাম। তিনিও অভিভূত, উচ্ছ্বসিত। বললেন, ‘আমি জানতাম, আপনি এর রহস্য উদ্ধার করে ছাড়বেন। কারণ দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন। সাংবাদিকরাও গবেষক। সামান্য সূত্র থেকে বিরাট রহস্য উদ্ধারে তাঁদের তুলনা নেই! আমি এ কারণেই আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। এখন কবিতাটি নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দিন। আর সম্ভব হলে শিলারের কিছু কবিতা অনুবাদ করে একটি বই করুন।’
আমি বললাম, ‘এটা আমার দ্বারা সম্ভব হবে না। কারণ আমি জার্মান ভাষাও জানি না, জানি না ভালো ইংরেজিও।’
তিনি বললেন, ‘এ ব্যাপারে আপনাকে আমি সাহায্য করবো। দরকার হলে গ্যেটে ইনস্টিটিউটে নিয়ে যাবো। জার্মান ভাষা শিখবেন। ‘
আরও নানা কথা বললেন। আমি বললাম, ‘যদি শিলারের কবিতা আমার পক্ষে অনুবাদ করা সম্ভব হয়, তাহলে বইটি আপনাকেই উৎসর্গ করবো।’
তারপর এক ধরনের পরিতৃপ্তি নিয়ে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলো।
প্রিয় পাঠক, এতক্ষণ যে কবিতাটিকে ঘিরে এত কথা হলো, এবার সেটি পড়ে নিতে পারেন। বলতে দ্বিধা নেই, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনার মৃত্যুথাবা অস্থির করে তুলেছে পুরো মানবসম্প্রদায়কে। এই দুঃসময়ে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত অনূদিত ফ্রেডরিখ শিলারের কবিতাটি হতে পারে একরকম সান্ত্বনা বা শরণ। কবিতাটি পড়ুন এবার :
………………..
তিনটি কথা
…………………
মানুষের মনে আমি সযতনে
লিখে যাব তিন বাণী
অগ্নি আখরে পরাণের ‘পরে
অমর এ লিপিখানি;
আশা রেখো মনে, দুর্দ্দিনে কভু
নিরাশ হয়ো না, ভাই,
কোনোদিন যাহা পোহাবে না, হায়,
তেমন রাত্রি নাই।
রেখো বিশ্বাস, তুফান বাতাসে,
হয়ো না গো দিশাহারা,
মানুষের যিনি চালক, তিনিই
চালান চন্দ্র তারা।
রেখো ভালবাসা সবারি লাগিয়া,
ভাই জেনো মানবেরে,
প্রভাতের মত প্রভা দান কোরো
জনে জনে, ঘরে ঘরে।
মনে রেখো এই ছোট ক’টি কথা,
‘আশা’, ‘প্রেম’, ‘বিশ্বাস’,
আঁধারে জ্যোতির দরশন পাবে
পাবে বল, যাবে ত্রাস।
…………………..
মূল : ফ্রেডরিখ শিলার
অনুবাদ : সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
পুনশ্চ : ড. ইসরাইল খান। বাংলাদেশের সাময়িকপত্র গবেষণার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম। ‘বাংলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতি ও সমাজের অগ্রগতিতে সাহিত্য পত্রিকার ভূমিকা (১৯৪৭-১৯৭১)’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ভারত সরকারের আইসিসিআর স্কলারশিপে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাময়িকপত্র নিয়ে উচ্চতর গবেষণা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গবেষণাগ্রন্থ হলো :
♦পূর্ব বাংলার সাময়িকপত্র : প্রগতিশীল ধারা (১৯৪৭-১৯৭১) প্রকাশক : বাংলা একাডেমি
♦পূর্ব বাংলার সাময়িকপত্র | প্রকাশক : বা/এ
♦মুসলিম সম্পাদিত ও প্রকাশিত বাংলা সাহিত্য পত্রিকা | প্রকাশক : বা/এ
♦বাংলা সাময়িকপত্র : পাকিস্তান পর্ব | প্রকাশক : বা/এ
♦ সাময়িকপত্র ও সমাজ গঠন
♦ ভাষার রাজনীতি ও বাংলার সমস্যা
♦ মনীষা ও মনস্বিতা
♦ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি
♦ অদ্বৈত মল্লবর্মণ : জীবন ও কর্ম
♦ কবি নজরুলের অসুস্থতা তর্ক-বিতর্ক ও দলিলপত্র
♦ বুদ্ধিজীবীদের দ্বন্দ্ব ও সাহিত্যসমাজের অবক্ষয়
♦ এরশাদের আমলে ভাষাকেন্দ্রিক রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক বিতর্ক (১৯৮২-১৯৯০)
♦ অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনাবলী | সংগ্রহ ও সম্পাদনা
♦ মোহাম্মদ লুৎফর রহমান : জীবন ও চিন্তাধারা
♦ আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের অভিভাষণসমগ্র | সম্পাদনা
[ড. ইসরাইল খান সংক্রান্ত তথ্যঋণ : গবেষক মামুন সিদ্দিকী ও ইন্টারনেট]
সূত্র : ইন্টারনেট
এরকম শিক্ষণীয় আলোচনা অব্যাহত থাকুক।