spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যঝরাপাতার রঙধনু

লিখেছেন আশরাফ আহমেদ

ঝরাপাতার রঙধনু

আশরাফ আহমেদ

পুরো গ্রীষ্মজুড়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে থাকা অরণ্যের সবুজ পাতাগুলোতে শরতের শুরু থেকেই বার্ধক্যের ছাপ পড়া শুরু হয়। বার্ধক্য অবধারিত হলেও মানুষ ও অন্যান্য পশুপক্ষীর বেলায় তা প্রায়ই অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে থাকে। যৌবনের অপার সৌন্দর্যের কাছে বার্ধক্যের নিষ্কৃয়তা সত্যিই করুণার উদ্রেক করে! কিন্তু গাছের পাতার বেলায় তা ভিন্ন। বার্ধক্যও যে অপরূপ হয়ে দেখা দিতে পারে তা প্রতি বছর উত্তর আমেরিকার পত্রশোভিত অরণ্যাঞ্চল আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।

‘শরতের রঙ’ বা ‘ফল কালার’ দেখতে আমেরিকার আর সবার মতো আমরাও একদিনের জন্য বেরিয়ে পড়ি প্রতি বছর। আমাদের কাছাকাছি তেমন আদর্শ গন্তব্য হচ্ছে পার্শবর্তী ভার্জিনিয়া রাজ্যের একশত পাঁচ মাইল দীর্ঘ শ্যানানডোহ ন্যাশনাল পার্কের স্কাইলাইন ড্রাইভ। অরণ্যাচ্ছাদিত ছোটো পাহাড়গুলো সবুজের খোলস ছেড়ে ছোপ ছোপ লাল, গোলাপি এবং হলুদের ফ্রক পরে মাথা নেড়ে নেড়ে আপনাকে স্বাগত জানাবেই। আর যুবতীরা একই রঙ কিন্তু আরো মোহনীয় নক্সার শাড়ি-ব্লাউজে সজ্জিত হয়ে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকবে। মনে হবে চারদিকের পাহাড়ের গায়ে আগুন জ্বলছে। আর তাতে যদি পড়ন্ত সূর্যের আলো পড়ে তবে পাতা ভেদ করে আলোটি তাপহীন, অর্ধ-স্বচ্ছ বা ট্রান্সলুসেন্ট লাল বর্ণ ধারণ করে দর্শকের মনকে আলোড়িত করে। পাহাড় চূড়া বা পাদদেশ অথবা উপত্যকার যেখানেই দাঁড়ান না কেন মনমাতানো সেই দৃশ্য আপনাকে উদ্বেলিত করবেই। এক সময় বৃন্তচ্যুত হয়ে সবাই বায়ূর স্পর্শানন্দে লুটোপুটি খাবে মাটিতে। সে আরেক মনমাতানো দৃশ্য।

কিন্তু সুন্দরীদের সেই হাতছানিকে সাড়া দিতে গেলেই বিপদ! কাছে যেতে গেলে হতে পারে গভীর গিরিখাদে পতন। আর কাছে যেতে পারলে অপরূপ সেই সৌন্দর্যের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। যেন আভরণহীন, মাংস ও মেদহীন কোনো সুন্দরীর কংকাল! অথবা প্রতিদিন একটি করে সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে মেরে পেট খুলে দেখার মতো! ফলে দূর থেকেই তাঁর সব সৌন্দর্য।

এবার পক্ষকাল আগের শনিবার আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া রাজ্যের পথে। শরতের পূর্ণ রূপ তখনো বিকশিত হয়নি। গিয়েছিলাম সেখানকার ব্ল্যাক ওয়াটার ফলস নামে একটি জলপ্রপাত দেখতে। সাপের চলার মতো পাহাড়ের আঁকাবাঁকা এবং গিরিখাদ ঘেঁষে দিগন্ত জুড়ে সবুজ পাহাড়ের আনাচে কানাচের পথে। প্রাগৈতিহাসিক কোনো সময় অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল কঠিন শিলার এইসব পাহাড়। পথের গা ঘেঁষে উঠে যাওয়া সুউচ্চ পাহাড় থেকে বিশাল প্রস্তরখণ্ড যে কোনো সময় গড়িয়ে নেমে এসে যাত্রীসহ গাড়িটিকে থেতলে দিতে পারে। আশংকাজনক তেমন স্থান আসার আগেই রাস্তার পাশের সাইনবোর্ড গাড়ির চালককে সাবধান করে দিচ্ছে। পথের বাঁক বুঝে গাড়ির গতিসীমাও নির্ধারিত করে দেয়া সাইববোর্ড ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে।

অসময়ে অথবা প্রত্যন্ত অঞ্চল দিয়ে যাচ্ছি বলে যান চলাচল খুবই কম। পর্বতমালার ওপরে দৃষ্টিনন্দন সারিবদ্ধ অসংখ্য বায়ূবিদ্যুত আহরণের পাখা। (বাংলাদেশেও সম্প্রতি তেমন একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। সৌরবিদ্যুতের ন্যায় বায়ূবিদ্যুত প্রকল্পের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে যন্ত্রাপাতির রক্ষণাবেক্ষণের বাইরে উৎপাদন খরচ একেবারেই নেই!) কোথাও বা দৃষ্টির শেষ পর্যন্ত উঁচু বা নিচু হয়ে যাওয়া সামনের সোজা পথটি একটি মাইল-লম্বা গালিচার মতো শুয়ে আছে আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে। সামনে বা পেছনে একটিও গাড়ি নেই। পৃথিবীতে যেন আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। এই অনুভূতি নিয়ে দুই পাশের মাদকতাপূর্ণ দৃশ্যের স্বাদ শুধু প্রত্যক্ষদর্শীই ভাগ্যেই জোটে। আমি তাই খুব ভাগ্যবান।

এভাবে সোয়া দুইশ মাইল ড্রাইভ করে প্রথমদিন গেলাম ব্ল্যাক ওয়াটার ফলস দেখতে রাজ্যের ডেভিস শহরের পার্কে। অতিকায় পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে আসা পাহাড়ি ঝরণার তীব্র একটি স্রোত হঠাৎ করে দীর্ঘ ৬২ ফুট নিচের পাথরে আছড়ে পড়ছে। পতিত জলের বাস্পে ভেতর দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে রঙধনুর ছটা। প্রপাতের আগে দুই পাশের গাছপালার রেণু, ফল ও পাতা থেকে নিষ্কাশিত দ্রব্যাদির সাথে মিশ্রণের ফলে পানির রঙ স্বচ্ছ না হয়ে চায়ের মতো হলদেটে। এই অস্বচ্ছতার কারণে এই পানিকে ব্ল্যাক ওয়াটার বলা হয়। এখানকার পাথরকে সল্ট-স্যান্ড বলা হয় কারণ এই পাথরে লেগে থাকা লবনকে পানিতে গুলিয়ে বাণিজ্যিকভাবে লবন-পানি উৎপাদন করা হয়।

রাতটি নিকটবর্তী এলকিনস শহরে কাটিয়ে পরদিন রোববার প্রায় দেড়শত মাইল পশ্চিমে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া রাজ্যের রাজধানী চার্লসটন শহরটি দেখতে গিয়েছিলাম। গতকাল এই রাজ্যে ঢোকার পর থেকে এটিকেই প্রথম একটি শহর বলে মনে হলো। আমেরিকার অন্যান্য বড় শহরের মতো এখানেও বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি স্থাপনা। কানাওহা নদীর তীরে একটি গণমঞ্চ সত্যিই খুব সুন্দর ছিল। তা সত্ত্যেও সম্ভবতঃ ছুটির দিন বলে শহরটিকে পুরোপুরি প্রাণহীন মনে হলো।

তৃতীয়দিন দ্বিতীয়বারের মতো আমরা ব্ল্যাকওয়াটার ন্যশনাল পার্কে আবার গেলাম। এবার জলপ্রপাত দেখার উদ্দেশ্য আমাদের নেই। অরণ্যের ভেতরে ঘুরে বেড়াতে চাই। শরতের বদলানো রঙ উপভোগের পরিবর্তে আভরণহীন, মাংস ও মেদহীন সুন্দরীর কংকালের খোঁজে।

পর্যটকদের জন্য নির্ধারিত জলপ্রপাত দেখার স্থানের রাস্তার ঠিক উল্টোদিকে একটি গাড়ি চলার পথ চলে গেছে। প্রায় আড়াই তিন মাইল লম্বা এই পথের দুধারে গাছের অরণ্য। কিছুদূর পর পরপরই টেবিল ও বেঞ্চ পাতা – গ্রীষ্মে বনভোজনের ব্যবস্থা। আবার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া রাস্তা ধরলে একের পর এক রিসর্ট পল্লী। গাড়ি ছেড়ে আমরা হেঁটে হেঁটে গাছগুলো দেখছিলাম। অধিকাংশ গাছের পাতাই সবুজ। হঠাৎ কোনো একটি গাছের পাতা হলুদ হতে শুরু করেছে। কোনোটি হলুদ ছাড়িয়ে গোলাপি হওয়া শুরু করেছে। কোনোটি পুরোপুরি গোলাপি রঙ ধারণ করেছে। আবার তাদেরই গোলাপের মাঝে কোনো কোনো পাতা লাল হয়ে আছে।

একটি গাছের পাতাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলাম শরতের আগমনে রঙটি সবুজ থেকে প্রথমে হলুদ, এরপর গোলাপি এবং সবশেষে লাল রঙ ধারণ করে। আর তখনই মনে পড়লো রঙধনুর কথা। বৃষ্টিস্নাত দিনে বায়ূমণ্ডলের জলীয় বাস্পের স্তর ভেদ করার সময় সূর্যের সাদা আলো সাতটি রঙে বিভাজিত হয়ে পড়ে। রঙধনুতে সবুজ, হলুদ, গোলাপি ও লাল রঙ এই ক্রমেই সাজানো থাকে।

খুবই আশ্চর্য হয়েছিলাম। কারণ, সাদা আলো থেকে প্রাপ্ত রঙধনুর প্রতিটি রঙ কতগুলো বৈদ্যুতিক-চৌম্বকীয় ঢেউয়ের সমাহার কিন্তু গাছের পাতার প্রতিটি রঙ একেকটি বিশেষ প্রাণরাসায়নিক দ্রব্যের ধর্ম। তখন দুটো ভাবনা মনে এসেছিল। প্রথমতঃ শরতে পাতার সবুজ ক্লোরোফিল সম্ভবতঃ নিজস্ব গঠন পর্যায়ক্রমে তিনটি ধাপে সামান্য কিছুটা পরিবর্তন করে করে হলুদ, গোলাপি ও লাল রঙ প্রদর্শন করে থাকে। অপর ভাবনাটি ছিল ক্লোরোফিলের সাথে রংধনুর (অর্থাৎ সাদা রঙের) হলুদ, গোলাপি ও লাল আলোর বিক্রিয়ার ফলেই শরতে পাতার রঙ পরিবর্তন হয়।

পরে বাড়ি ফিরে বই খুলে ও অন্তর্জাল ঘেঁটে জানলাম আমার এই দুটি ধারণাই ছিল ভুল। গাছের পাতার রঙ সবুজ হয়ে থাকে ক্লোরোফিলের সবুজ রঙ থেকে, তা সবারই জানা। হলুদ এবং গোলাপি রঙটি হয় পাতায় ক্লোরোফিল থেকে সম্পূর্ণ পৃথক, ক্যারোটিনোয়েড নামের একাধিক রাসায়নিক দ্রব্যের আধিক্যের ফলে। শরতের আগমনে দিনের দৈর্ঘ কমতে থাকায় পাতায় গাছে পতিত সূর্যালোকের পরিমাণও কমতে থাকে। ফলে নতুন করে সবুজ ক্লোরোফিলের জন্মাহারের চেয়ে মৃত্যুহার বাড়তে থাকে। এর ফলে সবুজ ক্লোরোফিলের তুলনায় হলুদ ও গোলাপি ক্যারোটিনয়েডের আধিক্য চোখে পড়ে। কোনো জাতের গাছে শুধুমাত্র অধিক পরিমাণে হলুদ ক্যারোটিনোয়েড থাকে আবার কোনো গাছে শুধুমাত্র গোলাপি ক্যারোটিনয়েড বেশি থাকে। ফলে পাতাটি হলুদ বা গোলাপি দেখায়। অন্যদিকে বিভিন্ন ঘণত্বের লাল রঙটি হয়ে থাকে শরতকালে পাতায় এন্থোসায়ানিন নামের এক ভিন্ন প্রজাতির রাসায়নিক দ্রব্যের নতুন সংশ্লেষণের ফলে। দিনের আলো ছাড়াও মাটি ও বাতাসের তাপমাত্রা এবং মাটিতে ক্ষারীয় বা অম্লীয় (ইংরেজিতে এলকালাইনিটি বা এসিডিটি)উপাদানের তারতম্যের ফলে এইসব রাসায়নিক দ্রব্যের সৃষ্টি ও ক্ষয় হয়ে থাকে।

কিন্তু যে ব্যপারটি আমাকে সবচেয়ে মুগ্ধ করেছে তা হচ্ছে শরতে গাছের পাতায় সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সবুজের পর হলুদ, হলুদের পর গোলাপি এবং গোলাপির পর লাল রঙের আবির্ভাবের সাথে রংধনুতে সবুজের পর হলুদ, হলুদের পর গোলাপি এবং গোলাপির পর লালের উপস্থিতির একাত্মতা দেখে। ব্যপারটি কাকতালীয়ও হতে পারে। তবে এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা থেকে থাকলেও আমার চোখে এখনও পড়েনি। ব্যখ্যা না থাকলে ব্যপারটি অনুসন্ধানী পদার্থবিদ, উদ্ভিদবিদ ও প্রাণরসায়নিকের গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে।

৪ঠা নভেম্বর, ২০২৩

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on কবিতার স্ফুলিঙ্গ, স্ফুলিঙ্গের কবিতা