তৈমুর খান
🐢
[রচনাটি মূলত ভারতের বাংলাভাষী কবিদের নিয়ে লিখিত। সম্পাদক : বাংলা রিভিউ ]
🙆
বিংশ শতাব্দীর শেষ দশক নব্বই দশক। এই সময় যা ঘটেছে তা দেখে মনে হয় মধ্যযুগ এখনো আছে। টিভি, কম্পিউটার, ইন্টারনেট এসেছে, কিন্তু আমরা পিছিয়ে গেছি আমাদের মানসিকতায়। জাত-ধর্মের রাজনীতি; শিক্ষা-দীক্ষায় অন্তঃসারশূন্য আস্ফালন; গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রহসন;ভোট কেনাবেচার রমরমা;এক থালা ভাতের জন্য যোনি পেতে থাকা নারী;নারী পাচার অথবা নারী বিক্রির রমরমা ব্যবসা; মৌলবাদী ফতোয়া; সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ;নিষিদ্ধ দল ও গোষ্ঠীর উত্থান; মধুচক্রের আসর, সেখানে স্বয়ং প্রশাসন বিভাগের লোক; সাধারণ মানুষের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতির বডিগার্ডদেরও ধর্ষকরূপে পাওয়া;প্রোমোটারদের সুচতুর দাঁতনখে রক্তাক্ত মানুষের চেহারা;হত্যাযজ্ঞে ভাড়াটে খুনিদের কর্মকাণ্ড;সেইসঙ্গে ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক নেতাদের উত্থান;ক্রিকেট উত্তেজনা; প্রায় নগ্ন ফ্যাশনের প্রভাব;কিডন্যাপিং-এর বাড়বাড়ন্ত;প্রেম নিছক প্রমোদ সঙ্গম; বিবাহে নয়, দায় এড়ানো সহবাসে, ভোগে আত্মচরিতার্থতা খোঁজা– এইসব চিত্রই যখন দেশের অভ্যন্তরে গা-সওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে চলছে উথালপাথাল এক ভাঙনকালের স্বাক্ষর। বাবরি মসজিদ ভেঙে পড়েছে, তার জেরে বাংলাদেশেও ভাঙাভাঙির খেলা। সম্প্রদায় চিহ্নিত হয়েছে। পাকিস্তানে ঘটেছে সাম্প্রদায়িক উত্থান। সাম্প্রদায়িকতার নির্লজ্জ ছোবলে ওড়িশার গ্রাহাম স্টেইন ও তার দুই পুত্রকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। আফগানিস্তানে ভেঙেছে বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি। বার্লিন প্রাচীর, যুগোস্লাভিয়া, সোভিয়েত রাশিয়া, একে একে ভেঙে গেছে।তার পরেই গুজরাটে সাম্প্রদায়িকতার আগুন জ্বলেছে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে ঘটেছে বিস্ফোরণ। নব্বইয়ের পরেও এসব ঘটনা ঘটলেও তার প্রস্তুতির বীজ ছিল নব্বই দশকে। ‘একটি চাকরি দাও মা’ গান গাওয়া যুবকের দল দিশেহারা হয়ে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত এসেছে স্কুল সার্ভিস। কিছু চাকরিও জুটেছে। ঋণ প্রকল্পে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী গজিয়ে উঠেছে। বেড়েছে গ্রামের মানুষের শহরমুখী অভিযান। আবার গ্রামে গ্রামে ঢুকে গেছে নানা টিভি চ্যানেল, ভিডিও হল, সিডি-ডিভিডি কত কী। সিনেমা প্রীতি, মাধুরী-শাহরুখ প্রীতি দিন দিন বেড়ে গেছে। ঘরের ঝিও এখন নিজেকে মাধুরী ভাবতে ভালোবাসে। সর্বত্রই একটি মেকি আভিজাত্যের পালিশ। পকেটে মোবাইল, গলায় পীরের দোয়া, মা কালীর মাদুলি তাবিজ, হাতে জড়ানো গিঁটমারা লাল সুতো–একইসঙ্গে চলেছে রেনেসাঁস ও সংস্কার। কে কাকে দেখে। সবাই সমান।
এই সময়ের পরিচয় দিতে গিয়ে নব্বই দশকের কবি রুদ্র প্রতি লিখেছেন: ”আমরা যারা নয়ের দশকের শুরু করেছিলাম তারা কিন্তু কেউ প্রান্তিক চাষী, কেউ ফেরিওয়ালা, কেউ কয়লাখনির শ্রমিক।নব্বই দশকের প্রথম কবিতা কলকাতা থেকে মফস্সল হয়ে গ্রামের প্রান্তে পৌঁছেছিল। সত্তর দশকের কবিতা কলকাতা থেকে মফস্সলে পৌঁছেছিল। আর নব্বই দশকের কবিতা শহর থেকে মফস্সল শহর হয়ে গ্রামের প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। যে জন্য নব্বইয়ের দশক উল্লেখযোগ্য।
নব্বই দশকের কবিরা শুধু অবক্ষয়ী নগ্ন আধুনিক কবিতা লেখেননি,তাঁদের প্রয়োজন হয়নি ভিটা গোল্ড এক্স কিংবা ভায়াগ্রার। তাঁরা দারিদ্র্য দেখেছে, ধানফুল দেখেছে, মাঠে মাঠে গাই-গরু চরিয়েছে, কয়লা খাদান থেকে কয়লা তুলে হাত ধুয়ে কবিতা লিখেছে— জীবনের, আনন্দের, দুঃখের। নব্বই দশকের প্রায় ৭০ শতাংশ কবি মদ্যপান থেকে বিরত থেকেছে।” (পাঠকমন: কবি সম্মেলন, জুন ২০০৫)। গ্রামের দু’বেলা ঘাস কাটা মজুরের ছেলেটিও রাজনীতির গড্ডালিকায় না গিয়ে বলে দিতে পেরেছে:
‘না বাবু কামাই হলে আমিই উপোস
কী খাই কী খাই সারাদিন?…’
এই যখন অবস্থা পরিবর্তনের জোয়ার, ‘ঠাণ্ডা ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক’ তখনই নব্বই দশকের সকাল। আমরা দেখি:
বোলপুর: ৩রা আগস্ট
“ধর্ষণ ঘটেছে একটা ইঁটভাটায় কাল
এক কাপ চায়ের পাশে দোমড়ানো সকাল
তিনটে মেয়ে খুন হয়েছে,মোট তিনটে লাশ
ভাঙা বোতলের টুকরো, আধ ভাঙা গেলাস
পুলিশ কুড়িয়ে পায় ঝুপড়ির ভিতরে
পরদিন সমস্ত ফাঁকা, শুকনো পাতা ওড়ে
শুধু একটা শুকনো পাতা উড়তে উড়তে খোঁজে আজকেও
কি কিছু ঘটলো খবরের কাগজে?”
(জিন্দাবাদ গেয়েছি আমি তোর :শিবাশিস মুখোপাধ্যায়)
হ্যাঁ, প্রতিদিনই কিছু না কিছু ঘটছে। আর পুলিশ লেফট রাইট করে পালাচ্ছে। পুরুলিয়ায় অস্ত্র বর্ষণ থেকে ধানতলা বানতলা পর্যন্ত। হাতকাটা পার্টির দাদা পর্যন্ত। আর সেই ফাঁকে চলছে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন। বর্ণ উল্লেখ করে পাত্র পাত্রীর খোঁজখবর। টেপ রেকর্ডারে বাজছে:
“মেহেন্দি লাগাকে রাখ না
ডলি সাজাকে রাখ না”
এসব ১৯৯০ এর ঝলকানি। কুশীলবেরা একেই আত্মস্থ করে বেড়ে ওঠেন, মাস্তানি করেন। আর কবিরাও পেয়ে যান ভাষা:
”আমাদের মতো করে কথা বলো উনিশশো নব্বই
বুবুনের মতো শূন্যে ছুঁড়ে দাও দুহাতের মুঠো
কাকলির মতো হেসে ভেঙে ফেলো ক্যান্টিনের গেলাস
সুমনের মতো রাগে দাঁড়িয়ে গিটার হাতে গাও”
(জিন্দাবাদ গেয়েছি আমি তোর: শিবাশিস মুখোপাধ্যায়)
এই বসন্তকালে খুর-তোলা মস্তানের মতো পলাশ চমকাচ্ছে। রাজনীতির গরম হাওয়ায় দাঙ্গা, কার্ফু, বনধ, জিপের টহল। সবই চলছে। তবু—
“সবকিছু অমান্য করে উল্টোডাঙা ব্রিজে প্রেম।”
থানায় তুলে নিয়ে গিয়ে এফ. আই. আর লেখা হচ্ছে। কিন্তু কাদের নামে? তাদের মুখেই শোনা যাক:
“লেখো এফ. আই. আর, লেখো আমাদের সকলের নাম
আমরাই গুলতানি মেরে ক্যান্টিনে জমিয়ে রাখতাম
লিখুন ও. সি সাহেব, স্পষ্ট করে লিখুন এস আই আমরাই
ভোটের দিনে দলবেঁধে ছাপ্পা দিতে যাই কোমরে মেশিন
গুঁজে গান শুনি, আশ্চর্য সময় আমাদের পাস করলে চাকরি
হয় না, পার্টি করলে হয়”
(জিন্দাবাদ গেয়েছি আমি তোর:শিবাশিস মুখোপাধ্যায়)
এই তো ১৯৯০ এর জিন্দাবাদ। পিনাকী ঠাকুরও একে ‘মুক্তির দশক’ হিসেবে গেয়েছিলেন।
‘হোস্টেলে রোজ মধ্যরাতে বসে পার্টির ক্লাস’
তাঁরও অভিজ্ঞতা। আর অভিজ্ঞতা মেধার ভাষা হয়ে গেছে কবিতায় বাস্তব চিত্রে কতকগুলি বিবৃতির বর্ণনায়:
“টেলিভিশন প্রিয় বউয়ের ডায়লগ:মফস্সলে কেউ মানুষ আছে নাকি?
মানুষ থাকে না তো তোমার বাপ দাদা কোথায় ছিল কচি, ডেলহি- মুম্বই?
মফস্সলে কেউ মানুষ নাই আর। রিক্সা। ভিড় বাস।লোকাল ট্রেন।ঘাম।
খরায় ফাটা মাঠ। কৃষ্ণচূড়া। ড্রেন। কলেরা-আন্ত্রিক। সন্ধ্যে মনমরা।
পার্টি দপ্তর। ভগ্ন মন্দির।ক্লাবের দাতাগণ।চাঁদসি ডাক্তার।
আমবাগান কেটে নগর পত্তন। নিজের বাড়ি চাই? এখনও ভেবে দ্যাখো।”
(শহর, শহরতলি: মেগাসিটি :পিনাকী ঠাকুর )
এক প্রাণহীন সভ্যতার নগর এরকমই মনমরা আর যান্ত্রিক হৃদয়ের মানুষ ব্যস্ততায় ডুবে যায় সেখানে। সুতরাং মেগাসিটি কামনা করে বউ। ঘর বানাতে হলে সেখানেই বানাতে হবে। সেখানেই বানাতে চাই সকলে।
মধ্যবিত্ত বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষা থেকে বাঁচার স্বপ্নও, মুখের ভাষাও কবিতা হয়ে ওঠে। পূর্বপুরুষদের প্রচলিত রীতি নীতি সমাজ-রাষ্ট্রের ভণ্ডামিকে নিয়ে ব্যঙ্গের তীক্ষ্ণ শ্লেষে কবিতায় চিরাচরিত বিষয়কে যেমন অস্বীকার করেছেন নব্বইয়ের কবিরা, তেমনি চিরাচরিত কবিতার ফর্মকেও ভেঙে দিয়েছেন ছন্দ এবং ছন্দোহীনতায়। কবিতা শুধু শব্দের খেলা নয়; সৈনিকের তরবারি, নতুন সূর্যের আলোর মতো ঝকমকে। উপমা প্রয়োগে,ক্রিয়াপদের ব্যবহারে, কবিরা অসাধারণ করে তুলেছেন নিজস্ব ভাবনাকে। অথচ সবই সময়-সূত্রের রচনা। সময়কে ক্যামেরাবন্দি করা। পরিবর্তনের এই ধারায় রূপক চক্রবর্তীর কণ্ঠস্বরও শোনা যায় :
“যা আমি মধ্যরাতে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম শহরের রাস্তায়। যাতে
লেখা ছিলো লখিন্দরের কেরিয়ার গুছিয়ে দিতে গিয়ে, নিরালা সুরম্য
ফ্ল্যাটে কীভাবে প্রযোজকদের স্টিপটিজ দেখিয়েছিলো বেহুলা। কোমরের
ভাঁজে ঝড় তুলে, কীভাবে সে খুশি করেছিল দাউদ ভাইকে।
তারপর ছিবড়ে হতে হতে সাত ঘাটের জল খেয়ে জায়গা করে নিয়েছিলো
বৌবাজার স্ট্রিটে।”
(ইস্তেহারের দ্বিতীয় অংশ)
এই ইস্তাহার মিথ্যা নয়। বউবাজারের বিস্ফোরণ, রশিদ খানের সঙ্গে পার্টির লোকদের যাতায়াত,মুখ খুললেই মুখ বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা— সবই পশ্চিমবঙ্গের তথা ভারতের বাস্তব ইতিহাস। দাউদ ভাই- মন্দাকিনী সম্পর্ক, আবুসালেম- মণিকা বেদি সম্পর্ক সবাই জানে। আধুনিক বেহুলার কাছে দাউদ ভাই যে শিব একথাও সকলের জানা। কেরিয়ারিস্ট হওয়ায় আখের গোছানোর স্বার্থে দেশ বিরোধী কার্যকলাপও চলতে পারে। সবুজবরণ বসু সে-কথা বলতেই বাংলা কবিতার বিষয়কে উল্লেখ করেছেন। আমাদের অন্তর-বাহির সেখানেই প্রজ্ঞার আলোয় আলোকিত হয়। কবিতা এরকমই মননধর্মিতার দিশারী— ‘কলমের দেহে আজ গোয়েন্দা নেমেছে।’ কারণ হিসেবে কবি বলেন—’কবিতা কবিতা নয়, অপরাধ বিজ্ঞান।'( তিন নম্বর চোখ) ।এই অপরাধবিজ্ঞানেই আমাদের মনোবিকলন প্রতিফলিত। যৌনতা প্রতিফলিত। মর্ত্যবাসনা প্রতিফলিত।আমাদের ভাষা, ছন্দ-অলংকার প্রতিফলিত।
রূপক চক্রবর্তী এরকমই উপমা ব্যবহারের ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত তুলে প্রবাহমান এক ব্যঙ্গের চাবুক তুলে দেন পাঠককে :
”তৈমুর লং-এর ঝটিকা বাহিনীর মত তেজী রোদ এত নরম হয়ে গেছে যেন প্রেমিকার স্তনে মুখ রাখার প্রথম দিনের স্মৃতি।” (আর্মস্ট্রং দেখেছিলেন)।
ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক মিথের আড়ালে রেখে দেন মানুষের জীবনযাত্রার নানা অসঙ্গতি। প্রকৃতি যৌনদৃশ্যের মতো ভরে ওঠে। দেবতাকে বিশ্বাস নেই তাই বৈপরীত্যের খেলায় তিনি মেতে ওঠেন— ‘মন্দিরে যাইনি কখনো। অথবা গেলেও বিগ্রহ দেখে ঈশ্বরকে আমার আল্লাহ বলে ডাকতে ইচ্ছে করে।’ (তিনি)। আল্লাহর গালে হয়তো যিশুর মতো নরম দাড়ি। পিঠে রাজনৈতিক অত্যাচারের কালশিটে দাগ। যুদ্ধ দাঙ্গার বিরুদ্ধে হয়তো সেই আল্লাহর ভাবনা থেকেই প্রমাণিত হয় কীরকম অস্থির সময়ে আমাদের ধর্ম-জাতি বিভেদের ঘেরাটোপ মানবকে খণ্ডিত করেছে। প্রতিহিংসার আগুন দেখে সেই ব্যঙ্গ বারবার দেখা দিয়েছে নব্বইয়ের কবিতায়। এই সময়ে মানুষ বুঝে গেছে ধর্ম মানে ভয়।ধর্ম মানে হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান। পাত্র-পাত্রী নির্বাচন থেকে চাকরি বাকরি সবকিছুতেই এর প্রভাব। একে ঘিরেই রাজনীতির ব্যবসা। মন্দির মসজিদ বানানোর মিছিল। সমস্তই জ্ঞানপাপীর মতো আত্মস্থ করে হেঁটে যায় মানুষ। কুসংস্কার আর অসভ্যতার তিলক, চন্দন, টুপি, টোপরের নিয়মবিধিকে জিইয়ে রাখে। ডাইনি বলে অপবাদ দেয়। এসব দেখতে দেখতে সমাজের মানুষ কবিরাও বলেন, ‘ঘাস চিবুচ্ছি চরিত্রবান ঘোড়ার মতো।’পিঁপড়ে, হাতি, বোয়াল, মাগুর সবই মানুষের রূপ। সূর্যমুখীর হাসির মতো পিছলে যাচ্ছে। এই মুহূর্ত সেই কারণে জটিল এতো। সংশয় আর জ্ঞানের ভারে বুঝেও নেয়। অভীক বন্দ্যোপাধ্যায় এই মুহূর্তকেই ধরতে চেয়ে এই মুহূর্তের জৌলুসের আড়ালেই হয়তো দেখেছেন হাজার বছর পিছিয়ে যাওয়া কোনো সময়কে:
“হয়তো তোমায় ছোঁয়াই সোজা এই মুহূর্তে
তবুও সেই মুহূর্তকে
পিছিয়ে দিচ্ছে হাজার বছর।
যদিও ফোন উঠছে বেজে।
কল্পতরু ভাতের হোটেল খুলছে রোজই।”
( কল্পতরু ভাতের হোটেল)।
কল্পতরু ভাতের হোটেল রোজই খুলে যায়। রোজই সকাল হয়। প্রেরণায় বুক ভরে ওঠে। গণেশ গজানন সিদ্ধিদাতা আমাদের বাপ। আমরা লিখে যাই মহাভারত বেদবাক্যের মতো।ঘরের মেয়ে মানুষ মূর্খ, তাকে আর কী বোঝাবো? জিনিয়াস কবি নিজের ব্যক্তিত্বেই সময়কে জানান দেন। যে বিষাক্ত সময় শুধু নিসর্গ নয়,নিসর্গের চাঁদের আলোয় তৈরি ঘর-বাড়ি আর সারি সারি পলাশ গাছ, মোরাম বিছানো রাস্তা, চিমনির ধোঁয়া আর গম্বুজ দেখে। কখনও জাহান্নামের আগুনের পাশে দেখে চাঁপা গাছ আর শ্মশান-বালক খই কুড়াচ্ছে; খুচরো পয়সা আর ছেঁড়া ঠোঙা হাতে। অথচ আমাদের প্রেম ছিল, প্রেমের নক্ষত্র ছিল। মধুর বংশী বাজানো ছিল। সেই সময় অতিক্রান্ত হলে মনের ভেতর এখনও বেজে ওঠে:
”মধুর মধুর বংশী বাজে, ঋতুচক্র ঘুরে এলে
আমি কি পথের মাঝে পথ হারিয়ে ফেলেছি
মধুর, তোর কপালে ঘুমিয়ে পড়ার জন্য রোগা ডালপাতা ধরে ঝাঁকা দিচ্ছি, পলকে পলকে উঁচু আকাশের ডানা থেকে নেমে আসছে টিপপোকা, পাতা
পাতা তারারা সবুজ হয়ে উঠছে, ইচ্ছে হয়ে উঠছে
কত নিঃস্ব ভিখারির… (ভ্রমরকে লেখা কবিতা: সাম্যব্রত জোয়ারদার।)
নিঃস্ব ভিখারির মনেও আশার সবুজ সংকেত। মনের চোখেই কবি নিজের দিকে তাকিয়েছেন। মনের চোখে বাইরের দিকে দেখলেও এই সময়ের রাজনীতির পোস্টার ঘাসফুল আর হাতুড়ির ছবি। সবটাতেই লুকোনো আছে রক্তমাখা ছুরি অথবা হাতুড়ির তলায় রাখা নখ। কখনো মনে হতে পারে সমস্ত দেশটি রাজনীতির দশক। চোখের সামনে ভেসে ওঠে : ভোট দেবেন কোনখানে…
আমরা যেন নকলনবিশ হয়ে ছুটে চলেছি। ঘন রাতে ডুব দিয়ে নিজেকেই নিজের খুনি করে তুলেছি। পৌলোমী সেনগুপ্ত সে-কথাই বললেন:
“ঘন রাতে যদি ডুব দিই।উঠে আসি জনহীন ঘাটে অপরাধী একা আমি হাত মুছি নিরীহ বাতাসে”
(ভুল অপরাধ)।
এই সময়ে নিজেকে মানুষ ভাবা যে বড়ই কঠিন সেকথা আমরাও জানি। আর জানি বলেই আমাদের কোনো আফসোস নেই, অনুতাপ নেই। গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু যে ক্ষয় ও আত্মিকসংকটে প্রতিনিয়ত ঝড়ের সম্মুখীন হচ্ছি তার দায় এড়ানো কি সম্ভব?
“জানালাগুলো বন্ধ করে দিয়ে
দুই হাঁটুতে মুখটি গুঁজে আছি
ভয়কে তবু ঠেকানো যাচ্ছে না
কড়া নাড়ছে বাইরে আরও কেউ”
(এমনি করেই: পৌলোমী সেনগুপ্ত)।
এই ঝড়কে ঠেকানো যাবে না। আমাদের জীবন-যাপনে নিঃস্ব দাঁত-নখ বেরিয়ে আসবে আর ঘৃণা থুতু দিয়ে ঢাকা এই সময়কে অতিক্রম করবো আমরা। মাঝে মাঝে গোল বাধে, তবু ‘ছুকছুকে’ মাছির দ্বারা। অর্থাৎ আকাঙ্ক্ষারা প্রবৃত্তির ডানায় ওড়ে। তখনই তারা হাতে মুখে বার বার উড়ে এসে বসে। ‘ক্ষত খুঁটে খায়’ (তিলোত্তমা মজুমদার)। সুতরাং কষ্ট বাড়তেই থাকে। মায়ার হাসি ফোটে। খেলার মাঠে যুবক হারিয়ে যায়। কবিতায় বারবার শরীর জেগে ওঠে। শরীর খোঁজে ভাষা। শরীর খোঁজে শরীর। কবিতা, গান, রোদ্দুর, আলো, অন্ধকার, বিদ্রোহ ,বেদনা এই শরীর:
“শরীর নব্বই সাল…. বন্ধুদের লেখা এই আমি
শরীর রবি ঠাকুর…. গানে গানে বউঠান-রোদ
শরীর ভাষার মতো…. উৎস থাকে মোহনায় রাজি শরীর ফুলন দেবী… সব হারানোর প্রতিশোধ!
যে-বাতাস বারুদের, হন্যে হয়ে আজ তাকে চাই!
শরীর স্বভাব কবি ।
এসো প্রেম প্রেরণা জোগাই……”
( শরীর: বিভাস রায়চৌধুরী)।
শরীরের গুরুত্ব অপরিসীম। মন্দাক্রান্তা সেনের কাছেও তা স্বরলিপি হয়ে বেজে উঠেছে। মিতুল দত্তের কাছেও। কখনও তা স্নানের ঘরে, কখনও একান্ত নিজস্ব আয়নায়। ‘সেখানে শূন্যতা আর অতৃপ্ত মোচন ঝরে/ মুগ্ধ নারী, মুগ্ধ পুরুষের’। সুতপা এই শরীরেরই কামে চোখ ফোটান। উত্তাপ আর গন্ধ সেখানে বাষ্প হয়ে ওঠে। জল হয়ে হয়ে গলে যায়।
এটাই তো প্রেম। তাকে শরীরে খুঁজলেও শরীরের বাইরে তার প্রকাশ। মহিমা লক্ষ করা যায় ক্রিয়ায় ও প্রতিক্রিয়ায়। সেই কারণেই তসলিমা নাসরিন প্রশ্ন তোলেন:
“ত্রিশোর্ধ শরীরখানা কাঁপে।
তরবারি কি আছে যুবক তরবারির খাপে?”
আরও বলেন:
“কাঁপছি আমি যেমন কাঁপে ঘূর্ণিঝড়ে কেরোসিনের কুপি
ভালোবাসার আগুন নিয়ে এসো আমার যুবক চুপি চুপি।”
(কাঁপন)
এ তো আবহমানকালের বিরহ-ই। কাঁপন বা ভাইব্রেশন নারী-পুরুষের মনের অথই প্রবাহে নিগূঢ় সত্যের সেতু যোজনা। যাতে কাছাকাছি আসার প্রবল আকর্ষণের প্রকাশ। একে কেউ অস্বীকার করতে পারে না।
যদিও নিজেরই মুখোমুখি। নিজেরই বৃন্তে নিজেকেই কোনও ভালবাসায় জড়ানো। কখনোই সেই নার্সিসাসকে ছাড়তে পারি না:
“ডানা তার ভাঙা ছিল যেন
আদিগন্ত পোড়া শস্যক্ষেত
যতদূর চোখ চলে তার
নিজেই নিজের সেই প্রেত।”
(প্রেম:সেবন্তী ঘোষ)।
‘নিজেই নিজের সেই প্রেত’ এই খেলা তো জীবনভরই চলতে থাকে। একাই বাঁচা। যেমন বাঁচে টিকটিকি। এক গ্লাসের ইয়ার, বন্ধু পার্টনার সবাই যে যার ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ। সুতরাং বেঁচে থাকা দুঃসাহস নয়, সাহস। অস্বাভাবিক নয়, স্বাভাবিক। নিজেকে নিজেই সাতপাকে বাঁধা:
“ভাবনা ছিঁড়ল,যেমন ছেঁড়ে,ফোনের বিশ্রী শব্দে—
‘বেলা অনেক হলো এবার জুটিয়ে নাও একটা’
কী জোটাবে—চাল-ডাল না লোডশেডিংয়ের লম্ফ নাকি, দু-চারজনের সামনে বাজবে জগঝম্প
সেটাই বাঁচা, সেটাই খেলা…. চলুক তবে একটু
বলুক সবাই—ওমা এতো একাই বর-বউ
রঙ্গ দেখ, একাকি একা বাঁধছে সাতপাকে;”
(একা:বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় )
কবি সামাজিক হলেও সাধারণ মানুষের মতো তাঁর ভাবনা নয়। বিয়ে করে সংসারী হয়ে নিস্তরঙ্গ জীবনের মোহ তাঁর নেই। আগেই আমরা জেনেছি নব্বই মুক্তির দশক, এই মুক্তি শুধু কবিতার ছন্দে আসেনি, কবির ব্যক্তিগত জীবনেও এসেছে। সুতরাং একে স্বাগত জানিয়েছেন সমস্ত কবিই। সুপ্রভাত মুখোপাধ্যায় দেখেছেন গৃহকর্তা সাংসারিক মুক্তি চেয়েছেন,’স্বামীটি হারিয়ে গেছে। জয়দেবে সাধু হবে বলে’। শ্রীজাত দেখার দৃষ্টিকে মুক্তি দিয়েছেন। পাল্টে গেছে দৃশ্য জগৎ, অনুভব, ঘ্রাণ-ইন্দ্রিয়। তিনি একবার বলেন, ‘একলা বর্ষা গিটার ভিজছে’। আর একবার বলেন ‘একলা গিটার বর্ষা ভিজছে’।থিসিস এবং এন্টিথিসিস-এর ভেতর দিয়ে এমন এক দর্শনে পৌঁছাতে চান, যেখানে দুটি জগৎ দুই প্রকৃতির রমণরঙ্গ কত সহজ ভাষায়, সহজিয়ায় অন্তঃস্থল ছুঁয়ে গেছে। তবু শ্রীজাতের ‘ভোলামন পোস্টমডার্নিয়া’—জীবনের বৈপরীত্যে ফুটে ওঠা আলো-আঁধারি—প্রাতঃকৃত্য করতে বলে লাথি খাওয়ার মত ডিগবাজি খেয়ে গড়াতে হয়। ‘মাছের নাম হাঙর। তার দাঁতের কিবা শোভা’—শ্রীজাতের চোখ দিয়ে আমাদের দেখতে হয়। শ্রীজাত কবিতায় জীবনকে নিয়ে রঙ্গ যেমন করেন তেমনি জীবনের আদিমতাকে ঢেকে রাখেন না। তার তলানি পর্যন্ত গড়িয়ে যেতে ভালোবাসেন। তাঁর চিত্রকল্পে সেই অঙ্গার ও আগুন তাই এরকম ছলকে ওঠে। অনায়াস শব্দবন্ধের অব্যর্থ টঙ্কারে জীবনের অভিঘাতকেই চিনিয়ে দেয়। বিনায়ক, শ্রীজাতের এই ধারায় নব্বই দশকের ধারালো মেধাকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলেন স্মরণজিৎ চক্রবর্তী। তিনি লেখেন এমন ‘শুভেচ্ছা পত্র’ যাতে আমাদের স্বাভাবিক বোধিবৃক্ষ নাড়া খায়। কল্পদৃশ্য নয়,ভাবদৃশ্য নয়, সত্যি সত্যি বৌদ্ধিক নির্ণয়ে প্রাকৃতিক সংহিতা—মনখারাপের ওড়না মাথায় শহরের ওড়া এবং তার পেছন পেছন বর্ষার ছোটা। এক লহমায় ‘শহর জুড়ে আকাশ লাগাই টবে’এবং
“সেই আকাশই মিটিং-মিছিল, ডি. এ-এর অবসরে ফুলের গন্ধ পৌঁছে দিচ্ছে সবার ঘরে ঘরে”
এই শুভেচ্ছাপত্রে ‘রোদ-মাটি, ধান, বর্ষা থেকে কয়েক পৃষ্ঠা টুকে তিনি পাঠিয়ে দেন মনখারাপের সমস্ত বন্ধুকে। খুব সহজ করে বলেও জটিল জীবনের এক সমীক্ষণকে সঠিকভাবে নির্বাচন করতে পারেন তিনি। এই দুরন্ত সময়—যখন সব মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে গেছে, আমাদের সব সম্পর্ক ক্ষয় হয়ে গেছে; মৃত্যু,ভয় অবিশ্বাস, আতঙ্ক, আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত গ্রাস করছে, তখন আর আমাদের সুখী গৃহবাস নয়,— আরণ্যক জীবন। এই বাঁচার মধ্যে মোহ নেই, স্বপ্ন নেই, আছে অভিযোজন, আত্মীকরণ। সুতরাং ‘ভোরের আলোয় চকচক করে ক্ষুর’—আততায়ী আমাদের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে। তবুও আমরা :
“ধারালো সকাল গলায় ঠেকিয়ে বাঁচি
শিরা-কাটা হাতে ধরা থাকে কারো হাত…
বন্ধুর চোখ শুষে নেয় সবকিছু;
বিষ, কাঁটাতার, আগুন, বজ্রপাত”
(আরণ্যক: স্মরণজিৎ চক্রবর্তী)
নব্বই দশক ও তার পরবর্তী সময় ধরে এভাবেই ‘রক্তমাখা ঘড়ি’ বেজে চলেছে। প্রেম বিছানো পথে আমরা হাঁটতে পারছি না। বিষ, কাঁটাতারে ভাগ হয়ে যাচ্ছি; বিষাদ আমাদের মেরে মুখে করে তুলে নিয়ে গেছে বনের ভেতর—সেই অরণ্য-যুগে। কী করে বাড়ি ফিরবো আমরা? সব বিশ্বাসের কাছে, সবার আশ্রয়ের কাছে আমাদের বিপদ সংকেত:
“জলস্তম্ভ ভেঙে পড়ছে
জল ঢুকছে বিছানা বালিশে
মাঝরাতে উঠে বসছে মরুভূমি কাঁটা চিবোচ্ছে উট পেছন থেকে ছুরি মারছে মুখোশ পরা লোকজন মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে কাটা আঙুল কাটা কান রক্তমাখা ঘড়ি
পাখির কঙ্কাল উঠছে জ্যোৎস্নার ভেতর”
(রক্তমাখা ঘড়ি:সাম্যব্রত জোয়ারদার)।
সময় এভাবেই রচিত হয়ে চলেছে। আবেগে আর আমরা কেঁপে উঠি না। বড় কোনও প্রেমিকও আমরা নই।একাকিত্ব আমাদের ভূষণ;আবার সহনশীলতাও। এর মধ্যেই চাঁদ দেখি, আকাশ দেখি। নিজেকে ছড়িয়ে দিই মানুষের ভেতর, অতীত ইতিহাসে, সভ্যতার প্রত্ন-নিদর্শনে।
নাসিম-এ-আলম এ-রকমই মিশরের মমি থেকে অজন্তার গুহাচিত্র, আইরিশ কলোনি থেকে এলিজাবেথের পালঙ্ক পর্যন্ত নিজেকে খুঁজেছেন। হাজার হাজার বছরের উত্তরাধিকারী হয়ে যেন তাঁর জন্ম-জন্মান্তর প্রয়াস। আশ্রয় খোঁজার বিরামহীন এক চঞ্চলতাও এই দশকের একটা বড় বৈশিষ্ট্য। এই আশ্রয় খুঁজতে খুঁজতেই মরুভূমি-দশকে নাসিম উপস্থিত হন: “তোমার আত্মজীবনী শুনবো বলে
মরুভূমি,বহুকাল দাঁড়িয়ে রয়েছি
স্বপ্নভ্রষ্ট—এও এক মিথ্যে স্বপ্নকথা
আমি পালিয়ে যাব না।”
( মরুভূমির প্রতি ফনিমনসা)।
এই ‘বহুকাল’ শব্দটিই নাসিমকে দেশকালের সীমা অতিক্রম করে চিরন্তনকালের মহাপর্যবেক্ষক করে তোলে যা মরুভূমি; আমাদের সত্তার পরম শুষ্ক ও সংকটময় দীর্ণ হাহাকারকে আত্মস্থ করার বাসনা, পলায়নী বৃত্তি থেকে আবার ফিরে দাঁড়ানো। ঠিক যেন বিভাস রায়চৌধুরীর মতো বলা যায়,—
“সত্যি বলছি, সত্যি
আমাদের নিরক্ষর প্রেমে
পৃথিবীটা আজ বইখাতা।”( বইখাতা)।
পৃথিবীটা যে সত্যি সত্যিই কবিদের কাছে বইখাতা, জীবনটা যে একটা কলম, আত্মরসায়ন যে সেই কলমের কালি এবং লেখার বিষয় যে সময় তা আমরা পৃথিবীর সব কালের সব সাহিত্যের বিচারে উপলব্ধি করি। আজকের সভ্যতায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ, পরিবেশ দূষণ, মানসদূষণ একইসঙ্গে ঘটে চলেছে। বেশ্যানগর, ঝাড়ুদার পাড়া, হাসপাতাল, শুঁড়িখানা এই নাগরিক সভ্যতায় এক-একটি প্রতিষ্ঠান, আশ্রয়ের নাম। আমরা এসবের মধ্যেই বেঁচে থাকি। ভালোবেসে নিঃস্ব হয়ে নিজেরাও ‘রেশমকীট’ হয়ে যাই। কবিতায় এসবেরই ছায়া পড়ে। প্রতিটি সকালে তবু ডানায় রক্ত লাগা প্রজাপতি উড়ে যায়। কখনও আমাদের আশ্রয় খোঁজার বিরাম হয় না। আঘাত-অভিঘাত ত্রস্ত করলেও লোকাচার, সংস্কৃতি এবং নির্জন প্রকৃতি আমাদের টেনে নিয়ে যায় আত্মনিবেদনের সুরে।
আমাদের পরিষেবাতেই এরকম আরও এক পর্যবেক্ষণ সুবীর সরকারের কবিতায়। নিজেকে আত্মগোপনের ভেতর তিনি চালিত করেন। ভেতরের ধূসর প্রচ্ছদকে আড়াল করেন বাহ্যিক মানুষের জীবনচর্চায়। মরমে বাউলের নেশা ধরে যায়, তখন বুঝতে পারি না গান গাওয়া পাখিটার রক্তাক্ত আত্মক্ষরণ। নিজেকে ভরিয়ে তোলেন প্রকৃতির অনাবিল নিগূঢ় পর্যটনে:
“উত্তেজনা কমে গেলে সমস্ত স্মৃতি ও গুজব এর বাইরে চলে এসো।
তুমি তো বরাবরই শান্ত প্রকৃতির, ফিরে এসো নির্জনতার আড়ালে ছায়া ফেলো আমাদের জীবনচর্যায়
স্মৃতির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে স্মৃতিরা, ভরা শীতে গাছের সমস্ত পাতা ঝরে যায়।
দেশান্তরী পাখিদের জন্য অপেক্ষারত বনদেবতা। আমার ছায়াছন্ন জীবনের খুব কাছে যদি আসতে পারো
তবে আমি তুষারপাত ভুলে যাব।”
(শ্লোক, শ্লোকের দিনলিপি)।
শোক ও শ্লোকের দিনলিপি লেখাই তো আজকের কবিতা। জীবনের জটিল ছিন্নপত্র তার স্মৃতিফলকে, জাতিস্মর বেদনায় বারবার অনুভব করে আদিম কৌমজীবনের পর্যটনকে। তখনই কবিতার ভাষায়, ভাবে, অসংলগ্নতায় বা গ্যাপে তাকে রূপ দেন কবি। এ আবার কখনও কখনও পোস্টমডার্ন বা অ্যান্টি কবিতাও হয়ে ওঠে। সুবীরের হাতে বারবার এই ভাবনাই উঠে আসে।তাঁর ‘ঘোড়া ও নারীর ছদ্মবেশ ওড়ে’, ‘জ্যোৎস্নার রেলগাড়ি’, ‘শাল জঙ্গলে নিঃসঙ্গ জিরাফ’ এবং সারি সারি পিঁপড়ের শোকযাত্রার মাঝখানে/ পৃথিবীতে বৃষ্টি এল’ সবই এই ভাবনা সঞ্জাত। আমাদের জীবন দর্শনে গ্লানি আর অতৃপ্ততা মর্বিডিটির পর্যায়ক্রমে রূপ ঘুরে-ফিরে আসে। এ সবের পাশাপাশি আসে আশাবাদ। জীবনের ছিন্নসূত্র জোড়া লাগে, অসহায় বলির পাঁঠার মতো আমাদের কাতরানি থেমে যেতে চায়। বাড়ি বাড়ি শান্তির বার্তা পৌঁছে যায়। বেদনার ক্লান্ত স্মৃতিকে নিয়েই বাকনদী মায়াজালের তীরে তীর্থ সমাগত হয়। তখন পুবের আকাশ ভেদ করে জ্যোৎস্না নামে। খোলা জানালায় এসে দাঁড়ায় সন্ন্যাসী চাঁদ। তার মাধুকরী আমাদের প্রেম;নারীপাচারের দেশে এখনও দেখতে পাই:
“ভূমধ্যসাগর হতে উড়ে এল এক ঝাঁক বিরাগী বিহগ তাদের ডানার নিচে লুকানো কাঞ্চন-কণা—
মানবিক পৃথিবীতে ভাঙচুর শেষে পাখিরা
কলকাকলিতে
মেতে উঠে জানাল অভীপ্সা…”
(সোনালী পালক– মধুমঙ্গল বিশ্বাস)।
এই ঝংকারের বাণী এখনও শোনা যাচ্ছে, হয়তো একদিন সব ভাঙচুর শেষ হবে। গড়ে উঠবে মানববন্ধন। পৃথিবী সুন্দর হবে। প্রজন্ম একটা নতুন দেশ পাবে।
নব্বই দশকের বিচিত্র কাব্য-ভাবনা প্রাচীন রীতির ছন্দকে আবার নতুন করে অনুশীলনে, শব্দ প্রয়োগের বাছ-বিচারহীন নিষ্ঠায় কবিতা-চর্চা হয়ে উঠেছে আত্মজীবনী রচনার মতো। জয় গোস্বামী যে পথ দেখিয়েছিলেন সেই পথেই অসংখ্য কবি এগিয়ে এসেছেন। তাঁদের বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষায়, চিত্রধর্মিতায়, রহস্যে, ব্যক্তিত্বের স্বয়ংপ্রভ আলোয় উদ্দীপিত হয়েছে কবিতা। কতকগুলি বৈশিষ্ট্য আমরা এখান থেকে পেয়ে যাই:
১) অস্থির ভাঙনকালের পরিমাপ—প্রেমে,স্বপ্নে, নির্মাণে, পলায়নে।
২) জীবনের আদি ও অন্তিম প্রলাপ।
৩) ঐতিহ্য ও সংস্কারের ভেতর আত্মদর্শনের প্রয়াস।
৪) পোস্টমডার্ন ভাবনায় স্বয়ংক্রিয় উদ্ধার।
৫)আত্মিক সংকট থেকে আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।
৬) যন্ত্রণা ও পলায়ন থেকে ঘুরে দাঁড়ানো।
৭) মিশ্রবৃত্ত ও মুক্তক ছন্দকেই ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়া।
৮) ঘৃণা ও শ্লেষের ভেতর সনাতন ধর্ম সংস্কারে উঁকি মারা।
এই বৈশিষ্ট্যগুলিই সবকালের কবিতাতেই থাকতে পারে, থাকতে পারে প্রেম-অপ্রেমের খেলা, বিশ্বাসহীনতাও।কোনও দিনই একটা সভ্যতাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসাবে পেতে পারি না আমরা। সুতরাং ভাঙন-নির্মাণ, পলায়ন-উত্থান, জীবন-মরণ পাশাপাশি বিরাজ করবেই। সেসব নিয়েই কবিতা লেখা হবে; বাউল একতারা বাজাবে; শিল্পী ছবি আঁকবে…
[ তৈমুর খান, কবি ও প্রাবন্ধিক। পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। ]