spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যনির্বাসন ও শহীদ কাদরী

লিখেছেন মনিজা রহমান

নির্বাসন ও শহীদ কাদরী

মনিজা রহমান

দেশ ছাড়ার অনেক আগে শহীদ কাদরী তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থে লিখেছিলেন– ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতাটি।

এই নিরুদ্দেশ যাত্রা যে দেশ ছেড়ে যাওয়া নয়, বরং সমাজের ভিতরের রুগ্নতা থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। আবার দেশ ছাড়ার আগে তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কোথাও ক্রন্দন নেই’ এ লিখেছেন–‘দাঁড়াও আমি আসছি’। পরাবাস্তব এই কবিতায় তিনি বলেছেন–

‘এখন আমি কোনোদিকেই যেতে পারছি না

সে কোন সকাল থেকে শুরু হয়েছে আমার অঙ্গভঙ্গী

আমার ডুব-সাঁতার, চিৎ-সাঁতার

উবু-সাঁতার, মৃদু-সাঁতার, মরা-সাঁতার, বাঁচা সাঁতার

হ্যাঁ, সত্যি। সাঁতার দিতে দিতেই আমার যেন বয়োবৃদ্ধি হলো,

জলের ওপর আমার কৈশোর, আমার যৌবন

কচুরিপানার মতো ভেসে

বেড়াচ্ছে কী দারুণ সবুজ!

……………………………….

দাঁড়াও, আমি আসছি…

চল্লিশ বছর পরে ‘আমার চুম্বনগুলি পৌঁছে দাও’ কাব্যে শহীদ কাদরী আবার লিখলেন ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ নামে আরেকটি কবিতা। সেই কবিতায় তিনি কৈফিয়ত দিয়েছেন কেন তিনি দেশে ফিরে যেতে পারেননি!

‘তিন তিনটি মহাদেশ থেকে

অন্তত ছয়বার উড়োজাহাজের টিকেট কিনেও

তোমাদের উঠোন পেরিয়ে

নিজস্ব আটচালার দিকে যাত্রা সাঙ্গ হয়নি এখনো!

………..

কিন্তু এই নিরুদ্দেশ যাত্রা ঘরের দিকেই-পদব্রজে,

হামাগুড়ি দিয়ে, গিরগিটি বা সাপের মতো

বুকে হেঁটে হেঁটে…।

কবি যখন বলেন, ‘কোনো নির্বাসনই কাম্য নয়’, তখন মানব জীবনের দুটি সত্য উদঘাটিত হয়। এক, মানুষের আরাধ্য নয় তার নির্বাসন, দুই, তবুও মানুষকে মেনে নিতে হয় তার নির্বাসিত জীবন। এই দুই দ্বন্দ্ব মানুষের জীবনে যে টানাপোড়েন তৈরি করে তার কোন উপসংহার নেই।

প্রকৃত বিচারে প্রতিটি মানুষই নির্বাসিত। অনস্বীকার্য যে মাতৃজঠরই মানুষের মৌলিক আবাস। সেখান থেকে স্খলনের মুহূর্ত থেকে নির্বাসনের শুরু। জীবনের বিভিন্ন স্তরে তাকে মুখোমুখি হতে হয় নির্বাসনের। ভিন্নমতের কারণে জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হওয়া সবচেয়ে কষ্টের নির্বাসন। তেমনই স্বেচ্ছা নির্বাসনের পরিণতিও শেষপর্যন্ত সচেতন মানুষের জবিনে পরোক্ষ ট্রাজেডি নিয়ে আসে।

কবি শহীদ কাদরী ছিলেন স্বেচ্ছা নির্বাসিত। দেশান্তরী হওয়ার বাইরেও আরেক ধরনের নির্বাসন শনাক্ত করা হয়েছে। এই নির্বাসন শারীরিকভাবে নয়, বৌদ্ধিক-মানসিক এবং চৈতন্যের। মানুষের যখন জীবনবোধ দৃঢ় হয়, স্বকীয় হয়, আত্ম পরিচয়ের ধারনা প্রবল হয়, নিজের চিন্তা যখন নিজস্ব হয়, তখন অন্য মানুষের সঙ্গে সাথে তার দূরত্ব বাড়তে থাকে। এটাও এক ধরনের নির্বাসন।

নির্বাসনের ধারণা এসেছে মানুষের একাকীত্ব থেকে এবং মানুষ শেষ পর্যন্ত একা। তারা সম্মিলিতভাবে হাসতে ভালোবাসে। কিন্তু কাঁদতে চায় একা, একাকী, আড়ালে। এই একাকীত্বই নির্বাসন। শহীদ কাদরী বলেন–

‘কোনো নির্বাসনই কাম্য নয় আর

ব্যক্তিগত গ্রাম থেকে অনাত্মীয় শহরে

পুকুরের যৌথ স্নান থেকে নি:সঙ্গ বাথরুমে…’।

কাম্য না হলেও কবিকে এই নির্বাসন মেনে নিতে হয়েছিল। তিনি নাগরিক কবি হওয়া সত্ত্বেও ‘পুকুরের যৌথ স্নান’ যখন তিনি ফিরে পেতে চান, বোঝা যায় তিনি নস্টালজিয়া বা স্মৃতিকাতরতা দ্বারা তাড়িত। স্মৃতিকাতরতা নির্বাসনের একটি অনুষঙ্গ। অস্তিত্ববাদের মূলেও রয়েছে একাকীত্ব। দুটি মানুষ একসঙ্গে থাকলেও আসলে তারা দুটি মানুষ। তাদের চিন্তা-চেতনা, বেদনাবোধ, আনন্দের অনুভূতি একরকম নয়। মূলত যে বোধটি তাকে নিজের মতো করে বাঁচতে শেখায়, সেই বোধটি আনন্দের নয়, বেদনার।

শুধু লেখক বা শিল্পীর জন্যে নয়, মানুষের জীবনের অন্যতম সত্যি তার অতৃপ্তিতে। এই অতৃপ্তি তাকে অতীতকে ভালোবাসতে শেখায়। এই অতৃপ্তি তাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা যোগায়। শহীদ কাদরীর মতো স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলেন না জীবনানন্দ দাশ। তিনি পথচলাকেই আরাধ্য করেছিলেন। সেই পথ ছিল ভারতবর্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন–‘সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে/ অনেক ঘুরেছি আমি; আরো দূর অন্ধকার বিদর্ভ নগরে।)

কিন্তু শহীদ কাদরী তিনটি মহাদেশ ছুঁয়েছেন (তিন তিনটি মহাদেশ থেকে/ অন্তত ছ’বার উড়োজাহাজের টিকেট কিনেও…)।

জীবনানন্দ দাশ মেনেছেন– ‘সব পাখী ঘরে আসে/ সব নদী/ ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন’। শহীদ কাদরী এখানে সংশয়াক্রান্ত। তিনি জানতেন তার আর ঘরে ফেরা হবেনা। তিনি যখন বলেন :

‘বৃষ্টিশেষের সন্ধ্যাবেলায় এই যে আমি একা একাই

গাছতলাতে দাঁড়িয়ে আছি।

তোমার মতোন আমি কি তাই বলতে পারি–

‘যাচ্ছি বাড়ি’।

………………………………………

ঘর ছেড়ে যে বেড়িয়ে গেছে তার থাকে না/ ঘরবাড়ি।

মাত্র ষোল বছর বয়সে একটি নিবন্ধ লিখে স্কুল থেকে বহিস্কৃত হবার আশংকায় পড়েছিলেন বার্টাল্ট ব্রেখট। কিন্তু পিতাসহ অন্যদের চেষ্টায় তিনি রক্ষা পান। ব্রেখট লিখেছিলেন, ‘An empty headed person could be persuaded to die for their country.’ হিটলারের নির্যাতনের ভয়ে তিনি জার্মানি ছাড়েন ১৯৩৩ সালে। ততদিনে তিনি খ্যাতির শীর্ষে। শিল্পী ম্যাক্স আর্নস্টও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মানি ছাড়েন। দলে দলে লেখক ও শিল্পীরা আত্মরক্ষার্থে বিশেষ করে আমেরিকাতে আশ্রয় নেন। কেউ থেকে যান চিরতরে। কেউ ফিরে যান জন্মভূমিতে। কিন্তু এই লেখক ও কবিদের মধ্যে নতুন এক মনস্তত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। নির্বাসনের কারনে একজন লেখকের বা শিল্পীর মনোজগতে যে ব্যাপক ভাঙ্গচুর হয়, তার প্রতিফলন লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। এই নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে।

পাশাপাশি কবি ও লেখক নির্বাসনের ভয়ে দেশ ছাড়া না হলেও নিজ দেশে থেকেই মনোস্তত্ত্বে নির্বাসন ধারণ করেন। তার অনুরণন দেখা যায় তাদের সৃষ্টিকর্মে। অন্যদিকে ‍পৃথিবীজুড়েই লাখ লাখ মানুষ স্বেচ্ছায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন নানা কারণে। এদের মধ্যে যারা লেখক-শিল্পী তাদের মনোজগতে নতুন এক ধারণা তৈরী হয়। কখনও সেটা ছেড়ে আসা দেশের জন্য আহাজারি, কখনো দেশে ফিরে যাবার আকুতি। এই সবই তখন হয়ে ওঠে তাদের লেখার বা শিল্পকর্মের বিষয়বস্তু।

বের্টল্ট ব্রেখট সেই কৈশোরের দেশ-অপ্রেম বিষয়ক বিতর্কিত দারণায় শেষ পর্যন্ত মনস্থির ছিলেন কিনা সেটা বলা না গেলেও, তার বিখ্যাত ও জনপ্রিয় নাটকে সেটা দেখা যায়নি। কিন্তু দেশত্যাগী লেখকদের মধ্যে দুটি ধারা বেশ প্রবল। একটি হলো দেশ থেকে যতদূরে যাক, দেশ তাকে টানে। আরেকটি হলো ধীরে ধীরে দেশ অপসৃয়মান হতে থাকে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার কারণে।

নির্বাসনকে পশ্চিমা মনীষীরা পরিত্যক্ত করেননি। বরং নগরসভ্যতার এই কালে তাকে আধুনিক মননশীলতার অনুসঙ্গ করেছেন। জ্যাকসন পোলক সেই অর্থে নির্বাসিত না হলেও তাঁর চিত্রকর্মকে নির্বাসিত মননের যথার্থ প্রতিফলন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই সব চিত্রকর্মের কোন পার্সপেকটিভ নেই, আছে সর্বজনীনতা। এঁকেছেন হোরাইজেন্টালি, কিন্তু ভার্টিকালি দেখলেও এর ইন্টার প্রিটেশনে কোন সমস্যা হয় না। শুরুতেই যেভাবে বলেছি নির্বাসনের সূচনা মাতৃজঠর থেকে স্খলন, জ্যাকসন পোলোকের চিত্রকর্ম যেন সেই আমৃত্যু আজীবনের চেতনাকেই ধারণ এবং পাশাপাশি নির্বাসিত শিল্পী ম্যাক্স আর্নস্ট ঘরে ফিরে যেতে চান। চান নির্বাসিত জীবনের সমাপ্তি। তার চিত্রকর্মেও তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। যেমনটি শহীদ কাদরীর কবিতায় আমরা পাই। 

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ