সাজ্জাদ বিপ্লব
……
কবি ও কবিতা নিয়ে মহাকবি জীবনানন্দ দাশ যে বই লিখেছিলেন,কবিতার কথা, এবং তাঁর চিঠিপত্রে উল্লেখিত কবিতা বিষয়ক অকাট্য মন্তব্য ও মতামত আজো সোনার অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে আমাদের সাহিত্যে।
একালে কোন জীবনানন্দ দাশ নেই। কিন্তু একজন আল মাহমুদ আছেন। আমরা ভাগ্যবান। বিশেষকরে, আমি। আমার কবিতাজীবনে তার অসামান্য অবদান ও তার প্রতি আমার ভালোলাগা, ভালোবাসা, এক জীবনে ফুরাবে বলে মনে হয় না।
বিষয়টি এভাবে ব্যখ্যা করা যায় : আমি আল মাহমুদ পড়ে সেই যে ভক্ত, অনুরক্ত ও আসক্ত হয়েছি। তা, প্রতি পদে-পদে অনুভব করি।করছি।
কবিতার মতো আল মাহমুদের যে কবিতা সংক্রান্ত দার্শনিক অমোঘ কিছু বাণী, বিশ্লেষণ ও উক্তি আছে। আমরা কি জানি?
ধরা যাক, তার, কবির সৃজনবেদনা, প্রবন্ধের এই উচ্চারণ : “কাব্য কোনো সময়েই কোনো প্রতিযোগিতার ব্যাপার ছিলো না। ঈর্ষার ব্যাপার ছিলো না।ছিলো আনন্দের বিষয়।ভবিষ্যতেও তাই থাকবে।প্রকৃত কবিরা রাবারের স্যান্ডেল পরে।খদ্দরের জামা গায়ে দিয়ে ভাঙা সুটকেস নিয়ে চিরকালই শহরের দিকে যাত্রা করেন।আর ফিরে যান না (শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা ৮১)।
এই যে কবির উঠে আসা। আলাদা স্থান দখল করা।সমকালে যায়গা করে নেওয়া।এটি তো সব প্রকৃত এবং প্রতিষ্ঠিত এবং খাঁটি কবিদের জীবনের বর্ণনা নয় কি? আমরা সবাই (অধিকাংশ-ই) কি মফস্বল থেকে উঠে আসিনি? ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়িনি শহরে-শহরে।ঢাকা-কলকাতা-লন্ডন-প্যারিস-বন-নিউইয়র্ক-সিডনী-টোকিয়ো ইত্যাদি আধুনিক নগরে?
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম ঘুর্ণনে কেউ-কেউ প্রকৃত কবিগুণের, কবিকণ্ঠের অধিকারী হয়েও থেকে যান, অনাদরে, অবহেলায়।অপ্রকাশ্যে। প্রচার-প্রোপাগান্ডার বাহিরে। তাদের যায়গা তখন সাময়িকভাবে চলে যায় অকবিদের বেদখলে।
এতে অবশ্য প্রকৃত কবিদের কোনোই লাভ কিম্বা ক্ষতি হয় না। তারা তাদের কাজ করে যান নিভৃতে, নীরবে।
যেমনটি করে গেছেন, বগুড়ায় : কবি আতাউর রহমান, সিলেটে: কবি দিলওয়ার, যশোরে: কবি আজীজুল হক, পাবনায় : কবি ওমর আলী প্রমুখ। এরা সকলেই পঞ্চাশের শক্তিমান কবি।সকলেই স্বীকৃত। প্রকৃত কবিতাপ্রেমী পাঠক এবং গবেষক এদের ঠিক-ঠিক স্মরণ রাখবে, মূল্যায়ন করবে।
পঞ্চাশের কবিদের নাম উচ্চারিত হলে যাদের মুখ ভেসে আসে, এদের মধ্যে হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, সাইয়ীদ আতীকুল্লাহ, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু হেনা মুস্তফা কামাল, মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আবদুস সাত্তার, আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দীন, আবু জাফর মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ, ফজল শাহাবুদ্দীন, সৈয়দ শামসুল হক, দিলওয়ার, আজীজুল হক, ওমর আলী, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী প্রমুখ অন্যতম।
পঞ্চাশের এই কবিদের কেউই আজ জীবিত নেই । তারা স্বশরীরে বেঁচে থাকুন বা না থাকুন, তাদের সৃষ্টি তাদের হয়ে কথা বলবে, বলে, যুগ-যুগ ধরে। এটি-ই প্রকৃতির নিয়ম।
কবি ওমর আলীও তেমনি একজন প্রকৃত ও খাঁটি কবিকণ্ঠ, যিনি বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে মিশে আছেন নিবিড়ভাবে।
এদেশ যতোদিন বাঁচবে, বাংলাভাষা এবং ভাষা-ভাষী মানুষজন যতোদিন বাঁচবে, ততোদিন তিনি বেঁচে থাকবেন তার কবিতার মধ্য দিয়ে।
ওমর আলী’র কবিতার একটি প্রধান এবং ব্যতিক্রম বৈশিষ্ট্য, তিনি অনেক যায়গার-স্থানের নাম এবং মানুষের নাম অনর্গল বলে যান তার কবিতায়। তার কবিতায় বাংলাদেশ এবং এ দেশের মানুষ ও প্রকৃতি মিলে-মিশে একাকার হয়ে যায়। অসংখ্য কাব্যগ্রন্থের জনক এই কবি’র গ্রন্থনামগুলি লক্ষ্য করলে পাঠকগণ চকিতেই বুঝে যান তিনি প্রেম ও প্রকৃতির কবি।
….
ওমর আলী’র কয়েকটি কবিতা
……
এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি
…..
এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি
আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসি মাখা;
সে নাকি স্নানের পরে ভিজে চুল শুকায় রোদ্দুরে,
রূপ তার এদেশের মাটি দিয়ে যেন পটে আঁকা ।
সে শুধু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে হরিণীর মতো
মায়াবী উচ্ছ্বাস দুটি চোখ, তার সমস্ত শরীরে
এদেশেরই কোন এক নদীর জোয়ার বাঁধভাঙা;
হালকা লতার মতো শাড়ি তার দেহ থাকে ঘিরে ।
সে চায় ভালোবাসার উপহার সন্তানের মুখ,
এক হাতে আঁতুড়ে শিশু, অন্য হাতে রান্নার উনুন,
সে তার সংসার খুব মনে-প্রাণে পছন্দ করেছে;
ঘরের লোকের মন্দ-আশংকায় সে বড় করুণ ।
সাজানো-গোছানো আর সারল্যের ছবি রাশি রাশি
ফোটে তার যত্নে গড়া সংসারের আনাচে-কানাচে,
এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর এ ব্যাপারে খ্যাতি;
কর্মঠ পুরুষ সেই সংসারের চতুষ্পার্শ্বে আছে ।
…..
আমি কিন্তু যামুগা
……
আমি কিন্তু যামুগা। আমারে যদি বেশি ঠাট্টা করো।
হুঁ, আমারে চেতাইলে তোমার লগে আমি থাকমু না।
আমারে যতই কও তোতাপাখি, চান, মণি, সোনা।
আমারে খারাপ কথা কও ক্যান, চুল টেনে ধরো।
আমারে ভ্যাংচাও ক্যান, আমি বুঝি কথা জানিনাকো।
আমার একটি কথা নিয়ে তুমি অনেক বানাও।
তুমি বড় দুষ্টু, তুমি আমারে চেতায়ে সুখ পাও,
অভিমানে কাঁদি, তুমি তখন আনন্দে হাসতে থাকো।
শোবোনা তোমার সঙ্গে, আমি শোবো অন্যখানে যেয়ে
আর এ রাইতে তুমি শুয়ে রবে একা বিছানায়,
দেখুম ক্যামন তুমি সুখী হও আমারে না পেয়ে,
না, আমি, এখনি যাইতেছি চলে অন্য কামরায়।
….
এখন পালাও দেখি
……
এখন পালাও দেখি! বন্ধ করে দিয়েছি দরোজা!
এ রাত্রিতে, আমার দু’হাত থেকে পারো না পালাতে।
বরং সেটাই মেনে নেওয়া ভালো, যা নির্ঘাত সোজা।
আমার আলিঙ্গনে বেঁধে থাকো এ সুন্দর রাতে।
মিছেমিছি কেন তুমি রাগ করে চলে যেতে চাও!
বেশ তো, আমার সাথে আজ রাতে কথা বলবে না।
হয়েছে তোমার রাগ, আলাদা কি হবে বিছানা?
অন্যখানে শুতে যাবে, কিছুতেই হবে না, হবে না!
চামেলী, মালতী আর রজনীগন্ধার সুরভিতে
তোমার বিত্ত্বল দেহ, সে সুরভি সারা ঘরময়,
আর সে সুরভি যেন কেঁপে ওঠে তোমার নীবীতে।
রাত্রিতে তোমাকে ছেড়ে একা থাকা…বড় কষ্ট হয়!
হে অভিমানিনী, আমি অসহায়, বড়ই কাতর,
প্রেয়সী, মিষ্টি হেসে ক্ষমা করো, তুমি নও পর।
আটলান্টা, জর্জিয়া।