কবি ও সম্পাদক সাজ্জাদ বিপ্লব আমার ৩০ টি কবিতা চেয়েছিলেন। চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম ভেবে, আমি আদৌ এতগুলো ভাল কবিতা লিখতে পেরেছি কি-না। নিজের কবিতা নিজে বাছাই করা একটি কঠিন কাজ। চেষ্টা করেছি ভাল কিছু লেখা পাঠকের হাতে তুলে দেয়ার।
আমি মূলত কষ্টপূজারী। জীবনকে ভাগ করে দেখি, পাথরে পাথর ঘসে-ঘসে আগুন জ্বালাতে চেষ্টা করি। জীবন ও মৃত্যু–এর মাঝে যে নিগুঢ় রহস্য, তা নিয়ত আমাকে আলোড়িত করে। সে রহস্য আমি অনবরত খুঁজে বেড়াই।
তাই আমার কবিতা এর বাইরে কিছু নয়। পোড়া জীবনের ঘ্রাণ শুঁকে আমি খুঁজে পেতে চাই মানুষের বেদনার, আকুলতার নীল মাছগুলো।
একটি কবিতায় তাই এভাবে বলেছিলাম:
এই তো জীবন!
জীবন মানে একটি স্মৃতি।
স্মৃতি মানে একটি স্কেচ,
তার ভেতরে অনেকগুলো রেখা।
আমি Art for art’s sake-এ বিশ্বাসী নই। আমি জীবনের কাছে সমর্পন করি নিজেকে। বেড়ে উঠি তার ছায়ায়।
চলুন পড়া যাক, আমার ৩০টি কবিতা।
পাগুলো
সেনাইয়া ও ইরবের জন্য
ঘর থেকে যে-পাগুলো চলে গেছে গোধূলির আগে
–ওরা আর ফেরেনি।
দূরে কুঁজো বাতাসে, জলপাই বনে–কেবল খুঁজেছি তাদের।
ক্রাচে ভর করে কত দুঃখ আর বয়ে নিয়ে যাব?
নির্জন রেলপথ ধরে হাঁটি,
জরাজীর্ণ এই পথ কত দূর গেছে জানা নেই।
খুঁজি এক দূরের সন্ন্যাস-বিকেল।
বৃষ্টি উৎকীর্ণ আকাশ চলে গেলে
গারোপাহাড় নেমে আসে সন্তাপ হাতে নিয়ে।
গাছের ফাঁকে-ফাঁকে অমারাত্রি আমাকে ডাকে।
যারা যায়, তারা আর ফেরে না।
শৈশব ফেরেনি আজও।
জলে পড়ে থাকে অন্ধ রাত।
নদী তাই ঘুমায় নি কোনো কাল।
অলক ও অস্পৃশ্য রোদ
অলক চলে গেলে,
মরে গিয়েছিল দূর্বাঘাসের মতো তার অনিদ্র আকাশ,
বসন্তে ঘরকোনো উইপোকাগুলোও।
তবুও
আমার অতলে, অস্পৃশ্য রোদগুলো ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে–ভাবি,
এ জীবন কিছু নয়,
তৃষ্ণার্ত কাকের ডাকের মতো।
যে দিন ত্রস্ত নিঃশব্দতা পানকৌড়ির মতো ডুবে ছিল,
সে দিনও কাঁচ-ভাঙা রোদ এসে বুক পুড়িয়ে দিত।
সেই দাহে পোড়া ঘ্রাণ ছাড়া কী ছিল বলো?
মনে হত, আজও মনে হয়,
মানুষের ডাক কখনও-কখনও অন্ধ নক্ষত্রের মতো–চোখ বুজে রাখে।
তবুও চোখ থেকে চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
হাত থেকে হাতের স্পর্শ উড়ে যায়। তারপর আঙুল থেকে আঙুল…
জন্মান্ধ চোখ
কাঠ ঠুকরো পাখিদের মতো
আমি গোটা আকাশটাকে ঠুকরে খাচ্ছি।
মেঘ ঝরে পড়ছে,
বৃষ্টি ঝরে পড়ছে,
কাদা মাটিতে এসব টুকরো জমছে।
স্তুপ হতে-হতে ঢেকে যাচ্ছে
রাশ-পড়া-চোখের-গ্লাস।
আমি দেখতে পাব না হয়ত।
কিন্তু বিম্বিত রোদের ছায়া
গ্লোকমার মত সাদা হয়ে উঠবে।
সেখানে ডাক্তারের ছুরি,চাকু
ব্যবচ্ছেদ করতে-করতে দেখতে পাবে
আমার রেটিনা বলতে কিছু নেই!
জন্মান্ধ দুটি চোখ কিভাবে মাপবে আকাশের পরিধি;
আমি শুধু সে-প্রশ্নের উত্তর চেয়েছি জয়িতার কাছে।
ঝিনুক
ঝিনুকে কে কেউ আমার নাম লিখে রাখে নি।
কাঁকড়ারা হেঁটে যায়;কিছু দাগ রেখে যায় মাটিতে।
সে দাগে সাবধানে আঙুল বুলিয়ে দি।
তারপর বৃষ্টি হলে সেই সব দাগ ধুয়ে যায়।
বালির দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে ভাবি,
আহা!আমার যদি ছোঁয়াছে রোগনা হত—
কিউ কি আমার নাম লিখে রাখত ঝিনুকে?
কুয়োতে ঝিঁঝিঁ-ডাকা-শব্দের মতো
একটানা ডাকতে থাকে রাত!
সব অন্ধকারে কেবল শুনতে থাকি সমুদ্রের গান।
মাছ
একটি পোস্টারে আমি প্রতিদিন লিখছি–মানুষ।
তারপর,এইসব মানুষ নিয়ে
আমি যখন একটি নদী পেরিয়ে যেতে চাইলাম,
একটি মাছ ডুব দিয়ে উঠেছিল।
শেওলায় জমেছিল কিছু কাদাজল অনাদরে।
মাছ নীরবেই ছিল ওখানে।
খড়কুটো,ধূলোমেঘও ছিল ভ্রূক্ষেপহীন।
আমি মানুষগুলোকে ফিরিয়ে নিলাম।
হোয়াইট-আউট দিয়ে একটি-একটি করে মুছলাম।
মাছ শুধু বলল,কাগজের ভেতরে
যে-রেখাগুলো রয়ে গেছে,
তুমি কিভাবে মুছবে তাকে?
এখন আমার ঘরে শুধু সাদা কাগজের স্তূপ;
জমতে-জমতে আকাশ হয়ে যাচ্ছে!
বাড়ি
কোনো-কোনো বাড়ি চেয়ে থাকে অনেক দূরে।
কোনো-কোনো ছায়া অবিকল ছায়া হয়ে থাকে দিন শেষে।
কেউ-কেউ সেই ছায়ায় নিজের চোখ খুঁজে বেড়ায়।
কেউ-কেউ স্বপ্নকেও ভেঙে-চুরে ফেলে।
কোনো-কোনো রোদ পুড়িয়ে ফেলে দুপায়ের ছাপ।
কোনো-কোনো ব্যথা কখনো কঁকিয়ে ওঠে অর্ধেক হাতের মতো;
পারদের মতো গলে-গলে গাঢ় হয়ে যায় আবারও।
মাটি ও পুষ্পবৃক্ষ সন্ধ্যা এলে নুয়ে পড়ে।
গাঢ় হয় মাটির সন্তাপ । ভেঙে যায় সব কিছু
–ইঁদুরের গর্ত, ইলাদের শুভ্র হাসি।
গুইসাপ তবু বুক দিয়ে লিখে রাখে বাড়ির ঠিকানা।
অক্ষমতা
সমুদ্র জানে কেউ অনেক দূরে চলে গেলে
আর ফিরে আসে না।
প্রদীপগুলো একে-একে ছুঁয়ে দিয়ে আঙুলে
পোড়া ঘ্রাণ শুঁকে
নৈশব্দই তখন বুকের মাঝে চিন-চিন করে ওঠে।
রোজ দরজায় কড়া-নাড়া রোদের ছায়ার মতো সব।
ভেঙ্গে-ভেঙ্গে যাচ্ছে সবকটা লাল পেন্সিল।
কোনো দিন লিখব না কোনো নাম
প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি আজ।
দিন ও রাতের মাঝে হয়ে আছি দূরত্ব হয়ে।
তাই একটি আকাশ টেনে নামিয়ে
দুই প্রান্ত সেলাই করে রাখি।
আমার অক্ষমতাকে তবুও একটি পিঁপড়ে এসে খেয়ে ফেলে।
দুঃখবাহী ভ্যান
দুঃখকে একটি ভ্যানে উঠিয়ে দিয়ে
চেয়েছিলাম যেতে অন্য কোনো শহরে।
রাতের অন্ধকারে অনেকগুলো চোখ এঁকে
তবুও পেছনে ফিরে তাকিয়ে ছিলাম;
কিন্তু যে-রাতকে বিশ্বাস করে চাঁদের চারিদিকে বৃত্ত এঁকে দিয়েছিলাম,
সে-রেখাগুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে।
আমার বিশ্বাসে কেউ কর্ণপাত করেনি।
বরং মাটি খুঁড়ে-খুঁড়ে আস্ত একটি পুকুর বানিয়ে ফেলে।
সেই পুকুরে গাছের ছায়া এসে পড়লে
মাঝখানে কেউ এসে আঙুলের টোকা দিয়ে একটি জলের বৃত্ত ছড়িয়ে দেয়।
ঘাসফুল,জলের বুকে ঢেউগুলো লেগে আছে আঠার মতো।
আমার হাতে আর কোনো চক নেই,
সব আকাশে ফুরিয়ে গেছে।
এখন শুধু ভ্যানটি যত দূর যাবে,
তত দূর যেতে থাকব।
প্রস্থান
যেখানেই যাই একজন সিগারেট-ধরা-লোক দাঁড়িয়ে থাকে।
যেখানেই যাই তবুও সেই মানুষ।
সেকি আমাকে চেনে?
নাকি তার আরো একটি সিগারেট দরকার?
আমি তাকে একটি কফি অফার করেছিলাম।
কিন্তু লোকটি তার পকেট থেকে একটি ছবি বের করে
আমাকে দিয়ে চলে গিয়েছিল।
পঁচিশ বছর ধরে তাকে খুঁজছি।
ছবির পেছনে যে ঠিকানাটি লেখা ছিল,
সেখানে গিয়ে দেখি;
শুধু একটি জোনাকি জ্বলছিল।
নাটাই
লাল রঙের ঘুড়ি,
নাটাইয়ের সুতো ছেড়ে চলে গেছে।
আমার দুঃখ নেই।
দুঃখটা আমার নাটাইকে নিয়ে ।
আর কিছু সুতো গেলে সে একা হবে।
সবাই ঘুড়ির কথা বলে,
কেউ বলে না,
ও নাটাই তুর বুকে আটকে রেখেছিলি
সুতো বহু যত্নে। মাঞ্জার ধারে কেটে গেছে তুর বুক।
অনেকেই ভাবে নাটাই আর্তনাদ করে।
আর্তনাদ নয়,অমীমাংসিত থেকে যায়
তার হারানোর গল্প।
একদিন বাড়ি ফিরতে গিয়ে দেখি,
নাটাইয়ের চাকা খুলে গেছে;
টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঘোড়ার আস্তাবল।
চুম্বক
একটি চুম্বকে আমার সব ইচ্ছেগুলো আটকে আছে।
আমি মানুষ হলে একটি-একটি ঝরে পড়ত।
আমি হয়ত অন্য কিছু–পারদ,প্লাটিনাম অথবা
শিশিরের কুয়াশাময় দুচোখ।
আমার একপাশে নদী বয়ে যাচ্ছিল তার চোখকে ভিজিয়ে।
সেই চোখে একটি সূর্য ডুবে গিয়ে রাত নেমে আসছিল।
হায়,আমি যদি মানুষ হতাম,
সন্ধ্যার সাথে দেখা হতো!
আমি হয়ত অন্য কিছু পারদ অথবা প্লাটিনাম,শিশিরের কুয়াশাময় চোখ।
আমার চার পাশে অজস্র মানুষ;
শিশুর কান্নার মতো ঢেউ,
জোতিষ্কের মতো আলোকবর্ষ দূরে
নিস্তব্ধতা একটি রেখা একে-একে ঘুমিয়ে পড়ছে।
আমিও ঘুমিয়ে পড়ি।
টের পাই চুম্বকে আটকে আছে আমার হাতও।
একটি প্রগাঢ়তম প্রার্থনা
একটি প্রগাঢ়তম প্রার্থনায় নিমগ্ন আমি।
আমার আড়ষ্ট আঙুল গুনে নিচ্ছে পৃথিবীর আয়ু,পরমায়ু।
একটি দীর্ঘ চুম্বনে,একটি গভীরতম ঘুমে আমাদের আত্না ফড়িং হয়ে উড়ে গেছে।
সেই আত্না ঘুরে-ঘুরে আমাদের কান্না শুনে নেয়।
তারপর উড়ে যায় পাখির ডানায়।
একটি লাশ
একটি সাঁকোতে তিন জন মানুষ সূর্যকে পিঠ দিয়ে বসে আছে।
তাদের পরিচয় বলতে একটাই,ওরা এক চোখে দেখে না।
তবুও তারা পুরো আকাশকে দেখতে পেল
নদীর পানিতে চোখ রেখে।
দিন চলে যায়,মশা ও মাছি ঢুকে পড়ে ঝোপঝাড়ে।
লোকগুলো সাঁকোতে হেলান দিয়ে গুনতে থাকে
আর কতগুলো ঢেউ ফেলে গেলে তীর দেখা যাবে।
অন্ধলোকগুলোর একজন দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিল নদীতে তার গভীরতা মাপার জন্য।
লোকটি অপেক্ষায় রইল কখন দীর্ঘশ্বাসটি
শব্দ করে উঠবে নদীর তলদেশে পড়ে।
আর একটি দিন চলে গেল,
এবার একটি উড়োজাহাজ চলে গেল তার মাথার ওপর দিয়ে।
এভাবে একের পর এক চলে যেতে লাগল সব,
সাঁকোতে-বসে-থাকা-অন্ধ-লোক দুটিও।
কিন্তু কোনো শব্দই সে শুনতে পেল না মৃত্যুর আগমুহূর্তেও।
শুধু সাঁকোতে আটকে থাকা অপেক্ষার চোখ দেখতে পেয়েছিল
একটি লাশ ভাসতে-ভাসতে চলে গেছে ওপারে।
শামুক
প্রতিটি রাতের ভেতর যেন এক-একটি দুঃখ শামুক হয়ে থাকে।
আমি কোনো রাতকেই শামুক ভাবি না। তবুও
শামুকের মতো ঘুমিয়ে পড়লে শুধু সহস্র সমুদ্র দেখি চোখে।
যে মৃত আত্নাগুলো আমাকে ডেকে দিতে চায়–
বলেছি তাদের,আমি নদীরও গভীরে চলে গেছি নোঙর হয়ে ।
আমি জেগে উঠলে অন্ধ আরব বনিকের মতো চলে যাব সেই দ্বীপে।
যেখানে উদ্বাস্তু পাখিরা টুকে-টুকে খায় হাঙরের চোখ।
আমি তো শামুক,আমার আত্নাকে খুঁটয়ে-খুঁটিয়ে খেলে কিইবা রবে শুধু খোলস ছাড়া।
কেউ-কেউ ফুঁ দিয়ে বাজাবে ভেঁপু।
আহা! কত দিন শ্বাস নিতে পারি না।
স্মৃতি
বরফে ঢাকা এই শহরটি একটি স্কেচ এঁকে চলে যাব অন্য কোথাও।
একটি স্মৃতি নিয়ে যাব সাথে।
আমার ঘরের দরজায় ঝুলে থাকা
তালাটির মতো নিস্তব্ধতা এক কোণে
এসে কাঁদবে বৃষ্টি ঝরার মতো।
কেউ দেখবে? হয়ত না।
তবুও সন্ধ্যাগুলো উড়ে গিয়ে ঢেকে দেবে পায়ের ছাপ।
এইতো জীবন!
জীবন মানে একটি স্মৃতি।
স্মৃতি মানে একটি স্কেচ,তার ভেতরে অনেকগুলো রেখা।
ওই যে দূরে পাগুলো দেখছেন,
ওগুলো অনেক দূরে যেতে চায়নি।
জলের ভেতরে ডুবে-যাওয়া সূর্যের মত পাগুলো ডুবে গিয়েছিল।
তারপর সাঁতরাতে-সাঁতরাতে চলে গেছে অন্য পারে।
ছাই-ওড়া-সন্ধ্যাগুলো তাই বার-বার পাগুলোকে ঢেকে দেয়।
দুটি পা আর তার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে রাত!
এমন বিষণ্ণতায় ডুবে আছে রাত!
কেউ কি জানে? হয়ত না।
ঘুড়ি
দরজাটা খুলতে-খুলতে খুব আস্তে করে ভেঙে গেছে;
পাহাড়িয়া ঘাসের মতো খুব নিচের দিকে চেয়ে দেখেছি,
কোনো এক বালকের হাত ছেড়ে ছুটে গেছে ঘুড়ি।
ঘুড়িতে লেখা আছে বালকের দুঃখ।
সূর্যাস্ত হয়ে গেলে রাত কি ফিরিয়ে দেবে তার ঘুড়ি?
না,বালক তাই ঘুমিয়ে পড়ে।
তার বুকে ধুপ-ধুপ,ধুপ-ধুপ করে রেল চলে যায়।
সাপ
শার্টের কালো দাগের মতো কেউ দাগ টেনে রেখেছে মেঘে।
কালো বিড়ালের বিস্ফারিত চোখের ভেতর
হারিয়ে-যাওয়া শিশিরের ফোঁটা। অথবা
নদীর আর্তনাদের মতো কিছু।
আমি ব্যথাগুলোকে শ্লেটে লিখে রাখছি,
জেনেও একদিন মুছে যাবে।
দুঃখকে আদৌ লেখা যায় না।
তবুও মেঘের ভাঁজে-ভাঁজে গুঁজে রেখেছিলাম।
যে তুমি চলে গেছো,চলে যাব আমিও ।
পিদিমের মতো জ্বলবে আমার বুক।
শেওলায় জমে-থাকা কুয়াশাগুলো সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে
কোনো এক মেপেল গাছের ছায়ায়।
ধুঁয়াশা আকাশ থেকে নামছে বৃষ্টি।
বৃষ্টির কোনো নাম নেই।
একটি ঘণ্টা ঝুলে আছে আকাশে
কেবল বাতাস এলে বেজে ওঠে।
গীর্জার ঘণ্টার মতো নয়, হৃৎপিণ্ডের মতো করে।
আমি সেই শব্দ শুনি কান পেতে।
আর আর্তচীৎকার করে উঠি যন্ত্রণায়।
তারপর থেমে যাই।
আমার স্থির চোখের ভেতর একটি সাপ পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে ঢুকে পড়ে!
আশ্চর্য প্রদীপ
অরণ্য কি বোঝে মানুষের ব্যথা?
ঘন কালো পাতার অন্ধকারগুলো কেবলি মানুষের দিকে চেয়ে থাকে।
মানুষের হাত ছুঁয়ে দেয় পাতার রেখাগুলো।
তিলে-তিলে জমে-ওঠা পাতার মর্মরতা
বৃষ্টি হলে টুপ-টুপ করে ঝরে মানুষের উঠোনে।
মানুষ কি বোঝে অরণ্যের ব্যথা?
ক্লোরোফিল শুকিয়ে গেলে পাতাগুলো
শুয়ে থাকে মানুষেরই কবরে!
পাতা ও মানুষ এক হয়ে মরে মাটির গভীরে!
পাতার মৃত্যু হলে আমি তাই আশ্চর্য প্রদীপ জ্বলিয়ে রাখি।
দীর্ঘতর রাত ও একজোড়া ডানা
গত রাতের চেয়ে এই রাত অনেক কঠিন।
গত সন্ধ্যার চেয়ে এই সন্ধ্যা আরো
প্রগাঢ়তম।
গত কালের চেয়ে আজ অনেক বেশি দীর্ঘ।
আমি দীর্ঘ রাতের সামনে দাঁড়িয়ে,
একটি দীর্ঘ সেতুর দিকে ঝুঁকে।
পাতার নিস্তব্ধতা আমাকে ম্লান করে দিচ্ছে।
এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে-থেকে হয়ে যাচ্ছি দীর্ঘতর ।
আমাকে কেউ অতিক্রম করে গেলে তারও নাগালে চলে আসছি।
একটি দীর্ঘতর সমুদ্র আমার সামনে এগিয়ে আসছে।
যেভাবেই হোক আমি সাঁতার শিখে নেবো।
যে পাখিটি আমার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে তার গন্তব্য আমি জানি না।
তবুও আমার হাত তার ছায়ার মতো লম্বা হয়ে যাচ্ছে ।
আমি হাত দিয়ে সূর্যকে ছুঁয়ে দি।
আমার একজোড়া হাত ডানা হয়ে ওঠে পৃথিবীর প্রতিটি ভোরে।
পিছুটান
টেবিল থেকে জল গড়িয়ে পড়ার মতো করে
ছায়াটি যতদূর গেছে আমিও তত দূর গিয়েছি হেঁটে।
যেতে-যেতে ঘাস গজিয়েছিল মাঠে।
পাথরের ওপর একটি বকপাখি বসে উড়ে গিয়েছিল।
পেছনে যে-ছায়াটি ফেলে এসেছি সেটি ছিল অন্য কারো।
হতে পারে একটি লাঠিমের প্রতিচ্ছায়া,
যে ঘুরতে-ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে আছে। অথবা কোনো মানুষের।
আমি যদি ফিরে তাকায়,নিশ্চয় আমার চোখ অশ্রুতে ভরে উঠবে।
আমি যে শহরে পৌঁছেছি,সেখানে জানলার ভেতর দিয়ে
একটি হাত এসে আমাকে ছুঁয়েছিল।
আমি নিঃশব্দে ট্রেন থেকে নেমে পড়ি।
কিন্তু আমার ছায়া আমার সাথে
কখনই যেতে চায়নি।
তিনটি দীর্ঘশ্বাস
আমার ঘরে তিনটি দীর্ঘশ্বাস ঘুরে-ফিরে।
একটি আমার
একটি আমার শিশু’র
একটি আমার স্ত্রী’র।
আমি দীর্ঘশ্বাসগুলো কুড়িয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
ঘুমের ভিতরে একটি দেয়াশলাই জ্বালিয়ে রাখি।
তারপর দেখি দীর্ঘশ্বাসগুলো দীর্ঘতর হতে থাকে।
বড় হতে-হতে হয়ে পড়ে পৃথিবী সমান!
আমি আর ঘুমাতে পারি না।
জেগে উঠে দেখি পৃথিবীতে দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে!
তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
মৃত্যু কি অনন্ত ঘুম না দীর্ঘ আলোর টানেল?
তাদের চোখ থেকে শুধু শিশির গড়িয়ে পড়েছিল।
একটি মারবেলের জন্য
একটি মারবেল গড়াতে-গড়াতে চলে গিয়েছিল,খুঁজে পাইনি আর।
একটি পিপিলিকা ওই পথে হেঁটে গিয়েছিল
–সূর্য থেকে আলোকবর্ষ দূরে।
কেউ যেন হাত দিয়ে রোদ ঢেকে দিয়ে যায়।
নিহত নক্ষত্রের মত আমার শরীরে অন্ধকার ভরে যায় তখন।
আমি অসুস্থ মানুষ;
শিশির তলায় শেষ সিরাপটুকু খেয়ে
ঘুমিয়ে পড়ি,দেখি–
কেউ যেন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে নৈঃশব্দের ভেতর!
মনে পড়ে না–ওটা কারো ছবি ছিল কি-না।
বৃত্তের মতো দুঃস্বপ্ন আমার রাত্রিকে ঘিরে রাখে।
শহরে জ্বলছে মৃতদের চোখ।
অদৃশ্য মানুষটিকে
কেউ কি দেখেছে, তাকে ঢুকে যেতে দৃশ্যের ভেতরে?
নাকি ওই পথে সে হেঁটে গেছে আঙুলের ছাপ রেখে মাটিতে?
ভাবছি,মারবেলটি একদিন সে নিশ্চয় খুঁজে পাবে। তারপর ভাববে পিপিলিকার কথা;
মৃত্যু জেনেও এতটা দূরে সে কীভাবে চলে গিয়েছিল একটি মারবেলের জন্য!
ভোর হলে আমি একটি পাথর
ছুঁড়ে মারি সমুদ্রে।
ছেলেটি গিটার বাজিয়ে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিল
ছেলেটি গিটার বাজিয়ে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিল।
আমি তাকে চিনি না, জানি না, দেখেছি এমনও নয়।
সে একজন আচেনা মানুষ।
আমার প্রতিপক্ষ দেয়ালের ওপাশে—সরীসৃপ-বুক টেনে দাঁড়িয়ে।
আদমসুরত তাকে চেনে। অতএব, ছেলেটি আমার প্রতিপক্ষ নয়।
তবুও ছেলেটি গিটার বাজিয়ে চলছে।
আর এগিয়ে যাচ্ছে রেললাইন ধরে।
সূর্য জাগছে। পাশাপাশি মানুষ। লাল পিঁপড়ে। প্রজাপতি।
জুনিপার ভ্যেলি থেকে শ্যামল বৃক্ষ।
বৃক্ষ কি জানে ছেলেটি কেন আমাকে জাগিয়ে তোলে?
ছেলেটি গিটার বাজাল। জন্মান্ধ চোখে কেবল দেখলাম জিব্রার মতো রাত।
আজ আমি মোপাসা পড়িনি। ভীত,ত্রস্ত হয়ে বার-বার জেগে উঠছি।
শুনছি গিটারের শব্দ,বহুদুরে কু-ঝিক,ঝিক
গিটারের শব্দ… ক্রমশ মিলিয়ে যেতে লাগল দুরপাল্লার এই রেলের মতো।
কেউ কাঁদছে নিশ্চয়,আমি শুনতে পাচ্ছি ছেলেটি।
চোখ
আমার বা-পাশের একাটি চোখ,
হারিয়ে গিয়েছিল শৈশবে।
চোখটি খুঁজে পেলাম–মধ্যরাতে।
আমি যে-বাড়িতে থাকি
তার ডান পাশে আর একটি বাড়ি;
ঘোড়ার শব্দ শুনতে পাই ওখান থেকে প্রতিদিন।
চোখ,ঘোড়া,আমার কাছে মধ্যরাত
কে বেশি প্রিয় জানি না।
তবে কেবল একটি চোখ আমাকে
বাম পাশে ফিরিয়ে নিচ্ছে।
বৃষ্টি হবে—সে-বৃষ্টিতে চোখ ভিজে যাক।
তবু মধ্যরাতে ডাকবো না কাউকে।
নিজের ছায়ার ভিতর পড়ে আছি,
চোখ,ঘোড়া,আমার কাছে মধ্যরাত
কে বেশি প্রিয় জানি না।
সন্ধান
সমুদ্রের ঢেউয়ে দুটি চোখ ক্রমাগত ভাসছে।
দু’জন মানুষ কিছুক্ষণ আগে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
তাদের দৃষ্টিতে এখন যেন গভীরতম সমুদ্র।
আমি তো সমুদ্র-যুবক।
আমি জানি গভীরতম সমুদ্র মানে কী।
লাল রঙের দুঃখ।
একটা সাদা সুতু নীল হয়ে যাওয়ার মত।
ঢেউগুলোর বুকে কী ছিল জানি না।
কিন্তু কানারাজা-এর-সুরঙ্গ-এ আটকে-পড়া
সেই রাতগুলো এখনো ভুলিনি।
আমি এবং আমার লাঠিম এখনও ঘোরছে
দু’চোখের সন্ধানে।
খোঁজ
বাতি নিভিয়ে দিলাম।
পৃথিবী কি ঘুমিয়ে যাবে এখন?
দূরাগত শব্দ ভেসে আসছে আমার কানে।
কেউ সাইকেল চালিয়ে মনে হচ্ছে আরো
কাছে চলে আসছে।
পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ুক।
আমি জুতো জোড়া পায়ে দিয়ে
বেরিয়ে গেলাম আবছায়া,অন্ধকারের দিকে।
কোনো এক জাহাজের গল্প
এই ঘোর সন্ধ্যায় নিস্তব্ধতায় বুদ হয়ে আছে পরিত্যক্ত একটি জাহাজ;
মাটির ভেতরে ডুবে গেছে তার নোঙর।
সূর্যের ছায়া এসে পড়েছে তার ডেকে।
সে ছায়া যেন পলাতক ছায়া।
রাত এলে চলে যায়।
কোথায় সে ছায়া যায়?
সমুদ্র হয়তো জানে। তবুও সে বলেনি কোনো দিন।
নির্লিপ্ত আকাশের নিচে মাঝে-মাঝে
অলস দুপুর ন্যুজ হয়ে আলতু ছুঁয়ে দিয়ে জাহাজের জানালাগুলো–সেও ফিরে আসে।
জাহাজ জানে ফিরে আসা মানে,কোনো দিন ফিরে না-যাওয়া।
জাহাজের মন ভারি হয়ে ওঠে মানুষের মতো।
মানুষের মতো তার চোখে ভেসে ওঠে অতীত। চকখড়ি দিয়ে লেখা কোনো নাম।
কিন্তু প্রশ্ন,কেন সে এখানে,এই নির্জন,
জনমানবহীন পারে?
সমুদ্র হয়ত জানে,বলেনি কোনো দিন।
এভাবে না-বলা-কথা রয়ে যায় কোথাও,
কারো হৃদয়ের গভীরে।
আমি শুধু দেখি,জাহাজের জং-ধরা-জানলায় মাঝে-মাঝে
কিছু বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে সমুদ্রে চলে যায়।
জাপানি মেয়ে
(রাইওকো সাকাই-এর জন্য)
কেউ যেন ইচ্ছে করেই ভেঙ্গে দিল কাচের আয়নাটি।
টুকরো-টুকরো রোদে আমার দুর্বিনীত চোখ যেন ফুকুশিমার বিনীত রাত।
আমার মুখ অর্ধেক কালো,অর্ধেক লাল।
আমার কোটে সেই জ্যামিতিক আকারের দুঃখ।
এইসব নিঃসঙ্গতার জন্য দায়ী আমার ক্লজিট।
কেননা,টেড বেকারের এই কোটে পাঁচটি আঙুলের ছাপ থাকার কথা ছিল।
আজ দেখি কেবল চারটি আঙুল। যে একটি হারিয়েছি,
সেটা তুমিই জানো। আমি শুধু সেই আঙুলের আপেক্ষায় থাকলাম।
বিষাদ
সেই সব ঘোর বর্ষাকে তুমি পাপ ভেবেছিলে।
তুমি হলুদ ফুটটি ছুঁয়ে দেখনি—
কারণ সে দিন উত্তরায়ণের চাঁদ উবে গিয়েছিল মেঘের ভেতর।
আমি কী ভীষণ স্বপ্নহীন কাঁচের ভেতরে মাছ হয়ে আছি!
একদিন নদীতে সূর্য ডুবে গিয়েছিল বলে শিশুরা কেঁদেছিল
কিন্ত আমার স্মৃতির গভীরে শেওলার মত দুলেছিল শূন্যতা।
শিশুরা ঘুমিয়ে পড়েছিল নিরাশায় গোধূলির ভেতর।
তাদের কান্নার কোনো সুর কানে আসেনি।
যদি কোথাও কখনও তোমার কোনো ছায়া খুঁজে না পাই,
হাত খুঁজে না পাই,চোখ খুঁজে না পাই ;
জানি আমি খুঁজে পাব এক দল পিঁপড়ের বাসা।
ফণিমনসার পাতায় চিলের আঁচড়।
প্রখর রোদের তাপে শুকিয়ে যাওয়া নদীর তলানি ।
তারপর পাথরে আস্তে-আস্তে গাঢ় হওয়া রাত!
আমাকে কেউ ভালবাসেনি–নক্ষত্ররা জানে।
শিউলি তলায় মাটিতে শুয়ে আছে আমার কত ভেজা রাত্রি।
আমার বুকে নদী। নদীর পার ছেড়ে চলে যায় নৌকা–ধীরে-ধীরে,
কুয়াশার রাতে মিলিয়ে যায়।
ম্যাজিক মাস্টার কিংবা নিষিদ্ধ ফুল
ম্যাজিক মাস্টারের কথা মনে পড়ে।
তিনি কিভাবে সাপকে ফুল বানাতেন,
এখনো সেই বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি।
সবাই বলতো,বেটা আস্ত প্রতারক।
নূহের কিস্তি যদি বানাতে পারে
তবেই তাকে বিশ্বাস করা যায়।
মৃত্যুর মতো চরম সত্যকে তোয়াক্কা না-করে,
তিনি মানুষকে জীবিত করেছিলেন!তারপর
কফিনে পুরে দিয়েছিলেন মানুষের তাবৎ অবিশ্বাসকে!
আমি বালক ছিলাম বলে,
ফুলটি রেখে দিয়েছিলাম।
কিন্তু ম্যাজিক মাস্টার যেদিন মারা গেল,
মানুষ নিষিদ্ধ করে দিল ফুলটিকে!
তারপর সেইসব মানুষ প্রতিদিন প্রতিক্ষার প্রহর গুনে
কখন ফুলটি আবার সাপে পরিণত হবে!
আমি জানতাম,গভীরভাবে জানতাম,
ম্যাজিক মাস্টার কখনো মিথ্যে বানাতেন না।
তিনি শুধু বিষধর সাপগুলোকে ফুল বানিয়ে দিতেন একজন বালকের জন্য।