১. আপনার প্রথম প্রকাশিত বই কোনটি? কবে প্রকাশিত হয়েছিলো? প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি কেমন ছিলো?
শীতমৃত্যু ও জলতরঙ্গ। প্রকাশিত হইছিল ১৯৯৩ সালে। আমি শুরু থেকেই গতানুগতিক ধারার কবিতা লিখি না, নতুন ভাব ও ভাষার প্রতি আমার আজন্ম টান। আবার আমার কবিতা যারা পড়েন তারা লক্ষ্য করে থাকবেন যে আমার কবিতা বরাবরই ইতিহাস, ঐতিহ্য, পরিবার, বাঙালি ও বাঙালি মুসলমানের ঐতিহ্য কেন্দ্রিক। কিন্তু ভাষাটা আমারই। কিছুটা পশ্চিমা ও স্থানীয় উত্তর আধুনিকতার মিশেল। এই বইয়ের কবিতাগুলিও তাই। প্রথম বই প্রকাশের সময় খুবই রোমাঞ্চিত ছিলাম। প্রায় অর্ধরাত জেগে ছিলাম। পাঠকের কথা ভাবি নাই, বই যে বের হবে এই আনন্দেই ছিলাম। তখন আমি ঢাকা সদরঘাট পোস্ট অফিসের দায়িত্বে ছিলাম(সহকারী পোস্টমাস্টার জেনারেল-বি সি এস(পোস্টাল)। তো সেখানে জুয়েল ইন্টারন্যাশনালের সত্ত্বাধিকারী মনির ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়। তিনি আমাকে বই বের করতে বলছিলেন। প্রচ্ছদ করে দিয়েছিল ধ্রুব এষ। পরে খোন্দকার আশরাফ সম্পাদিত ‘একবিংশ‘ ছোট কাগজে একটা রিভিউ বের হইছিল।
২. সাহিত্যে আপনি কার উত্তরাধিকার বহন করেন?
উত্তরাধিকার একটা বড় বিষয়। আপনি কোন উত্তরাধিকারের কথা বলছেন ঠিক পরিষ্কার না । তবে যদি মনে করি সাহিত্যিক উত্তরাধিকার, তাহলে আমি মনে করি আমি দুই উত্তরাধিকার — বাঙালি ও বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যিক ও ঐতিহ্যিক উত্তরাধিকার বহন করি। ঐতিহাসিক ভাবে এই বাংলা ভূখণ্ড এই ধারা ধরে রাখে। একে খণ্ডিত করে দেখার উপায় নাই। আপনি যদি সেই চর্যাপদ থেকে শুরু করে এই বর্তমান কাল পর্যন্ত কবিতার একটা ব্যবচ্ছেদ করেন তাহলে দেখবেন আমরা এই দুটি উত্তরাধিকার সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিকভাবে বহন করে চলছি। শাহ্ মুহম্মদ সগীর, সৈয়দ হামজা, সৈয়দ আলাওল, দৌলত কাজী, এরকম অনেক প্রতিভাবান বাঙালি মুসলমান কবির হাত ধরে বাংলা কবিতা এ পর্যন্ত আসছে। চর্যাপদ থেকে শুরু করে ভারতচন্দ্র পর্যন্ত মুসলমানি শব্দ, আবহ বাংলা কবিতায় বাধাহীনভাবে স্বাভাবিক ব্যবহৃত হইছে । আমরা দেখি বিশের দশকে নজরুল এবং পরে চল্লিশের দশকে ফররুখ ও জসীম উদ্দিনের মাধ্যমে মুসলমানি ভাব ও ভাষার কবিতার চর্চা হইছে । কিন্তু তলে তলে ত্রিশের দশক থেকেই ইউরোপীয় আধুনিকতার নাম করে, বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে, হিন্দু বাঙালি জাতীয়তাবাদী স্রোতটি শক্তিশালী হইতেছিল। সেইটি কিছুটা ক্ষীণ ধারায় এখনো অব্যাহত। এই ধারায় যারা কবিতা লিখেছেন তাদের কবিতা খণ্ডিত, তাদের কবিতা অসম্পূর্ণ । চল্লিশের আলী আহসান, আহসান হাবীবের হাত ধরে বাঙালি মুসলমান মুসলমানি ঐতিহ্যের কবিতার ধারা আগাইছে। অবশ্য তখনকার বিশ্ব ও উপমহাদেশের রাজনৈতিক, কতক জাতিগত ও ভাষাগত সাম্প্রদায়িকতার কারণে মুসলমানি ধারার কাব্যচর্চা বাধা প্রাপ্ত হয়। কিন্তু পুরাপুরি থাইমা থাকে নাই। আমাদের মাঝে স্বাধীনতা পরবর্তী কবি আল মাহমুদকে মুসলমানি ঐতিহ্যের কবিতা লেখার পথিকৃৎ বলা যায়। তার ‘সোনালী কাবিন’ সেই অর্থে মুসলমানি কবিতার কাব্যগ্রন্থ না যতোটা ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’। আসলে আল মাহমুদের–‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ (১৯৭৬), ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’ ও ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ বাংলাদেশের কবিতার আদর্শ এর গতিবিধি অনেকটাই পরিবর্তন কইরা দিছে। কবি আল মাহমুদ বলছিলেন পরবর্তী কবিরা কোরান আর নবীজির (সা) জীবনের আলোকে নুতন কবিতা লিখবে। আজ অনেকাংশে তার কথা সত্য হতে চলছে। আমার ‘সিজদা ও অন্যান্য ইসরা'(২০১৬) ও ‘সমস্ত বিসমিল্লাহ'(২০২২) কাব্যগ্রন্থ দুইটা এর অনন্য উদারহণ। এমন না যে আমি কবি আল মাহমুদের কথা অনুযায়ী লিখছি, এইটা আমার আদর্শ, আমার মঞ্জিল পরিবর্তনের কারণেই স্বাভাবিকভাবে ঘটছে।
৩. এ যাবৎ সর্ব মোট আপনার কতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? এর মধ্যে কোনটি বা কোন-কোন কাজকে বা কোন বইকে আপনি আপনার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করেন?
এ পর্যন্ত আমার ১০ টি কবিতার বই, একটি গদ্য, একটি গল্প এবং একটা আরবি কবিতা অনুবাদের বই প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৯ সালে সালে আমার দ্বিতীয় কবিতার বই ‘পলাশী ও পানিপথ’ প্রকাশিত হয়। এই বইটি আমার কাছে নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। এই বইতে আমি নিজেকে আবহমান বাংলা, মা ,মাটি , ইতিহাস ঐতিহ্যের ভিত্তিমূলে রেখে কবিতার চাষবাস করছি। নব্বইয়ের দশকে উত্তর আধুনিকতা ও উত্তর উপনিবেশ চর্চার যে হাওয়া শুরু হইছিল তার প্রভাব আমাদের মনেও পড়ছিলো। এই কবিতা বইটিতে এগুলো পাওয়া যাবে। এই বইতে একটা কবিতা আছে ‘পলাশী’ নামের। এইটাকে পশ্চিমবঙ্গের লেখক, অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্য সহ বাংলাদেশের সমালোচকেরা গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করছে। ২০১০ সালে প্রকাশিত ‘গানের বাহিরে কবিতাগুচ্ছ’ এবং ২০১২ সালে এক সাথে প্রকাশিত ‘নো ম্যানস জোন পেরিয়ে’ ও ‘জল্লাদ ও ‘মুখোশ বিষয়ক প্ররোচনাগুলি’ ও আমার কাছে উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।
১৯৯৯ সালের মার্চ মাসে আমি অভিবাসী হয়ে, স্থায়ীভাবে অস্ট্রেলিয়া চলে আসি। এইখানে আইসা আমি অনেকদিন কবিতা লিখতে পারি নাই। ২০০০৮ সাল থেকে আবার কবিতা লিখতে শুরু করি। এখানে একটা কথা বলে রাখি– ‘পলাশী ও পানিপথ‘ ও ‘গানের বাহিরে কবিতাগুচ্ছ‘র কবিতাগুলি বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় লেখা হইছিল। ২০১৫ সালে ‘ক্রমশ আপেলপাতা বেয়ে’ প্রকাশিত হয় । এতে আমি কবিতাকে নুতন ভাষা ও ভাবে ধরার চেষ্টা করি। আমার নুতন বাসস্থল, নুতন জীবন এই বইতে ধরা আছে। জিয়োপোয়েটিক্স বলতে যা বোঝায় আর কি। ২০১১ সাল থেকে আমার ভেতর এক ধরণের পরিবর্তন আসতে শুরু করে। বলতে পারেন আমার শেকড়ের সাথে একটা মিলন ঘটতে থাকে। এই পরিবর্তনের কেন্দ্রে যিনি ছিলেন তিনি হলেন আমাদের প্রিয় রাসূল মোহাম্মদ সাঃ। সেই সময়ে আমি এখানে কাজে কর্মে বাইরে গেলে আমার শুধু নবীজির (সা) কথা মনে হইতো। তার মক্কা জীবন বিশেষ করে ভাবতাম, তিনি যুবক বয়সে মক্কায় কিভাবে চলাফেরা করতেন– কিরকম ছিল তার উপস্থিতি, কিরকম ছিলেন তিনি দেখতে– এরকম ভাবতাম। প্রায়ই চোখে পানি চলে আসতো। এরকম মায়া বা টান আমি আজ পর্যন্ত কারো জন্য ফিল করি নাই। ভাবতাম তাকে যদি দেখতে পাইতাম, আহা আমার প্রিয় রাসূল (সা)। এর সাথে সাথে আমার একটা স্পিরিচুয়াল জার্নি শুরু হয়। সেই অনুভব থেকেই আমি কিছু মুসলমানি ইসলামিক কবিতা লিখি। সেইগুলি ‘সিজদা ও অন্যান্য ইসরা'(২০১৬) কবিতাগ্রন্থে ঠাঁই পায়। আমার যে ব্যাকগ্রাউন্ড মানে সেকুলার, আধুনিক ব্যাকগ্রাউন্ড, সেই জীবনধারা থেকে সরে আইসা আমি ইসলাম ধর্মের সুশীতল ছায়াতে চলে আসি। সেই জার্নিটা আমার এই বইয়ের কবিতাগুলিতে পাওয়া যাবে। সেই দিক দিয়ে দেখলে এই বইটির গুরুত্ব অনেক।
২০২০ সালে বইমেলায়, বৈভব প্রকাশনি থেকে আমার ১১ নম্বর কবিতার বই ‘নতুন পাণ্ডুলিপির দিনে’ বের হয়। নানা কারণে আমি এই কবিতার বইকেও গুরত্বপূর্ণ মনে করি। একজন কবি সব সময় নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেন, নতুন ভাব ও ভাষায় কবিতা লেখার চর্চা করেন। আমিও তাই। আমি এই বইয়ের কবিতাগুলিতে আমার ইতিহাস, সমকাল, বাঙালিত্ব ও মুসলমানি ঐতিহ্যকে এক করে, নতুন ভাষা, ছন্দ, অলংকারে কবিতার চাষাবাস করছি। এই বইতেই আমি প্রথমবার মাত্রাবৃত্ত ছন্দ ব্যবহার করেছি।
৪. সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার নতুন বই সম্পর্কে বলুন।
সম্প্রতি আমার দুটি বই প্রকাশিত হইছে। একটা কবিতার বই ‘সমস্ত বিসমিল্লাহ’ আর একটা– আধুনিক আরবি কবিতার অনুবাদ ‘জলপাই পাতার গান‘। ‘সমস্ত বিসমিল্লাহ‘ মুসলমানি ঐতিহ্যের কাব্যগ্রন্থ। আমার ভেতর সাম্প্রতিক যে স্পিরিচুয়াল পরিবর্তন আসছে তাকেই এখানে ধরতে চাইছি। নজরুল ,ফররুখ, আল মাহমুদ ও মান্নান সৈয়দের ইসলামিক মুসলমানি কবিতার ধারায় আমি দাঁড়িয়েছি এই কাব্যগ্রন্থে। কবিতার সমস্ত দায়বদ্ধতা মিটিয়ে দিয়েই কবিতাগুলি লেখা। আমি মনে করি একজন বাঙালি মুসলান হিসাবে আমি দুইটি ঐতিহ্যকে ধরে রাখি। তাই কবিতা এক ঘরানার না, দুইটি ধারাকেই ধরতে চেয়েছি। আধুনিক আরবি কবিতার অনুবাদ বইটিতে এডোনিস, মাহমুদ দারবিশ থেকে শুরু করে নিজের কাব্বানী, সমীহ আল কাশেম, ফাতিমা নুত পর্যন্ত অনেকের কবিতার অনুবাদ আছে। মূল আরবি এবং ইংরেজি পাশাপাশি রেখে অনুবাদ করেছি।
৫. আপনি নিজেকে কোন দশকের কবি-লেখক বলেন? কেন?
কবি কোনো নির্দিষ্ট দশকে আটকে থাকে না। আমাদের কবিগণ যাদেরকে আমরা পঞ্চাশ, ষাট বা সত্তরের কবি বলি, আসলে তারা প্রায় সবাই পরবর্তী দশকেই তাদের সৃষ্টিকে একটা চূড়ায় নিতে পারছেন। শামসুর রহমান, আল মাহমুদ পঞ্চাশের দশকে লেখা শুরু করেন। কিন্তু তারা স্বমহিমায় আবির্ভাবিত হন পরের দশকগুলিতে। আমি নব্বইয়ের দশকের কবি। ১৯৯৩ সালে আমার প্রথম কবিতার বই ‘শীতমৃত্যু ও জলতরঙ্গ’ প্রকাশিত হয়। সত্য আমি আশির দশকের শেষের দিকে কিছু কবিতা লিখেছি, কিন্তু নব্বইয়ের শুরুতে আমি কবিতায় পুরাপুরি নিবেদিত হই এবং আমার লেখার ভাষা পেয়ে যাই। আবার আমি মনে করি আমি এই সময়েরও কবি, কেননা প্রথম ও দ্বিতীয় দশকেই আমার শ্রেষ্ট কবিতার বইগুলো বের হয়। যেমন ‘পলাশী ও পানিপথ (২০০৯)’ ‘ক্রমশ আপেলপাতা বেয়ে (২০১৫)’ সিজদা ও অন্যান্য ইসরা(২০১৬)’ ‘নতুন পাণ্ডুলিপির দিনে(২০২০) এবং সমস্ত বিসমিল্লাহ (২০২২)।
৬. আপনার সমকাল নিয়ে বলুন।
আমার সমকাল তো আমি নিজে যে সময়ে বাস করি, সে অৰ্থে আমি এই সময়ের কথা বলতে পারি। কিন্তু যদি বলেন আমার শুরুর কাল, তার মানে তো নব্বইয়ের দশক। আমি তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে পড়ি। তখন ইংরেজির অধ্যাপক খোন্দকার আশরাফ হোসেন ‘একবিংশ’ নাম বিখ্যাত লিটলম্যাগ বের করতেন এই লিটলম্যাগ আশরাফ হোসেনের দক্ষ সম্পাদনা ও ক্রিয়েটিভিটির জন্য পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হইছিল। আমার ভাগ্য ভালো ছিল যে হাতের কাছে ‘একবিংশ’ পাইছিলাম। তখন ‘একবিংশ’তে লিখত আশির মাসুদ খান, সুব্রত গোমেজ, শোয়েব শাদাব, শান্তনু চৌধুরী, সৈয়দ তারিকসহ অনেকেই। তারপর নব্বই দশকের আমি, তুষার গায়েন, খলিল মজিদ, বায়তুল্লাহ কাদেরী, টোকন ঠাকুর, শাহীন শওকত, শিবলি মোকতাদির সহ অনেকেই এই লিটল ম্যাগাজিনে লিখছে। এই ম্যাগাজিনে লেখার কারণে আমার সাথে খোন্দকার আশরাফ হোসেন, তুষার গায়েন ও খলিল মজিদের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠছিলো। ১৯৯১ সালে আমার বিসিএস(ডাক) ক্যাডারের চাকরির বদৌলতে আমি জামালপুর প্রধান ডাকঘরে সহকারী পোস্ট মাস্টার জেনারেল হিসাবে বদলি হই। সেখানে গিয়ে আমার কবিতার চর্চা আরো বেড়ে যায়। গাছ গাছালি ঘেরা নীরব, শান্ত পোস্ট অফিসের দোতালায় আমার বাসা ছিল। প্রতিদিন পাখি আর পাতা পড়ার শব্দে ঘুম ভাঙতো। এখানে একবার আশরাফ স্যারও বেড়াতে আসছিলেন। তার বাড়ি ছিল এই জামালপুরেই। তো এখান থেকে মেইল করে কবিতা ‘একবিংশ’তে পাঠাইয়া দিতাম। পরে ১৯৯৩ সালে ঢাকায় বদলি হওয়ার পর তুষার গায়েনের সাথে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়। পেশায় স্থপতি তুষার গায়েনের কবিতা খুব ভাল লাগত। তার কবিতা নিয়ে আলোচনাও করেছি। মানুষ হিসাবে সে খুব সৎ। একবার কবি আবু হাসান শাহরিয়ার আমাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করলে তুষার গায়েন এর তীব্র প্রতিবাদ করছিল। ২০১১ সালে ফেইসবুকে যোগদান করার পর তুষারকে দেখছি লেখালেখি ও তার রাজনতিক বিশ্বাস নিয়া খুব সরব, বেশির ভাগ সময়ই তার কণ্ঠস্বর কম্যুনাল। আমার হঠাৎ পরিবর্তন, মানে মুসলমানি ঐতিহ্যের কবিতা লেখা তার ভালো লাগে নাই। এই বিষয়ে তার সাথে ম্যাসেঞ্জারে অনেক কথাবার্তা হয়। ইদানিং তুষারের সাথে আর যোগাযোগ নাই। আমার মুসলমানি ঐতিহ্যের আলোকে কবিতা লেখার কারণে সে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিছে, মনে হয়!
৭. সাম্প্রতিক কালে কারা ভালো লিখছে বলে মনে করেন?
এখন বাংলা কবিতা বড় দুঃসময় পার করতেছে। কবিতা একটা বৃত্তে আটকাইয়া গেছে। কারো লেখায় কোনো সৃষ্টিশীলতা পাই না। সৃষ্টিশীলতা একটা বিরাট বিষয়। আপনি কবি হিসাবে অনেক কিছুই লিখতে পারবেন, এইটারে ছন্দ অলংকার দিয়া সাজাইতে পারেন। কিন্তু যদি সৃষ্টিশীলতা, একটা নুতন ভাষা যদি না থাকে তাইলে কবিতা মরা মরা লাগে । অবশ্য ব্যতিক্রম তো আছে। কেউ কেউ ভাল লিখতেছে কিন্তু তার সংখ্যা খুবই কম। আমি একটা প্রবন্ধে বলছিলাম যে আমাদের কবিতা বিশেষ করে আশির দশকের কবিতা কলকাতার ভাব বলয়ের অনুগামী। তার হাত ধরেই ঢাকায় এখনো কবিতা রচনা হইতেছে। কবিতাকে তার ফিতরা বা আসল পরিচয়ের কাছে ফিরে যাইতে হবে। আমাদের আসল পরিচয়, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিকে তাকাইতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের বাংলাদেশী কবিদের একটা জাতি ও ধর্মগত পরিচয় আছে। একটা আর একটার পরিপূরক। আপনি ধর্মগত পরিচয়কে বাদ দিয়া শুধু জাতি-বাঙালি হিসাবে কবিতা লিখলে সেইগুলি খণ্ডিত, অসম্পুর্ণ ও রুগ্ন হবে। কবিতা আপনার ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্ম, ভাষা ইত্যাদি ধইরা আগায়। একজন প্রতিভাবান কবি এই বিষয়গুলি বাদ দিতে পারেন না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, কবি হিসাবে আমাদের ভাববলয় শুধু তিরিশি জনবিচ্ছিন্ন, ইউরোপীয় আধুনিকতাকেন্দ্রিক নয়, আমাদের ভাববলয় আমাদের নিজস্ব ইতিহাস, ধর্ম ও ঐতিহ্যকেন্দ্রিক। আশার কথা হইলো অনেকের মধ্যে বাঙালি মুসলমানের স্পিরিট ভিত্তিক কবিতা লিখতে দেখা যাইতেছে। সেইটা পরিস্ফুট হইতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে। সেই অপেক্ষায় আছি ।
৮. কত দিন আপনার প্রবাস জীবন? কোথায় আছেন? কি করছেন? পারিবারিক পরিচিতি জানতে চাই।
আমি ১৯৯৯ সালের মার্চ মাসে অস্ট্রেলিয়াতে পার্মানেন্টলি চলে আসি। প্রথমে আইসা এখানে অস্ট্রেলিয়া পোস্টে চাকরি পাই। দুই বছর করার পর এখানে ইউনিভার্সিটিতে ইংলিশ টিচিং নিয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েড ডিগ্রি নেই এবং ইংরেজির শিক্ষক হিসাবে যোগদান করি। বর্তমানে এখানকার একটা সরকারি কলেজে ইংলিশ টিচার হিসাবে কাজ করছি। আমার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে এখানকার হাই স্কুলের টিচার, ছোট মেয়ে ইয়ার টুয়েলভ শেষ করলো আর ছেলে পড়াশুনার সাথে সাথে ব্যাংকে কাজ করছে ।
৯. প্রবাস জীবনে সাহিত্যচর্চায় প্রতিবন্ধকতা বা সুবিধা কি-কি? কোথায়?
এইখানে প্রথমে আইসা আমি কালচারাল শক পাই। তাই দীর্ঘ দিন লিখতে পারি নাই। নতুন দেশ, নুতন পরিবেশ, আবার রুটি রুজির চেষ্টা– এইসব বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই দীর্ঘদিন লেখালেখি বন্ধ ছিল। আর একটা বাধা আছে এইখানের স্থানীয়তা। এখনকার জীবন মানে এইটা ঠিক বাংলাদেশ না, আপনি এখানে নিজের ভাষা ও দেশ ছাড়া জীবন যাপন করবেন। এইটা একটা অভাব। কারণ কবি হিসাবে এইটা লাগে এবং আমরা এইটা কামনা করি কিন্তু পাই না। কবিতা একটা গাছের মতো তার নিজস্ব ভূমি লাগে, আবহাওয়া লাগে। এইগুলি আপনি বিদেশে পাইবেন না। বলবেন তাইলে কেমনে লিখি? এই যে আমার ভেতর যে স্মৃতি, যে বাংলাভাষার মানস-সংগঠন আছে, তার সান্নিধ্যে গিয়া কবিতা লিখি। তবে এখন সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে দেশ কাছে চইলা আসছে। এইটা একটা ভালো দিক।
১০. আপনি কখনো কি কোন পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন অথবা সংকলন সম্পাদনা করেছেন? বিস্তারিত বলুন।
না কোনো ধরণের অভিজ্ঞতা নাই।
১১. লিটল ম্যাগাজিন এর সংজ্ঞা কি? এ নিয়ে আপনার ভাবনা বলুন।
লিটল ম্যাগাজিন একটা পরীক্ষা নিরীক্ষার জায়গা। এইটার ইউনিক চরিত্র তাই। আমি শুরু থেকেই লিটলম্যাগ-এ লিখেছি। তবে বাংলদেশের অধিকাংশ লিটল ম্যাগাজিন বেশি বেশি গোষ্ঠীবদ্ধ, দলকানা। সম্পাদককে উদার ও কঠোর দুই হইতে হয়। ‘একবিংশ’ আমাকে লেখালেখির সুযোগ না দিলে হয়তো আজকের এই জায়গায় আসতে পারতাম না। এইজন্য খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কাছে আমি ঋণী।
১২. আগামী দিনের সাহিত্য কেমন হবে? আপনার কল্পনায়।
আগামী দিনের সাহিত্য, মানে বিশেষ করে কবিতা সোশ্যাল-মিডিয়া নির্ভর, লাইট ও সহজলভ্য হয়ে যাবে। এইটার খারাপ দিক হইল যেইটা সহজলভ্য সেইটার লক্ষ্য থাকে পাঠকের সাথে সহজ ভাব বিনিময়, তাকে জাগানো বা ভাবানো লক্ষ্য থাকে না। তাই কে আসল কবি কে নকল কবি– চেনা বড় কঠিন হয়ে পড়বে। আর একটা দিক হবে– অনলাইন প্রকাশনা সহজলভ্য হওয়ার কারণে বই প্রকাশের তেমন দরকার পড়বে না।
সাক্ষাৎকার গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব
নভেম্বর ০৭, ২০২৩