কাজী জহিরুল ইসলাম
জীবনানন্দ দাশ পঞ্চপাণ্ডবের একজন হলেও, পশ্চিমের প্রভাবে বাংলা কবিতার মূলধারা যে ত্রিশের দশকে বদলে গেল, এই বাঁক বদলের সঙ্গে মূলধারার একটি সেতুও তিনিই। তিনি যেন একটি কাঠের সাঁকো হয়ে রবীন্দ্রনাথ আর বুদ্ধদেব বসুদের মাঝখানে শুয়ে আছেন। বিশেষ করে “বনলতা সেন” কবিতাটি সেই সাঁকোর এক উজ্জ্বল পাটাতন।
এই কবিতায় মধ্যযুগ থেকে প্রচলিত পয়ারের শুদ্ধ প্রয়োগ যেমন আছে, আছে অন্ত্যানুপ্রাস বা অন্তমিল, আছে নিটোল অনুপ্রাস, এমন কী ত্রিশের কবিদের ছুঁড়ে ফেলে দেয়া ক্রিয়াপদে সাধুরীতির প্রয়োগও একেবারে বাদ যায়নি। আজ এই রচনায় “বনলতা সেন” কবিতাটি নিয়ে আমার মত করে কিছুটা আলোচনা করার চেষ্টা করবো। বনলতা সেনকে বুঝতে হলে এই কবিতায় ব্যবহৃত ঐতিহাসিক/পৌরাণিক শব্দসমূহকে এবং এইসব শব্দের পটভূমি কিছুটা হলেও বুঝতে হবে। তিনি এই কবিতায় ব্যবহার করেছেন, বিম্বিসার, অশোক, বিদর্ভ নগর, বিদিশা, শ্রাবস্তী। প্রথমে এই শব্দগুলোর সঙ্গে পরিচিত হই।
প্রাচীন ভারতের একজন রাজা ছিলেন বিম্বিসার। বয়সে তিনি ছিলেন গৌতম বুদ্ধের কাছাকাছি। প্রায় অর্ধশতককাল তিনি মগধ রাজ্য শাসন করেন। তার জন্ম যীশুখৃষ্টের জন্মের ৫৫৮ বছর আগে। বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারে তার পৃষ্ঠপোষকতার কথা জানা যায়। রাজ্যবিস্তারের এক অদ্ভুত কৌশল তিনি গ্রহন করেন। বিভিন্ন রাজ্যের রাজকুমারীদের বিবাহের মাধ্যমে রাজ্যবিবাদ মিমাংসা এবং সাম্রাজ্য বিস্তার করতেন তিনি। বিম্বিসার কোশলরাজ মহাকোশলের কন্যা কোশল দেবীকে বিবাহ করে দুই রাজ্যের দীর্ঘদিনের বিবাদ নিস্পত্তি করেন। এই বিবাহের যৌতুক হিসেবে তিনি কাশীর অধিকার লাভ করেন। তিনি বৈশালীর লিচ্ছভি মহাজনপদের প্রধান চেতকের কন্যা চেল্লানাকে বিবাহ করেন। যার গর্ভে তার এক বীরপুত্র অজাতশত্রুর জন্ম হয়। বিম্বিসারের তৃতীয় পত্নী ছিলেন ক্ষেমা, তিনি ছিলেন মদ্র রাজ্যের রাজকন্যা। বিম্বিসার বিদের রাজকন্যা বাসবীকেও বিয়ে করেন।
কথিত আছে বৈশালীর নগরবধু অপরূপ সুন্দরী আম্রপালির প্রেমে নিমজ্জিত ছিলেন বিম্বিসার। আম্রপালির গর্ভে তার এক পুত্র সন্তানও জন্ম নেয়। পরবর্তিতের তার পুত্র অজাতশত্রুও আম্রপালির প্রেমে পড়েন। বিবাদে জড়িয়ে অজাতশত্রুর ভাইয়েরা আম্রপালিকে বন্দি করেন এই খবর পেয়ে অজাতশত্রু পুরো বৈশালী পুড়িয়ে দেন। এতে কেবল আম্রপালি ছাড়া আর কেউ জীবিত ছিল না।
বিম্বিসারের মৃত্যুর প্রায় আড়াইশ বছর পরে মগধকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মৌর্য্য সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহন করেন সম্রাট অশোক। এই সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল পাটালিপুত্র। মৌর্য্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা অশোকের দাদা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য। চন্দ্রগুপ্তের একজন মন্ত্রী ছিলেন চাণক্য, যিনি তার সময়কালের সবচেয়ে বিচক্ষণ দার্শনিক, অর্থনীতিক এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। চন্দ্রগুপ্তের রাজ্য মূলত পরিচালিত হত চাণক্যের পরামর্শে। মৌর্য্য সাম্রাজ্য সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করে অশোকের সময়ে। অশোক ছিলেন মৌর্য্য সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শাসক বিন্দুসার ও এক দাসীর পুত্র। বিন্দুসারের মৃত্যু হলে ২৬৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মৌর্য্য সাম্রাজ্যের তৃতীয় শাসক হিসেবে অশোক সিংহাসনে আরোহন করেন। অশোকের সাম্রাজ্যই ছিল ভারতবর্ষের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য। তাই অশোকের ইতিহাস এখন শ্রীলঙ্কা, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ সকলেরই ইতিহাস। তিনি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। সেই সময়ে ক্ষমতাবান মানুষদের একাধিক স্ত্রী ছিল, অশোকেরও পাঁচজন দাম্পত্য সঙ্গী ছিলেন, তারা হলেন: অসন্ধিমিত্রা, দেবী, কারুবকী, পদ্মাবতী এবং তিষ্যরক্ষা। কারো কারো মতে বিদিশা নামক একজন স্ত্রীও তার ছিলেন। অশোকের মৃত্যুর পর তার পৌত্র দশরথ পাটালিপুত্রের সিংহাসনে আরোহন করেন।
মহাভারতের একটি পৌরাণিক নগর বিদর্ভ, এর রাজা ছিলেন ভীম। পৌরাণিক নগর হলেও মহারাষ্ট্রে বিদর্ভ নামে একটি নগর আছে। বিদর্ভ নগরের কিছু প্রাচীন মুদ্রা পাওয়া গেছে, যেগুলো খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে মুদ্রিত।
বিদিশা শব্দটি নিয়ে নানান ধুম্রজাল আছে। এটি এখন মধ্যপ্রদেশের একটি শহর। প্রাচীন ভারতে যে বিদিশা নগর ছিল এটিই সেই বিদিশা কিনা তা বলা মুশকিল। কারো মতে বিদিশা নগরীর এক নারী যার নামও ছিল বিদিশা, তিনি রাজা অশোকের স্ত্রী ছিলেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের অনুরাগী ছিলেন এবং অশোককে মানুষ হত্যা থেকে নিবৃত্ত রাখতে চেয়েছিলেন। অশোক স্ত্রীর কথা শোনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা ভঙ্গ করেন। কলিঙ্গের যুদ্ধে ব্যপক হতাহতের পর অশোকের বিজয় হয় ঠিকই কিন্তু রাজ দরবারে ফিরে এসে বিদিশাকে আর পাননি। বিদিশার গর্ভেই অশোকের দুই পুত্র-কন্যা মহিন্দ্র এবং সঙ্ঘমিত্রার জন্ম হয়। কারো মতে অশোকই সঙ্ঘমিত্রা এবং মহিন্দ্রকে সিংহলে পাঠান, কারো মতে ওরা মাথা মুড়িয়ে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নিয়ে সিংহলে চলে যান। বিদিশা গৃহত্যাগী হবার আগে অশোককে একটি চিঠি দিয়ে যান। সেখানে লেখা ছিল পুত্র-কন্যাকে অশোকের কাছে রেখে তিনি বুদ্ধসঙ্ঘে যোগ দিতে গৃহত্যাগী হয়েছেন।
যে কোশল রাজ্যের রাজকন্যা কোশল দেবীকে বিয়ে করেন রাজা বিম্বিসার সেই কোশলের এক সুন্দর নগরের নাম শ্রাবস্তী। শ্রাবস্তী ছিল মগধ ও তার আশেপাশের রাজ্যসমূহের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর নগর।
অপ্রচলিত শব্দগুলোর অর্থ জানা হয়ে গেল এখন কবিতাটি জলের মত পরিস্কার লাগবে। আরো একটি জায়গার নাম ‘সিংহল’ এই কবিতায় আছে, সেটি হচ্ছে শ্রীলঙ্কার প্রাচীন নাম।
প্রথমে কবিতার ছন্দটি দেখে নিই। এটি শুদ্ধ অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা এবং যে অর্থে ফ্রি ভার্স শুরু হয়েছিল, ছন্দ ঠিক থাকবে কিন্তু ভার্স বা পঙক্তি ছোটো বড়ো হবে, অর্থাৎ ভার্সগুলো ফ্রি থাকবে, এখানেই থাকবে কবির স্বাধীনতা, বনলতা সেন কবিতায় এই কাজটি তিনি করেছেন। প্রথম ৬ লাইনের পর্ব বিন্যাস ৮/৮/৬ মাত্রায়। অর্থাৎ ২২ মাত্রার মহাপয়ার।
৭ম লাইনে ছন্দ এবং অনুপ্রাসের দারুণ খেলা আছে। অক্ষরবৃত্তে ১৮ মাত্রার পঙক্তি হলেও এর ভেতরে রয়েছে স্বরবৃত্ত এবং মাত্রাবৃত্তের লুকানো কাজ, আছে অনুপ্রাসও। এই ১৮ মাত্রার পর্ব বিন্যাসটা ৮/১০ কিংবা ৮/৪/৬ এই দুইভাবেই করা যেতে পারে। এবার দেখুন, কবেকার অন্ধকার বিদিশার এই তিনটি শব্দই স্বরবৃত্তে তিন মাত্রার পর্ব। আবার চুল তার/কবেকার/বিদিশার এই তিনটি পর্ব মাত্রাবৃত্তে ৪ মাত্রার পর্ব। এবং চুল তার/ কবেকার/ অন্ধকার/ বিদিশার এই চারটি শব্দ বা শব্দযুগলে রয়েছে “আর” ধ্বনির অন্ত্যানুপ্রাস যা পঙক্তিটিকে নিয়ে গেছে এক ভিন্ন উচ্চতায়। পরের পঙক্তি “মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ‘পর” ২২ মাত্রায় নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু পর্ব বিন্যাসের ক্ষেত্রে অক্ষরবৃত্তের সবচেয়ে সহজ সূত্র “জোড়ে গাথো জোড় বেজোড়ে বেজোড়” অর্থাৎ দুটি শব্দ দিয়ে একটি জোড় সংখ্যার পর্ব বানাও, অনুসরণ করাই অধিক যুক্তিসঙ্গত। তবে কোনো শব্দের যদি মাত্রা সংখ্যা ৪ বা ততোধিক হয় তাহলে এক শব্দেই একটি পর্ব হতে পারে। এক্ষেত্রে এই পঙক্তির পর্ব বিন্যাস নানানভাবে করা যায়। আমি এর বিন্যাসটি এভাবে করছি। “মুখ তার/ শ্রাবস্তীর কারুকার্য;/ অতিদূর/ সমুদ্রের ‘পর (৪/৮/৪/৬)। পরের লাইনটিকে ৮/৬ এ ভাগ করা যেতে পারে, তবে ‘হাল’ এই জোড়ের পর ‘ভেঙে’ জোড় দিয়ে একটি পর্ব এবং ‘যে’ বেজোড়ের পর ‘নাবিক’ বেজোড় দিয়ে একটি পর্ব তৈরি করা যেতে পারে। এরপর ‘হারায়েছে দিশা’ একটি ৬ মাত্রার পর্ব। অর্থাৎ লাইনটি দাঁড়ালো ৪/৪/৬।
পরের দুটি লাইন “সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,/তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, এতোদিন কোথায় ছিলেন?” নির্মিত হয়েছে ২৬ মাত্রায়, অর্থাৎ প্রকৃত অর্থেই ওরা মহাপয়ার। এই লাইন দুটির পর্ব বিন্যাস ৮/৮/১০ মাত্রায় বিভাজিত। পরের লাইনে গিয়ে আবার তিনি ফিরে এসেছেন ২২ মাত্রায়। এই যে পঙক্তির মাত্রাসংখ্যায় উঠানামা করে ছন্দের প্রবাহ ঠিক রেখেছেন এটিই শুদ্ধ ফ্রি ভার্সের কবিতা। যদিও পরবর্তিকালে পশ্চিমের এবং বঙ্গদেশের কবিরা ফ্রি ভার্সের কবিতা থেকে ছন্দের প্রচলিত বিন্যাসকেও তুলে দিয়েছেন, আমার কাছে সেইসব কবিতার স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দেহ আছে। শেষ ৬ লাইনে আরো বৈচিত্র এনেছেন। এই ৬টি লাইন নির্মাণ করেছেন ১৮, ১৮, ২২, ১৮, ২৬ এবং ১৮ মাত্রায়।
১৮ লাইনের এই কবিতাটির অন্তমিলের ক্ষেত্রেও তিনি একটি ভিন্ন সূত্র অনুসরণ করেছেন। ৬ লাইনের ৩টি স্তবকে বিভক্ত কবিতাটির স্তবকগুলো নির্মিত হয়েছে কখকখগগ সূত্রে অর্থাৎ প্রথম লাইনের সাথে তৃতীয় এবং দ্বিতীয় লাইনের সাথে চতুর্থ লাইনের মিল। পঞ্চম এবং ষষ্ঠ লাইনে মিল।
এবার আসি কবিতাটির বিষয়বস্তুতে। এক অতৃপ্ত আত্মার হাহাকার চিত্রিত হয়েছে এই কবিতায়। ক্ষণিকের জন্য সেই অতৃপ্ত আত্মা কারো মুহূর্তের সান্নিধ্যে তৃপ্ত হয় কিন্তু তা আবার হারিয়ে যায়। বারে বারে সে কেবল সেই বিশেষ মুহূর্তটিকেই খোঁজে। সেই তৃপ্তি কেমন তা প্রকাশ করতে গিয়ে ঝড়াহত হালভাঙা নাবিকের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। যে নাবিক মাঝ সমুদ্রে দিক দিশাহীন, ব্যর্থ, হতাশ, মৃত্যুর প্রহর গুনছেন, সে যদি হঠাৎ দৃষ্টিসীমার মধ্যে দেখতে পান এক সবুজ দ্বীপ, তাও আবার দারুচিনি দ্বীপ, তিনি যেমন নতুন জীবন ফিরে পান, আনন্দে উদ্বেলিত হন, ঠিক তেমনি তৃপ্ত হয় সেই অতৃপ্ত প্রাণ।
শুরুতে যে ‘হাজার বছর’ তিনি ব্যবহার করেছেন তা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। কেউ বলেছেন যেহেতু একজন মানুষের পক্ষে হাজার বছর হাঁটা সম্ভব নয় তাই এখানে কবি মানব জাতির দীর্ঘ যাত্রার কথা বলেছেন। এই ব্যাখ্যা এই কবিতাকে মহান করে নিঃসন্দেহে। তবে জীবনানন্দকে বিশ্লেষণ করলে এটি নিশ্চিত বোঝা যায় যে তিনি হাজার বছর বলতে দীর্ঘকাল বুঝিয়েছেন। তিনি বহু কবিতায় ‘হাজার বছর’ এই শব্দযুগল ব্যবহার করেছেন। আমি বলবো এটি তার মুদ্রাদোষ। বেশ কিছু শব্দের প্রতি তার পক্ষপাত ছিল, তার কবিতায় ঘুরে ফিরেই ‘অন্ধকার’ শব্দটি এসেছে, প্রয়োজনে এবং অপ্রয়োজনেও। দেখুন একজন শিশুকে যদি জিজ্ঞেস করেন, তোমার আব্বু কত টাকা বেতন পায়, সে বলবে, একশ টাকা। তোমার নানাবাড়িতে কয়টা গরু আছে? সে বলবে, একশটা। তোমাদের গাছে কয়টা চড়ুই পাখি বসেছে? সে বলবে, একশটা। কারণ একশই তার কাছে সবচেয়ে বড়ো সংখ্যা। জীবনানন্দ দাশও অনেককাল বোঝাতে কবিতায় বার বার হাজার বছর ব্যবহার করেছেন। এর আরো একটি কারণ হয়ত এই যে তার প্রিয় ছন্দ অক্ষরবৃত্তে হাজার বছর শব্দযুগল দিয়ে একটি শুদ্ধ পর্ব হয়। লক্ষ বছর বা কোটি বছর দিয়ে তা হয় না।
‘বিম্বিসার অশোকের ধুসর জগতে’ কিংবা ‘আরো দূর অন্ধকার বিদর্ভ নগরে’ এই রকম শব্দ বিন্যাসকেই বোধ হয় স্যামুয়েল কোলরিজ বলেছেন Best words in best order বা শ্রেষ্ঠতম শব্দের শ্রেষ্ঠতম বিন্যাস। বিম্বিসার এবং অশোকের পরিচয় যখন আমরা জানি তখন সেই ধুসর জগতটা মুহূর্তেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কবিতায় প্রাচীন স্থান, নিদর্শন, কাল এবং মিথের ব্যবহার পাঠকের চোখের সামনে একটি ভিন্ন জগতের দরোজা খুলে দেয়। পাঠকের ভাবনাকে উস্কে দেয়। নারীর মুখে শ্রাবস্তীর কারুকার্য কিংবা চোখে পাখির বাসা দেখার উপমা তখন তো বটেই এখনও নতুন। আক্ষরিক অর্থে এই উপমার সঙ্গে নারীর মুখ কিংবা চোখকে মেলাতে গেলে হতাশই হবেন। এই উপমাগুলো এমন যে প্রবেশ করতে হবে এর মর্মার্থে। তখনকার দিনে সুন্দর নগরের দৃষ্টান্ত ছিল শ্রাবস্তী, ব্যাস এখানেই থাকুন। হাজারও জনপদের মধ্যে শ্রাবস্তী যেমন আলাদা, তেমনি বনলতা সেন হাজার নারীর মধ্যে আলাদা। নীড় যেমন তার সকল উষ্ণতা নিয়ে ক্লান্ত পাখিকে প্রেমের, প্রজননের, বিশ্রামের আহ্বান জানায় তেমনি আহ্বানের ভাষা কবি দেখেন বনলতার চোখে।
শেষ স্তবকের ‘শিশিরের শব্দের মত সন্ধ্যা আসে’ কিংবা ‘ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল’ একাধারে অসাধারণ উপমা এবং চিত্রকল্প। এরকম অভিনব চিত্রকল্প রচনার জন্য শতবর্ষ পরেও আজকের কবিরা আইঢাঁই করে কিন্তু পারছে কই? শিশিরের শব্দ শোনার কান আজকের কবিদের অনেকেরই নেই, তারা শোনে পদকের ঝংকার। ডানার রৌদ্রের গন্ধ শুঁকে জীবনানন্দই আমাদের জানিয়েছেন অবিরাম উড়ে বেড়াবার ক্লান্তি কত বেদনার। অসুখী দাম্পত্যজীবন, শিল্প-সাহিত্যের হাঙর-সঙ্কুল সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া, বার বার কর্মহীন হওয়া, অর্থ, যশ, খ্যাতিহীন, মেধা নিয়ে বয়ে বেড়ানো জীবন যে কত কষ্টের, কতটা ক্লান্তির তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই কবিতায়।
তবু একটু আশা, একটু ভালোবাসা গভীর অন্ধকারে জোনাকির আলোর মতো জ্বলে ওঠে যখন “সব নদী ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন/ থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন”। বনলতা সেন কবির ক্লান্ত জীবনের একমাত্র অনুপ্রেরণা।
এই কবিতায় তার ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয়েছে একথা ঠিক কিন্তু কবিতাটি মহৎ হয়ে ওঠে যখন তা ব্যক্তিকে ছাপিয়ে হয়ে যায় সার্বজনীন। আজকের পৃথিবীতে মানুষের মুখোশ পরে কত দানব ঘুরে বেড়াচ্ছে। এইসব দানবের আঘাতে, কামড়ে, ক্ষত-বিক্ষত হতে হতে প্রতিনিয়ত ক্লান্ত হচ্ছে মানুষ, ভাবছে আত্মহননের কথা, আবার কোনো না কোনো বনলতা সেনের ভালোবাসার স্পর্শে, হোক না দুদণ্ডের, তাদের ক্লান্তি, অবসাদ, হতাশা দূর হচ্ছে; তারা নতুন উদ্যমে আবার ফিরে আসছেন জীবনের উজ্জ্বল ভোরের কাছে।
বনলতা সেন কবিতাটি অ্যাডগার অ্যালান পোর “টু হেলেন” -এর ছায়া অবলম্বনে রচিত কিনা এই প্রশ্ন জীবনানন্দ দাশের জীবদ্দশাতেই উঠেছিল। জীবনানন্দ গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ তাকে একদিন সরাসরিই জিজ্ঞেস করেছিলেন। এতে তিনি কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলেছিলেন, তুমি যে সমাজে বাস করো, যে ভাষা শোনো এবং পড়ো সেই ভাষাই তো তোমার মুখে উচ্চারিত হবে। জীবনানন্দ দাশ বনলতা সেন কবিতাকে পো’র টু হেলেনের ছায়া হিসেবে স্বীকার করেননি।
“আমি অনুবাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে অনুরোধ করেছিলাম “টু হেলেন” বাংলায় অনুবাদ করে দিতে। তিনি গতকাল সেটি অনুবাদ করে পাঠিয়েছেন। মঞ্জু ভাইয়ের অনুবাদটি এখানে তুলে দিচ্ছি:
হেলেন, আমার চোখে তোমার সৌন্দর্য
নিসিয়া’র সুপ্রাচীন জাহাজের মতো,
যে জাহাজ ঢুকে পড়ে সুগন্ধ-সাগরে,
ক্লান্ত, জীর্ণ-মলিন যাযাবরের মতো
তার চিরচেনা নিজস্ব সৈকতে।
বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে আমি দীর্ঘকাল একাকী ঘুরেছি,
কচুরিপানার শেকড়ের মতো তোমার সঘন এলোচুল
অপরূপ তোমার সুন্দর মুখ,
তোমার সুতীব্র আকর্ষণ আমাকে ফিরিয়ে এনেছে ঘরের কাছে
ঐশ্বর্যময় গ্রীসের কাছে এবং
জাঁকজমকপূর্ণ রোমের কাছে।
ওইখানে অত্যুজ্জ্বল জানালার কুলুঙ্গির ভেতর তোমাকে
দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি প্রতীমার মতো,
তোমার উজ্জ্বল করতলে বিশুদ্ধ আকীক পাথরের মায়াবী প্রদীপ,
আগত পবিত্র ভূমি থেকে তুমি, হে সুন্দরী!”
জীবনানন্দ দাশ স্বীকার করুন আর না করুন “টু হেলেন” কবিতার একটি বেটার ভার্শন “বনলতা সেন” এতে কোনো সন্দেহ নেই। কচুরিপানার শেকড়ের চেয়ে ভালো চিত্রকল্প তিনি রচনা করেছেন, “চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা” পঙক্তি নির্মাণের মাধ্যমে। পো’র অপরূপ সুন্দর মুখে তিনি শ্রাবস্তীর কারুকার্য যোগ করেছেন। রোম, গ্রীস ঘুরেছেন অ্যালান পো, জীবনানন্দ দাশ গিয়েছেন বিদর্ভ নগরে, বিদিশায়।
মাত্র ৪০ বছর বেঁচেছিলেন অ্যাডগার অ্যালান পো। দুই বছর বয়সের মধ্যেই বাবা-মা দুজনকে হারান। বেড়ে ওঠেন অন্য এক পরিবারে। ১৪ বছর বয়সে এক সহপাঠি রবার্টের বাড়িতে গেলে সহপাঠির মা জেইন স্ট্যানার্ড হাত ধরে তাকে আদর ও সম্মানের সাথে অভ্যার্থনা জানান। এতে তিনি শিহরিত, রোমাঞ্চিত এবং আনন্দিত হন। এতোটা ভালোলাগা তার জীবনে আর কখনোই ঘটেনি। জেইনের বয়স তখন ৩০। পো তখন থেকে জেইনের প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতেন। এই আকর্ষণের মধ্যে মা এবং প্রিয়তমা দুটোই ছিল। পরের বছর জেইন মারা গেলে পো “টু হেলেন” কবিতাটি লেখেন। যে কারণে পো “জেইন” নামে কবিতা না লিখে “হেলেন” লিখেছেন হয়ত ঠিক একই কারণে জীবনান্দ দাশ “আসামের শোভনা দাশ” না লিখে লিখেছেন নাটোরের বনলতা সেন।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৩ এপ্রিল ২০২২
নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষণ। মিথগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা বলেই প্রতীয়মাণ হল। কখন একটি ভাল কবিতা পড়ার পর নিজের ভেতরেও একটি নতুন কবিতার জন্ম হতেই পারে। টু হেলেন আর বনলতা সেন সম্পূর্ণভাবে আলাদা দুটি কবি সত্তা থেকেই উৎসারিত, ভাবে কিছুটা মিল থাকলেও কী বা যায় আসে! একটা আর একটার নলক বা অনুকরণ বলার সুযোগ নেই! পঞ্চপান্ডবের সবচেয়ে সুস্থির কবি প্রতিভা জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন বাংলা কবিতার একটি অনবদ্য দলিল হিসাবেও হাজার বছর ধরে ঠিকে থাকবে কোন সন্দেহ নেই।
আলোচকে আন্তরিক শুভেচ্ছা।
অনেক ধন্যবাদ প্রিয়জন।শুভকামনা জানবেন।