বাংলা রিভিউ: আপনার প্রথম প্রকাশিত বই কোনটি? কবে প্রকাশিত হয়েছিলো? প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি কেমন ছিলো?
নাজিব ওয়াদুদ: আমার প্রথম প্রকাশিত বই গল্পগ্রন্থ– ‘কাক ও কারফিউ’। প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। সেটা একটা মিশ্র অভিজ্ঞতার ব্যাপার। কাহিনিটাও দীর্ঘ। সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন সংস্কৃতিমনা ছাত্র তাদের লেখাপড়ার শেষ দিকে এসে বইয়ের ব্যবসা করবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। তারা স্কয়ার নামে একটি প্রকাশনা সংস্থাও গড়ে তুলল। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়াম মার্কেটে ঘর ভাড়া নিয়ে কাজ শুরু করল। কাজ বলতে আসলে কম্পিউটার কম্পোজ, প্রিন্ট, ফটোকপি, এইসব। তো আমাকে এবং সায়ীদ আবুবকরকে ধরল পাণ্ডুলিপির জন্য। সেটা সম্ভবত ১৯৯৬ সালের দিকে হবে। তখনও পর্যন্ত আমার কোনো বই হয়নি। সেজন্যে অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের পরও রাজি হলাম। পাণ্ডুলিপি দিলাম। কম্পোজ হলো। ট্রেসিং বের হবে। এমন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংঘর্ষ হলো। এতে যা হয়, ভাংচুর, জ্বালাও-পোড়াও। আরো অনেকগুলো দোকান-পাটের সঙ্গে স্কয়ারের দোকানও আক্রান্ত হলো। অনেকদিন দোকান বন্ধ থাকল। আমাদের পাণ্ডুলিপিও উদ্ধার করা সম্ভব হলো না। মাস ছয়েক পরে তারা জানাল কম্পিউটার নষ্ট হয়ে গেছে, কম্পোজ্ড ম্যাটার উদ্ধার করা যাচ্ছে না। তারা ব্যবসার কথাও আপাতত ভাবছে না। তারপর হঠাৎ একদিন, ১৯৯৭ সালের শেষ নাগাদ, তিনজনের একজন মনির হাজির। জানাল কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক থেকে ম্যাটার উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তার বক্তব্য হলো, যেহেতু সে কথা দিয়েছে, এবং আমার গল্পের ভক্তও সে, তাই ব্যবসা না করলেও সে বইটা করতে চায়। কী আর করা। আমারও তো কোনো উপায় নেই। সুতরাং বইটা বের হলো। প্রকাশনার মান তেমন ভাল হয়নি। কিন্তু বইটা পাঠক এবং সমালোচকদের সুদৃষ্টি পেয়েছিল। দুঃখের বিষয়, বইটা তেমন একটা প্রচার পায়নি। কারণ, প্রকাশক এই ব্যবসাতে ছিলেন না। তিনি তখন চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক কলেজের শিক্ষক। আমাকে রয়ালটি স্বরূপ দুশ কপি বই দিয়ে তিনি তার দায়িত্ব শেষ করলেন। আমি কিছু বই উপহার দিলাম। বিভিন্ন জায়গায় বিক্রির জন্যেও দিয়েছিলাম। কয়েকটা জায়গা থেকে সামান্য কিছু টাকা পেয়েছিলাম। তারপর সে বইয়ের খবর রাখা আমার পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। যাই হোক, আমার সৌভাগ্যই বলতে হবে, কবি-প্রাবন্ধিক মরহুম আহমদ বাসিরের (আল্লাহ তাকে জান্নাত নসিব করুন) উদ্যোগে ২০১২ সালে বইটি নতুন করে প্রকাশিত হয়। এবার প্রকাশক ঢাকার মহাকাল প্রকাশনী।
বাংলা রিভিউ: সাহিত্যে আপনি কার উত্তরাধিকার বহন করেন?
নাজিব ওয়াদুদ: এটা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। কারণ এর সঙ্গে বহুমুখি, মানে নানান রকম বিষয় জড়িত রয়েছে। যেমন ভাষা, বিষয়, আঙিক, জীবনভাবনা, ঐতিহ্য, ইত্যাদি। এমনিতে বলা যায়, বাংলা কথাসাহিত্যের মূলধারা, যেটা রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক হয়ে প্রবাহিত হয়েছে, আমি সেই সাহিত্যিক ধারার বাইরে যাইনি। তবে ভাষা, ভূ-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় বিশিষ্টতার কারণে ১৯৪৭-এর পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, অর্থাৎ বর্তমানের বাংলাদেশে সাহিত্য পশ্চিম বঙ্গীয় কোলকাত্তাইয়া ধারা থেকে বেরিয়ে আসে। এই বিশিষ্টতার আমিও একজন ধারক-বাহক। বাংলাদেশের সাহিত্যও এখন আর এক ধারায় নেই, সাহিত্যতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে যেমন, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দিক থেকেও তেমনই। বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-ধর্ম-সংস্কৃতি, তার রাজনীতি-অর্থনীতি, এখন একদিকে কোলকাত্তাইয়া (আসলে ব্রাহ্মণ্যবাদী, হিন্দুত্ববাদী) আগ্রাসন, অন্যদিকে সাধারণভাবে পাশ্চাত্যীয় প্রভাব-প্লাবনের শিকার। সাহিত্যও তার ব্যতিক্রম নয়। তার মধ্যেও শেকড়-সন্ধানী, স্বাজাত্যাভিমানী, আত্মগর্বী, একটি ধারা কখনো প্রবলভাবে, কখনো বা দুর্বল গতিতে প্রবহমান থেকেছে। এদের মধ্যেও নানান ধারা-উপধারা রয়েছে। মোটা দাগে আমি এই ধারার সাহিত্যকর্মী।
বাংলা রিভিউ: এ যাবৎ সর্ব মোট আপনার কতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? এর মধ্যে কোনটি বা কোন-কোন কাজকে বা কোন বইকে আপনি আপনার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করেন?
নাজিব ওয়াদুদ: এ পর্যন্ত নানা রকম বই মিলিয়ে আমার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৪টা। এর মধ্যে ছোটগল্পের বই ছয়টা, প্রবন্ধের বই একটা, উপন্যাস তিনটা, অনুবাদ ছয়টা, ছড়াগ্রন্থ একটা, সায়েন্স ফিকশন একটা, চিকিৎসা বিষয়ক একটা, যৌথগল্পগ্রন্থ একটা, বাকিগুলো সম্পাদনা। আমার মনে হয় এর মধ্যে গল্পগ্রন্থগুলোই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। ’কাক ও কারফিউ’, ‘নষ্ট কাল অথবা হৃদয়ের অসুখ‘, ‘কমরেড ও কিরিচ‘, ‘পদ্মাবতী কিংবা সুন্দরী মেয়েটির নাক বোঁচা‘, ‘বরেন্দ্রবাংলার গল্প‘, কিংবা ‘সেরা পঁচিশ‘। আমার অনুবাদের কাজগুলিও ভাল বলে আমার মনে হয়– ‘নোবেলবিজয়ী অরহ্যান পামুক’, ‘জননায়ক‘ (চিনুয়া আচেবের উপন্যাস), আধুনিক ফিলিস্তিনী গল্প’, ‘আনাড়ী রসিকজন‘ (বালজাকের উপন্যাস), ‘বিশ্বসেরা ছোটগল্প’, কিংবা ‘স্বর্ণনদীর রাজা’ (জন রাসকিনের কিশোর ক্ল্যাসিক)। অনেক আলোচক-সমালোচকও সেটা স্বীকার করেছেন।
বাংলা রিভিউ: সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার নতুন বই সম্পর্কে বলুন।
নাজিব ওয়াদুদ: সম্প্রতি প্রকাশিত বই আসলে সম্পাদিত গ্রন্থ। বরং তার আগে প্রকাশিত আমার গল্পগ্রন্থ ‘সেরা পঁচিশ’ সম্পর্কে কথা বলাই উত্তম। এই বইয়ের নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে আমার সেরা গল্পগুলি এই গ্রন্থে নেওয়া হয়েছে। এগুলো আমার দৃষ্টিতে সেরা, পাঠক-সমালোচক আমার বিবেচনা সর্বাংশে সমর্থন না-ও করতে পারেন। যাই হোক, কবি-প্রাবন্ধিক খুরশীদ আলম বাবুর আলোচনা (নয়া দিগন্ত সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত) থেকে ধার নিয়ে বলতে পারি, এই গল্পমালায় বিষয় এক ম্যানারিজমের মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি, বিষয়বৈচিত্র্যের বর্ণচ্ছটা এতে বিচ্ছুরিত হয়েছে প্রিজমের মত নানা দিগন্ত ঘিরে। এই গ্রন্থের ২৫টি গল্পের বিষয়বস্তু পঁচিশ রকম। তিনি এসব গল্পের রচনাশৈলীতে একইসঙ্গে রম্য ও বাস্তবতা জড়ানো শিল্পের ছাপ লক্ষ্য করেছেন। সমালোচকের ধারণা, এসব গল্পে গল্প আছে, সেদিক থেকে গল্পকার মপাঁসীয় ধারার লেখক, কিন্তু চেখভও তার অন্যতম কাণ্ডারি। পাশাপাশি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের প্রভাবও তিনি লক্ষ্য করেছেন। একটা কথা তিনি যথার্থই বলেছেন বলে আমার মনে হয়, সেটা হলো আমি গল্পে রূঢ় অভিজ্ঞতার কথা বললেও জীবনের আনন্দ ও প্রগতিকে আমি কখনো অস্বীকার করিনি, এসব গল্পে তার পরিচয় পাওয়া যাবে। জীবনে নাস্তির প্রাবল্য সত্ত্বেও আস্তিই গন্তব্য।
বাংলা রিভিউ: আপনি নিজেকে কোন দশকের কবি-লেখক বলেন? কেন?
নাজিব ওয়াদুদ: সাহিত্যের আলোচনা ও তার গতি-প্রকৃতি শনাক্ত করা এবং সেখানে বিশেষ একজন লেখকের অবস্থান ও ভূমিকা বিচার করার জন্য দশক-চিহ্ন সহায়ক ভূমিকা পালন করে একথা ঠিক। তবে বিষয়টাকে সেভাবে না দেখলেও চলে। যাহোক, গত শতাব্দীর আশির দশকের একেবারে শুরুর দিকে (১৯৮০-৮১) আমার সাহিত্যচর্চার শুরু, এবং শুরুতেই শেষ। তারপর ওই আশির দশকের একেবারে শেষপাদে এসে (১৯৮৭) আবার আমার সাহিত্যচর্চা আরম্ভ। কিন্তু প্রকৃত অর্থে নব্বই-এর দশকেই আমার সাহিত্য চর্চার উন্মেষ। অর্থাৎ আমার অবস্থা না-ঘরকা না-ঘাটকার মতো না-আশিকা না-নব্বইকা আরকি! তো বয়স এবং লেখালেখির শুরু বিবেচনায় আমাকে লোকেরা আশির দশকের লেখক বলে চিহ্নিত করেন। আমি ও নিয়ে মাথা ঘামাই না।
বাংলা রিভিউ: আপনার সমকাল নিয়ে বলুন।
নাজিব ওয়াদুদ: সমকাল মানে তো সমসাময়িক অর্থাৎ বর্তমান কাল। সেটা শুধু আমার নয়, সে তো এখন যারা অস্তিত্ববান সকলেরই। যাই হোক, বর্তমানে আমরা ভয়ঙ্কর সময় পার করছি। সারা দুনিয়াতেই এখন দুষ্কাল। কর্তৃত্ববাদী, স্বৈরাচারী, নিপীড়ক, দুর্নীতিবাজ, আগ্রাসী সরকারগুলো দেশে দেশে নিজ নাগরিকদের ওপর যেমন অন্য দেশের জনগণের ওপরেও তেমনই দুঃশাসন চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের সাম্প্রতিক নির্মমতা ও ধ্বংশযজ্ঞ আমাদের অসহায় হয়ে প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। সারা বিশ্বে এর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করলেও সরকারগুলো হয় নীরব, না হয় নপুংসকের ভূমিকা পালন করছে। আর সাম্রাজ্যবাদী ইউরো-আমেরিকান সরকারগুলো তো ইসরায়েলের এই প্রকাশ্য ভয়ানক অন্যায়কে ডাকাতের মতো সরাসরি সমর্থন ও সহযোগিতা করে চলেছে। এদিকে আমাদের দেশে দেখ, স্বাধীন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই, ভোটের অধিকার নেই, সংগঠন করার অধিকার নেই, সভা-সমাবেশ করার অধিকার নেই, জানমালের নিরাপত্তা নেই। চব্বিশ ঘণ্টা ভয়ে-ভয়ে থাকতে হয় কখন পুলিশ বা সাদা পোশাকের লোক এসে তুলে নিয়ে যাবে, কখন আমার বাড়ি, জমি বা ব্যবসা বেদখল হয়ে যাবে । তো এই অবস্থার মধ্য দিয়েই আমাদের দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। সাহিত্যেও তার প্রভাব গভীর এবং সুদূরপ্রসারী। এই বিষয়ে কিছু বলা যাবে না, সেই বিষয়ের সমালোচনা বা নিন্দা করা যাবে না, অমুকের লেখা ছাপা যাবে না, এই রকম অবস্থা চলছে। এমনকি অমুক-অমুকের সঙ্গে ওঠা-বসা করা যাবে না, লেনদেন, বিয়ে-শাদি করা যাবে না, এ রকম সেন্সরশিপের মধ্যে চলছে আমাদের সামাজিক জীবন। এরকম পরিস্থিতিতে লেখক-বুদ্ধিজীবীরা তাদের ক্ষুরধার লেখনি নিয়ে দাঁড়ান জনগণের পাশে। কিন্তু উল্টোটাই বরং ঘটছে এখন, বিশেষত আমাদের দেশে। এরকম ঘোর তমসা এ জাতির জীবনে এর আগে আসেনি কখনো।
বাংলা রিভিউ: সাম্প্রতিক কালে কারা ভালো লিখছে বলে মনে করেন?
নাজিব ওয়াদুদ: ভাল লেখা খুব কমই হচ্ছে। কারণ সে পরিবেশই নেই। এখন লেখার নামে খিস্তি-খেউড়, বিকৃতি আর ইউটোপিয়া চলছে। লেখকরা হয়ে পড়েছেন ক্ষমতাবান-ধনবানদের দাস, বশংবদ, অনুগত, পদলেহনকারী। অথচ প্রচারমাধ্যমে এদেরই দাপট। সে কারণে সত্যিকার সাহিতচর্চায় মনোনিবেশ করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরেও দু’একজন হয়তো নীরবে-নিভৃতে সাধনা করে চলেছেন, কিন্তু তারা রয়ে যাচ্ছেন আড়ালে। এই কুয়াশা কাটলে তবে বোঝা যাবে প্রকৃত অবস্থা। বর্তমানে দেশে কোনো নিয়মিত সাহিত্যপত্রিকা নেই বললেই চলে। দৈনিক পত্রিকার সঙ্কুচিত পরিসরের সাহিত্যের নামে আসলে ফিচারচর্চা ও প্রোপাগাণ্ডা চলছে। তাহলে ভাল সাহিত্য হবে কীভাবে?
বাংলা রিভিউ: কোথায় আছেন? কী করছেন? পারিবারিক পরিচিতি জানতে চাই।
নাজিব ওয়াদুদ: আমার জন্ম রাজশাহীতে, এখানেই বড় হয়েছি, লেখাপড়া, জীবন-জীবিকা সব এখানেই। আমি অনেকদিন পেশাদারী সাংবাদিকতা করেছি। ঢাকার বড়-বড় কাগজ যেমন দৈনিক নয়া দিগন্ত, দ্য ডেইলি স্টার, দ্য নিউ এইজ, প্রভৃতি পত্রিকার ব্যুরো চীফ হিসেবে কাজ করেছি। স্থানীয় অনেকগুলো কাগজ যেমন দৈনিক প্রথম প্রভাত, দৈনিক নতুন প্রভাত, দৈনিক লাল গোলাপ, প্রভৃতি পত্রিকার সম্পাদক ও প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। এখানকার প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলাম অনেক বার। পরে অবশ্য আমি চিকিৎসা পেশায় ফিরে এসেছিলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রের অতিরিক্ত প্রধান চিকিৎসক পদে থাকা কালে গত ২০ জুলাই (২০২৩) আমি অবসর গ্রহণ করেছি। গত ছ-সাত বছর ধরে আমি জনস্বাস্থ্য বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণাকর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এখনো সে কাজে ব্যাপৃত রয়েছি। পাশাপাশি চিকিৎসা সেবার কাজও চলছে। ইদানীং লেখালেখিতেও মনোনিবেশ করছি। আমার স্ত্রী ঘর সামলান, একমাত্র সন্তান, ছেলে, ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ছে।
বাংলা রিভিউ: স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা সাহিত্য–কোন ধারায়? কিভাবে প্রবাহিত হয়েছে– হচ্ছে–বলে আপনি মনে করেন?
নাজিব ওয়াদুদ: স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তর বলতে হয়তো ১৯৪৭-১৯৭১ এবং ১৯৭২-বর্তমানকে বোঝানো হয়েছে। ১৯৪৭-১৯৭১ পর্বের সাহিত্য তত্ত্বে ও প্রয়োগে, জীবনবোধ ও সাংস্কৃতিক উন্মেষের কাঙ্ক্ষায় সমৃদ্ধ ও গতিমান ছিল। সত্তর দশকের শেষাবধি এই ধারার জের ছিল। যদিও গুণে-মানে তা খুব একটা উল্লেখ করার মতো নয়। তারপর থেকে অধোগমনই ঘটেছে, সব অর্থেই। সে কারণে আমরা দেখেছি, পঞ্চাশ ও ষাট দশকের কবি-লেখকরাই স্বাধীনতা-উত্তর কালেও রাজত্ব করেছেন। ষাট দশকের পর এখনও পর্যন্ত আমরা কোনো বড় লেখকের উত্থান লক্ষ্য করিনি। একমাত্র ব্যতিক্রম হূমায়ুন আহমেদ। বিতর্ক থাকলেও কোনো কোনো বিবেচনায় তিনি এই কাল-পরিসরের একজন উল্লেখযোগ্য লেখক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন স্বাধীনতা-উত্তর কালে সাহিত্য নতুন গতি পেল না। বিশদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার জায়গা এটা নয়। এটুকু ইঙ্গিত দেওয়াই হয়তো যথেষ্ট হবে যে, স্বাধীনতার পর গোটা জাতি যেভাবে তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পথ ও গন্তব্য হারিয়ে ফেলেছিল, সাহিত্যও তার থেকে বেঁচে থাকতে পারেনি। যত দিন গিয়েছে পরিস্থিতি বরং তত খারাপ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত লেখকরা পরিণত হয়েছেন অধঃপতিত রাজনীতিক-ব্যবসায়ী-আমলাদের নির্লজ্জ অন্ধ স্তাবকে। খুব দ্রুত এর থেকে উত্তরণের কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।
বাংলা রিভিউ : আপনি কখনো কি কোন পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন অথবা সংকলন সম্পাদনা করেছেন? বিস্তারিত বলুন।
নাজিব ওয়াদুদ: আমি সেই আশির দশক থেকে রাজশাহীর বিভিন্ন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। ‘পরিলেখ‘ এবং ‘নন্দন‘ নামে দুটি লিটলম্যাগ সম্পাদনা করেছি অনেকদিন। করোনা পরিস্থিতির কারণে নতুন করে তা আর হয়ে ওঠেনি এখনো পর্যন্ত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় মাসিক সাহিত্য পত্রিকা নির্ঝর, আমি সেটা একনাগাড়ে কয়েক বছর ধরে সম্পাদনা করেছি। সংকলন সম্পাদনা বলতে ‘পদ্মাপাড়ের ছড়া‘ (২০০৪), ‘পদ্মাপাড়ের গল্প‘ (২০০৭), সায়েন্স ফিকশন সংকলন ‘আজব গ্রহে সবুজ ভূমি’ (২০২২)। আরো দুটো সংকলন গ্রন্থ, একটা কিশোর গল্প, অন্যটা লেখালেখির কলা-কৌশল নিয়ে, প্রকাশের পথে।
বাংলা রিভিউ: লিটল ম্যাগাজিন এর সংজ্ঞা কি? এ নিয়ে আপনার ভাবনা বলুন।
নাজিব ওয়াদুদ: অনেকদিন আগে ‘ছোটকাগজ, বড় দায়িত্ব’ শিরোনামের একটা ছোট্ট প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সম্ভবত ইত্তেফাক সাময়িকীতে ছাপা হয়েছিল। সেখানে আমি বলেছিলাম, লিটলম্যাগ উপস্থাপন করে প্রচলিত ধারার বিরুদ্ধে এমন নতুন কিছুকে যা প্রচলিত (তথাকথিত বড়) কাগজগুলোতে প্রশ্রয় পায় না। এইসব নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা সাহিত্যের বিষয়, চিন্তা, ভাষা, প্রকরণ, যে কোনও ক্ষেত্রেই হতে পারে। লিটলম্যাগ আসলে একটা তাৎক্ষণিক সাহিত্যিক আন্দোলন, অন্তত আন্দোলন-প্রয়াসের ফসল, যার লক্ষ্য সাহিত্যকে প্রচলিত ধারা ও বিশ্বাস এবং প্রতিষ্ঠানের দাসত্ব থেকে পূর্ণ বা অন্তত আংশিক মুক্ত করা। অর্থাৎ এর রচনা, সম্পাদনা, প্রকাশনা, ব্যবস্থাপনা এবং সর্বোপরি অর্থায়ন, হবে অ-প্রাতিষ্ঠানিক, স্বাধীন, বৈপ্লবিক, এবং অ-বাণিজ্যিক। লিটলম্যাগের সম্পাদক, প্রকাশক ও লেখকরা সাধারণত ‘সিরিয়াস’সাহিত্য করতে চান, কিন্তু তারা নবীন, বা কম পরিচিত, ও স্বল্পালোচিত; তারা সাহিত্যকে পণ্য গণ্য করেন না, সাহিত্যের বিনিময়ে অর্থোপার্জন ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা, এমনকি সাহিত্যিক খ্যাতিলাভও তাদের লক্ষ্য নয়।
লিটলম্যাগের একটা সীমাবদ্ধতা হলো এই যে, বেশি দিন সে তার চারিত্র্য ধরে রাখতে পারে না। তার অনেক কারণের একটা হলো কোনো নতুন প্রকরণ, বা বিষয়, বা চিন্তা, বা আঙিক, যা-ই হোক না কেন, একবার আবিষ্কৃত হয়ে গেলে সেটা পুনরাবৃত্ত ও চর্চিত হতে হতে ক্রমেই হয়ে ওঠে আরেকটা প্রচলিত ধারা। ‘নতুন’জিনিস তো আর বছর-বছর বা এমনকি প্রতি দশকেও আবির্ভূত হয় না। তাই লিটলম্যাগ সর্বশেষ নতুন জিনিসটা যা এখন বাস্তবে পুরনো ও প্রচলিত, তারই চর্চা করে যেতে থাকে। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, প্রায়শঃই লিটলম্যাগ হয়ে ওঠে যা-ইচ্ছা-তাই লেখা ও প্রকাশের হাতিয়ার। আজকাল লিটলম্যাগ নামে যা-সব বের হয় তাকে চারটি ধরনে চিহ্নিত করা যায়। এক, অন্য কোথাও লেখা প্রকাশ করা যাচ্ছে না বলে নিজেরাই পত্রিকা বের করে নিজেদের লেখা, তা যত নিম্নমানেরই হোক না কেন, নিজেরাই প্রকাশ করা। দুই, একটা গ্রুপ গড়ে তুলে নিজেদেরকে যা-নয় তাই বলে প্রচার করা। তিন, বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য-লক্ষ্যের তোয়াক্কা না করে যা পাওয়া যায় তা-ই ছেপে যাওয়া। চার, সত্যিকার লিটলম্যাগের দায়িত্ব পালনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। লিটলম্যাগের নামে এই প্রথম তিন ধরনের পত্রিকার সংখ্যাই এখন বেশি। সত্যিকার লিটলম্যাগ নেই বললেই চলে।
আমার মতে, সত্যিকারের লিটলম্যাগ করা সত্যিই বেশ দুরূহ কাজ। যারা লিটলম্যাগ করছেন তাদের কাছে আমি তিনটা জিনিস প্রত্যাশা করি। একটা হলো, তারা নবীন ও প্রতিশ্রুতিশীল লেখকদের আবিষ্কার ও লালন করবেন এবং বিকাশ ও উৎকর্ষের পথ দেখাবেন। দ্বিতীয়ত, প্রাচীন ও সমকালের লেখক ও সাহিত্যের মধ্যকার সম্পর্কসূত্র আবিষ্কার, পুনর্মূল্যায়ন ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবেন। আর তৃতীয়ত, নতুন কিছু আবিষ্কার করার চেষ্টা করে চলবেন প্রতিনিয়ত, আর যতক্ষণ না তা সম্ভব হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত সমকালের বৃত্তায়নপ্রক্রিয়াকে শনাক্ত করার মাধ্যমে লেখকদের মধ্যে তাকে ভাঙ্গা ও অতিক্রম করার উৎসাহ ও দুঃসাহস সৃষ্টি করবেন। আমাদের আজকালকার অধিকাংশ লিটলম্যাগ এই কাজটুকুও করতে পারছে না। তারা আসলে একেকটা ছোট ছোট বৃত্ত তৈরি করছে মাত্র।
বাংলা রিভিউ: অনলাইন ম্যাগাজিন বা ওয়েব ম্যাগাজিন চর্চাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
নাজিব ওয়াদুদ: যদিও আমি ওয়েব ম্যাগাজিনের সঙ্গে এখনো সহজ ও অভ্যস্ত হতে পারিনি, তবু এটাকে আমি সমর্থন করি। ডিজিটাল টেকনোলজির অগ্রগতি ও প্রসার অভাবনীয়। সাহিত্য ঠিক এরকম গতি বা লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে চলার বিষয় নয়। তবু ডিজিটালাইজেশনকে অস্বীকার বা অবহেলা করার সুযোগ নেই। তবে সাহিত্যের মানসম্পন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন একেবারেই হাতে গোণা। এ নিয়ে আমাদের অনেককিছু করতে হবে। প্রিন্ট-পাবলিকেশন ক্রমশ সংকুচিত হয়ে চলেছে। এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার শংকা হয়। সুতরাং ওয়েব ম্যাগাজিন এবং ডিজিটাল পাবলিকেশন নিয়ে আমাদের কাজ করা উচিত।
বাংলা রিভিউ: আগামী দিনের সাহিত্য কেমন হবে? আপনার কল্পনায়।
নাজিব ওয়াদুদ: আমি হতাশ হয়ে পড়ি। কাগজের পাতায় মুদ্রিত অক্ষরে সাহিত্য পড়তে না পারার সম্ভাব্য অতৃপ্তি আমাকে আতঙ্কিত করে তোলে। অবশ্য সে পরিস্থিতি দেখার আগেই আমরা চলে যাব। যাই হোক, প্রথমত, আমি মনে করি ভবিষ্যতে সাহিত্যের স্থান সংকুচিত হয়ে যাবে। সফটওয়্যার অ্যাপ কবিতা-গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ লিখবে। সেসব লেখা কে পড়বে, কেন পড়বে আমি জানি না। সেসব কথা ভাবতে গেলে আমি শিহরিত হই। মানুষ নিজেই যখন প্রায়-বস্তুতে পরিণত হবে বা রোবটের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হবে, বা তার মনন ও মস্তিষ্ক অ্যাপ এবং চিপসের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়বে, মন হয়ে উঠবে অপ্রাসঙ্গিক ও অপ্রয়োজনীয়, তখন হয়তো সাহিত্যের কোনো প্রয়োজনই থাকবে না, বা থাকলেও তার রূপ কী হবে তা কল্পনা করাও মুশকিল এখন। মানুষ মানুষ না থাকলে সাহিত্যও থাকবে না।
গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব
নভেম্বর ২০২৩