spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদবই নিয়েএবাদতনামা : নতুন কবিতাপথের যাত্রাবিন্দু

লিখেছেন : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ

এবাদতনামা : নতুন কবিতাপথের যাত্রাবিন্দু

আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ 

ফরহাদ মজহার ষাটের দশকের কবি। তার উত্থান ষাটের দশকে কিন্তু বিকাশ ও পরিণতি ষাটের পরবর্তী দশকগুলিতে। তিনি দার্শনিক, চিন্তক বুদ্ধিজীবী এবং ‘ভাব’ আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। এগুলো কবিতার জন্য অপরিহার্য কিছু নয়, কিন্তু আমরা যদি পৃথিবীর বড় বড় কবি সাহিত্যিকদের দিকে তাকাই যেমন এলিয়ট, ইয়েটস, সীমাস হিনি, পাবলো নেরুদা, মাহমুদ দারবিশ, এডোনিস, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ কিংবা আল মাহমুদ– তাহলে দেখতে পাই তারাও দার্শনিকতা বা চিন্তার তূরীও অভিজ্ঞতাকে কবিতায় সাফল্যের সাথে অঙ্গীভূত করতে পেরেছেন। বাংলাদেশের কবিতা ইতিহাসে ফরহাদ মজহার শক্তিশালীরূপে ও স্বাভাবিকভাবে এইসব এলিমেন্টস ব্যবহার করতে পেরেছেন, বিশেষ করে আমার আলোচ্য বই এবাদতনামায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী  দশক হলো ষাটের দশক। এই ষাটের দশক নানা কারণেই স্মরণীয় আবার মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সত্তরের দশক– এটিও নানান অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক রাজনৈতিক কারণে অনন্য। তার সাথে যোগ হয়েছে ভেঙে পড়া আর্থ-সামাজিক অবস্থা, দ্রুত তালে গড়ে ওঠা -সামাজিক শ্রেণীকরণ, ক্ষমতার পালাবদল। এইগুলো আমাদের কবি সমাজকে আক্রান্ত করেছে বেশি। কবিরা তো সমাজেরই সৃষ্টি, তাদের চিন্তা ভাবনা শূন্য থেকে আসে না, সমাজের চারপাশ থেকেই আসে। ষাটের দশকের অন্যতম কবি– আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবুল হাসান, রফিক আজাদ নির্মলেন্দু গুন এবং অবশ্যই– ফরহাদ মজহার। সত্তর ও আশির কিছু সময় ফরহাদ মজহার উচ্চ কন্ঠের কবি। কিন্তু তার রাজনৈতিক প্রস্তাব-ভাবনা কবিতায় নির্মলেন্দু গুণেরর চেয়ে ভিন্ন রকমের। গুণ কবিতায় ব্যক্তিগত বিপ্লবকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন নাই। ফরহাদ সমাজ ও ইতিহাসের ভেতরে থেকে যুগপৎ ব্যক্তি ও ‘যুথবদ্ধ’ সামষ্টিকতাকে বর্তমান ও ভবিষতের সাথে মিশিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। এতদসংক্রান্ত তার কবিতার বই ‘খোকন এবং তার প্রতিপুরুষ(১৯৭২)’ উল্লেখযোগ্য। তারপর আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শুরু করি ১৯৮২/৮৩ সালের দিকে, তার এরকম আর একটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ বের হয়– ‘আমাকে  তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিপ্লবের সামনে’ নামে। অনেকেই জানেন যে আশির দশকে, বাংলাদেশে কবিতা সাহিত্যে কবিতাকে কবিতার কাছে ফিরিয়ে আনার জন্য একটি দশক হিসাবে কেউ কেউ মনে করে। তো সেই সময়ে আমরা এই বইয়ের নামে দেখে এর কন্টেন্ট ও ভাষাযোগ বলে দিতে পেরেছিলাম। এই বইতে ফরহাদ তার স্বভাব সুলভ বিপ্লবী ও  ইতিহাস চেতনা কবিতায় ব্যবহার করেছেন। এভাবে আমরা পাই ‘মেঘ মেশিনের সংগীত (১৯৮৮)’। কিন্তু আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো দুটি বছর- তার কাব্যগ্রন্থ ‘এবাদতনামা’ পাইতে। ১৯৯০ সালে আমার মনে আছে আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ ধাপে পড়ছি। এমন সময় পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারি এই বইয়ের খবর। নাম শুনেই চমকে উঠেছিলাম। নব্বইয়ের দশকে এরকম নামে শুনি নাই। এ যেন একটা নাম বিদ্রোহ। এই কবিতা বইয়ের মাধ্যমে কবি ফরহাদ মজহার তার সমসাময়িক কবিদের কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা হয়ে পড়েছেন। কন্টেন্ট, ফর্ম, লেঙ্গুয়েজ সবদিক থেকেই এই বইয়ের কবিতাগুলি ভিন্ন ঘরানার। এ যেন বাংলা কবিতায় একটা নতুন কবিতাভাবনা। ইসলামিক বিশ্বাস কিন্তু আবার পর মুহূর্তেই প্রশ্ন আর অবিশ্বাসের দ্বান্দিকতায় তিনি এমন একটি কাব্য জগৎ সৃষ্টি করলেন যা আগে কখনো ছিলো না। চিন্তা ও ভাবের এরূপ নতুন প্রকাশ তার সমসাময়িক কবিদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় নি। একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস কেন্দ্রিক জীবন যাপন, তাদের সংষ্কৃতি, চিন্তা কাঠামোকে ব্যক্তিগত এবাদত ও না-এবাদতে, একটি  ফরহাদীয় ভাষায় গেথে তুলেছেন। যদিও এর কন্টেন্ট ও লেঙ্গুয়েজে বিশুদ্ধ মুসলমানি বিশ্বাস ও আক্বিদাকে দেখা যায় না, তবু বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের বাইনারি সেলিব্রেশন আমাদেরকে টেনশনে ফেলে দেয়, আমাদেরকে বারবার অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। সাথে সাথে কবিতা আস্বাদের তীব্র কামনাও বাড়তে থাকে।

দুই

না আমি কামেল নই, নই এহতাকাফের বিড়াল

আমি কবি: বৃক্ষতলে চোর কিংবা বাদামভিখারি।

(এবাদতনামাঃ ২)

কবিতা বইয়ের নাম ‘এবাদতনামা’। কবির নাম ফরহাদ মজহার। ৯০ দশকে প্রকাশিত অন্যতম কবিতার বই এটি। বইটির ইউনিক বৈশিষ্ট্য এর ধর্মীয় (মুসলমানি) থীম– এবাদত। ষাট, সত্তর বা আশি এমনকি আমার দশক- নব্বইয়ের দশকেও এরকম নাম শোনা যায় নি। বাঙ্গালি ভাষাভিত্তিক হার্ডকোর জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে এ যেন একটি বিশেষ নামফলক- ভাষাপ্রতিবাদ। বস্তুত বাংলা কবিতায় এরকম একটি ইসলামিক নাম কবিরা ব্যবহার করতে পারে তা তখন পর্যন্ত ভাবা যায় নি। সে জন্য কবির বাহবা প্রাপ্য।

বাংলা কবিতায় ‘এবাদত’ এর সার্থক ব্যবহার(পজিটিভ অর্থে) এর আগে একবারই হয়েছিল- রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’তে। তবে এই দুই বইয়ের থীমের মধ্যে পার্থক্য আকাশ পাতাল। কারণ ‘গীতাঞ্জলি’ এক আস্তিক কবির গান আর এবাদতনামা এক কমিনিউনিষ্ট কবির গান, যিনি সহজে  ধর্মীয় বিধানে আস্থা রাখতে বা ইমান আনতে চান না। তাই এর প্রধান থীম হয়ে যায় কবির আত্মস্বীকারোক্তিমূলক, দ্বন্দ্বমুখর ডিস্কোর্স- সৃষ্টিকর্তা ও তার ঐশী বিধি বিধানের সাথে। যার ফলে ‘এবাদতনামা’ কবিতার স্তরে স্তরে কবির প্রশ্নমুখর, বিদ্রোহী (রেবিলিয়াস) সত্তা বের আসছে বারবার। এই বইয়ের আর একটি শক্তি ফরহাদীয় বিচিত্র ডিকশন যা তার জ্ঞান, দর্শন, বিশ্বাস/অবিশ্বাস, পছন্দ, জীবনাচরণ থেকে উঠে আসছে বলে মনে করি। এবাদত তথা ইসলামিক সঙ্গ অনুষঙ্গ যেমন আল্লাহ, নবী, রাসুল, নামাজ ইত্যাদির সাথে সাথে এসেছে আরো কতো বিবিধ বিচিত্র অনুষঙ্গ। এসেছে- রবীন্দ্রনাথ, বিনয় মজুমদার, শ্রীরাম, গৌরাঙ্গ, নিমাই পণ্ডিত, রাধিকা, ছেউরিয়া, দেকার্ত ইত্যাদি। আরো এসেছে বাঙ্গালির আধুনিক ও লোকজ জীবন, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ, অর্থনীতি ইত্যাদির ছায়াঅনুসঙ্গ ।

কবিতার বইয়ের নাম ‘এবাদতনামা’। তাই সর্ব প্রথমে প্রশ্ন জাগে কোন ধরণের এবাদতের কথা বলছেন কবি? আমরা জানি ‘এবাদত’ একটি আরবি শব্দ। এবাদত শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো চূড়ান্ত বিনয়, আনুগত্য ও বশ্যতা। ইসলামিক পরিভাষায় বলা যায় প্রকাশ্য কিংবা গোপনীয় যতসব কথা ও কাজ আল্লাহ ভালোবাসেন ও পছন্দ করেন, সে সবের একটি সামষ্টিক নাম হলো এবাদত। কিন্তু আমরা ফরহাদ মজহারের এবাদতনামায় দেখি এবাদতের ইসলামিক পারিভাষিক অর্থকে মিসইন্টারপ্রিট করা হয়েছে। মানে কবির দেয়া নামটি আসলে নেগেশন অব এবাদত, ইসলামিক পারিভাষিক মিনিংকে অপোজিট কোনোটেশন দেয়া হয়েছে। এবাদত থেকে আবিদ মানে বান্দা কোনো রকমের অবিশ্বাস, সন্দেহ বা প্রশ্ন ছাড়াই এক আল্লাহর এবাদতে মশগুল। কিন্তু কবি এবাদতনামায় আল্লাহর সাথে এরকম মালিক-আবদ(গোলাম) কোনো সম্পর্ক গড়েন তোলেন না। উপরন্তু তিনি তার অবিশ্বাস, গাফলতি, ফাসিকি(রেবিলিয়াসনেস) নিয়ে একা  আল্লাহর সাথে বোঝাপড়ায় আসছেন, ডিস্কোর্স করছেন। এমনকি তার এই রেবিলিয়াসনেস নিয়ে তিনি অহংকারবোধও করছেন।

বিশ্বাসে ইমান নাই তদুপরি তুমিও মালিক

বুদ্ধি দিয়েছো ঠিকই, অথচ খাটালে বুদ্ধি ভাবো

মস্তিষ্কে আসর করে বেতমিজ দুষ্ট ইবলিশ

ফাঁপরে পড়েছি মাওলা কী বা করি কোন রাহে যাই।

(এবাদতনামা- ১১)

কবি বইয়ের শুরুতেই বলছেন তিনি এবাদত করেন তার বুদ্ধিকে, যুক্তিকে(উৎসর্গ পদ্য, এবাদতনামা : ১১)। মানে তার এবাদত হলো তার ইন্টেলেক্ট। এটিকে একটি  করুণ আইরনি বলা যায় কারণ তিনি যে ইন্টেলেক্টের কথা বলছেন, সেই ইন্টেলেক্ট কিন্তু আল্লাহর সৃষ্টি রহস্যেরই অংশ- তাঁকে বোঝার জন্য, তাঁর কাছে সাবমিট হওয়ার জন্য। সুতরাং এবাদত বলতে আমরা যা বুঝি তা এখানে  নাই, তার বদলে আমরা পাবো এক কমিউনিষ্ট কবিকে (ম্যায়বি নাস্তিক!) যিনি তার তার এবাদত আল্লাহকে করতে নারাজ (এবাদতনামা ৫, ৮ ১৬, ৯৬)। অবশ্য এটি বলে কবি সাহস ও শক্তির পরিচয় দিয়েছেন, বলা যায় এটি কবির সততা। তিনি তার অবিশ্বাস, তার সন্দেহ,  তার অসস্থি ঢেকে রাখেন নি। তাই আমার মনে হয় এই কবিতার বইটির নাম ‘এবাদতনামা’ রাখা কবির নামগত ফ্যালাসি বলা যায়। তার বদলে ‘অভিযোগনামা’ বা ‘বিদ্রোহনামা’ এরকম কিছু রাখলে মানানসই হতো বলে মনে করি।

বইয়ের বিভিন্ন কবিতায় কবিকে দেখা যায় কবি নিজেকে একই সাথে হিন্দু ও মুসলমান মনে করছেন। তিনি ইন্টেলেক্টচ্যুয়ালি শ্রেণীবিভেদ তথা আল্লাহর এবাদতে জাতপাত ও ধর্মের ব্যবধান ঘুচাতে চাইছেন। এতে তার  ওপেননেস বা উদার মন মানসিকতার পরিচয় পাওয়া গেলেও, তার ধর্মীয় আডেনটিটির (যদি তিনি সত্যিকার অর্থে একজন বিশ্বাসি হয়ে থাকেন) আক্বিদাগত বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা যায়। তাই তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না যে একজন আবিদের আল্লাহকে বোঝার প্রথম রাস্তা হলো তার সঠিক ইমান মানে আল্লাহর তাওহীদে বিশ্বাস স্থাপন, তারপর আল্লাহর বিধি বিধানকে লালন ও পালন। কোরান, হাদিস, সালাত আর মসজিদ ছেড়ে নদীয়ার ভাবান্দোলন, নিত্যানন্দ, গৌরাঙ্গ বা ছেউরিয়ায় লালন শাহর মাজারে সাধুসঙ্গে জীবনের অর্থ বা আল্লাহকে তালাশের মধ্যে তার ইমানের দুর্বলতা অর্থাৎ তাওহীদ সম্পর্কে জ্ঞান বা জানার গাফিলতি, উন্নাসিকতাই বোঝায়। এটিকে  ফরহাদ মজহারের অনিচ্ছাকৃত ভুল হওয়ার করার কারণ দেখি না, যেখানে জানি তিনি বাংলাদেশ এবং এই উপমহাদেশের একজন প্রথম সারির বুদ্ধিজীবী এবং কালচারাল ও পলিটিক্যাল ইসলামের প্রতি তার একটি সফট কর্নার আছে। এমন হতে পারে তিনি এবাদতনামা লেখার সময় জ্ঞানের একটি ভিন্ন প্যারাডাইমে বাস করতেন। তিনি বলছেন ‘আমি হিন্দু ঘোর পৌত্তলিক’ (এবাদতনামা : ৮৪) যা একান্তই একটি এন্টি ইসলামিক জ্ঞানকথা। কারণ তাওহীদ এক আল্লাহতে বিশ্বাস ও এবাদত বোঝায়। তার বিপরীতে অবস্থান করে ফিজিক্যাল ও মেন্টাল পৌত্তলিকতা, যার অস্বীকার ইসলামের মূল ম্যাসেজ।

ফরহাদ মজহার কবিতার মধ্যে রহস্য রাখেন না তার কবিতার স্বর অধিকাংশ সময়ই এক্সট্রোভাট। তিনি পরাবস্তবতা বা প্রতীকবাদী কবিও নন। তিনি প্রচণ্ড রকমের সমাজ ও রাজনীতি সচেতন কবি। এই বইয়ের প্রায় প্রত্যেক কবিতাই কোনো না কোনোভাবে ব্যাক্তিগত টপিকের আড়ালে সামাজিক বা রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে হাজির হয়েছে। তবে এই বইয়ের কিছু কবিতা আলবৎ আছে যা রহস্যখোঁজা কবিতাপিয়াসি মনের খোরাক জোগাবে নিশ্চিত। এমন একটা কবিতার নাম ‘বৃক্ষতলে চোর কিংবা বাদামভিখারি’। চমৎকার এই কবিতাটিতে কবি কাঠবিড়ালি এবং চোর বা বাদামভিখারির প্রতীকে মানুষের দুটি পরস্পর বিরোধী সত্তাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। কাঠবিড়ালি এহতাকাফে অর্থাৎ এবাদতে বসেছেন। তার ধ্যানে, মনে শুধু তার সৃষ্টিকর্তা, দুনিয়ার কিছুই তাকে ধ্যানমুক্ত করাতে পারছে না। এ এক অপূর্ব, মনোহর দৃশ্য। কবি এহতেকাফি বিড়ালের চারিদিকের আবহ যেভাবে সৃষ্টি করেছেন তা তুলনারহিত।

‘মাসুম বিড়ালি…বুদ্ধের মতো এসে বসে শিকড়ের মূলে।

তারপর চলে ধ্যান, মাঝে মধ্যে উঁচু ডাল থেকে

নিজের মর্মের ভারে ঝরে যায় সুন্দরী বাদাম

ভেতরে সফেদ শাঁস; ঊর্ধলোকে কোথাও জান্নাতে

এইসব স্বাদু ফল ফেরেস্তার মাখনে প্রস্তুত।

কিন্তু কবি তাতেও ভারাক্রান্ত হচ্ছেন না, ঘটছে না তার কনক্রিট ইন্টেলেক্টের পরিবর্তন। শেষ পর্যন্ত তার আদি ও অনাদি ঘোষণা একই থাকে :

না আমি কামেল নই, নই এহতাকাফের বিড়াল

আমি কবি : বৃক্ষতলে চোর কিংবা বাদামভিখারি।

তিন

কবির বিশ্বাস অবিশ্বাস কবির নিজস্ব জ্ঞানকাঠামোর বিষয়। কবি স্বাধীন, তার বিষয়-আশয় তার পছন্দের। এতে আমাদের করার কিছুই নাই, আমরা সাধারণ পাঠক হিসাবে কেবল তার কবিতাকে মূল্যায়ন করতে পারি। যদিও আজকাল সাহিত্য বিচারে লেখকের ব্যক্তিগত জীবন, তার আদর্শ, রাজনৈতিক বিশ্বাস কেউ কেউ বদ উদ্দেশে ব্যবহার করেন। এ ক্ষেত্রে এবাদতনামার কবি বলা যায় পাশ নাম্বার পেয়ে গেছেন শতভাগ। কারণ এই বইয়ের কবিতাপাঠ একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা বটে, বাঙ্গালি পাঠক এ ধরণের ডিস্কোর্স, এবাদত ও না-এবাদতের মুখোমুখি এর আগে কখনো হয় নি। এই বইয়ের বিরাট সম্পদ এর ফরহাদীয় বুদ্ধিদীপ্ত কাব্যভাষা, এর থীম যেন আধুনিক মানুষের দ্বন্দ্বমুখর মনের ট্রাজিডি– রাব্বুল আলামিন– সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তাকে না বোঝার  বিয়োগান্তক মহাকাব্য। এবাদতনামায় তিনি বরাবর তার নিজস্ব উপস্থাপন ভঙ্গিমায় নিজেকে জাহির করেছেন, তবে কোনো জায়গায় আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে আল মাহমুদের সোনালী কাবিনের কথা। তিনি টেকনিক হিসাবে সোনালি কাবিনের ফর্ম ও সনেটকে অবলম্বন করেছেন। কিন্তু তার ভাব আর বক্তব্যকে প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি আল মাহমুদের অনেক ডিকশন ও কথনের  স্টাইল ছায়ার মতো ধরে রেখেছেন। (এবাদতনামা : ৪)। তাতে অবশ্য এর মৌলিকত্ব এতোটুকু কমে যায়নি কারণ ফরহাদীয় কাব্যভাষা মন মগজ হয়ে পাঠকের মনে মায়াজাল নয়, পাঠকক একটি চ্যালেঞ্জের ভেতর ফেলে দেন, যা থেকে মুক্তি ঘটে কেবল বুদ্ধির মুক্তির মাধ্যমে।

কবিতা কী ? কবিতা হলো কবিতার ইতিহাস- এরকম বললে কবিতাকে সম্পূর্ণভাবে ধরা যায় না। দর্শন কী ? দর্শনের ইতিহাস– ঠিক আছে, কিন্তু কবিতা যেহেতু সরাসরি ইতিহাসের কথা বলে না বরং কবিতা বর্তমানে দাঁড়িয়ে অতীতের কথা বলে, ভবিষতের কথা বলে, স্বপ্ন, দ্রোহ, প্রেম, বিরহ, আশা নিরাশার কথা বলে, যা দেখা যায় না তার কথা বলে। তাই কবিতা হলো কবিতার ইতিহাসের সাথে চিন্তা ও ভাষা পরিবর্তনের ইতিহাস। শিরোনামে আমি বলছিলাম ‘এবাদতনামা নতুন কবিতা পথের যাত্রাবিন্দু।‘ অনেকেই জানেন আমি নিজে কবিতা লিখি, আমি খুব বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছি যে বাংলা কবিতা বিশেষ করে বাংলাদেশের কবিতা একটা খাদে আটকে আছে।  সেই উনিশ শতকীয়  উচ্চ বর্ণের হিন্দু বাঙালির সংস্কৃতি ও তার থেকে প্রবাহিত একটা একঘরে, বন্ধ্যা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার আবহ মন্ডলে ডুবে আছে। তাদের হেজেমনিতে বাধা পড়ে কবিরা মুসলমানি কনটেন্ট ও লেঙ্গুয়েজ ব্যবহার করতে সংকোচে থাকে। সাহিত্যিকভাবে এক ঘরে হবার ভয়ে থাকে। সেখানে  ফরহাদ মজহার এই ‘এবাদতনামা’র মাধ্যমে আশার আলো নিয়ে আসলেন। ফরহাদ কত আন্তরিকতার সাথে মুসলমানের ব্যক্তিগত এবং যুথবদ্ধ জীবনের স্মৃতি, ইতিহাস, ভাব, চিন্তা- মুসলমানি ডিকশন ও ল্যাংগুয়েজে বাঁধলেন! ত্রিশ বছর আগে তিনি এই ভাষা-বিদ্রোহ করতে পেরেছিলেন -– ভেবে অবাক হই! আজকে যারা বাংলাদেশে নতুন কবিতা লিখছে, নতুন ভাষা-ভাবনার কথা ভাবছে, তাদের জন্য ‘এবাদতনামা’ একটা উজ্জ্বল বাতিঘর হয়ে থাকবে। বিশেষ করে যারা ইসলামী ঐতিহ্যে মুসলমানি কবিতা লিখতে চান। ফরহাদের প্রথম দিকের কবিতা বিবরণমূলক, উচ্চকন্ঠের, কবিতায় রাজনৈতিক বক্তব্যকে প্রাধান্য দিতে দেখা যায়। কিন্তু এবাদতনামায় তার ভাষা ঘনীভূত হয়ে আসছে, প্রতীক, উপমা ও চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন কবিতাকে আরো বেশি পেনিট্রেটিং করার জন্য। ভালো কবিতার অন্যতম  লক্ষণ হলো কবিতা পড়ার সাথে সাথে এর আবেশ নষ্ট হয়ে যায় না। পাঠের শেষেও আমাদের মনে দোলা দিতে থেকে, আমাদের সংবেদকে আঘাত করতে থাকে। ফরহাদের ‘এবাদতনামা’র  কবিতাগুলিও তাই। এবাদতনামার প্রায় সব কবিতায়ই মাল্টি লেয়ার্ড, তাই এর এসেন্স পড়া মাত্রই শেষ হয় না। এগুলো আরো আবিষ্কারের দিকে ইঙ্গিত কর। যেমন নিচের কবিতাটি, এইটা বাংলা কবিতার ভূবনে একটা অনন্য সষ্টি  হয়ে থাকবে :

বলি ও টগর ফুল

বলি, ও টগরফুল ফুটিলি কি বঙ্গে গুলিস্তাঁয়

জিব্রাইল ফেরেশতার সফেদ পায়ের ভাষা লয়ে

পাপড়ির শুভ্রতায়; আমি তোকে পেয়ে এবাদতে

বসেছি পুষ্পোদ্যানে ফুলে ফুলে নতজানু হয়ে ।

শর্করা দানার মত ফুটিলি কি ফুল প্রাণেশ্বরী

আলো হয়ে এই বঙ্গে ? রোশনীতে ভরে অন্তর ।

অতো ফর্শা কোথা পেলি ? দুনিয়ার নানা বাগিচায়

আছে নানা ফুল, কিন্তু কেউ নয় বঙ্গীয় টগর ।

জায়নামাজের স্থান আজ আমি বিছাবো পুষ্পের

অন্তঃস্থল লক্ষ করি; পাপড়িগুলো তসবির মতো

গুনবো যেন নিরানব্বই নামে ফের পৃথিবীতে

ফুল ও পাপড়ির ধর্ম পুনর্বার প্রচারিত–

রোজ হাশরের দিন তুই তবে সাক্ষ্য দিস ফুল

সুন্দরের এবাদতে কেটে যায় কবির জিন্দেগী ।

(এবাদতনামা : ১)

০৫/০৯/২১

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

এ্যাডঃমনিরুল ইসলাম মনু on গুচ্ছ কবিতা : বেনজীন খান
পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা