spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্য'নজরুল জয়ন্তী'র ইতিবৃত্তের সন্ধানে

লিখেছেন : ইসরাইল খান

‘নজরুল জয়ন্তী’র ইতিবৃত্তের সন্ধানে

ইসরাইল খান

‘বাংলার সাহিত্যক্ষেত্রে নজরুল-প্রতিভার উন্মেষ ও বিকাশের ইতিহাস সংকলন করতে গেলে নজরুল-চর্চার অনুপুঙ্খ তথ্যও সংকলন করা বিধেয়।’–এই মন্তব্য করেছেন ‘নজরুল-জীবনী’ প্রণেতা অরুণকুমার বসু। কাজী নজরুল ইসলাম-এর জন্মশতবর্ষ পূর্তি (১৮৯৯-১৯৯৮) উপলক্ষ্যে বিশেষভাবে পরিকল্পিত, রচিত ও প্রকাশিত এই জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ করে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাদেমী ২০০০ সালে। মূলত যাবতীয় পূর্ব প্রকাশিত তথ্য সংকলনসহ টীকা-ভাষ্য সংযোজন করে স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে রচিত এই জীবনীতেও পুনঃবিশ্লেষণের ও দ্বিমত পোষণের মত অনেক মতামত তিনি উপস্থাপন করেছেন। নিজেই স্বীকার করেছেন, বর্তমান এই জীবনীটি নতুন কোনো স্পর্ধা নয়, কোনো নতুন তথ্যে সমৃদ্ধ নয়, কেবল একাধিক জ্ঞাত-বর্ণিত-পঠিত জীবনীর পুনরুক্তি ও পুনর্বিন্যস্ত খসড়া মাত্র।
বস্তুত ১৯১৮-২০ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলায় নজরুলকে অবলম্বন করে খ্যাতি নিন্দা স্তুতি ঈর্ষার যে টানাপোড়েন চলেছিল, তার অসংখ্য তথ্য ক্রমশ উদ্ঘাটিত হচ্ছে। এবং এ সকল তথ্য উদ্ঘাটন করেছেন বাংলাদেশের নজরুল গবেষকগণই। মনস্বী আবদুল কাদির, অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইউম, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ দীর্ঘদিন ধরে নজরুল চর্চার আকর তথ্যসমূহ সংগ্রহ করে দেয়ার ফলেই অধ্যাপক অরুণকুমার বসু এই জীবনী গ্রন্থ অল্পায়াসে লিখতে পেরেছেন। কারণ, নজরুল-চর্চার বিস্তারিত বিবরণ নজরুল জীবনীরই অন্যতম অঙ্গ।
মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় প্রকাশিত আবুল কালাম শামসুদ্দীনের ‘নজরুল-জয়ন্তী’ শীর্ষক একটি রচনা সংগ্রহ করার পর আমি ‘নজরুল জয়ন্তী’র ইতিহাস অবলোকনের চেষ্টা করি। সর্বশেষ লিখিত পূর্ণাঙ্গ জীবনী অরুণকুমার বসুর উপযুক্ত বইয়ে আশা করেছিলাম এ সম্পর্কে স্পষ্ট একটি মতামত থাকবে, কখন থেকে নজরুল জয়ন্তী উৎসব আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন করা হতে থাকে। কিন্তু অরুণকুমার বসু নিজস্ব কেনো তথ্য সংগ্রহ বা সংযোগ না করে মুস্তাফা নূরউল ইসলামের ‘সমকালে নজরুল ইসলাম’ (১৯৮৩) গ্রন্থ থেকে আনন্দবাজার ও সওগাতের দুটো খবর দিয়ে নজরুল-জয়ন্তী-উৎসবের তথ্য পরিবেশন করেন। ১৯৪১ সালে অনুষ্ঠিত এই জয়ন্তী উৎসব সম্পর্কে জিজ্ঞাসার নিবৃত্তিমূলক কোনো অবলোকন তাতে পাওয়া গেল না।

আবুল কালাম শামসুদ্দীনের ‘নজরুল-জয়ন্তী’ শীর্ষক এই রচনাটি অনেকগুলো তথ্য দেয়–তা হল কলকাতার বাইরেও বিভিন্ন স্থানে সাড়ম্বরে নজরুলের জন্মজয়ন্তী ১৯৪১ সনের ২৫ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ) প্রথম বারের মত উদযাপিত হয়। প্রথম বারের মত উদযাপিত উৎসবের সভাপতি হিসেবে তিনি এত অল্প বয়সেই জন্মজয়ন্তী উৎসব উদযাপনের পক্ষে পাণ্ডিত্যপূর্ণ যুক্তি উপস্থাপন করেন। তিনি উল্লেখ করেছেন বাংলা সাহিত্যের অন্য কোনো লেখকেরই ‘জন্মজয়ন্তী’ এত কম বয়সে (৪২ বছর বয়সে-৪৩ তম জন্মতিথি) পালন করা হয়নি। — ‘নজরুল ইসলাম যুগপ্রবর্তক কবি। রবীন্দ্রোত্তর কাব্য-সাহিত্যে যে নূতনতা এসেছে, নজরুল ইসলামই তার প্রবর্তন করেছেন। আধুনিক বাঙ্গলা কাব্যের প্রথম প্রবর্তক মাইকেলের পরে যেমন রবীন্দ্রনাথ নবযুগস্রষ্টা, রবীন্দ্রনাথের পরে তেমনি নজরুল ইসলাম বাঙ্গলা কাব্যে নতুনতা এনেছেন। নজরুল কাব্যে দানের প্রাচুর্য্যে রবীন্দ্রনাথের তুলনা নেই নিশ্চয় এবং সেদিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের কোনোরূপ তুলনা হয় না একথাও ঠিক। তবু রবীন্দ্র-কাব্য-প্লাবিত বাঙ্গলা সাহিত্যে নজরুল ইসলাম নূতন ধারা প্রবাহিত করেছেন এ-কথা অস্বীকার করা যায় না। –’’(সংক্ষিপ্ত)

‘নজরুল-জয়ন্তী’ উদযাপনের জন্য ১৯৪১ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’, ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পরিষদ’, ‘চট্টগ্রাম সাহিত্য মজলিস’ বনগাঁ সাহিত্য সমিতি প্রভৃতি সাহিত্য প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ গ্রহণ করে।
মাসিক সওগাত-এর ফাল্গুন, ১৩৪৭ সংখ্যায় ‘সাময়িকী’ বিভাগে মন্তব্য করা হয়। ‘… এবার নজরুল জয়ন্তী করিতেছেন জানিতে পারিয়া আমরা অতিশয় আনন্দিত হইলাম।’ অতঃপর সওগাতের ভাষ্য :
“নজরুল ইসলাম তরুণ। এত অল্প বয়সে জয়ন্তীর সম্মান লাভ করা খুবই বড় কথা। কিন্তু নজরুল ইসলাম এই বড় কথার চেয়েও বড়। তিনি যুগ-স্রষ্টা। রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল ও বঙ্কিমচন্দ্র যুগস্রষ্টা বটে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্কিমচন্দ্রের যুগ-স্রষ্টাত্ব তাদের সারাজীবনের সাধনার ফল। আর মাইকেলের প্রবর্তিত যুগের কোনো ভাববাদিত্বপূর্ণ গুরুত্ব নাই।
কিন্তু নজরুল আসিয়াছেন ভাববাদীর বাণী মুখে করিয়া। তাহার যুগ-প্রবর্তকতা প্রমাণ করিতে তাহাকে সারাজীবন সাধনা করিতে হয় নাই। তাহার প্রথম কণ্ঠস্বর শুনিয়াই তরুণ বাংলা বুঝিয়াছে, তাহার নায়ক আসিয়াছেন। কাজেই নজরুলের জয়ন্তী হইবে নয়া বাংলার নিজেরই জয়ন্তী।”
আনন্দবাজার পত্রিকায় মুসলিম সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে কাজী নজরুল জন্মতিথি উৎসব পালনের সংবাদ পরিবেশিত হয় ২৮ মে ১৯৪১ তারিখে। লেখা হয়:
“কাজী নজরুল ইসলামের ৪৩ তম জন্মতিথি উপলক্ষে বিগত রবিবার অপরাহ্নে মুসলিম সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে ১১৪ নং লোয়ার সার্কুলার রোডস্থ ডেন্টাল কলেজ হলে একটি প্রীতিপ্রদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কবি শ্রীযুক্ত যতীন্দ্রমোহন বাগচী সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বক্তা কবি নজরুলের কবিতা ও সঙ্গীতের গুণবাচক সমালোচনা করিয়া তাহার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। মি. আবদুল কাদের ও কাজী আবদুল ওদুদ সভায় স্বরচিত প্রবন্ধ পাঠ করেন। যতীন্দ্রমোহন বাগচী কাজী নজরুলের উদ্দেশ্যে একটি স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন। আব্বাসউদ্দীন কবি নজরুলের রচিত একটি সঙ্গীত গাহেন।…”

মাসিক সওগাত এর আষাঢ় ১৩৪৮ সংখ্যায় এই জয়ন্তী উৎসবের খবর ছাপা হয়। তাঁদের মন্তব্য–
‘এই উৎসব অভূতপূর্ব সাফল্যমণ্ডিত হইয়াছিল। নজরুল ইসলামের জনপ্রিয়তাই এই অনুষ্ঠানের সাফল্যের একমাত্র কারণ।’

১৯৪১ সনের জন্মজয়ন্তী উৎসব উদযাপনের পর ১৯৪২ সনের জন্ম জয়ন্তী উৎসব পালনের কোনো সংবাদ আপাতত জানা যাচ্ছে না। (কেউ জানালে উপকৃত হবে নজরুল-অনুরাগীগণ)। ১৯৪২ সনের জুলাই থেকে নজরুলের অসুস্থতা জনসমক্ষে প্রকাশ পায়। ১৯৪৩ সাল থেকে অতঃপর অসুস্থ নজরুলের জন্মজয়ন্তী উৎসব নিয়মিতই হতে থাকে। বাংলার সবখানে নজরুলের অসম্ভব জনপ্রিয়তা, নজরুল-জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ব্যাপক লোক সমাগম হতে থাকে।

নজরুলের ৪৫তম জন্মতিথি উদযাপিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ইনস্টিটিউট হলে। রায় বাহাদুর অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ মিত্র সভাপতিত্ব করেন। আনন্দবাজার পত্রিকা ২৬ মে ১৯৪৩ সংখ্যার শিরোনাম ছিল:
‘কবি নজরুল সংবর্ধিত। দেশবাসীর পক্ষ হইতে অভিনন্দন। বাংলার জাতীয় জাগরণে ও হিন্দু-মুসলমান সংহতি প্রচেষ্টায় কাব্য ও সাহিত্যের মধ্য দিয়ে কবি নজরুলের অপরিমেয় অবদানের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করা হয়।… কলিকাতাবাসী তথা বঙ্গবাসীর পক্ষ হইতে কবি নজরুল ইসলামকে তাঁহার জন্মতিথিতে অভিনন্দিত করিয়া শ্রীযুক্ত সজনীকান্ত দাস সভায় একখানি মানপত্র পাঠ করেন। এই অভিনন্দনপত্রখানি কবির বাসভবনে কবির হস্তে অর্পিত হইবে।’
গুলিস্তাঁর একটি সংখ্যায় (১৯৪৪) অসুস্থ নজরুলের সাড়ম্বরে জন্মদিন পালনের সংবাদ দেয়া হয়। নজরুলের সাহিত্যিক ভাতা মঞ্জরির পরে আচার্য রায় বাহাদুর খগেন্দ্রনাথ মিত্র ‘দুস্থ কবির সম্মান’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে লেখেন, নজরুল যে ব্রিটিশ-রাজের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে, বিপ্লবী কবিতা ও সঙ্গীত রচনা করে বাঙালির চিত্তে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল, সেই ব্রিটিশ সরকার নজরুলকে সাহিত্যিক ভাতা মঞ্জুর করেছে, যা কিনা এ পর্যন্ত কবি সাহিত্যিকদের জন্য মঞ্জুরিকৃত সকল প্রকার ভাতার চেয়ে বড় অঙ্কের (সরকার কর্তৃক ১৯৪৩ সালে ২০০ টাকা সাহিত্যিক ভাতা মঞ্জুর করা হয়)।
অসুস্থ নজরুলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান নিয়মিত অতঃপর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। ১৯৪৯ সালে মাসিক ‘অগত্যা’ পত্রিকার উদ্বোধনী সংখ্যায় (১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা, আষাঢ় ১৩৫৬) সম্পাদকীয় কলামের শিরোনাম ছিল “২৫শে মে… জাতির চরম লজ্জার দিন”। লাল কালিতে সম্পাদকীয়র ঐ পৃষ্ঠাটি ছাপা হয়। নজরুল জীবনীর আকর তথ্যরূপে বিবেচিত হবে আশায় উদ্ধৃতিটি পূর্ণাঙ্গ দিচ্ছি:
“হে নজরুল।
তোমার জন্মদিন ঘিরে আজ যে আন্দাজ।
কলকোলাহল আর আলোড়ন জাগছে দেশময়।
তাতে ‘তুমি আছ কি নেই’ সেই প্রশ্নই বারবার লাঞ্চণার মতো
উচ্চকিত হচ্ছে আমাদের সামনে। কতদিন আর বাঁচবে তুমি?
দেখছো না তোমার জীবন আজ আমাদের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে। ব্যাপক আয়োজন আর সমারোহ সব-কিছুর মধ্যেই রয়েছে তোমার অস্তিত্বের প্রতি একটা নিরঙ্কুশ ব্যঙ্গ। তুমি বেঁচে আছ তবু তোমাকে ছাড়াই আজ তোমার জন্মতিথি উদযাপন।
অন্ধকার কক্ষে তুমি পঙ্গুজীবনের শেষ দিন গুনছো, হয়ত তুমিও জাননা আজ তোমার জন্মদিন,… কিন্তু বাইরে দেখ আমরা কি ঘটা করে তোমার জন্মদিন পালন করছি।
তুমি আমাদের প্রিয় কবি, তাই তোমাকে ছাড়াই কত আনন্দ,
উচ্ছলতা, আর কত অনুপ্রেরণা… কত মাতামাতি করছি আজ তোমার সাহিত্য, দর্শন, কাব্য নিয়ে সভা সমিতিতে।
যারা তোমার লেখা এক পাতাও পড়েনি, এমন কত নেতা আজ অভিনেতার বাকচাতুর্যে সভায় দাঁড়িয়ে তোমার দর্শন আর
কাব্যের বুলি কপচাচ্ছে– চেয়ে দেখ মঞ্চের পেছনে আরও কতজন দাঁড়িয়ে আছে তোমার জীবনতত্ত্বের ওপর আলোচনা করবার জন্যে। হাজার হোক আমরা প্রতিভার দাম দিতে জানি। তুমি এবার তাদের সুযোগ দাও। কি হবে আর বেঁচে।
হে আমাদের অমর কবি, জানি তুমি বিদ্রোহী, জানি তুমি সৈনিক, জানি তুমি একদিন অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ রোধ করার জন্যে উদাত্ত কণ্ঠে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলে। কিন্তু আজ আর কেন?…
তুমি তো ভাল করেই চেন এ জাতিকে…. জানোইত,
আমরা ছেঁড়া জুতোর দাম দিই না।
তোমার মৃত্যু হোক,
আর এক মাইকেলের জন্ম দাও তুমি!
নেতারা পাক সুযোগ তোমার উপর কিছু বলবার–
করবার যখন কিছু তাদের নেই-ই!
আর তোমার বেঁচে থেকে লাভ কি?
কৃতঘ্নতা ও নির্লজ্জতার শেষ তুমি কখনই দেখতে পাবে না?’ (অগত্যা)

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ