খসরু পারভেজ
দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে,
আমার সুরগুলি পায় চরণ,
আমি পাই নে তোমারে ॥
এপার-ওপার এই অদৃশ্য বন্ধন, পাওয়া না পাওয়ার বেদনাবোধ নিয়েই আমাদের কাছে উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের সত্তায় চিরপ্রবহমান এক সুরপ্রবাহ। যাকে বাদ দিয়ে আমাদের সাহিত্যের ইতিহাস ও তার অগ্রগতির কথা ভাবা যায় না। এত বিশাল ব্যাপ্তিময় প্রভাব আর কোনো কবি আমাদের জীবনে রাখতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ এক বিশাল মহীরুহ। যার প্রকাশ ঘটেছিল ‘কুহেলিকা করে উন্মোচন, সূর্যের মতন।’
আমাদের জীবনের এমন কোনো অভিব্যক্তি, অনুভূতি নেই; যেখানে রবীন্দ্রনাথ অনুপস্থিত। এই মহাপৃথিবী, এই বাংলা, বাংলার প্রকৃতি, জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, জীবনের অপার সৌন্দর্যবোধ সবখানেই তিনি। তাঁর যে বিশাল ব্যাপ্তি তার ভিত রচিত হয়েছিল পরিবার থেকেই। তৎকালীন ভারতে জোড়াসাঁকোর কলকাতার ঠাকুর পরিবার ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক উচ্চবিত্ত বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতি-সামাজিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল। রবীন্দ্রমানস গঠনে পারিবারিক এই ঐতিহ্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর যে ধর্মীয় বোধ, আত্মমগ্নচিত্ততা এটাও উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আভিজাত্য, ব্যক্তিত্ব, পিতা মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাণ্ডিত্য, সাহিত্যপ্রীতি, রক্ষণশীলতা রবীন্দ্রনাথকে পূর্ণ রবীন্দ্রনাথে রূপান্তরিত করেছিল। আমরা জানি, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য। সমাজ সংস্কার ও সাহিত্যান্দোলনের ব্রত নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন। আর এই সংগঠনের পত্রিকা ছিল ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’। পারিবারিক বলয় থেকে এ পত্রিকা ছাড়াও প্রকাশিত হত ‘ভারতী’ ও ‘বালক’ নামে আরও দুটি পত্রিকা। এসব পত্রিকায় কৈশোর থেকেই লিখতেন তিনি। তাঁর কবি হওয়ার ভিত রচিত হয়েছিল পরিবার থেকেই।
আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথের উল্লেখযোগ্য প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ছিল না। একের পর এক চারটি স্কুলে তাঁকে ভর্তি করানো হয়। তারপরও তাঁর স্কুলের পাঠ শেষ হয়নি। প্রকৃত শিক্ষা কখনও প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে না। প্রকৃতপক্ষে ঠাকুর বাড়ি ছিল শিক্ষার্জনের জন্য এক অনুকূল প্রতিষ্ঠান। এই বাড়িতেই তিনি প্রাচ্য, প্রতিচ্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে বিপুল জ্ঞানার্জন করেন। এটা সম্ভব হয়েছিল পারিবারিক পাঠাগার, পরিবারের আধুনিক পরিমণ্ডল থেকেই। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, সেকালের অনেক লেখক, শিল্পী, মনীষীর আবির্ভাব হয়েছিল এই ঠাকুর পরিবার থেকেই।
আমরা একটু পেছনে ফিরে যদি দেখতে চাই, তাহলে দেখব, ঠাকুর পরিবারের প্রথম খ্যাতিমান ব্যক্তি ছিলেন গোপীমোহন ঠাকুর (১৭৬০-১৮১৮)। ইংরেজ ও ফ্রান্সদের বানিয়া হিসেবে খ্যাতি লাভ করলেও তিনি ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ, ডাচ, পর্তুগীজ, সংস্কৃত, পার্সি ও উর্দুসহ বহুভাষায় জ্ঞানার্জন করেন। তাছাড়া হিন্দু কলেজের (১৮১৬) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং প্রধান অর্থকর্তা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
গোপীমোহন ঠাকুরের পুত্র প্রসন্নকুমার ঠাকুর (১৮০১-১৮৬৮) ছিলেন ভারতীয় জাতীয় মহাসভার অগ্রদূত ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠিাতা সদস্য। ‘টেগোর ল লেকচার’ শিরোনামে বার্ষিক বক্তৃতা প্রবর্তনের জন্য তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে মোটা অংকের অর্থ প্রদান করেছিলেন। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কলকাতার হিন্দু নাট্যশালার। ১৮৬১ সালে প্রথম ভারতীয় আইনসভা প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি প্রথম এর ভারতীয় সদস্য হন। প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের পুত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর (১৮২৬-১৮৯০) ব্যারিস্টারি পড়তে ইংল্যান্ড গমন করেন এবং তিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় ব্যারিস্টার । এই ঠাকুর পরিবারেই জন্ম হয়েছিল যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর (১৮৩১-১৯০৮) এর মত বিশিষ্ট অভিনেতা ও সঙ্গীতজ্ঞের। কলকাতা নাট্যশালা উন্নয়নে তাঁর ছিল উল্লেখযোগ্য অবদান। তিনি ১৮৬৫ সালে পাথুরিয়াঘাটায় বঙ্গ নাট্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাটক রচনা, মঞ্চায়ন এবং প্রথম কাব্য প্রকাশের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তাঁর অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয় । ভারতীয় সঙ্গীতাঙ্গনে অর্কেস্ট্রাকে পরিচিত করে তুলতে তিনি ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। যতীন্দ্রমোহন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের সভাপতি এবং ‘রয়াল ফটোগ্রাফিক সোসাইটি’র প্রথম ভারতীয় সদস্য ছিলেন।
রমানাথ ঠাকুর (মৃ. ১৮৭৭) ও যতীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলায় ইউরোপীয়ান শিল্পচর্চার প্রধান কর্ণধার ছিলেন।
পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর ভবন ছিল ইউরোপীয়ান চিত্রকর্মের প্রধান সংগ্রহশালা। শৌতীন্দ্রমোহন ঠাকুর (মৃ. ১৮৯৮) ছিলেন রয়াল একাডেমীর প্রথম দিকের ভারতীয়দের মধ্যে অন্যতম একজন সদস্য। তিনি শিল্পকর্ম বিষয়ে প্রভূত শিক্ষা লাভ করেন।
এই পরিবারেরই একজন খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ও সঙ্গীতজ্ঞ শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর ( মৃত্যু ১৮৯৮)। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সঙ্গীতের তুলনামূলক পাঠ তৈরি করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ১৮৭৫ সালে তিনি ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সঙ্গীতে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তাছাড়া ১৮৯৬ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরো একটি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৭১ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘বঙ্গ সঙ্গীত বিদ্যালয়’ এবং ১৮৮১ সালে ‘বেঙ্গল একাডেমি অব মিউজিক’ নামের সঙ্গীত শিক্ষাকেন্দ্র। ইরানের শাহ তাঁকে ‘নবাব শাহজাদা’ সম্মাননা প্রদান করেন এবং ব্রিটিশ সরকার ভূষিত করেন ‘নাইট’ উপাধিতে।
ঠাকুর পরিবারের প্রভাবশালী, বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬) কলকাতার ইংরেজি সেমিনারী স্কুল থেকে শিক্ষা লাভ করেন। সরকারের রাজস্ব বিভাগে সেরেস্তাদার হিসেবে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। এক পর্যায়ে তিনি চাকুরি ত্যাগ করে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৮২০ সালে বাংলার একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তিনি ব্যাংকিং, ল্যান্ডহোল্ডিং এবং ইউরোপীয়ান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে প্লানটেশন, শিপিং, মাইনিংসহ অন্যান্য ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বাংলায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্রিটিশদের সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। তাঁর পুত্র দেবেন্দ্রেনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) ছিলেন শিক্ষা -সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। দ্বারকানাথের অপর দুই পুত্র গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮২০-১৮৫৪) ও নগেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮২৯-১৮৫৮)। তাঁরাও শিক্ষা – শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। গিরীন্দ্রনাথের পুত্র গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪১-১৮৬৯) সঙ্গীত, নাট্য এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪২-১৯২৩), রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতা। তিনি প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান। ১৮৬৪ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের সদস্য হন। ১৮৫৭ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর ভাই জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রথম ছাত্র। জ্ঞানেন্দ্রনাথ প্রথম আধুনিক জাতীয়তাবাদী সঙ্গীত রচয়িতার কৃতিত্বের দাবীদার। তিনি বেশ সংখ্যক গান লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এবং হিন্দুমেলা সংঘটনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর এক পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯-১৯২৫) ছিলেন একাধারে লেখক, শিল্পী, সুরকার, গীতিকার এবং নাট্য ব্যক্তিত্ব। তিনি অসংখ্য নাটক লিখেছেন,পরিচালনা ও অভিনয় করেছেন। সব পরিচয়কে ছাপিয়ে তিনি মূলত একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে সমধিক পরিচিত। ১৯১৪ সালে লন্ডনে তাঁর নির্বাচিত চিত্রকর্মের একটি প্রদর্শনী হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই ভ্রাতা ১৯০২-০৩ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দীর্ঘকাল আদি ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক (১৮৬৯-৮৮) এবং ব্রাহ্মধর্মবোধিনী সভার সম্পাদক ছিলেন। ব্রহ্মসঙ্গীতের প্রসারের জন্য তিনি ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ সঙ্গীতবিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজে অনেক ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করেন। ঠাকুর পরিবারের গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬৭-১৯৩৮), অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১) ও সুনয়নী ঠাকুর চিত্রকলায় সমধিক প্রসিদ্ধ লাভ করেছেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিত্রকলা বিষয়ের আধুনিক বাংলা স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৪০-১৯২৬) দ্বিতীয় পুত্র সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬৯-১৯২৯) ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ লেখক। রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়েও ঠাকুর পরিবার শিক্ষা -দীক্ষায় সমাজে অবদান রেখেছেন। সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯০১-৭৪) নেতৃস্থানীয় বামরাজনীতিক ছিলেন। আমাদের একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান রয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ও বিকাশ শিক্ষা-সাহিত্য-সঙ্গীত-চিত্রকলা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ একটি বিখ্যাত পরিবারে। তাই তাঁর মানস বিচারে পারিবারিক এই ঐতিহ্যের দিকে চোখ ফেরানোর প্রয়োজন হয়।
আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অতীন্দ্রবাদীতায় বিশ্বাসী ছিলেন। ব্রাহ্ম ধর্মের একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী তাঁর চেতনা। তাঁর সমগ্র সাধনা পরমেশ্বরে সর্ব সমর্পিত। সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তিনি অনুধাবন করেছেন সমগ্রকে। স্পর্শ করতে চেয়েছেন অনন্তকে, অসীমকে।
রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন যে সুন্দরের আরাধনা করেছেন, সে সুন্দরের অস্তিত্ব পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে হয়। তিনি যখন বলেন:
‘এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর
ধন্য হলো অঙ্গ মম, ধন্য হলো অন্তর।’
তখন মানবপ্রেম ও ঈশ্বর প্রেম একাকার হয়ে যায়। আবার যখন বলেন :
কোন্ আলোতে প্রাণের প্রদীপ
জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আস।
সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো,
পাগল ওগো, ধরায় আস।
তখন আমরা বুঝতে পারি, এই পৃথিবীতে, মানব সমাজে তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অনুভব করতে চেয়েছেন। ঈশ্বর কখনও সাধক, প্রেমিক, বন্ধু রূপে তাঁর কাছে প্রতীয়মান হয়। তাঁর সৃষ্টির মূল উৎস হৃদয় থেকে উৎসারিত। পরমেশ্বরের কাছে তাঁর পরম আকুতি সকল মানবের আকুতি হয়ে অনুরণিত হয়। তিনি উচ্চারণ করেন :
“আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে।
সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে॥
নিজেরে করিতে গৌরব দান
নিজেরে কেবলি করি অপমান,
আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে।।
আমারে না যেন করি প্রচার আমার আপন কাজে,
তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ আমার জীবনমাঝে।
যাচি হে তোমার চরম শান্তি,
পরানে তোমার পরম কান্তি,
আমারে আড়াল করিয়া দাঁড়াও হৃদয়পদ্মদলে।।”
রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন ধর্ম, বেদ, পুরাণ, উপনিষদ, বাইবেল, কোরআন, ত্রিপিটক সবকিছুই আত্মস্থ করেছেন। তাই তাঁর গানে, কবিতায় এসব ধর্মের সারবার্তাগুলো প্রতিভাত হয়। প্রয়াত কবি বেগম সুফিয়া কামাল একবার রবীন্দ্রনাথের গানকে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা বলেছিলেন। এ বক্তব্যের প্রতিবাদে সারাদেশে ঝড় উঠেছিল। সুফিয়া কামাল ভুল কিছু বলেননি। আমাদের চিন্তা-চেতনার সংকীর্ণতা আমাদের বোধের পরিধিকে ছোট করে ফেলে। তাই আমরা অনেক সত্যকে মেনে নিতে পারি না। আমরা যারা রবীন্দ্রসংগীত নিবিষ্ট মনে শুনি, তখন কী আমাদের হৃদয় মন পরম সেই সুন্দরের কাছে সমর্পিত হয় না?
‘ ডাকবো না, ডাকবো না অমন করে বাইরে থেকে
পারি যদি অন্তরে তার ডাক পাঠাব, আনব ডেকে॥’
এটার মধ্য দিয়ে তিনি তো সেই পরমাধ্যকে ডেকেছেন।
এমনি অনেক দৃষ্টান্ত দেয়া সম্ভব। আমি সেদিকে যাব না। আমি রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি ও বাংলা প্রীতির দিকে দৃষ্টি ফেরাব।
রবীন্দ্রনাথ যেমন ঈশ্বর প্রেমিক, তেমনি প্রকৃতি প্রেমিক। বাংলার প্রকৃতি এত বিচিত্র রঙ ও রূপে তাঁর মত অন্য কোনো কবির রচনায় এত ব্যাপকভাবে প্রস্ফূটিত হতে দেখি না। আমার ধারণা পূর্ববঙ্গের কুষ্টিয়া -শিলাইদহে আসবার পর রবীন্দ্রনাথ বাংলার রূপ প্রকৃতিকে পরিপূর্ণভাবে অবলোকনের সুযোগ পেয়েছিলেন। এরপর বাংলার প্রকৃতি ও আত্মাকে তিনি তাঁর সাহিত্যে-অন্তরে প্রতিস্থাপন করেছিলেন।
পূর্ব বাংলায় আসবার আগে রচিত তাঁর কবিতা -গানের সাথে পূর্ব বাংলায় আসবার পর রচিত কবিতা-গান যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে এই দুইয়ের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করব। প্রথমে তিনি মনোজাগতিক, অন্তরের সৌন্দর্যকে প্রস্ফূটিত করার জন্য ধ্যানমগ্ন ছিলেন। পরে তিনি বাইরের দিকে চোখ ফেরালেন। এলেন মাটি ও মানুষের কাছাকাছি।
প্রকৃতির একান্ত সান্নিধ্য লাভ ও একই সাথে তাঁর অন্তরস্থিত সৌন্দর্যের পূর্ণ বিকাশ ঘটে এখানে আসবার পর। বাউল সাধনার পীঠস্থান কুষ্টিয়া অঞ্চল।
এখানে আসবার পর তাঁর কবিতা -গানে ব্যাপকভাবে বাউল প্রভাব লক্ষ্যনীয়। আমি এভাবে বলতে চাই–
রবীন্দ্রনাথের অন্তরে যে বাউল এতদিন ঘুমিয়ে ছিল, পূর্ব বাংলায় বাউল সুর ও বাউল কবি গগন হরকারা, লালন ফকিরের সৃষ্টির সংস্পর্শে সে বাউল জেগে উঠল।
“ভেঙে মোর ঘরের চাবি
নিয়ে যাবি কে আমারে
ও বন্ধু আমার!
না পেয়ে তোমার দেখা,
একা একা দিন যে আমার কাটে না রে ॥
বুঝি গো রাত পোহালো,
বুঝি ওই রবির আলো
আভাসে দেখা দিল গগন-পারে–
সমুখে ওই হেরি পথ,
তোমার কি রথ পৌঁছবে না মোর-দুয়ারে ॥”
ঘর ভেঙে বেরিয়ে আসার এই আকুতি আগেই রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে বহমান ছিল। পরে তা রূপ নিল প্রকৃত সার্থকতায়। বলতে চাই, তিনি যদি পূর্ব বাংলায় না আসতেন; তাঁর কাছ থেকে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ এর মত এত গভীর আত্মনিবেদিত দেশবন্দনা মূলক গান কি পেতাম? পেতাম না। হয়ত আমাদের জাতীয় সংগীত হতো অন্য কোনো দেশাত্মবোধক গান। বাংলা মায়ের প্রতি এমন দরদ মাখানো কথা আর বাউল সুরের অপূর্ব সংমিশ্রনে অনবদ্য সৃষ্টি কমই চোখে পড়ে। গগন হরকারার গান ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে ‘ এর সুরে তিনি ‘আমার সোনার বাংলা’ কে বাঁধেন।
সমগ্র রবীন্দ্রসাহিত্যে পূর্ববঙ্গে অবস্থানকালে রচনার গুরুত্ব অপরিসীম। এ বিষয়ে আমি ভিন্ন প্রবন্ধে আলোচনা করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছি।
রবীন্দ্রনাথের চেতনায় জীবনের যে অনিবার্য দুঃখবোধ তা তাঁকে তাড়িত করেছে, কখনও তার ভেতরে জীবনের আনন্দ প্রকাশই মূখ্য উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে। তিনি বলেছেন, “আনন্দই সাহিত্যের উদ্দেশ্য। সেখানে লেখকের দায় খুঁজতে যাওয়া নিরর্থক।”
রবীন্দ্রনাথ সৌন্দর্য ও সুন্দরের জগতে বিচরণ করেছেন কিন্তু গভীর বেদনাবোধ তাঁকে যে আক্রান্ত করেনি, এমন নয়। একের পর এক পুত্র,
কন্যা, সজনের মৃত্যু, স্ত্রীর মৃত্যু তাঁকে একান্তভাবে বিপর্যস্ত করেছে। সমগ্র রবীন্দ্রসাহিত্যে যে বেদনা ও বিষাদের সুর অনুরণিত হয়েছে, তা যেন আনন্দে মিশে গিয়ে আনন্দ-বিষাদের এক অপূর্ব দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে।
“প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন, তবু প্রাণ কেন কাঁদে রে । চারি দিকে হাসিরাশি, তবু প্রাণ কেন কাঁদে রে ॥”
অথবা
“কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসার ঘায়ে,
নিবিড় বেদনাতে পুলক লাগে গায়ে।।”
এ যেন দুঃখ নিয়ে দুঃখজয়ের সাগরে এক আনন্দ অবগাহন। নিবিড় বেদনাতে গায়ে পুলক লাগতে পারে, বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের আগে কেউ আমাদেরকে এই বোধে আক্রান্ত করেছেন বলে আমার জানা নেই।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সুখ-দুঃখের অবস্থান খুঁজেছেন এভাবে :
“সুখে আছে যারা সুখে থাক তারা
সুখের বসন্ত সুখে হোক সারা।।”
তিনি জীবন ও জগতকে কখনও নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেননি, সবকিছুই ইতিবাচক ভেবেছেন। এখানেই রবীন্দ্রমানসের বড় বৈশিষ্ট্য নিহিত।
রবীন্দ্রনাথের বিচরণ ছিল সৌন্দর্য ও আনন্দের জগতে। মানব জীবনের অপার সৌন্দর্যবোধ ও মহিমাকে শিল্পীত রূপ দিয়েছেন তিনি। এ কারণেই তিনি সামন্ততান্ত্রিক, না ধনতান্ত্রিক, না অতিন্দ্রীয়বাদী এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যাওয়া নিরর্থক। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা তাঁকে জর্জরিত করি। তিনি হৃদয়তাড়িত, জীবন-মৃত্যুর রহস্য আর সৌন্দর্য আবিস্কারেই সচেষ্ট থেকেছেন আজীবন। তাঁর নাটক, কবিতা, নৃত্যনাট্য সবই গভীর জীবনবোধে উদ্ভাসিত।
রবীন্দ্রনাথ একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, কথাশিল্পী, ছোটগল্পকার, সঙ্গীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, তাত্ত্বিক, চিন্তাবিদ, সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিক। তাঁর রচনার সংখ্যা বিপুল। এর মধ্যে ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তাঁর জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর অসংখ্য কবিতা, প্রবন্ধ, গান, বক্তৃতার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র, সমাজের কল্যাণের কথা বলেছেন, জীবনমুখী শিক্ষার কথা বলেছেন, জীবনের দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তির কথা বলেছেন। তাঁর সকল সৃষ্টিতে, কর্মকাণ্ডে তিনি মানবকল্যাণে সমর্পিত। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি কৃষকদের উন্নতির জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন কৃষিব্যাংক। আর্থসামাজিক উন্নয়নে আজ যে ক্ষুদ্রঋণ, কৃষিঋণের প্রচলন ও প্রসার ঘটেছে; তার শুরুটা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের হাতেই।
তিনি বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে বিশ্বসভায় বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। ১৯১৩ সালে প্রথম এশীয় হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির কারণে তিনি এতখানি সামাদৃত-আলোচীত এমন একটি সাধারণ ধারণা আমাদের। এটা আমাদের বাঙালিদের গড়পরতা মানসিকতা। আমি বলতে চাই, রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার না পেলেও,তাঁর বিপুল ও স্বর্ণময় সাহিত্য নিয়ে আমাদের গর্বের কোনো ঘাটতি হতো না। কিন্তু তাঁর নোবেল প্রাপ্তিতে যেটা ঘটেছে, সেটা হলো -বিশ্বের কাছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তুলে ধরার যে প্রয়াস নিয়েছিলেন আমাদের প্রথম আন্তর্জাতিক চেতনার কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে তা পূর্ণতা পেয়েছে।
রবীন্দ্রনাচেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ এই বাংলার মাটি, নদী, জল, বাংলার প্রকৃতি। তাঁর ঐশ্বর্যমণ্ডিত সাহিত্যে প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, সৌন্দর্যবোধ, চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ইতিহাসচেতনা, নান্দিকতা, দর্শন, ভাব, ভাষা ও ছন্দের বহুমাত্রিকতার যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা শুধু আমাদের সাহিত্যে নয়, বিশ্বসাহিত্যে বিরল। আমরা বাঙালি, আমাদের প্রাণে, চেতনা, মননে, সমগ্র সত্তা জুড়েই রবীন্দ্রনাথ দীপ্ত হয়ে আছেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, আজকের দিনে রবীন্দ্রনাথ কতটুকু প্রাসঙ্গিক? আমি প্রথমেই এমন ধরনের একটা কথা বলেছি , আমাদের জীবনের এমন কোনো অনুভূতি নেই, যেখানে রবীন্দ্রনাথ নেই। তিনি চির নতুনের কবি। প্রতিটি দিন তিনি নতুন রূপে আমাদের কাছে ফিরে আসেন। কেননা, আমরা এখনও মানবমুক্তির সংকটে আবর্তিত। আমাদের সংকটে তাই রবীন্দ্রনাথকে বারবার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কবির সাধনা ছিল মানবমুক্তি। এই মুক্তি অসুন্দর,অসত্য, অমানবিকতার শৃঙ্খল থেকে মানবের মুক্তি। তিনি জীবনের শুরু থেকে শেষ দিনটি পর্যন্ত হৃদয়ে লালন করেছেন মানব মুক্তির দর্শন। এই মানবমুক্তি শুধু স্বদেশের জন্য নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন বিশ্বমানবতায়। তিনি মানবিকতা, মানবকল্যাণ ও মানবমুক্তির স্বপ্নকে হৃদয়ে লালন করেছেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের প্রতি প্রেম ও ভালোবাসা এবং পরার্থে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন। এই বিশ্বজগৎ, পারলৌকিক জগৎ, ধর্ম, সত্য-সুন্দর কোনো কিছুর অস্তিত্ব মানুষকে বাদ দিয়ে নয়। এজন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘মানুষের ধর্ম’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘ধর্ম মানেই মনুষ্যত্ব- যেমন আগুনের ধর্ম অগ্নিত্ব, পশুর ধর্ম পশুত্ব। তেমনি মানুষের ধর্ম মানুষের পরিপূর্ণতা।’ এই মানবকল্যাণে মধ্যেই রবীন্দ্রমানসের তাৎপর্য নিহিত। আর মানবমুক্তির জন্য অন্তরের পরিপূর্ণ বিকাশের প্রয়োজন। আর এই জন্যই তাঁর প্রার্থনা:
“অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে
নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে।”
রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-চেতনায় কাঙ্ক্ষিত ছিল শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ, মুক্তচিন্তার প্রসার ও মানব মুক্তির প্রত্যাশা। তিনি বলেছেন, ‘‘মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় হচ্ছে, সে মানুষ।” আজকের দিনে এই কথা বলবার সময় এসেছে যে, মানুষ সর্বদেশের সর্বকালের। তার মধ্যে কোনো জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণতা বা বর্ণভেদ নেই।
আমি গুরুবাদে বিশ্বাসী নই। তাই আমি আমার আলোচনায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কোথাও ‘কবিগুরু’ অভিধায় উল্লেখ করিনি। আমার মনে হয়েছে, রবীন্দ্রনাথকে মূল্যায়ন বা অবমূল্যায়ন যাই-ই হোক না কেন, তাঁর প্রতি অতিভক্তি, গুরুবাদ আরোপ
প্রকৃত রবীন্দ্র-উন্মোচনের অন্তরায় হয়ে আছে।
আমাদের মানবিক সংকটে, বর্ণবৈষম্য, সাম্প্রদায়িক হীনমন্যতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনদর্শন সত্য ও সুন্দরের কাছে সমর্পিত হতে আমাদেরকে সহায়তা করতে পারে। আসুন রবীন্দ্রআলোয় আমরা আলোকিত হই।