১.
ধোকার এ জিন্দেগি তো শেষ হয়ে যাবে একদিন,
কামনার ধূপকাঠি পুড়তে পুড়তে হয়ে যাবে ছাই;
রয়ে যাবে পৃথিবীতে মত্ত করা বসন্ত রঙিন,
শুধু আমি থাকবো না, চিরতরে হয়ে যাবো নাই।
নাই হয়ে চলে যাবো, খুঁজে কেউ পাবে না কোথাও;
তখন তোমার কাছে করা হবে আমাকে হাজির;
এ মুখদর্শনে, হায়, যদি তুমি ক্রুদ্ধ হয়ে যাও
বর্ষার মেঘের মতো ছেড়ে দেবো দুচোখের নীর।
দুচোখের নীরে যদি না ভেজে গো তোমার হৃদয়,
আমি কবো, “হে দয়ালু, আজ তুমি হয়ো না পাষাণ;
কী করে হিসেব দেবো, কবিরা তো বেহিসেবী হয়–
যা-ই করি, তুমি জানো গেয়ে গেছি কার গুণগান,
কার গুণগান আমি গেয়ে গেছি সমস্ত জীবন;
মিলনের দিনে কেন বুনো ওল করে আছো মন?”
২.
তোমার কুসুম দেখে প্রশংসায় হয়েছি মুখর
কামিনীর মধুবাস মধ্য রাতে করেছে উতলা;
হেলেনের মুখ দেখে সারা অঙ্গ কাঁপে থরথর,
পড়েছে ঝড়ের রাতে হৃৎপিণ্ডে বিদ্যুতের ফলা;
বিদ্যুতের ফলা গেছে বিদ্ধ করে সমস্ত শরীর,
তোমার সৃষ্টির রূপে মূর্ছা গেছে আমার দুচোখ;
কী রসে রেধেছো তুমি জীবনের সৌন্দর্যের ক্ষীর,
স্বাদেগন্ধে এ জগৎ হয়ে আছে যেন স্বর্গলোক।
স্বর্গলোক সৃষ্টি করে ফেলে দেছো কপোতাক্ষপাড়ে,
কাশফুলে সর্ষেফুলে ঝিকমিক করে স্বর্ণরোদ;
এত ভালো কেন লাগে এ জীবন? অস্থি-মজ্জা-হাড়ে
কে বাজায় কামনার স্যাক্সোফোন-সানাই-সরোদ?
তোমার সৃষ্টিরা যদি করে রাখে এভাবে মাতাল,
না জানি তোমাকে দেখে এ মূর্খের কী হবে গো হাল!
৩.
কি-সূন্দর বানানেঅলা, কি-সুন্দর বানায়েছো সব!
বানায়েছো বেনে বউ, গাঙচিল, দোয়েল, শালিক;
বানায়েছো কত ফুল, কত তার রঙ ও সৌরভ,
সে-সৌরভে মত্ত হয়ে গান জোড়ে বসন্তের পিক।
ছোটে ছোট্ট পিপীলিকা, বানায়েছো কি-চঞ্চল করে,
চলতে চলতে পথে যারই সাথে হয়ে যায় দেখা
থেমে থেমে কথা কয়, কত কথা কয় প্রাণভরে,
তারপর যেন অশ্ব ঝড়োগতি ছুটে চলে একা।
কি-সুন্দর করে তুমি বানায়েছো বিশাল গগন,
দাাঁড়িয়ে খাম্বাবিহীন কিংবা যেন ঝুলছে বাদুড়;
নিশিতে নক্ষত্ররাজি করে তোলে কুসুমের বন,
বর্ষায় বারিদবালা নৃত্য জোড়ে গুড়গুড়গুড়।
কি-সুন্দর বানানেঅলা, যেই তুমি বলে দাও কুন
সাথে সাথে বিশ্বময় হয়ে যায় ফুলের ফাল্গুন।
৪.
আর কাহারেও আমি এ জীবনে কবো না সুন্দর,
তোমার সুন্দরে পুড়ে হয়ে গেছি ভস্ম কোহে তুর;
পুড়েছে সোনার দেহ আর এই রূপার অন্তর,
পুড়ে পুড়ে ছাই, তবু এ জীবন হয়েছে মধুর।
আর কারো নাম আমি এ জীবনে নেবো না জবানে,
তোমার নামের স্পর্শে সারা গাল হয়ে আছে চিনি;
এ চিনির কি যে স্বাদ আর এর মর্ম যারা জানে,
নিতে তারা চাইবে না আর কিছু মুখে কোনোদিনই।
কানে আমি শুনবো না এ জীবনে আর কারো নাম,
তোমার নামের মাঝে ডুবে গেছে এ নামীর মন;
আমার অস্তিত্ব জুড়ে বাজে আজ তোমার কালাম,
আসুক তুফান ঝড়, তোমাতেই নিয়েছি শরণ।
তোমার সুন্দরে পুড়ে এই চোখ হয়ে গেছে সোনা;
তুমি ছাড়া, হায় প্রভু, আর আমি কিছু দেখবো না।
৫.
আমি এক ক্লিষ্ট প্রাণ, কামনার কালানলে পুড়ে
হয়ে গেছি যেন ছাই। বসন্তের প্রফুল্ল প্রসূন
করেছিল গন্ধে মত্ত; এ হৃদয় গিয়েছিল উড়ে
মধুকর হয়ে; হায়, নিশীথে সে হয়ে যায় খুন!
যে প্রমোদতরী এসে ভিড়েছিল রাতের বন্দরে,
আমি তার কোলাহলে হারিয়েছি আমার চেতনা;
নেশার নীহারে গেছে দুচোখের দুই পাতা ভরে;
ভোরের আজান আর কিছুতেই হয় নাই শোনা।
আমি কি গিয়েছি ভুলে একবারও তোমাকে হে নাথ?
শোনোনি কি ফাঁদে পড়া কপোতের করুণ ক্রন্দন?
আমি এক ক্লিষ্ট প্রাণ, ফুলের পাপড়ির মতো হাত
রাখো যদি এ শরীরে, মনে হবে তাও কোটি মণ।
ভালবাসা দিয়ে ছোঁও, জয়ী হোক রহমান নাম;
বয়ে যাক চতুর্দিকে শান্তিঝড়—সালাম সালাম।
৬.
কি-ক্ষুদ্র, কি-তুচ্ছ আমি, কি-নগণ্য এ-সৃষ্টিজগতে!
যে-মহাবিশ্বের কাছে এ-পৃথিবী ছোট্ট এক বিন্দু,
যেখানে শেওলা হয়ে অতলান্ত মহাকালস্রোতে
ছুটছে নক্ষত্ররাজি, উপচে পড়া মহাসৃষ্টিসিন্ধু;
কত যে এস্টরয়েড, কায়পার বেল্ট কত, ছোটে
মহাশূন্যে, ছোটে গ্রহ উপগ্রহ গ্যালাক্সি নেবুলা;
কি-বিশাল মহাকাশে কি-বিপুল সূর্যফুল ফোটে!
সেখানে এ ক্ষুদ্র কবি, সারা অঙ্গে মাখা যার ধূলা,
কী সাহসে তোলে মুখ, বলে ওঠে, ‘আমিও, মহান,
কি-সুন্দর সৃষ্টি দ্যাখো, সত্য বটে অতিশয় ক্ষুদ্র
কিন্তু এ হৃদয়ে আছে অন্তহীন বসন্তের গান,
বুকে নিয়ে চলি আমি কি-উত্তাল সুরের সমুদ্র!
তুমি যদি চাও, তবে, চাইতে হে করো না কসুর,
না চাইলেও দিয়ে দেবো সব গান আর সব সুর।’
৭.
কে আর গাইতে পারে, আমি ছাড়া, তোমার প্রশস্তি
এত মিষ্টি করে? হায়, কে বা জানে এত মিষ্টি ভাষা!
আকাশপারের কোন্ তারা বলো, যেন জলহস্তি,
এভাবে বুনতে পারে অশ্রু দিয়ে বাবুই-এর বাসা?
জানি তুমি সুবিশাল, সীমাহীন তোমার রাজত্ব;
তোমার আদেশে ঘোরে কোটি কোটি সুপার ক্লাস্টার
নক্ষত্র নেবুলা নিয়ে কোটি কোটি; কিন্তু এ-ও সত্য,
আমার হাতেই শুধু বেজে ওঠে সুরের সেতার।
কেমন বাজাতে পারি, শোনো তুমি এ বীণার সুর;
আমার এ সুর শুনে মহাবিশ্ব কাঁপে থরথর,
চোখের পলকে রাত হয়ে যায় ভয়েতে দুপুর
কারণ বলেছি আমি—’বিশ্বে শুধু তুমিই সুন্দর’।
তুমি যে সুন্দর কত, আমি ছাড়া জানে তা ক-জন?
সুন্দরের সেই গান গাই আমি, শোনো দিয়ে মন।
৮.
আমি তো থাকবো পড়ে সংজ্ঞাহীন সহস্র বছর
যেদিন দুচোখ খুলে দেখতে পাবো প্রথম তোমাকে;
তোমার রূপের কথা কোনোদিন শোনে নাই ভোর,
শোনে নাই চন্দ্র-তারা; যে-কুসুম মুগ্ধ করে রাখে
সুবাসে-সৌন্দর্যে, সেও শোনে নাই কেমন সুন্দর
সৃজেছে যে তাকে; আর সূর্যাস্তও শোনে নাই কানে
তোমার সুশ্রীর কথা; হয়ে যেতো লজ্জায় মন্থর,
যে-পানি অশ্বের মতো লেজ তুলে ছুটেছে উজানে
যদি সে শুনতে পেতো সর্বনাশী সুন্দরের কথা।
আমার দুচোখ জানে আর জানে আমার হৃদয়—
এমন সুন্দর তুমি, যে-সুন্দরে সব সুন্দরতা
জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে তোমার সম্মুখে নত হয়।
জ্বলে যাই পুড়ে যাই আর যা-ই থাক এ কপালে,
তোমাকে একটিবার দেখি যেন মরণের কালে।
৯.
কী কবো লজ্জার কথা, হয়ে যায় আড়ষ্ট জবান,
দিয়েছিলে যে-জীবন, তার দিকে মুখ তোলা দায়–
যেন এক সারমেয়, পিঠে যার মাছি গায় গান,
পিঠের পশম উঠে ভরে গেছে ঘা ও পাঁচড়ায়,
ছড়ায় বোটকা গন্ধ, দূর দূর করে লোকজন।
কী করে দেখাই, হায়, তোমাকে এ হৃদয়, দরদী,
যে-হৃদয় এককালে ছিলো ভরা-কুসুমের বন,
ছিলো এক খরস্রোতা আঁকাবাঁকা উন্মাতাল নদী,
আজ তা ভাগাড় শুধু; ভরে আছে পচা-গলা লাশ;
উৎকট দুর্গন্ধে তার সমীরণও গেছে পচে পুরো;
জগতের প্রেতিনীরা এ হৃদয়ে বসে বারো মাস
পেতে গেছে কূটজাল; সেই জালে পড়ে এই মূঢ়
হারিয়ে ফেলেছে সব- স্বপ্ন, সাধ, জীবন, যৌবন;
তুষের অগ্নির মতো কি-লজ্জায় জ্বলে যায় মন!
সায়ীদ আবুবকর
জন্ম ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ বাংলাদেশের যশোর জেলায়। নব্বইয়ের দশকের শক্তিমান কবি। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ১৫টি। প্রণয়ের প্রথম পাপ (১৯৯৬) সবচেয়ে জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ। নবিনামা (২০২১) তাঁর একটি বহুল আলোচিত মহাকাব্য। অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে জুলেখার শেষ জাল (২০০৪), সাদা অন্ধকারে কালো জ্যোৎস্নায় (২০০৬), বঙ্গেতে বসতি (২০০৮), এবার একটিবার একসাথে (২০১০), কপোতাক্ষ পাড়ের রোদ্দুর (২০১২), কাগজ কুসুম (২০১৪), আমার কোথাও যাওয়ার নেই (২০১৭), মহাকালের কান্না (২০১৮), বাংলাদেশ (২০২২) উল্লেখযোগ্য। প্রকাশিত প্রবন্ধের বই ৪টি: কবিতা কমল (২০০৬), কবিতার আধুনিকতা (২০১০), সাহিত্যের সাত-সতের (২০১৮) ও সাহিত্যের সীমানা (২০২৩)। তিনি একজন বিশিষ্ট অনুবাদকও। বাংলা ভাষায় মধুসূদনের ইংরেজি কবিতার প্রথম অনুবাদক। মধুসূদূনের ইংরেজি কবিতা (২০০৯), আল মাহমুদের The Golden Kabin (২০১০, যুক্তরাষ্ট্র), ভিন্ন ভাষার শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৪), নির্বাচিত বিদেশী কবিতা (২০১৮), নজরুলের The Egalitarian (২০২০, আমাজন), হ্যান্স এন্ডারসনের বেহেস্তের বাগান (২০১৮, মধুসূদনের ইংরেজি সনেট (২০২৩, কলকাতা) তাঁর উল্লেখযোগ্য অনুবাদগ্রন্থ। আধুনিক বাংলা কবিতা (২০০৯, ২০১৯)তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকলন। Bangla Literature নামে তিনি একটি ইংরেজি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করে থাকেন। পেশা অধ্যাপনা, সরকারি কলেজে।