আবু তাহের সরফরাজ
নব্বইয়ের দশকের কবিতার সরণি ধরে হেঁটে আসছেন একঝাঁক তরুণ। সকলেই তারা কবি। আগের দশকগুলোর কবিরা এই পথেই হেঁটে গেছেন। সরণির এখানে-ওখানে ছড়ানো রয়েছে তাদের কবিতাকীর্তি। হাঁটতে হাঁটতে দামাল কবির দল অগ্রজদের কীর্তি দেখছেন, বুঝে নিচ্ছেন কবিতার কৃৎকৌশল। ভাষার শিল্পরীতি ও কারুকাজ। এরপর এগোচ্ছেন সম্ভাবনার নতুন কবিতার সরণি খুঁজে নিতে। নতুন কবিতা চাইলেই কি লিখে ফেলা যায়? তা কিন্তু যায় না। কেন যায় না? যায় না কারণ, নতুন কবিতা সকল সময়ের, সকল জাতির। যে কবিতা শাশ্বত সময়ের মানবিক অনুভূতি প্রকাশ করে, সেই কবিতাই নতুন কবিতা। নতুন কবিতা মানে নতুন লেখা কবিতা নয়। আজকে বসে যে তরুণ একটি কবিতা লিখছে, দ্যাখা গেল সেই কবিতা দুশো বছর আগের। মানে, ওই কবিতার অর্ন্তনিহিত ভাব ও শৈলী দুশো বছর আগের। অথবা এমনও হতে পারে, বাংলা সাহিত্যে ওরকম কবিতা অনেক লেখা হয়েছে। আরও লেখা মানে সময়ের অপচয়।
নতুন কবিতা তাহলে কিভাবে লেখা যায়? নতুন কবিতা আসলে লেখা যায় না। নতুন কবিতা কবিকে মাধ্যম করে লিখিত হয়। নতুন কবিতা আসলে আলোর ঝলকের মতো একটি ইশারা। কবির বোধের গহনে ওই ইশারা ঢেউ তোলে। এরপর অন্তর্বোধের রসায়নে জারিত হয়ে ভাষায় নিজের অবয়ব মেলে ধরে। কবি কেবল ইশারা দ্বারা চালিত হন। এইভাবে যে কবিতা লেখা হয়ে ওঠে, সেই কবিতাকেই আমরা নতুন কবিতা হিসেবে ধরে নেব। কারণ, এই কবিতার আবেদন সকল সময়ের। সকল জাতির মানবিক ও সামাজিক জীবনকে নতুন কবিতা ধারণ করে। কী রকম? রহমান হেনরীর ‘অধিকাংশ চাবির চরিত্র’ কবিতাটি পড়া যাক:
তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে
দাঁড়িয়ে যায়— টানটান
এবং বলে যে, পারব…
তারপর
ভিতরে ঢুকে
কসরত চালাতে থাকে
ওদিকে, ঝনঝন করে ওঠে তালা, খোলে না—
তারপর
ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত, বের হয়ে আসে,
তালার পদতলে, নতমুখ
বসে থাকে— কিছুক্ষণ;
অবশেষে, লুজার— ব্যর্থ চোরের মতো দৌড়ে পালায়
ছোট ছোট বাক্যে টানটান উত্তেজনার একটি কবিতা। তালা ও চাবি ব্যবহারের অভিজ্ঞতা পৃথিবীর সকল জাতির মানুষেরই রয়েছে। তালা ও চাবিকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে রহমান হেনরী মানুষের জীবনের যে মুহূর্তকে মূর্ত করে তুলেছেন, সেই মুহূর্ত সকল মানুষের যাপিতমুহূর্ত। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত। বিশেষ ওই মুহূর্তে নারী ও পুরুষের মধ্যে কী কী ঘটনা ঘটতে থাকে, সেসব ঘটনার বর্ণনা আমরা পাচ্ছি কবিতা পড়ে। এই বর্ণনা শিল্পকৌশলে এতটাই সূক্ষ্ম যে, পাঠককে তাড়িত করে। প্রতিটি শব্দই যেন এক একটি ইশারা। প্রতীকের আড়ালে জীবনের যে মুহূর্তের ঘটনা কবি বললেন, সেসব ঘটনার অভিজ্ঞতা সকল নারী-পুরুষেরই আছে। কাটকাট বাক্য। যেন ক্যামেরার এক একটি ফোকাস। এক একটি ক্লিকে বিশেষ মুহূর্তে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনাকে ফ্রেমবন্দি করছে। পড়তে পড়তে পাঠকের ভেতরও মৃদু উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কবিতার শরীরে বাক্যের এই জাতীয় কারুকাজ পাঠককে মুগ্ধ করে। বিশেষ ওই মুহূর্তের ফ্রেমে পাঠকও বন্দি হয়ে পড়ে।
তালা ও চাবির ঘটনাগুলো কি কি? যেসব ঘটনার মুহূর্ত রহমান হেনরী কবিতায় তুলে এনেছেন, সেসব মুহূর্তের অনুভূতি কেমন? এটা খুঁজতে যাবার কারণ, ওখানেই কবিতার প্রাণ-ভোমরা লুকিয়ে আছে। ওটাই মানুষ হিসেবে হেনরীর জীবনবোধ। হেনরী প্রচুর কবিতা লিখেছেন। এখনো লিখছেন। সকল কবিতাতেই তার জীবনবোধের স্ফুরণ রয়েছে। সকল কবিতা মিলিয়েই আসলে হেনরীর জীবনবোধ। ‘অধিকাংশ চাবির চরিত্র’ কবিতাতেও হেনরীর অন্তর্জগতের স্ফুরণ আমরা পাই। কবিতার শিরোনাম পড়ে বুঝতে পারি, বেশির ভাগ তালার চরিত্র নয়, চাবির চরিত্র কী করম সেটা আমরা পড়তে চলেছি। হেনরী পুরুষ, তাই চাবির চরিত্র তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে। প্রতিটি বিশেষ মুহূর্তে চাবি ও তালার ভেতর ঘটে যাচ্ছে ঘটনা। আর পাঠক তার অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে নিতে থাকে। এক একজন এক এক রকমভাবে অনুভূতির শিহরণ টের পায়। শেষ বাক্যে এসে পুরুষ পাঠক নিজেকে লুজার মনে করে। নারী-পুরুষের গভীর মনস্তত্ত্ব আমরা পাই তালা ও চাবির মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো থেকে। এসব ঘটনায় দার্শনিকতাও রয়েছে। গভীর অন্তর্বোধ না থাকলে এই অনুভূতির কবিতা লেখা সম্ভব নয়। এটাই নতুন কবিতার ধরণ। তাহলে আমরা এখন হিসাব মিলিয়ে নিতে পারি, রহমান হেনরীর কবিতা সবসময়ই নতুন।
নব্বইয়ের দশকের কবিতার সরণি ধরে হেঁটে আসা হাতেগোণা কয়েকজন কবি নতুন সরণি খুঁজে নিতে পেরেছেন। রহমান হেনরী তাদের একজন। তার কবিতার অন্তর্নিহিত বোধ বিশেষ কোনো কালখণ্ডের নয়, সকল সময়ের। কবিতার শরীরে বোধের সুইসুতো দিয়ে যেসব শব্দ তিনি সেলাই করেন, সেসব শব্দ নব্বইয়ের দশকের বিশিষ্ট কাব্যভাষা। নব্বইয়ের দশকের কবিদের কবিতার ভাষায় কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন রূপ চোখে পড়ে। কামরুজ্জামান কামু এক ধরনের ভাষারীতিতে কবিতা লেখেন। সেই রীতি কামুকে ওই দশকের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। আবার, মাহবুব কবির ভিন্ন আরেক ভাষারীতিতে কবিতা লেখেন। এই ভাষারীতিতে তিনিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। একইভাবে, রহমান হেনরীও তার মতো একটি ভাষারীতিতে কবিতা লেখেন। তার কবিতায় এক রকম গাম্ভীর্য থাকে। প্রাজ্ঞতার ছাপ থাকে। কবিতায় তার লেখা চটুল শব্দটিও কী রকম যেন দার্শনিকতা প্রকাশ করে। প্রতীকের রূপায়ণে মানবজীবনের নানা মুহূর্তের অনুভূতি তার কবিতা প্রকাশ করে। ‘গোলাপ গো, আমি ঘাসফুল’ কবিতাটি পড়া যাক।
ধরো, হাঁটতে গিয়ে, পথিপার্শের একটি ঘাসফুল দেখে, তুমি বলে ফেললে: ‘সুন্দর’। …গোলাপ প্রতিবাদ করলো। বললো, ‘কী এমন সুন্দর?’ তখনও, সুন্দরের তুল্যমূল্য: তুমি জানো না।… কিন্তু তোমাকে দাঁড়াতে হবে, ওই ঘাসফুলের পাশে; লড়াই করতে হবে— যতক্ষণ না তোমার হৃদয়াবেগের পাশে পৌঁছে, প্রতিবাদী গোলাপ স্বীকার করছে যে, ‘হ্যাঁ, সত্যিই, ঘাসফুলটি সুন্দর’।
হতে পারে: ঘাসফুলটি (প্রচলিত অর্থে) গোলাপের মতো সুন্দর নয়; তাতে কী? তোমার মনে হয়েছিল: সুন্দর; অতএব, গোলাপের সাথে লড়তেই হবে তোমাকে।
এমন কিছুরই নাম যুদ্ধ…
এখানে,. কোনো এক পক্ষের পরাজয় ব্যতীত অন্যপক্ষের জয় অসম্ভব।
গোলাপ ও ঘাসফুলের প্রতীকে জীবনের গূঢ় যে সত্যি হেনরী বলে দিলেন, সেই সত্যি একেবারেই দার্শনিক উপলব্ধি। হেনরীর অনেক কবিতাতেই এ ধরনের উপলব্ধি পাঠকের অনুভূতিতে ধরা পড়বে। যুদ্ধ যে আসলে হৃদয়াবেগ, দার্শনিক এই প্রজ্ঞা কবিতাটিতে বিশেষভাবে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। পথের পাশে ফুটে থাকা ঘাসফুল এক রকমের সুন্দর। আবার, গোলাপও আরেক রকমের সুন্দর। এই দুই সুন্দরের অনুভূতি একেকজন মানুষের বেলায় একেক রকম। এটাই সুন্দরের তুল্যমূল্য। এই বোধ সবার থাকে না। তাই তুমি বললে, ঘাসফুল সুন্দর। কিন্তু গোলাপ নিজেকে বেশি সুন্দর দাবি করলো। এখানেই প্রকাশ পেল সুন্দরের অহংকার। সুন্দরের অহংকারে তোমার হৃদয়াবেগ জেগে উঠল। তুমি যুদ্ধংদেহী হয়ে উঠলে। গোলাপ যতক্ষণ স্বীকার করবে না ঘাসফুল সুন্দর, ততক্ষণ তুমি যুদ্ধ করতে থাকবে গোলাপের সাথে। গোলাপের অহংকারের ওপর তুমি ওড়াবে তোমার হৃদয়াবেগের পতাকা। হেনরী বলছেন, এমন কিছুর নামই যুদ্ধ। যুদ্ধে এক পক্ষের পরাজয় ছাড়া আরেক পক্ষের জয় অসম্ভব। ‘বাক-স্বাধীনতা’ কবিতাটি পড়া যাক।
শান্তির কানের ভিতর
অনর্গল বেজে চলেছে— আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর পারস্পারিক
আলাপ-আলোচনা; এবং তারই নেপথ্য সংগীত…
‘ঠাণ্ডা লড়াই’ এর দিনগুলোর কথা বলছি না; দুনিয়াব্যাপী
চিত্তবিনোদনের স্বাদহীন সালুনে, নুনের যোগান দিতেই,
হয়তোবা Salt নামে খ্যাতি পেয়েছিল:
কৌশলগত অস্ত্র সীমিতকরণের আলোচনা!
শান্তি ও গণতন্ত্রের জন্য গলদঘর্ম নেতারা, দুনিয়ার
দেশে দেশে তৎপর রয়েছেন; বাক-স্বাধীনতার পক্ষে
তাদের দৃঢ় অবস্থান — মুগ্ধ করছে আমাকে: আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে
কুলুপ এঁটে দেয়াটা, একদমই, পছন্দ করেন না ওঁরা
মেশিন বলেই কি তার বাক-স্বাধীনতা থাকবে না?
পৃথিবীতে যুদ্ধ অপরিহার্য। কারণ, সুন্দরের তুল্যমূল্য একেক জাতির কাছে একেক রকম। তাই, ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির দ্বন্দ্ব, জাতির সাথে জাতির দ্বন্দ্ব। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় চলমান রয়েছে ইজরায়েলের বর্বরোচিত হামলা। নিহতের সংখ্যা ৩৫ হাজার। আহতের সংখ্যা ৭৮৫০০। অনেক মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছে। উদ্ধারকর্মীরা তাদের কাছে পৌঁছতে পারছে না। জাতিসংঘের নিষেধকেও অমান্য করছে ইজরায়েল। দেশটিকে অস্ত্র-সহায়তা করে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে বারবার ভেটো দিয়েছে দেশটি। দীর্ঘযুগ ধরেই ফিলিস্তিন-ইজরায়েল ইস্যুটি বিশ্বের প্রধান সমস্যা। মূলত এ সমস্যাকে কেন্দ্র করেই আন্তর্জাতিক রাজনীতি পরিচালিত হয়। দ্বন্দ্বের প্রধান কারণ ইহুদি-মুসলিম বিরোধ। ইহুদি জাতি ফিলিস্তিন থেকে মুসলমানদের হটিয়ে বায়তুল আকসা দখল করতে চায়। পবিত্র এ মসজিদটি ইসলাম, খ্রিস্টান ও ইহুদি তিন ধর্মেই পবিত্র হিসেবে গণ্য। ফলে, খ্রিস্টান জাতি যুক্তরাষ্ট্র ইহুতি জাতি ইজরায়েলকে সমর্থন দেবে, এটাই তো উচিত। ‘গোলাপ গো, আমি ঘাসফুল’ কবিতায় আমরা একটি শব্দ পড়েছি, ‘হৃদয়াবেগ’। যুদ্ধের কারণ হিসেবে রহমান হেনরী হৃদয়াবেগকে উল্লেখ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র যে আবেগ নিয়ে ইজরায়েলকে সহযোগিতা করছে সে আবেগের নাম ধর্মীয় আবেগ। মূলত ধর্মই বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির ভেতর রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি করে। ইজরায়েল এবার গাজার রাফাহ শহরে হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা হামাসকে নির্মূল করতে চায়। আরও মানুষকে হত্যা করতে চায়। সাধারণ মানুষ রাজনীতির কূটকৌশল পছন্দ করে না। মানুষ হত্যাকে সমর্থন করে না। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা গাজায় যুদ্ধ বন্ধের জন্য আন্দোলন করছে। এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্নি দেশে। এসব আন্দোলন এ কথাই জানাচ্ছে যে, ধর্ম নয়, মানুষই সত্য। এই সত্য উপলব্ধি করে নয়, নানামুখি চাপে এখন বেকায়দায় পড়ে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছি, যদি তারা রাফাহতে হামলা চালায়… তবে আমি অস্ত্র সরবরাহ করছি না।” বাইডেনের মন্তব্য শুনে জাতিসংঘে ইজরায়েলের রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরগান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র ইজরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করবে, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।” কেন করবেন? তিনি তো জানেন, এটা বাইডেনের রাজনৈতিক কূটকৌশল। এই কৌশলগত ফিসফাস শুনতে পাই হেনরীর পঙক্তিগুচ্ছে:
শান্তির কানের ভিতর
অনর্গল বেজে চলেছে— আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর পারস্পারিক
আলাপ-আলোচনা; এবং তারই নেপথ্য সংগীত…
ইজরায়েল-হামাসের চলমান সংঘর্ষ শুরুর আগের লেখা কবিতা ‘বাক-স্বাধীনতা’। যুদ্ধ যে অনিবার্য, সেই বিষয়ে সূক্ষ্ম ইঙ্গিত আছে কবিতার শেষে। হেনরী কবিতা শুরু করেছেন শান্তি আলোচনা দিয়ে। আর শেষ করেছেন আগ্নেয়াস্ত্রের মুখের কুলুপ খুলে দিয়ে। সভ্যতার সকল সময়ের মানুষই যুদ্ধের বীভৎস চেহারা দেখেছে। যুদ্ধে প্রাণ হারানো প্রিয়জনের নিথর দেহ দেখেছে। সকল সময়েই যুদ্ধের কারণ শান্তির তুল্যমূল্য জ্ঞান না থাকা। শুভবোধ না থাকা। হেনরীর এই কবিতাটির ভাষাশৈলী বিষয়কে অনুসরণ করে এগিয়েছে। যেন আলাপচ্ছলে হেনরী যুদ্ধের অনিবার্যতা বোঝাতে কিছু কথা বলছেন। বাক্যগুলো কবিতার মতো পেলব নয়, কী রকম যেন খড়খড়ে। কেন? কারণ, শান্তির ঐকমত্যে বিশ্বনেতাদের কূটকৌশল কাটখোট্টা, পেলব নয়। দেখা যাচ্ছে, বিষয়ের সাথে সঙ্গতি রেখেই বাক্যগুলো নিজস্ব গতিতেই ছুটেছে এই কবিতায়। বিষয়ের সাথে ভাষারীতির মেলবন্ধন হেনরীর সকল কবিতাতেই আমাদের চোখে পড়বে। যখন যে অনুভূতি দ্বারা তাড়িত হয়ে হেনরী কবিতা লেখেন, তখন সেই অনুভূতির ভাষারীতি কবিতাকে নির্মাণ করে। এটাও নতুন কবিতার একটি বৈশিষ্ট্য।
অনেকেই বলে যে, আজকের সময়ে এসে প্রেমের কবিতা নতুন রূপে লেখার কিছুই আর নেই। তাদের ব্যাখ্যা, প্রযুক্তিনির্ভর অস্থির এই প্রজন্মের কাছে প্রেমের অনুভূতি আগের প্রজন্ম থেকে ভিন্ন। সৌন্দর্যের শিহরণ নয়, প্রেমের মানে তাদের কাছে শরীরের শিহরণ। মুখোমুখি বসে আছে প্রেমিক-প্রেমিকা। অথচ চ্যাট চলছে স্মার্টফোনে। মুখে কোনো কথা নেই। প্রযুক্তির সুবিধাগুলো প্রেমের অনুভূতি চাপা দিয়ে আজকের প্রজন্মকে শরীরস্বর্বস্ব করে তুলছে। আগের প্রজন্মের প্রেমিক-প্রেমিকা একে অন্যকে দেখার সুযোগ তো ছিলই না, কথা বলার সুযোগ তো আরও অসম্ভব। দেখতে না পারার এই বিরহই যে কত রূপে ও রসে শিহরণ তুলতো তাদের অন্তর্জগতে, সেই খবর আজকের প্রজন্ম জানতেও পারবে না। প্রেমের অনুভূতি শাশ্বত, সকল সময়ের। প্রতিবেশের নানা উপাদানের প্রভাবে সেই অনুভূতি নানা মোড়কের, নানা রঙের। কিন্তু শীর্ষানুভূতি একই রকম। তা সকল সময়ের, সকল মানুষের। এই শীর্ষানুভূতি যে কবিতা ধারণ করে, সেই কবিতাও সকল সময়ের, সকল মানুষের। মহামহিম রবীন্দ্রনাথের কাছে যাওয়া যাক।
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি
আকাশে জল ঝরে অবিরাম
জগতে কেহ যেন নাহি আর।
সমাজ সংসার মিছে সব
মিছে এ জীবনের কলরব।
কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব
আঁধারে মিছে গেছে আরসব।
তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
নামাতে পারি যদি মনোভর।
হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভবই প্রেম, প্রেমের শিহরণ। যা বহমান যুগ-যুগান্তের মানবজীবন স্রোতে। আজকের প্রজন্ম প্রেমকে এভাবে উপলব্ধি করতে পারবে না। তাদের কাছে প্রেম শরীরী, অন্তর্গত সৌন্দর্যের তৃষ্ণা নয়। অবশ্যি এসব ভারি কথাবার্তাও এ প্রজন্ম এখন আর বুঝবে না। রহমান হেনরীর ‘বৃষ্টিঋতুতে’ কবিতাটি পড়া যাক।
বৃষ্টিঋতুতে চাইছি যে, তুমি আসো—
শুভ্র ডানা গো, হাঁসের পালকে বোনা;
বর্ষণে ভেজা, সারাদিন জলে ভাসো,
সে জল শেষে ঝেড়ে ফেলো, লক্ষ্মী সোনা!
বৃষ্টিঋতুতে চাইছি সে পুরনোকে
পুরাণের পাখি এসো এই নিধুবনে
সজলসন্ধ্যা ভূগোলে যখন ঝোঁকে
তোমাকে চাইছি: দিবসসন্ধিক্ষণে;
বর্ষণে কাঁপে থরথর দেহ, মনও—
নবীনা ভূমি সদ্য স্রোতকে জাগা
সিক্ত দিবসে রাত্রির মতো ঘন
শুভ্র ডানা গো, হাঁসের পালকে বোনা,
অন্তিমে যদি সাথীটিও রইলো না
অন্ধকারে তো আমি এক দুর্ভাগা!
হেনরী বৃষ্টিঋতুকে চাচ্ছেন। কারণ, বৃষ্টির ঝমঝম শব্দের নির্জনতায় সমাজ সংসারকে মিছে করে দিয়ে প্রেমিকার মুখোমুখি তিনি বসবেন। আর এজন্য রবীন্দ্রনাথের মতোই কাতরতা ফুটে উঠছে হেনরীর কবিতায়। কিন্তু সেই কাতরতা পেলব ও গীতল নয়, কী রকম যেন ছাড়া-ছাড়া অনুভূতির কারুকাজ। কারণ, রবীন্দ্রনাথের সময়কাল থেকে হেনরীর সময়কালে জীবযাপন ও প্রতিবেশ নানা চড়াই উতরায় পেরিয়ে অনেক বদলে গেছে। ফলে, অনুভূতির বর্ণনারীতিও বদলে গেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের যে অনুভূতি সেই অনুভূতির প্রকাশ আমরা হেনরীর এই কবিতাতেও দেখতে পাই। পাই কারণ, হেনরী প্রজ্ঞাবান কবি। হেনরীর লেখা প্রতিটি কবিতা তার প্রজ্ঞার স্মারক।
হেনরীর কবিতার উপমা-উৎপ্রেক্ষা ও বাকরীতি নব্বইয়ের আরসব কবিদের কবিতা থেকে স্বতন্ত্র। সেসবে হেনরীর স্বকীয় শিল্পশৈলী পাঠকের চোখে পড়বে। কয়েকটি উদাহরণ:
ক. সচল মুদ্রার মতো প্রিয়তমা নারী যদি চোখের পলকে নাচে হাত থেকে হাতে।
খ. এই যে উদাসী মেঘ, ভেসে যায় রোদের আদর মেখে, সে যদি না মানে পিছুটান।
গ. বিশেষ মুহূর্ত এলে কোনো কোনো শরীরও মন্দির হয়ে যায়।
ঘ. এ চাঁদ সেই ব্যর্থ প্রেমিক— যে কিনা অনন্তকাল ছুটে যাচ্ছে মুহূর্তে হারানো তার প্রেমিকার দিকে।
ঙ. ফুলের ছোবল খাওয়া সাপ এসে শুয়ে আছে সবগুলো সড়কের ঠিক মাঝখানে।
ওপরের উপমা-উৎপ্রেক্ষাগুলো পড়ার পর স্বীকার করতেই হবে, এসব হেনরীর পক্ষেই লেখা সম্ভব। হেনরীর শিল্পরীতি বয়ানরীতি স্পষ্টভাবে উপস্থিত উপমাগুলোতে। এইভাবে, রহমান হেনরীর যে কোনো কবিতাই তার স্বকীয় শিল্পসৌন্দর্যে ভাস্বর। কবিতার প্রাজ্ঞ পাঠক একটু লক্ষ্য করলেই দেখবে, হেনরীর কবিতা বিষয়-ভাবনায় নব্বইয়ের আরসব কবিদের কবিতা থেকে আলাদা। শব্দ বুননে আলাদা, বাক্যগঠনেও আলাদা। কবিতার ভেতর দিয়ে যে অনুভূতি হেনরী পাঠকের ভেতর সঞ্চার করেন, সেই অনুভূতিও হেনরীকে আলাদাভাবে বিশিষ্ট করে তোলে। কোনো কোনো কবিতায় গুরুগম্ভীর শব্দের আয়োজন পাঠককে তটস্থ রাখে। আবার, কিছু কবিতায় দেখা যায় প্রতিদিনের পরিচিত শব্দের আয়োজন। এর কারণ, কবিতার বিষয় বাহন হিসেবে যে শব্দ দাবি করে সেই শব্দ হেনরী ব্যবহার করেন কুশলী দক্ষতায়। হেনরীর কবিতায় ব্যবহৃত শব্দগুলো সুশৃঙ্খল। শব্দের পরিমিতিবোধ হেনরীর প্রজ্ঞাজাত। সেসব শব্দের গূঢ়ার্থ নানামাত্রা প্রকাশ করে। পাঠকের অনুভূতির জগৎকে বিস্তৃত করে দ্যায়। বিচিত্র নানা আঙ্গিকে হেনরী কবিতা লিখেছেন। কখনো তার কবিতা ছন্দের বাহনে পাঠককে চড়িয়ে ঘুরিয়ে আনে অন্তর্লীন জীবনস্রোতে, কখনো তার কবিতার অবয়ব নির্মিত হয় টানা গদ্যে, গদ্যের মতোই সুঠাম শব্দবিন্যাসে। তবে যেভাবেই লিখিত হোক তার কবিতা, সেসব কবিতার আস্বাদ পাঠককে বহু বর্ণিল অনুভূতিতে জারিত করে। রহমান হেনরীর কয়েকটি বইয়ের নাম পড়া যাক: গোত্রভূমিকাহীন, প্রণয় সম্ভার, সার্কাসমুখরিত গ্রাম, ব্রজসুন্দরীর কথা, তোমাকে বাসনা করি, ত্রাণসুন্দরী, অন্ধকার বেলা ও খুনঝরা নদী। প্রতিটি শিরোনামে রয়েছে আভিজাত্য, শিল্পরুচির পরিশীলিত ছাপ।
বলেছি যে, হেনরীর কবিতা সবসময়ই নতুন। কিন্তু সকল কবিতাই নতুন নয়। সেটা হওয়া সম্ভবও নয়। তার অজস্র কবিতার ভেতর থেকে কয়েকটি কবিতার উদ্ধৃতি এই প্রবন্ধে ব্যবহৃত হয়েছে। সকল কবিতা ভেঙেচুরে দেখার সুযোগ এখানে নেই। কবিতার যারা পাঠক তারা জানে, হেনরীর কবিতা মানেই নব্বইয়ের দশকের আলাদা একটি সরণি। আগের দশকগুলো থেকে নব্বইয়ের দশকের কবিতা যে বাঁক ফিরিয়েছে, সেই বাঁক ফেরানোর কৃতিত্বে ওই সময়ের কয়েকজন কবির সাথে হেনরীও একজন সহযাত্রী।