❑ এক
আচমকা তোমারে দ্যাখলে পরানডা ক্যামন জানি করে
মাটির বাসনে ধবধবে সাদা ভাতের লাহান মুখ তোমার
পুন্নিমার চান তোমারে শরম পায়, আমি কোন ছার?
অলক্ষ্যে আমারে তুমি ডাকাত কও, নিঠুর কও
আমার মন্দ লাগে সই, ভাতে মন বসে না, অপুষ্টিতে ভুগি৷
বারবার তোমার সমুখে দাঁড়াইবার তাল-বাহানা করি
কই? তোমারে হরণ করার ইচ্ছা তো করি না৷
তোমার ছোডো ছোডো আঙুলে জাদুমন্ত্র আছে
তোমার লেখার খাতা খুইলা দেখছি— কী সোন্দর নাম!
তোমার ছবির ঘরে কারে আঁকো কোনোদিন জানি নাই
দুয়ার বাইন্ধা রাখো৷ জানি, আমারে তুমি ভালোবাসো নাই৷
❑ দুই
তোমার কণ্ঠ শুনলে ভালা লাগে, শরীলে জ্বর কইমা যায়
তোমার গলার স্বরে অভিমানী বাচ্চা, কাঁদলে পরানে দাগ লাগে৷
তবু, আমারেই তুমি তাচ্ছিল্য করো, গেরামে গেরামে কুকথা কও
আমার দুঃখ লাগে, গাছের গায়ে হেলান দিয়া জল দেখি;
আমার দেহ কালো, চক্ষু লাল, আমারে তাই কঠিন কও
আমি যে জলের লাহান ঠাণ্ডা এই খবর তুমি রাখো না৷
তোমার পায়ের আওয়াজ শুনলে চুপচাপ মাটি হয়া যাই
মাটির লাহান নরোম আর তাহার মতন অসহায় হয়া যাই
তুমি যাতে আঘাত দিতা পারো, আমি তার ফিরতি না দিতা পারি৷
তুমি দশজনরে কথা দেও, ফুল দেও, আমারে কোনোদিন দেওনাই
ধুরধুর তাড়াইয়া দেও; আমি জানি, আমারে তুমি ভালোবাসো নাই৷
❑ তিন
তোমার এত সোন্দর ঠোঁট ক্যান এত উদ্যত কথা কয়
তোমার ভাষা অন্তরে যে শেল মারে, এফোঁড় ওফোঁড় করে
ফুটু বানায় তুমি টের পাও না? চক্ষে টলমল করে জল
মুখ ঢাইকা রাখি, ভান করি চক্ষে লুতিপোকা; তুমি দেইখা হাসো৷
আমার জমি নাই অর্থ নাই পরের উঠানে বানাইছি ছনের ঘর
আমারে তুমি ফতুর কও, অভাগা কয়ে গাল পাড়ো
গোসলে গেলে ঠাট্টা মসকারা করো, শুকনো কাপড় ভিজায়ে দেও
আমারে অপমান করা য্যান বৃক্ষের পাতা ছেঁড়ার মতন সরল
অপমানের মান টুকু আমারে দেও নাই কোনোদিন, দিয়াছো চরম হেলা৷
আমার কেহ নাই; অন্তরে পিরিত থাকলে কামে মন থাকলে
বাইরে আর কিসের প্রয়োজন কোনোদিন তলব করি নাই
মানুষের দুঃখে মানুষ তয় এমন সুখ পায় কোনোখানে দেখি নাই
রিফিউজি কও? জানি, আমারে অন্তর দিয়া একবারও দ্যাখো নাই৷
❑ চার
আসমানে চান উঠছে, জমিনে নামছে ধলা খরগোশের মতন জোছনা
চান আমার পায়ে পায়ে হাটবাজারে যায়, ঝিঁঝিপোকা কার লগে মাতে জানি না৷
হাট থেকে ফেরার সময় পথ জুইড়া কলাবাগান দাঁড়াই থাকে মাঠে
বৃক্ষ বিহানে রোদ খায়, রাইতে খায় জোছনা; বৃক্ষের পাতার কত সুখ!
আমি আদম, ঘরে ফেরার চেরাগ আমার জন্যি একা আন্ধার গোনে
গাছের লাহান শীত বর্ষা দাঁড়াই থাকবার সুখ আমার জীবন যৈবনে নাই৷
পাথরাজের পার দিয়া গেলে তোমার হাসির শব্দ শোনা যায়
কাপ ফিরিসের টু টাং আওয়াজ লাগে কানে, লাশগাড়ির সাইরেন বাজে পরানে;
তুমি কার লগে হাসো, চা বানাই দেও কারে আমার অন্তর জানে নাই
আমার গোস্বা লাগে, টিনের চালে ঢিল মাইরা চোরের লাহান পলাই
তুমি জানো, তোমার ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ উঁকি দেওনের নাই
আমি মুখচোরা; দুয়ার জানে, আমারে তুমি একবারও ঘরে ডাকো নাই৷
❑ পাঁচ
আলপথে দাঁড়াইলে বৌদ্ধ বিহার দেখা যায়, রাত্রে কারেন্টের বাত্তি জ্বলে
কতদিন বিহারে যাই না, আমার পরান কান্দে, ঘাসের জন্য মন পোড়ে
বোধিগাছ কি এখনও তেমন চুপচাপ আছে জানবার সাধ পায়৷
ওরা আমার নামে কুৎসা রটায়, পাড়ায় পাড়ায় পাণ্ডিত্য ফলায়
আমারে তুমি নিদারুণ হেলা করো, প্রবারণা আমার বিষাদ লাগে
তুমি ফানুস ওড়াইয়া দেও, চীবর দানে নয়া জামা গায়ে লাগাও;
তোমারে দ্যাখবার ভীষণ ইচ্ছা হয়, আমি সেই ইচ্ছামারা শোকভোলা
তোমার হাতের আঙুল ভুইলা যাই, তাচ্ছিল্যের ঘরে টোকা মারি
অবহেলা দুয়ার খুইলা রাখে, আমি বালিশ জড়ায়ে ধরে মায়েরে ভাবি৷
ঘুমে স্বপ্ন আসে, স্বপ্নের লগে আলং আসে, একবারও তুমি আসো নাই
চারদিকে এত্ত ফুল! আমি জানি, আমারে তুমি ভালোই বাসো নাই৷
❑ ছয়
আমারে তুমি ভালোবাসো নাই সত্য, আজ মগচিতার মোড়ে জানলাম
আমারে তুমি কোনোদিন দুই চক্ষেও দ্যাখতে পারো নাই
বেবাক লোক কয় ভালোবাসা আসমানী কারবার, সাদা তার জামা
মেঘের ভিতর তার একখানা বাসা, শহরের মতন তার অলিগলি নাম্বার
আমার ছনের ঘরে শীত ঢুকে, রৈদ ঢুকে, মাঘীপুন্নিমার জোছনা ঢুকে
তোমারে না পাইবার দুঃখ ঢুকে সারাক্ষণ, খালি ভালোবাসা ঢুকে না;
কোনোদিন আমি শহরে যাই নাই, আমি কোনো নাম্বার জানি না৷
সে কোন আদরের বাচ্চা? আমি তার নাগাল পাই না, স্বপ্ন পাই না
তার গালে কমলার ট্যাব পড়ে? তয় সে এত চমৎকার ক্যান!
সে কি চান্দের লাহান দূরে? আলে বসে নিদারুণ চেয়ে থাকা
খামচি দেয়া যায় না, কাতুকুতু দেয়া যায় না, এ কোন অচ্ছুত পাপ?
আমারেই সে ছুঁলো ক্যামনে? আমি তারে ছুঁতে পারি না!
❑ সাত
নিদয়া কৈতর, ক্যান তোমারে মায়া লাগলো আজও বুঝি নাই
ক্যান তোমারে কৈতর কয়া ডাকি? তোমারে তো দেই নাই ধান
ক্যান তোমারে পরী কয়া ভাবে মন? দুনিয়া জানে পিরিতি পাষাণ
সাগরের মাপ দিয়া বানাইছে তোমারে, তরঙ্গ আমারে নেয় নাই৷
আজ থিকা তোমারে দুঃখ কয়া ডাকি, রাত-বিরেতে ভাতের লগে অভিমান
ভাবি, দুঃখও এমন একখান দোস্ত যে ভালা দোস্তের ঠিকানা জানায়৷
তোমার চুলে অমাবস্যার আন্ধার, হাসিতে ব্যথা, সিনা তবু টানটান
ঘরে ঘরে ক্ষুধিত মহাজন, দুখিরে কে পিরিতের কিচ্ছা শোনায়?
নয়া নয়, পুরান নয়, এ ক্যামন বদলের বাতাসে ভিনদেশি দল
নদী নয়, পাহাড় নয়, তয় তুমি কি নিথর দুফরে চিন্তাহরণ বন?
বছর ফুরালেই উৎসব, উত্তর দখিনের অচিনা পূজারির ঢল৷
পাখির কোথাও যাবার নাই৷ ডানা নাই? তার নাই ক্যান পলায়ন!
❑ আট
এই দেমাক তুমি আর কারে দেখাবা? আছে কেউ গাছের লাহান
চুপচাপ চাইয়া থাকে? আমারে ক্যান খালি ভয়ানক আঘাত দেও?
তোমার কথা আমি পাখিরে কই, তার ডানা বান্ধা আছে খাঁচায়
তোমার কথা আমি নদীরে কই, বয়ে চলা যার রক্তের ভিতর
আর কারে কই কথা মাটি ছাড়া? মাটি দিয়ে গড়া মাইনষের চেহারা৷
ফুলের সোন্দর নিয়া বানাইছে তোমারে, চোখে ঠোঁটে পাতা পাপড়ি
ছুঁইতে গেলে নিদারুণ কাঁটা বিঁধে, পিরিতি না-ধরা হাত বড় আনাড়ি৷
কারে তুমি দিবা মন, কারে দিবা শরীলের জ্বর, এ আমি জানি না
আমার দেহে তোমার পরান এ কথা গেরামের কানেকানে পাঁচখানা;
আমি তো দরবেশ নই, পথ ঘরের কোনো দুঃখ আমারে নাই ছোঁবে
ব্যথা দিয়া মজা লুটে দশজন, দুখি একজন কোন বনপথে যাবে?
কে তুমি যারে দেও তারে দেও সব, না-দেয়ারে দেও নিদয়া কৈতর
কোথাও প্রিয় নাই পিয়ন নাই, আসে না তয় কাগজের চিঠিপত্তর৷
❑ নয়
তুমি চইলা যাবা? ঘরদোর ভাইঙা যাবে আমার৷
ঘরের আয়না আমি বেইচা দিমু, আগুনে পোড়াবো জামা
বাসনকোসন ফেইলা দিমু জলে, চুলায় ভাত বসাবো না৷
নিঝুম দুফরে পারে বইসা থাকুম, য্যান ভাসমান শীতের পাতা
তার মতন জীবন নিয়া গাছেরে আর ভালোবাসুম না৷
গাছেরও কি বেদনা নাই? পাতা তার জলে ভাসে করুণ
একা একা ঘুরপাক খায়, নিজেরে লেখার নাই কোনো খাতা৷
এমন অদ্ভুত না-থাকা নিয়া সে ক্যামন মেজাজ নিয়া থাকে
জানবার সাধ তোমার কোনোদিন হয় নাই, মনে কী লাভ?
জানি, তুমি বৃক্ষ নও, ভাবো নাই পাতার জীবন টোন
পাতারও যে শিরা আছে পরান আছে, থাকে মরা কঙ্কাল
সে কথা বৃক্ষ জানে না? জল জানে না? জানে অনন্তকাল!
❑ দশ
নিজের ছায়ার মতন সোন্দর কোনো ছায়া নাই
নিজের মুখের মতন নাই করো ভালো মুখ
নিজের নিজের লাহান আর কোনো নিজ নাই
নিজের দুঃখের লাহান নাই কোনো সোন্দর সুখ৷
এমন সুখের কথা আমি কার কাছে গিয়া কই?
কার কাছে গিয়া কই নিজেরে এইবার ভালোবাসিলাম?
তুমিই যে আমার নিজ আছিলা এ কথা কারে কই?
পরানে পিরিতের বিষ নিয়া ক্যান এত হাসো সই?
জলের নরোম গায়ে খালি ক্যান ঢিল ছুঁড়ো?
জলেরও কি ব্যথা নাই? একদিন তরঙ্গরে জিগাইয়ো
কষ্ট তার কিসের মতন? জলের উত্তর নিয়া
কাজকাম থুইয়া একদিন আমারে তুমি ভালোবাসিও৷
বিচিত্র তুমি সম্ভার।তুমিতে নিমজ্জিত কবি।কবির তুমি কবিতাতে এসেছে বর্ণিল রূপে।ভালো লাগায় ভরপুর।
রিকেল বড়ুয়ার অসামান্য জীবনালেখ্য পড়লাম। একটা বৃহৎ জীবনের উপাখ্যানে মর্মরিত হলাম। প্রচলিত আঞ্চলিক শব্দ প্রয়োগে এমন কবিতা লেখা যায় তা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। যে কোনো শ্রেণির পাঠককেই স্পর্শ করবে। উপলব্ধির সঙ্গে নাটকীয় সংলাপধর্মিতা, প্রেম, প্রকৃতি, জীবন এবং স্বপ্ন সবই একাকার হয়ে গেছে। খুব আন্তরিক এবং স্পর্শাতুর তার প্রতিটি উচ্চারণ:
“আমারেই তুমি তাচ্ছিল্য করো, গেরামে গেরামে কুকথা কও
আমার দুঃখ লাগে, গাছের গায়ে হেলান দিয়া জল দেখি;
আমার দেহ কালো, চক্ষু লাল, আমারে তাই কঠিন কও
আমি যে জলের লাহান ঠাণ্ডা এই খবর তুমি রাখো না৷”
আহা এর তুলনা হয় না।
আঞ্চলিক ভাষায় লেখা কবিতার একটা আলাদা মজা আছে।
এই কবিতা তার প্রমাণ।
সৈয়দ শামসুল হক – এর “পরানের গহীন ভেতর” কবিতার বইয়ের ছায়া একটু বেশিই আছে।