আল মুজাহিদী
প্রাককথন :
ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন : Poetey is emotion recollected in tranquility. ভ্রান্তি বিলাস চর্চার এই যুগে সাহিত্যের সাথে রাজনীতির সম্পর্ক বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে এখন এক অসকাল। সমাজ থেকে গণজীবন, গণজীবন থেকে মাটির কাছাকাছি, তারপর এক বিশ্ব এক সমাজ এবং মানবতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে আজকের নষ্টালজিক সমাজে দর্শন, ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রেম ও গভীর মমতার এক মাইলফলক এঁকেছেন একজন কবি। নির্মল সত্তা, গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিষয়-আশয়কে পুঁজি করে তিনি লিখে চলেছেন কবিতা। যেহেতু সমগ্র দিয়েই সাহিত্য সৃষ্টি হয়, মনের কোনো এক খিল দেয়া কামরায় অনুভূতির স্বতন্ত্র বৃত্তি নেই তার, তাই তিনি সর্বাগ্রে ডাঙার নরম সবুজ মাটির মত কবিতাকে করেছেন ফলময়। মহৎ কবিতা তাকেই বলা যায় যা একাধারে সমসাময়িক, শাশ্বত, যুগধর্মী, ঐতিহ নির্ভর এবং যুগান্তরগামী। ফ্যাসিস্ট তামসিকতার নগ্ন অভিযানে আজকের কবিতা অঙ্গন যখন কলুষিত তখনো তিনি সামাজিক দৃষ্টিকে পরিচ্ছন্ন রেখেছেন। তিনি কবি আল মুজাহিদী। গভীর, গভীরতরভাবে তার কবিতা বিশ্লেষণ করলে অনেক পরীক্ষিত ও বাস্তবীকৃত শিল্পচয়িতার পরিচয় পাওয়া যায়। সুচিন্তিতি, সুলিখিত, প্রকর্ষিত চিত্তের ফল সর্বদা। সুস্বাদু হয়। দেশ-কাল-বিশ্ব ভেদাভেদে আল মুজাহিদীর কবিতা ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন, ঐতিহ্য মানবতার যে কথা লিখে চলেছেন তা চিন্তারাজ্যে নতুন ভূ-খণ্ড আবিষ্কার করে। এ কারণে আল মুজাহিদীর কবিতাকে বলা যায় চলমান, ঘূর্ণামান, সংক্রমণশীল এবং মৌল বিশ্বাসের প্রতিরূপ। প্রেম মানব জীবনের চরম অমূল্য সম্পদ। যত্নবান সচেষ্ট শব্দশিল্পী আল মুজাহিদীর কাব্যিক পটভূমি মাঝে-মাঝেই প্রেমময় হয়ে ওঠে।
মৃত্তিকার কবি : মাটির আদম :
অ্যাংলো-স্যাকসন মহাকাব্য যদি ‘উলফ’-এ আমরা দেখি যে অন্ধকার সাগর থেকে একটি ভয়ঙ্কর বেরিয়ে আসছে মৃত্তিকার মানুষকে আঘাত করবার জন্য। দীর্ঘদিন মানুষ যন্ত্রণা ভোগ করেছে। শেষ পর্যন্ত সকল মানুষ একত্রিত হয়ে সমুদ্রের ভয়ঙ্করকে ধ্বংস করেছে এবং অবশেষে মানুষের জন্য মুত্তিকার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে। আল মুজাহিদীর কবিতায় বারে বারে, ফিরে-ফিরে ‘মৃত্তিকা’ শব্দটির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। এ কারণে অনেকেই এটাকে শব্দদূষণ আবার অনেকে অতিকথন বলে। নিজ দায়িত্ব এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু সমালোচকের দৃষ্টি অস্বচ্ছ হলে খুব একটা বেশিদূর পথচলা যায় না। কেন একজন কবি আল মুজাহিদী একটি শব্দকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরে আছেন যুগ-যুগ ধরে। শব্দ সচেতন কবি আল মুজাহিদীর এই রহস্যময় অবস্থান আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে অন্য এক বাস্তব অনুভূতির দুয়ারে। একটি বিষয়ের বারংবার ব্যবহার আসলে ঐ বিষয়ের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে। কবির এই মৃত্তিকা শুধু কি মাতৃভুমির ভূ-খণ্ডের? নাকি সমগ্র বিশ্ব-ভূখণ্ডের মৃত্তিকার, আগে এই বিষয়ে পরিষ্কার হওয়া উচিত।
“হে মৃত্তিকা, তুমি আজ সেই প্রাকৃত সাংস্কৃত পারসীয় আরবীয় লাতিন হিব্রুর
সংগীত স্তবক উপহার দাও। অরণ্যে উদ্যানে পাখির পালকে
আমি আজীবন বন্দী অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে তোমার;
তুমি গোটা মানব জাতির অস্তিত্ব স্পন্দন
আমি আজ তোমার কাছেই ফিরে আসি
পদ্মা মেঘনা যমুনা বিধৌত পলল ভূমিতে
তুমিই আমরা
আমিই তোমার অখণ্ড গতির
মহাকাব্য।
(মৃত্তিকা অতিমৃত্তিকায়)
মৃত্তিকা অনুরাগ কেবল রোমান্টিক আবেগই নয়, বাস্তব পৃথিবীমুখী চেতনার উষ্ণ প্রকাশ। এই যে ঐতিহ্যানুরাগী, জাতীয়তা, আন্তর্জাতিকতা এটা তাঁর স্বভাব বৈশিষ্ট্য এবং রক্তের সাথে মিশে গেছে। ফলত তার কবিতায় বিশ্বসাম্রাজ্যকে উপস্থাপন করার এই মনোবাসনা মানবিক চৈতন্যের স্বতঃস্ফূর্ত উদগীরণ। একজন কবি যখন মানসিক দিক দিয়ে পরিতৃপ্তি সহকারে ও যত্নসহকারে উচ্চনিনাদিত শব্দাবলী ও তত্ত্বের বিশাল আকাশ নিয়ে নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডের মাঝে দাঁড়িয়ে যান তখন পৃথিবী তার কাছে বড্ড ছোট্ট হয়ে যায়। বিষাদ ও নৈরাশ্য যখন কবির চারপাশ অক্টোপাসের মতন জড়িয়ে রাখে সামাজিক বিকৃংখলার সুযোগে, তখনও কবি মৃত্তিকাকে আগলে রাখেন পরম মমতায়। এক আশ্চর্য মোহাচ্ছন্ন করে রাখেন কবির চারপাশ। দুঃখ যেখানে উইপোকার মতন আঘাত দেে কুড়ে কুড়ে খেলেও তিনি সলাজ ভঙিতে বলেন :
সুমুত্তিকা, আমাকে কি দেবে কেবল কটাক্ষ? নাকি হিমঝরা সুখের জলদি
কতো আর পাড়ি দেবো নদ-নদী
গ্রোতস্থল বঙ্গোপসাগর-কাল নিরবধি!
শ্যামল প্রেয়সী সুমুত্তিকা
এ-বাংলার দারুণ দহন এই বুকে শুধু দুঃখ দেবে, দাও
কালের ক্রন্দসী, আমাকে কাঁদাও-
আমার জীবনে কতো যে রোদন, আহা!
(সুমৃত্তিকা)
আমি স্বপ্নের জাগরণে এখনও মাটি চাই
তুমি সেই মহান মৃত্তিকা, আমার স্বদেশ
তোমার বিষ চোখের কোটরে কম্পমান
আমার অস্তিত্ব।
(স্বদেশের নান্দীপাঠ)
কবি আল মুজাহিদীর বাংলাদেশ ও বিশ্ব সংলগ্নতা একই সঙ্গে অর্থময়। মানবিক অস্তিত্বের সার্থকতা সন্ধানে সদাসতর্ক কবি একদিকে যেমন দেশের মানচিত্রে তার গন্তব্য খুঁজে পান’ অন্যদিকে আবার ‘সার্বভৌম সুরের কোরাসে’ ‘‘দীর্ঘতম ভবিষ্যৎ” সন্ধান করেন। বন্দী শিবিরে সূর্যোদয়ে’ যেমন তিনি স্বদেশ ভূমি’তে ফিরে আসার কথা বলেন তেমনি উৎস মানুষ’ কবিতায় নিজের হৃদস্পন্দনে শুনতে চান সারা মানবজাতির হৃদস্পন্দন।
‘হে আমার অস্তিত্বময় একান্ত মৃত্তিকা অতিমৃত্তিকা,
এখানে কেবল চলমান পৃথিবীর, পৃথিবীবাসীরা বেঁচে থাকে।
ইতিহাস, ঐতিহ্যের সবুজ মহাদেশ : ” Poetry is excellent words in excellent arrangement abd excellent metre.” দশ-পনেরো হাজার বৎসর পূর্বে আল্টামিরার গুহাগাত্রে নানা জন্তু-জানোয়ারের মূর্তি খোদাই করা হয়েছিল। পাথরের গায়ে এমন আশ্চর্য সজীব মূর্তি যে আদিম কারিগররা রেখে গেছেন তাঁদের কলাকৌশলের তারিফ না করে আমরা পারি না। সভ্যতার গোড়াতে শিল্পকলার মূল্য ছিল নিতান্ত প্রয়োগসিদ্ধ। সভ্যতার এই উৎকর্ষ পর্যায়ে প্রাপ্ত ইতিহাস সকল দেশে, সকল কালেই কবি-লেখকরা আলোকিত করেছেন। ঘুটঘুটে অন্ধকারময় ইতিহাসকে আলোকিত রৌদ্রে টেনে এনেছেন কবিতার উপমা, রূপক, শব্দচয়ন, আতিশয্য, উৎপ্রেক্ষা, অনুপ্রাসের চিত্রকল্পময় কারুকাজে। আল মুজাহিদী ঠিক অনুরূপ কাজটি করেছেন সুনিয়ন্ত্রিত, সুসংবদ্ধ অক্ষর দিয়ে।
মৃত্যুবাণ যাও খৃষ্ট ক্রুশ প্রস্তরখণ্ড
বেথেলহেমের পর্ণকুটীর
মৃত্যু যেন সুগম্য চৈতন্য মুহাম্মদ অলৌকিক
সিনাচাক মহাপুনরুত্থান।
ইতিহাস শোণিতাক্ত
মহান যীশুর হৃদপিণ্ড ক্রুশদর্ণ
আমরা এখন শনাক্ত করতে পারছি না শত্রু-মিত্র
চতুর্দিকে কী ভীষণ অন্ধকার।
আমি জন্ম-জন্মান্তরের নান্দি পাঠ করি।
অগ্নিচুল্লিগুলো ভস্মীভূত হোক আমার বিদগ্ধ নিঃশ্বাসে।
হৃদয় নামক অস্ত্র হোক আমাদের পারিজাত পুষ্প
এই ধ্বংস আর ভস্মরাশি থেকে আমি জেগে উঠে আবার
নির্মাণ করবো পৃথিবীর মনোজ্ঞ উদ্যান ।
পৃথিবীর বেঁচে থাকা পাখি, ফুল, নদী, নিসর্গ, সমুদ্র, নীলিমা
নর, নারী, শিশু, যুবা, বৃদ্ধ, নিঃস্ব, অসহায়-আর্ত সকলেই উচ্চারণ করে
আর ধ্বংস নয়। ভস্মস্তূপ নয়।
“নো পাসারান’
নো পাসারান।
(নো পাসারান)
হে ঠাণ্ডা কফিন!
তুমি কাঁদবে না একবারও
মৃতভূমিবাসীদের জন্য?
আমি তোমাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখলাম
মৃত ব্যক্তিদের আত্মা
গুমরে গুমরে কাঁদছে
বিভীষিকাময় আগস্টের
আগ্নেয় প্রত্যুষ।
(আগ্নেয় প্রত্যুষ, ৬ আগস্ট)
হিরোশিমা,
তোমার মৃত্তিকা আর
ভূগর্ভস্থ প্রাচীন করোটি, হাড়গোড়
আমি আমার আত্মার আর্কাইভে
সংগ্রহ করে রেখেছি।
(হিরোশিমা, মন, আমুর নাগাসাকি, মন আমুর)
জলপাই-রঙ বেয়াড়া গাড়িটার নীচে পড়ে আছে
মানুষের সারি সারি অসংখ্য গলিত লাশ।
সাদা আলখাল্লায় ঢাকা আমার কফিনের ভাঁজ পাশে রেখে দাও
আমার ফেলে আসা কালোরাতির পুরনো পাণ্ডুলিপি
(জলপাই-রঙ বেয়াড়া গাড়ী)
বাংলাদেশের কবিতায় বুদ্ধিবৃত্তিক স্বরের স্রোত অতি ক্ষীণ । বুদ্ধিবৃত্তিক কবিতা শুনে শুনে হয় না, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। যদিও ভালেরির মন্তব্য ‘কেবল বুদ্ধি দিয়ে কবিতা হয় না।’ একথা সত্য, তদুপরি বুদ্ধির চৌকসতা আর কবিতার বিষয় একজন কবি যখন উপলব্ধি করতে পারেন What is his aim তখনই বুঝি সত্যিকার কবিত্বশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। হিরোশিমার জন্য কবির যে দরদ, উপলব্ধি, বোধ, তা বাংলা কবিতা কেন আমার মনে হয় বিশ্ব সাহিত্যেও বিরল। কথাটি এজন্য বললাম, অংসযজ্ঞের মাঝে একজন কবি হৃদয় কী পরিমাণ শোকাচ্ছন্ন তা বোঝা যায় আল মুজাহিদীর ‘কাঁদো হিরোশিমা কাঁদো নাগাসাকি কাব্যগ্রন্থ পাঠ করলে। ‘All great Poetry is realistic’- কথাটির ব্যাখ্যা আল মুজাহিদীর কবিতায় পাওয়া যায়।
ইতিহাস সচেতন কবি আল মুজাহিদীর কবিতায় শব্দচয়ন ও বাক্যবিন্যাস এক্ষেত্রে লক্ষণীয়। বাহ্যিক পারিপার্শ্বিকতার আবহে তার এ শব্দচয়ন অনেক পাঠকের বিরক্তি উদ্রেক করতে পারে; কিন্তু মূল বিষয় নিগূঢ়ভাবে পর্যালোচনা করলে থমকে যেতে হয়। শব্দের বাক্সময়তার প্রকৃত জীবনদর্শন জীবন্তভাবে ধরা দেয়। এই শব্দের জীবনদর্শনই যার করায়ত্ত তার শৈল্পিকসত্তা নিঃসন্দেহে শক্তিশালী। এক্ষেত্রে Matthew Arnold- এর উক্তি প্রণিধানযোগ্য- “The great Power of Poetry is the Power of so dealing with things as to awaken in us a wonderfully full,new and intimate sense of them and our relations with them.”
কবিতায় শৈল্পিক অলংকার, জীবনদর্শন এবং ভাবের গভীরতা নিয়ে যে কবির কাব্যযাত্রা তিনি কালের প্রয়োজনে বারংবার আলোচিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। শেক্সপিয়র, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কীটস, শেলী, বায়রন, হুইটম্যান আবার বাংলা কবিতায় (আধুনিক যুগে) মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ কবিদের কবিতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে শৈল্পিকসত্তা, জীবনদর্শন, ভাবের গভীরতা, অনুভূতির ব্যাপ্তি এবং বৈচিত্রের ব্যঞ্জনা। অতি সামান্য বিষয়কে তাঁরা অসামান্য রূপ দিয়েছেন। আল মুজাহিদীর দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্ব সাহিত্য অঙনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। অনুভূতির করালোকে আবর্তিত হয়ে তার নির্মাণশৈলী ভাবের গভীরতা, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন নন্দনপ্রেমীদের দৃষ্টি কাড়ে।
০১. কখনো বসন্ত যদি দোলায় পল্লব এই রাতে
তুমি তো ফাল্গুনি মেয়ে, আহা তোমার চোখের নীড়ে
জেগে আছে নীল পাখি লাল জবা কতো কৃষ্ণচূড়া।
(সুমৃত্তিকা)
০২. মেট্রোপলিটন মানুষেরা হাভাতের মতো আত্মসাৎ করে রাত্রির নিটোল চাঁদ আর রুটি
ঈশ্বরের বাজেট ঘাটতি ঘটে যায়; তবু আমার জিহবায় লেগে থাকে
কবিতা প্রসাদ-কবিতার চেয়ে অতিরেক আর কিছু
রোচে না এখন আমার জিহবায় ।
(মেট্রোপলিটন পংক্তিমালা)
০৩. তুমি জেনে রেখো, পাখিরা নিকট প্রতিবেশী মানুষের। মানুষেরা
পাখির বসতি খোঁজে আজকাল- শান্তিময় ডুমুর উদ্যান, নিজ নিজ
সম্প্রদায়- নিজস্ব জাতির।
(ডুমুর বাগান)
০৪. হে বন্দী শিবির! তুমি কেনো আড়াল করেছো আমার সূর্যকে
রাজধানীর প্রত্যুষ, জ্যোৎস্নার শামিয়ানা, লোকালয়।
(বন্দীশিবিরে সূর্যোদয়)
০৫. তুমি তো ফাল্গুনি মেয়ে, আহা, তোমার চোখের নীড়ে
জেগে আছে নীল পাখি লাল জবা কতো কৃষ্ণচূড়া
(সুমৃত্তিকা)
ঐতিহ্য ও ব্যক্তি প্রতিভা প্রসংগে টি, এস, এলিয়ট বলেছেন : ” What I mean by tradition involves all those habitual, habit & Custom from the most significant religions rites to our Conventional way of greeting a stranger, which represent the bloodkinship of the same people living in the same place.”
অর্থাৎ একটা ভৌগোলিক খণ্ডের রক্তের সম্পর্ক সম্পর্কিত জনসমষ্টির নিত্য-নৈমিত্তিক আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি, সামাজিক-ধর্মীয় প্রথাদি ঐ বিশেষ জনসমষ্টির ঐতিহ্য এবং এ ঐতিহ্য উত্তরাধিকার সূত্রে লব্ধবস্তু মাত্র নয়, প্রচুর সাধনার মধ্যদিয়ে তাকে পাওয়া যায়। এবং এর সাথে The Historical sense involves a perception, not only of the pastness of the past, but of its presense. অর্থাৎ কেবল অতীতের অতীতটাই নয় বরং অতীতের বর্তমানটাই ইতিহাস চেতনার উপজীব্য। আল মুজাহিদী খোলা চোখের কবি। তিনি সংযমী এবং ঐতিহ্যের আঙিনায় ভাষার অভিজাত পুরুষ। ঐতিহ্যনির্ভর এই কবির কবিতা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে সমুজ্জ্বল। আধুনিক মেজাজের এই কবি সমকালীন কবিতার মৌল স্বভাবটি আশ্চর্য সুষমায় নিজের আয়ত্তে এনেছেন।
০১. আমি আজ তোমার কাছেই ফিরে আসি
পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত পলল ভূমিতে
তুমিই আমার
আমিই তোমার অখণ্ড গতির
মহাকাব্য।
(মৃত্তিকা অতিমৃত্তিকা)
০২. হে আমার অস্তিত্বময়তার একান্ত মৃত্তিকা, অতি মৃত্তিকা
এখানে কেবল চলমান পৃথিবীরা, পৃথিবীবাসীরা বেঁচে থাকে।
আজ এই নির্বাসন থেকে ও নিঃসঙ্গতার করিডোর থেকে পাঠ করছি তোমার
আবেগ উপচে পড়া কখনো বৃক্ষের বৃত্তচ্যুত পত্রালির মতো হৃদয়ের ক্রোড়পত্র।
ঋতুর বৈচিত্রে তুমি বারবার লুকিয়ে উঠো
নবোদগাম উদ্ভিদের মতো ।
(মৃত্তিকা অতি মৃত্তিকা)
নান্দনিক সবুজ আহার:
ইংরেজীতে ‘সিলোজিস্টিক প্রগ্রেশন’ বলে একটা কথা আছে অর্থাৎ যুক্তিবাদী অগ্রসরমানতা। এমনভাবে কবিতার শব্দগুলো অগ্রসর হবে যে পাঠকের কোন কিছু নির্মাণ করবার সুযোগ দেয়া হবে না। অর্থাৎ কবি নিজের বক্তব্য প্রকাশের জন্য ব্যাকরণের বন্ধনের সাহায্যে এমনকি আবেগের সাহায্যে এমনভাবে কবিতার বাক্য নির্মাণ করবেন যে কবির উদ্দিষ্টের অতিরিক্ত কোন কিছু পাঠক কল্পনা করতে পারবেন না। কবির বক্তব্য পাঠক গ্রহণ করতে বাধ্য হবেন। যেমন মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ কাব্যে’র আরম্ভ :
সম্মুখ সমরে পড়ি বীর চূড়ামণি
বীরবাহু চলি যবে গেলা যমপুরে
অকালে, কহ, হে দেবী, অমৃতভাষিণী
কোন বীরবহে বরি সেনাপতি পদে
পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষোকুলনিধি
রাঘবারি।
এখানে পাঠক বা শ্রোতার কোন সুযোগ নেই কোন নতুন তথ্য সংযোজনের বা নতুন শব্দ প্রয়োগের। কবি কোন ফাঁক রাখেননি। কি ধরনের যুদ্ধে বীরবাহুর মৃত্যু হল? সম্মুখ সমর। বীরবাহু কোন ধরনের বীর ছিলেন? বীর চূড়ামণি। বীরবাহুর বয়স কত ছিল? অকালে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। এর পরবর্তী অবস্থা কি? রাঘবারি অর্থাৎ রাবণ পুনরায় কাকে যুদ্ধে পাঠালেন? এই ‘পুনঃ’ শব্দটিও ব্যবহৃত হয়েছে। এই সম্পূর্ণ অংশটি পাঠ করলে দেখা যায় এমনভাবে সিলোজিষ্টিক প্রগ্রেশন ঘটেছে যে পাঠক বা শ্রোতার কোন শব্দ পরিবর্তনের কোনই সুযোগ নেই। তেমনি আল মুজাহিদীর স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের কবিতা “বিজয় দিবস’ও তেমন একটি কবিতা। এই কবিতায় যদিও কিছুটা আবেগ আছে তবু কবিতাটির সমস্ত অবয়বে কোন ফাঁক নেই। পাঠক শ্রবণমাত্র অভিভূত হবে এমনটি ভাবা যায়।
“কুলায় প্রত্যাশী পাখিদের মতো আমি ফিরে আসি নিজ বাসভূমে
রাজপথে কালো পিচঢালা অ্যাশফন্টে কোনো কনভয় লরি নেই
জলপাই রঙ খাকি উর্দি পরা গাড়ি
ওড়না উড়িয়ে স্কার্ফ পরা শ্যামলী মেয়েরা
তাদের নিজস্ব প্রিয় রাজধানী দেখে নিচ্ছে সহগ্রবার
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে
শিশু আবাল-বৃদ্ধ- -বণিতা
বিপণির কাসকেটে রাখা স্বর্ণ দ্রব্যগুলো বুলোচ্ছে আদরে
ওরা যেন এক একজন মাতৃভূমি
এরা যেন এক একজন উদার নীলিমা
ওরা যেন এক একজন প্রত্যুষের সমুদ্র বলয়
ওরা যেন এক একজন মসলিন প্রজাপতি
প্রত্যুষের আলো থেকে জেগে ওঠা প্রতিমা মৃত্তিকা
নীল চোখের স্তবক
এই পৃথিবীতে এক একজন শরীরী উপত্যকা’
আল মুজাহিদীর ‘সিলোজিস্টিক প্রগ্রেশন’ অর্থাৎ যুক্তিবাদী অগ্রসরমানবতার সাথে যুক্ত হয়েছে ‘কোয়ালিটেটিভ প্রগ্রেশন’ অর্থাৎ গুণগত অগ্রসরমানতা। এখানে আল মুজাহিদীর যে গুণের কথা বলছি, তা ঠিক যুক্তির সাহায্যে না সাজিয়ে গুণকে একের পর এক সাজিয়ে, গুণ মানে কোয়ালিটি– অভ্যন্তরীণ সত্তাকে আমি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্ট করছি। যেমন শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতা। শামসুর রাহমানের এই কবিতায়, আবার আল মাহমুদের ‘সোনালী কাবিন’ কবিতার শব্দের গতিবেগের বিন্যাসে গুণগত অর্থসমানতা অত্যন্ত কৌশলের সাহায্যে অভ্যন্তরীণ সত্তার উন্মোচন সাধিত হয়েছে। এক একজন কবির ‘কোয়ালিটেটিভ প্রগ্রেশন’ পাওয়া যায় ভিন্ন-ভিন্ন কবিতায়। বর্তমান আধুনিক বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে নিগঢ় ছেঁড়া বক্তব্যের পাশাপাশি সংযমী, ঋজুতার যে মহৎ দৃষ্টান্ত আল মুজাহিদী স্থাপন করেছেন তা গুণগত অগ্রসরমানতায় একদিকে সৃষ্টি নৈপুণ্যে ব্যঞ্জনময় অন্যদিকে পরিশীলিত চিৎপ্রকর্ষের অভিজ্ঞান।
০১. আমি স্বপ্নে জাগরণে এখনও মাটি চাই
তুমি সেই মহান মৃত্তিকা, আমার স্বদেশ
তোমার বিষুব চোখের কোটরে কম্পমান
আমার অস্তিত্ব।
(স্বদেশের নান্দীপাঠ)
০২. একজন কবি না এলে নদীতে জোয়ার ভাটা থেমে যেতো
শুরা দ্বাদশীর চাঁদ থমকে দাড়াতে অন্ধকারে,
একজন কবি না এলে কেবল হত্যার উৎসব লেগে থাকতো এ গ্রহে
আমি জানি একজন কবি না এলে ‘সুদীর্ঘ বর্বরতায়
জর্জরিত হতো আমাদের এ পৃথিবী
আমি আজ একজন কবিরই, চাই অনিবার্য আবির্ভাব।
(বসন্ত কামিনী)
০৩. হে পৃথিবী, আজ দেখছি তোমার নিজের মঙ্গল চেতনায় তুমি মগ্ন
আর আমি আমার প্রেয়সীর জন্যে বিলাপ করছি
আর আমার পিতৃপুরুষের ফসিলের জন্য।
নাগাসাকি, তুমি বাংলার এ মৃত্তিকা থেকে কুড়িয়ে নাও
শতাব্দীর ঝরাপাতা
এলিজিগুচ্ছ।
(নাগাসাকি সভ্যতার শেষকৃত্যে)
পরমাত্মার সন্ধানে স্বপ্ন বিলাস : একজন কবি সহজেই জগতের বাধা-বিপত্তির বিষম পার্থক্য। অস্তিত্বের সাথে অস্তিত্বের দ্বন্দ্ব কবিকে দগ্ধ করে। শিল্প-প্রকৃতের মাঝখানে নিজস্ব স্বপ্ন দেখেন। নির্ভূতের গহীন জানালায় বসে প্রত্যক্ষ করেন জগতের সারসত্তায়; শব্দের অনুকল্প স্থাপনা, দৃশ্যের সচেতনের অদৃশ্যতা-অচেতন-বোধ সৃষ্টি; তরঙ্গায়িত উপলব্ধির বস্তু কাঠামো বিনির্মাণ- এসব পরীক্ষা প্রক্রিয়া প্রকল্পই কবিতার শরীর ও মন নির্মাণে কবির এ ভাষিক শিল্পের সংস্থিতি। যেখানে অনিশ্চয়তা-নিশ্চয়তার অন্তলোক সর্বাধিক বিকশিত হতে চায় সেখানে আল মুজাহিদী এলিয়ট মতাদর্শের ব্যাখ্যাবলে মৃদু আবেগ যুক্ত, ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিরর কবি। অতিরিক্ত আবেগ যাকে কখনো গ্রাস করেনি, সতত প্রবাহমান তিনি। পূর্বসূরী ওয়ার্ডসওয়ার্থের বিশিষ্ট কাব্যতত্ত্বের প্রতি নির্মম মত পেষণ করেছিলেন টি এস এলিয়ট। তিনি লিখেছিলেন-“The business of the Poet is not to find new emotions. But to use the ordinary ones and in working them up into Poetry to express feeling which are not in actual emotion at all. And emotion which he has never experienced will serve his turn as well as those familiar to him. Consequently, We must believe that emotions recollected in an inexact formula. For it is neither emotion nor recollection, nor without distortion of meaning tranquility ” (The music of Poetry: T.S Eliot)
আবেগের মাত্রাতিরিক্ত সৌধ আল মুজাহিদী ঝেড়ে ফেলেছেন অনেক আগেই। ভিক্টোরীয় যুগের রোমান্টিক ধাঁচ, আর আধুনিক ইংরেজী সাহিত্যের কাব্যকলার সাথে আল মুজাহিদী মিশে গেছেন সাম্প্রতিক কবিতায়; অনিবার্যভাবে, এ এক পরম প্রাপ্তি পাঠকদের। এলিয়টের ক্ষ্যাপা কাব্য সমালোচনা আল মুজাহিদীর কবিতার জমিনে প্রজোয্য নয়।
আল মুজাহিদীর কবিতায় নারী:
স্বপ্ন প্রার্থনার সম্মিলিত ঢেউ : ত্রিশের আধুনিক বাংলা কবিতার পথিকদের ভাষা ছিলো ঋণসর্বস্ব। ইংরেজী জানা এসব কবিদের চেতনায় বিশ্বদরবার ছুটে আসত সবসময়। নারীকে রবীন্দ্রনাথের কিংবা নজরুলের আধুনিক দৃষ্টিভঙিকে এরা পাশ কাটিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতার স্কার্ট, মিডিতে দেখতেই অভ্যস্ত ছিলেন। দেশ, কাল, সমাজের নারীর আচরণ এদের কবিতায় ফুটে উঠত পাশ্চাত্য নারী ঢঙে। অথচ এদের অগ্রপথিক এলিয়টের নারীর ব্যাপারে আগ্রহ ছিল। রক্তমাংসের মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার মত, নর-নারীর সম্পর্ক তাই নানান জটিলতা নিয়ে উপস্থিত তাঁর কবিতায়। আধ্যাত্মিক ভাববাদের কাছে এলিয়টের নারীকে তিনি সমর্পণ করেননি । কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তা করেছিলেন। এলিয়ট নারীকে প্রস্তাব দেন ভ্রমণের রাত্রি যাপনের
তাহলে বেরিয়ে পড়ি তুমি আর আমি দুজনায়
যখন ছড়ানো সন্ধ্যা আকাশের গায়
যেনো রোগী টেবিলে শায়িত, আচ্ছন্ন ইথারে;
চলো যাই সেই পথে জনশূন্য প্রায় সেই দিক
যেখানে আপন মনে কথা বলে নির্জন পথিক
অশান্ত এক রাতের পালা শেষ হলে হোটেলের
এবং কাঠের গুড়ো রেস্তরায়, যেখানে জমেছে খোলা ভাঙ্গা ঝিনুকের
সেই পথ যা এগোয় একঘেয়ে কুতর্কের মতো,
চতুর মতলবে নিয়োজিত
এবং যা ঠেলে নিয়োজিত
এবং যা ঠেলে দেয় চূড়ান্ত প্রশ্নের দিকে…….
জিজ্ঞাসা করোনা যেন, সেটা কী আবার?’
চলো যাই, এই তো সময় বেরোবার।
(টি. এস. এলিয়ট : জে, অ্যালফ্রেন্ট প্রুফকের প্রেমগীতি, অনুব জগন্নাথ চক্রবর্তী)
এলিয়টের এই প্রস্তাব ভ্রমণের; রাত্রি যাপনের সেখানে আল মুজাহিদীর কবিতায় নারী চরিত্র দেশ, ঈশ্বর, বিশ্ব সম্মিলিত সংমিশ্রণের সাথে একমাত্রায় মিশে গেছে। আল মুজাহিদীর নারীপ্রেম আসলে জগৎসংসারের দৈহিক কামনা-বাসনার ঊর্ধ্বে এক আলাদা সত্তা।
০১. হে আমার অস্তিত্বময়তার একান্ত মৃত্তিকা, অতিমৃত্তিকা
এখানে কেবল চলমান পৃথিবীরা, পৃথিবীবাসীরা বেঁচে থাকে
আজ এই নির্বাসন থেকে ও নিঃসঙ্গতার করিডোর থেকে পাঠ করছি তোমার
আবেগ উপচে পড় কখনো বৃক্ষের বৃত্তচ্যুত পত্রালির মত হৃদয়ের ক্রোড়পত্র।
ঋতুর বৈচিত্রে তুমি বারবার লুকিয়ে উঠো
নবোদ্গাম উদ্ভিদের মতো।
(মৃত্তিকা-অতিমৃত্তিকা)
০২. খেলা করো রাতদিন। বন্দী খাঁচার শিকলি কাটো তোমার করাত দিয়ে;
তুমি ডানা ঝাড়ানোর গান গাও শুধু।
তুমি কেন অম্ল-অণু শুষে নাও অরণ্যের শীর্ষ চূড়া থেকে? প্রকৃতির জরায়ু
যোজিত করো তুমি; সংকলিত করো ফল-মূল জংঘার আঁধার থেকে।
(ডুমুর বাগান)
গ্লোবাল ভিলেজে চেতনার নেপোলিয়ান : আল মুজাহিদী হাজার বছর ধরে মানুষের চিন্তা ও সংস্কৃতির দীর্ঘ বিকাশের ধাপটিকে তাঁর কবিতায় রূপায়িত করতে চেয়েছেন এবং তাঁর দেশ কাল সংস্কৃতি কোন নিদিষ্ট ভূ-খণ্ডে সীমাবদ্ধ নয়। সকল কালের এবং মানুষের সভ্যতা ও বিকাশের ইতিহাসের সঙ্গে তিনি একাত্ম ও উত্তরাধিকার অনুভব করেছেন। তাই ব্যাবিলন এবং গ্রীসীয় সভ্যতা তাঁর কাছে সুদূরপরাহত মনে হয় না। মানুষের মৃত্যু হলে তবু মানব থেকে যায়, অতীতের থেকে উঠে এসেে মানুষের কাছে চেতনার হিসাব নিতে আসে। আল মুজাহিদীর আবিষ্কৃত জীবনাদর্শ তাঁর কবিতায় প্রতিফলিত। মানুষের উপলব্ধি ও অগ্রগতির ইতিহাস তার কাব্যে।
“আমরা কি করে যাবো মৃতকল্পে হিমযুগে, বধ্যমূমে
পৃথিবীর মৃত ঘড়িঘরে।
যদি কালের রাখাল ছুটে আসে দ্রুত পায় প্রস্ততায় জনপদে, সাগর প্রান্তরে-
আবার জাগিবে প্রাণ, এইসব পোড়াজমি, পল্লবিত হবে- মহাবিক্ষর কালে
পৃথিবীকে বলে দাও পৃথিবীবাসীর কথা।’
শিল্প, সাহিত্য পরিবর্তনযোগ্য এবং সভ্যতার মতোই গতিময় অর্থাৎ ক্রমঅগ্রসরমান। কবিতার নির্যাসটুকু হয়তো কোন কোন ক্ষেত্রে প্রায় একই, কিন্তু এর বাইরের যে অলংকরণ, অন্তরের যে গীতপ্রবণতা তা বিভিন্নকালে ভিন্নভাবে কবি চেতনায় ধারণকৃত। শিল্প অভিনিবেশ ও গভীরতা দাবি করে। আপাতকালীন সে খোলস পাল্টে হালকা হলেও তার মর্মে ছড়িয়ে আছে তীক্ষèতা, ঋজুতা। কালে কালে যে ধ্বংসযজ্ঞ, মৃত্যু চিন্তা করি- সাহিত্যিকদের চেতনায় গাঢ় হয়ে বসে আছে তার থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিপূর্ণ শিল্প। এক একটি আরম্ভের ঠিক জন্মের মত যেমন শেষ আছে, ঠিক তেমনি আছে সম্ভাবনা। হাজার বছরের বাংলা কবিতার ইতিহাসে চর্যাপদ, বৈষ্ণব, পদাবলীর মাধ্যমে যে পথ ক্রমশ মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, ফররুখ আহমদ অতিক্রম করে। বিংশ শতাব্দীর বাংলা কবিতার মডার্নিজম, পোস্টমডার্নিজম তত্ত্বভাবে ক্রমশ এগুচ্ছে সেই মিছিলে আল মুজাহিদীও অংশগ্রহণ করেছেন। তবে ভাষা, বিষয়, চিন্তার ক্ষেত্রে আল মুজাহিদীর টেকনিক সাম্প্রতিক বাংলা কবিতায় অন্যরকম। যদিও এদেশের পঠন-পাঠন এখনও রোমান্টিসিজমের দিকেই ঝুঁকে আছে। আল মুজাহিদী রোমান্টিক ধারার কবি হলেও তাঁর মাঝে কাজ করে ঐতিহ্য, মানবতা, সমাজমনস্কতা, ইতিহাস চেতনা এবং বিশ্ব ভূ-খণ্ডের এক ও অভিন্ন অবস্থান। এই চিন্তা-চেতনার জন্য তাঁর কবিতার বাচনভর্তি আলাদা কাব্যস্টাইলের পথ খুঁজে পেয়েছে। এজন্যই তিনি বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র ধারার কবি। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেখা যাক–
আমার মৃত্তিকা তুমি জনামুহূর্ত বাক্সময় করে। তোমা বুকের লতানো
পত্রপল্লবীতে আমার উন্মেষ; দিগন্তের খণ্ড খণ্ড মেঘ ঝরে পড়ে। জোয়ান
কৃষক বুকের জমিতে ফলায় শস্যকণা।
এত অস্থির আলো-আধার নেভে আর জ্বলে
জীবনের জোনাকির ঝাড়ে নেমে আসে নারী এক দেবীর মতন।
পাখি অগুনতি পাখি, কোটি কোটি পাখি আকাশ রেখায় শুধু ডানা
মেলে ভেসে যায়।
এইসব প্রাচীন, প্রাগার্য পাখির বুকের গভীরে-
পালকের নিচে শুধু জ্বলে স্বভূমি-স্বদেশ, অরণ্যের উষ্ণ উত্তরাধিকার।
শেষ কথা : আল মুজাহিদীরা কবিতার বিষয়বস্তু একটি উদার মানবতাবোধ, দেশপ্রেম, নারীপ্রেম ও নিসর্গ নিমজ্জনে চক্রাকারে সৌরজগতের ন্যায় ঘুরছে এটা তার কবিতা পাঠে বোঝা যায় । বিশ্বসংস্কৃতির নানাবৃত্তি, মিথে তার মনোযোগ । ইতিহাস ও কিংবদন্তী থেকে অনায়াসে অনুষঙ্গ ও উপমা চয়ন করেন এবং যে চেতনার মাঝে নিজেকে সমর্পণ করেছেন তাকে লাগে এক অবারিত দূরযাত্রা, যেদিকে পড়ার সময়ও আমরা নিতে থাকি তার সঙ্গ। তার কবিতায় আশার পাশাপাশি কিছুটা সংশয়বাদও কাজ করে । এই সংশয় আসলে তার আত্মার অতৃপ্তি। অধিকতর ক্ষুদ্রস্তরে নেমে না এলে তার কবিতায় প্রেরণা কিভাবে কাজ করছে তা উপলব্ধি করা যায় না। তাঁকে বুঝতে হলে সভ্যতার আদি ইতিহাসের উপর জানাশোনা থাকা উচিত। ইতিহাস ও ঐতিহ্যবাদী এই কবি কাল পেরিয়ে মহাকালে আলোচিত হবেন এ আশা করা যায়।