টিকফা, ট্রানজিট ও সিরাজ
মমিনুল হক তালুকদার, আগুনবিদ্যার জঠোরেও
বেড়ে ওঠে আগামি প্রত্যুষের লাল মোরগের ডাক।
সিরাজের চোয়াল চুয়ে গড়ে পড়ে সূর্যাস্তের লালরশ্মি
আমার প্র-পিতামহের ললাটে অঙ্কুরিত হয়,
রক্তাম্বরের নীল ঠোঁটের অট্টহাসি
বিদ্রোহের পাঠ পড়ে পড়ে, আমার শরীর কোষে বেড়ে
ওঠে
অস্বীকারের ধ্রুপদী কবিতা
ঘুম জড়ানো চোখ, তন্দ্রার মাঝে ছুটে চলে সতের
অশ্বারোহীর দল।
ফেলে যায় অজস্র পদচিহ্ন।
লবনজলে সোনালি ঘাম, দূর নীলিমার গতরে আজ
কৃষাণীর বিষণ্ণ গীত উৎসব…
বর্গী আসছে… বর্গী আসছে…
রঙিন লিফলেটে ভরে যায় গ্রাম, শহর, আটচালা, চা-স্টল
সূর্যাস্তের বিষণ্ণতায় নিমগ্ন তবু আমি
প্রপিতামহের করোটি হাতে গৃহস্থালির ধ্যানে…
সমুদ্রের শাদা ফেনায় ভাসে সখিনা বুবুর আতঙ্কিত
হৃৎপিন্ডের উৎপীড়নের ক্ষতচিহ্ন
সখিনা বুবু,
কসম, গোলামির শরাব খেয়ে কন্ঠ হবে আজ নীল,
রক্ত আর বারুদের উল্লাসে জাহান্নামের জাকুম
বিষবৃক্ষ ভরে উঠবে পত্রপল্লবে
জলের আর্তনাদে কলিজা হবে চৌচির
অথচ, হেমন্তে কুয়াশায় মুখ লুকিয়ে আমি দিব্যি হেঁটে
বেড়াবো কাশ্মিরী গোলাপ হাতে
আহা মানচিত্র,
হায় স্বাধীনতা,
হাহ্ মুক্তি
মাতম করে করে একদিন শুধু ইতিহাস নগরেই
কাঁদবে!
অভিমানের টেরাকোটা
নত হও অভিমানী রাত; তোমার চিবুকে রাখি ক্রন্দসী
সুখ
যমুনার পাড়ে ফেলে আসা সোনালি অগ্রহায়নের ঘ্রাণ,
বাদাম তোলা পালে মাঝির সুগন্ধা ঘামে উজ্জ্বল সোনা
সোনা শিশির স্নাত পলাশের মগ্ন কৈশোরীসন্ধ্যা
নত হও অভিমানী রাত; তোমার গলায় বাধি
লখিন্দরের যন্ত্রণাবাসর
সুখ-সোহাগিনী! রক্তচূড়া গালে চুম্বনের পসরা
সাজিয়ে রেখে হেঁটে যাও স্বপ্নালোকের তেপান্তর।
তোমার অভিমানী চুমুতে লিখে যাই সমস্ত নগরের
কোলাহল, রাত্রির চৌকাঠে
কেঁদে ওঠে সন্ধ্যার রক্তিম আকাশ,জোনাকির
জৌলুস আর ঝিঁঝিঁ পোকার বিদ্রুপ উল্লাস…
নিয়ন আলোয় পরাভূত সুখগুলো গুঁজে দিবো তোমার খোঁপায়
জোছনার রঙ গেঁথে দিবো
তোমার কর্ণিয়ার ধূসর গালিচায়
নত হও অভিমানী রাত; তোমার চিবুকে রাখি
সোহাগীক্রন্দন
ঘুড়ির লাটায়ে বেধে রাখি সুহাসিনীভোর
মার্চ হবে শিশির ভেজা রোদ্দুরে
মাছরাঙা ঠোঁটে এঁকে দাও যুদ্ধহীন পৃথিবীর
মানচিত্রচুম্বন,
নগরের নিয়ন আলোর পরাভূত বিষাদগাঁথায় নিশ্চয়
ফুটবে হাসনাহেনা…
কসম প্রিয়তমা, পৃথিবীর যুদ্ধবাজরা একদিন নিশ্চয়
পরাজিত হবে সামান্য এক গোলাপের কাছে…
মাঝি
দুঃখ-পাথরটাকে জড়িয়ে নিই হাতের মুঠোয়। ঝর্ণার
কলতান তবুও ভেসে আসে ইথারে।
দৃষ্টির ভূগোল উল্টিয়ে পড়ে নিই তোমার অহঙ্কারের
লাল ভাঁজগুলো…
নারী, তোমাকে এভাবেই পড়ি। পাঠ্যসূচিতে নামটা
টুকে রাখি।
আজন্ম কৈশোরবিহ্বল দৃষ্টিকে সযত্নে রাখি ফ্রেমে
বন্দী।
ইতিহাসের দস্যিপনার ভেলায় চড়ে আমি শমসের
মাঝি,
পৌঁছে যাই রানী ইসাবেলার রাজদরবারে।
দুচোখ অগ্নিগর্ভা অহঙ্কার বলে ওঠে, ‘প্রহরী, এ বেটা
কে?’
: মহামান্য রাজমাতা, জানিনে, তবে মনে হয় মরিস্ক
ক্রীতদাসের প্রেতাত্মা।
: প্রহরী, বন্দী করো। নিক্ষিপ্ত করো ঐ নীলাভ উন্মুক্ত
জলে।
সে-ই থেকে নারী– আমি শমসের মাঝি, মহাকালের
ডিঙ্গি করি। দরিয়া থেকে দরিয়া চষে ফিরি।
মৃত্তিকার মতো শাদা মুখে আজ ফাঙ্গাসের বসতি…
দুচোখে পুরে থাকে উদ্বাস্তু শিবির। শুধু কবিতার মতো
ভোর হয়ে জেগে আছি আজবধি।
জোছনারাত কিংবা জলমগ্ন সময়
তুমুল বিতর্কের পর একদিন ঠিক হবে
অবশিষ্ট বেদনার নাম ’যৈবতী কন্যা পদ্মাবতী’
কালের ধুলোয় উড়বে তোমার দৃষ্টির মিথ্যা উপাখ্যান।
বেদনার্ত বর্ণমালার মতো
লোনাজলের কলতানে ভরে উঠবে তোমার উঠোন।
গোধূলিবেলায় তোমার বিষাক্ত নিঃশ্বাস
বিরামচহ্নি হয়ে খুঁজে ফিরবে অনুবাদের পাঠশালা।
দুই হাজার চার সংখ্যক নীল কমল
গোখরো সাপের ফণায় সাজাবে বেহুলার ফুলশয্যা
চুরি হবে কাঙাল হরনাথের স্বর; ডাকাত বউ
চুলের বেনী বেধে প্রতিক্ষার সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে আনবে
রাত্রি দ্বিপ্রহর…
আর নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নে তোমার
জোছনারাত হবে দস্যু-বণিকের লাল শরাব…
সুবর্ণা
হয়তো পৌষের কোন এক রাতে
শিশির স্নাত কুয়াশায় জুবুথুবু সকালে
সুবর্ণা একদিন ভুল করে ভালোবাসতো
কিংবা ভালোবেসেছিল; এখন তাচ্ছিল্যেও আগুন
যতো
পোড়ামুখে সে ভীষণ ঘৃণা করে অবিরত
ঠিক তোরই মতো…
হয়তো ট্রেনের হুইসেল এঁকে দিতো তার মন
সবুজ ক্ষেত, আঁকাবাঁকা পথ; চাবাগান সারি সারি
গোধূলি মাখানো জলপাই রঙের অভিমান,
ঘয়তো ট্রেনের হুইসেল এঁকে দিতো তার পরান
ঘরে ফেরা পাখির তুমুল কলরব
রাখাল বালকের গরুর পাল ফেলে
ডাহুকের পিছু ছুটে চলা অবিরাম
হেঁসেলে কৃষাণির আবির রাঙা মুখ
হয়তো ট্রেনের হুইসেল এঁকে দিতো তার
মনের কোঠরে বেধেছিলো যত সুখ।
মতিহারের সবুজ চত্বর, আনমনে বসে কোন একদিন
দ্বাদশী চান্দের ঐশ্বর্য্য বুঝি এঁকেছিল দুরুদুরু বুকে
প্যারিসরোড হাতে হাত, স্মিত হাসি ছিল মুখে
চোখে কাজল–
হলুদ খামে ভরেছিল শত অভিমানের আঁচল
হয়তো সুবর্ণা ভালোবাসার নামে
সংগোপনে সাজিয়ে ছিল করুণার ফুলদানি যতো;
তাই বুঝি স্বপ্নঘোরে দেখি রোজ
অবহেলা পান্ডুলিপি করে খোঁজ
তাচ্ছেিল্যর বিষাদভরা মুখখানি, ঠিক তোরই মতো…
আমার পৃথিবী জুড়ে যখন সন্ধ্যা নামে– নিকষ কালো
রাত;
কুপির আগুনে সুবর্ণার আগুনপাখি মুখ হয়তো
আকাশে আকাশে ভাসে,
নারিকেল দ্বীপ; হয়তো ডালে ডালে তার হাসনাহেনা
হাসে
বার বার আলো আঁধারের লুকোচুরির মাঝে
সুবর্ণা ফিরে আসে, আসে ফিরে হলুদ ব্যাথার
নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে
ঠিক যেন তোর আবছায়া মুখ
বাদাম তোলা নৌকা নিয়ে দূরদ্বীপে ভাসে…
সুবর্ণা একদিন ভুল করে ভালোবাসতো
কিংবা ভালৈাবেসেছিল; এখন তাচ্ছিল্যের আগুন
যতো
পোড়ামুখে সে ভীষণ ঘৃণা করে অবিরত
ঠিক তোরই মতো…
শীত
ছিন্নমূল মানুষের আয়ুষ্কাল
ঝরে পড়ে ক্ষণে ক্ষণে
অঝোর ধারায়;
কী
গ
ভী
র
হৃদ্যতায়
শান্তাহার জংশনে…
নস্টালজিয়া
নিরুদ্দেশ হতে হতে শাদা ফেনায় এঁকেছি
মানুষের ঘর্মাক্ত ললাটের জলছবি। তন্দ্রার ছলে
আন্দালুসিয়ার প্রান্তরে ফেলে এসেছি
শাদা বাজপাখির ডানা, মৃত ঘোড়ার খুর–
বিপন্ন বসন্ত-বিকেল,
আর সাঁওতাল মেয়ের শস্যবিলাশ…
নক্ষত্রের দীর্ঘশ্বাস নিয়ে
গাঙচিলের ডানায় উড়ে প্রাগৈতিহাসিক ভোর
নৈঃশব্দ অন্ধকারে
মাতৃ-জরায়ুতে জমাট বাধে
আগামির স্পর্ধা
আহা বেদুইন, শূন্য উদ্যানে আজও খিলখিলিয়ে ওঠে
নাবালিকা জৈবিক পারদসন্ধ্যা।
আহ্ জিব্রাল্টার! আজও তোর বাদাম তোলা নৌকার পাটাতনে
শুয়ে শুয়ে অশ্বের হ্রেষাধ্বনি শুনি…
হেমন্তে জোছনার সরল দুঃখপাঠ
দৈনতার জলপাই বাগানে হেঁটে যায় বিলাসী চান্দের
সরল দুর্ভিক্ষের মানচিত্র। আন্দারের নিস্তব্ধতা খেয়ে
যায় নীল চোখের দোয়েলঘুম। কালো ঘোড়ার খুরে
জমে থাকে বরফশীতল ক্লান্তির সোনালি মেঘ।
আভিজাত্য বয়ে বেড়ায় ঘুঘুর ছানা, শিকারীর দু’নলা
বন্দুকের স্থির নিশানায়।
কলম্বাসের বাদাম তোলা জাহাজে মরিস্ক নারীর
আর্তনাদে ছন্দ তোলে আটলান্টিকের ঢেউ। বিমুর্ত
নারীর স্বপ্নে হেসে ওঠে সুলতানের রঙতুলি। অগণিত
শোকের দরিয়ার জলে ডুব-সাঁতার দেয় আলেপ্পোর
ধ্বংসস্তুপ। মাতৃস্তনে মুখ রেখে ঘৃণার কবিতা লিখে
যায় মৃত আরব শিশুর অক্ষিপট। কাগজের ভাঁজপত্রে
লিখা হয় মেঘবালিকার ওষ্ঠের মতো সরল সাঁওতালী
দুগ্ধবতী জোছনার অভিসন্দর্ভ। মমতার মানবিক
বন্দরে উপেক্ষিত হয় মানচিত্রহীন বাসি-মুখগুলো।
আর নাগরিক দৃষ্টিরা হেসে ওঠে কানা জাফের
ফকিরের দৃষ্টিহীন বঞ্চনার উপাখ্যানে…
পোর্ট্রটে
নিঃসঙ্গতা আর রূপকথা জমজ দু’বোন
সেদিন বেড়াতে এসেছিলেন
আমার অগোছালো পৈত্রিক নিবাসে
আমাকে নিয়ে সে কী উৎকন্ঠা তাদের!
আমার মুর্খতা আর বোকামি নিয়ে হাসাহাসি করলেন।
গালমন্দও করলেন বেশ…
তারা ভেঙে পরা পুঁইশাকের মাচার কথা বললেন;
আমি নিরুত্তর
তারা সজনে গাছে দোয়েলের বাসার কথা বললেন;
আমি নিরুত্তর
তারা মাছে ভরা পুকুরের কথা বললেন;
আমি নিরুত্তর
পিতৃব্যর রোপন করা নিমগাছের কথা বললেন;
আমি নিরুত্তর
আমি তাদের দিকে বিষন্ন পৃথিবীর গ্রন্থিতে লটকানো
চড়ুইপাখির স্বপ্ন-মোড়ানো শস্যদানা
ঠোঁটের পোর্ট্রটে ধরিয়ে দিলাম। অনুচ্চারিত কন্ঠে
তারা পুঁথিপাঠের মতো পড়তে থাকলো…
‘বঞ্চিত মানুষের অভিশাপে জ্বলছে
প্রতারকের জালে জড়িয়ে- ঝুলন্ত পৃথিবীর আত্মা…’
ছেনুয়ার আত্মজ তোয়াহা
সমস্ত নগর জুড়ে ঘরে ঘরে ঘুরে ঘুরে দেখেছি
কোথাও কোন কান্না নাই।
কোথাও অশ্রু নাই, নাই তুমুল কোন তর্ক।
খবরের কাগজে হত্যার শিরোনামে কোন খবর নাই।
নির্ঘুম কোন রাত নাই।।
নিয়ন আলোর নিচে কুয়াশাচ্ছন্ন লাইটপোস্টে কোন
সুগন্ধি ভোর নাই। তোমার হত্যার পর কোন মিছিল
নাই,
নাই কোন শোকর্যালি। কবির কবিতার খাতায় নাই
কোন মৃতের স্কেচ।
তোমার হত্যার পর মহাসাগরে নাই কোন যুদ্ধ জাহাজ,
নাই কোন
বোমারু বিমানের গর্জন দূর আকাশে। প্রেমিকার ওষ্ঠে
নাই কোন অভিমান,
যুবতীর চোখ ভাসে না দূর গন্তব্যে!
সমস্ত শহর ঘুরে ঘুরে দেখেছি– ছেনুয়ার ছেলে
হত্যাকারিনীর বিপরীত কোন আদালত নাই।
নাই কোন
ফাঁসির মঞ্চ। তাবৎ পৃথিবী ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত চোখ
খুঁজেছে শুধু যেন আলেয়ার আলোর পিছু…
…
সুমন সৈকত
জন্মতারিখ : ২৭ ডিসেম্বর ১৯৮০
জন্মস্থান : সুলতানপুর, নওগাঁ।
সম্পাদনা : বোল (যৌথ)
গ্রন্থ : শাদা বাজপাখির ডানায় ক্রীতদাসের উপাখ্যান (প্রকাশিতব্য)
মোবাইল : ০১৭১০১৪০৪৫৬
“দৈনতার জলপাই বাগানে হেঁটে যায় বিলাসী চান্দের
সরল দুর্ভিক্ষের মানচিত্র” অসাধারণ ,