spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধবুদ্ধদেব বসুর নজরুল বিচার : একটা বিলম্বিত জবাব

লিখেছেন আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ

বুদ্ধদেব বসুর নজরুল বিচার : একটা বিলম্বিত জবাব

আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ

আবু সায়ীদ আইয়ুব থেকে শুরু করে, হুমায়ুন কবীর, বুদ্ধদেব বসু, কাজী আবদুল ওদুদ এবং হুমায়ুন আজাদ পর্যন্ত কেউই কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিভার মূল্যায়ন সঠিকভাবে করতে পারেন নাই বা তাকে তার যথযথ প্রাপ্যটুকু দিতে চান নাই। তার অনেকগুলি কারণ থাকতে পারে। কিন্তু যে জিনিসটি তাদের চোখে আর মনে পর্দা পরাইয়া দিছিল সেইটা হইল তাদের রবীন্দ্রপাঠ। রবীন্দ্রনাথ তাদের শুধু বিস্ময়াভূত এবং কতক অন্ধ করে রাখে নাই, রবীন্দ্রনাথ তাদের সাহিত্যিক ন্যায় বিচারও ধংস কইরা দিছিল। তারা যে আয়না দিয়া নজরুলকে দেখছিল তা রবীন্দ্রনাথেরই আয়না। সে আয়না শুধু রবীন্দ্রনাথকে দেখা যায়, নিরপেক্ষ চোখ দিয়া না, একটা পক্ষপাতদুষ্ট মন দিয়া। তারা রবীন্দ্র-প্রেমে এত মজছিলেন যে কবিতা বা শিল্পের যে আর একটা দ্রোহী রূপ, আর একটা মজলুমভাষা অস্তিত্ব থাকতে পারে, একটা জুলুম-বিরোধী মজলুম-নন্দনতত্ত্ব যে তৈরি হইতে পারে তা তারা বিশ্বাস করে নাই অথবা ইচ্ছা করে এড়িয়ে গেছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যিনি নজরুলকে অপরিপক্ক এবং অজ্ঞান সমালোচনা করছেন তিনি হইলেন কবি এবং সমালোচক বুদ্ধদেব বসু। বসুর কবি হিসাবে তেমন নাম ডাক নাই, কবি হিসাবে তাকে ব্যর্থই বলা যায়, অন্ততপক্ষে তার সমসাময়িক কবিদের সাথে তুলনা করলে। কিন্তু একজন পণ্ডিত-সমালোচক হিসাবে তার অবস্থানকে তিনি নজরুল নিন্দামুখর এই বাংলায় প্রতিষ্ঠা করে গেছেন বলা যায়। বুদ্ধদেবের সবচেয়ে ভ্রান্ত এবং স্বৈরাচারি বিচার হইল নজরুল ইসলামের কবিতাকে ইমম্যাচিউর(অপরিণত) হিসাবে সাব্যস্ত এবং প্রচার করা। তার ধারণামতে নজরুল সারাজীবন একটা বালকের মত লিখছেন। প্রমাণস্বরুপ তিনি নজরুলের  ‘আমি চির-শিশু, চির-কিশোর’(বিদ্রোহী) এই লাইনটা আক্ষরিক অর্থে ধইরা নজরুল সম্পর্কে এই নেগেটিভ ইতি টানছেন। কিন্তু এইটা যে কবিতাটার আবহে লেখা এবং সিম্বলিকালি কবিতার ভেতরের একজন বিদ্রোহীর চির সবুজ প্রাণ প্রাচুর্য্যকে ফুটাইয়া তুলে- বুদ্ধদেবের মত মেধাবী সমালোচকের এইটা অজানা থাকার কথা ছিল না। এই বাক্য দিয়া নজরুলের প্রতিভার প্রকৃত মূল্যায়ন হয় না, তার পুরা কাব্যসত্তা এবং কাব্য-স্বভাবের ওপর শেষ বিচার ঘোষণা করা যায় না। কারণ একজন কবি এক এক কবিতায়, কবিতার আবহ, বিষয় বুঝে তার মনের ভাব বিভিন্ন আঙ্গিক এবং উদ্দেশে প্রকাশ করেন। আমাদের বুঝতে হবে নজরুল যে মহান কষ্ট(সাবলাইম সাফারিং) এবং ব্যথার(পেইন) কথা বলতেছেন, যে দ্রোহ এবং ক্ষোভের কথা বলতেছেন সেইটা চালু করবে তার যুবসত্তা, তার সজীব প্রাণসত্তা। তাই এইটা একটা ফাউন্ডেশন স্তর। এইটাতেই নজুরলের কবিতা-সাইকির বীজ লুকাইয়া আছে। তাই এই সমালোচনাতে বসুর মালিশাস(বিদ্বেষপরায়ণ) ক্রিটিকাল থিউরি ব্যবহার হইতে দেখি, যেখানে তিনি শিল্পকে মানুষের সংগ্রামের, মানুষের কল্যাণের উপাদান মনে না কইরা শুধু নিজ শ্রেণীর ক্ষমতা এবং জ্ঞানের আলোকে বিবেচনা করছেন। নজরুলের সাবলাইম সত্তাকে অস্বীকার করছেন। এখানে সাবলাইম(মহান) তত্ত্ব সম্পর্কে দুইটা কথা বলি। সাবলাইম তত্ত্বের বিষয়বস্তু হলো কবিতার ভাষা ও শৈলী। এই কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে ভাষার উচ্চতা আর চমৎকারিত্ব ধইরা রাখা হয়। সাহিত্যের সাবলাইম ভাষার উপাদান বা উপকরণ হইলো- মহৎ ভাব ধারণের ক্ষমতা, প্রচণ্ড আবেগ জাগানোর ক্ষমতা, ভাষার অলংকার, উচ্চমার্গীয় শব্দ এবং শব্দের মহৎ বিন্যাস। এই সবগুলি গুণই নজরুল ইসলামের কবিতা এবং গানে দেখতে পাওয়া যায়। যেমন গ্রীক ট্রাজেডির নাট্যকার ইস্কিলাসের আগামেমন এবং প্রমিথিউস বাউন্ড,  সফোক্লিসের ইডিপাস এবং আন্তিগোন এবং শেক্সপিয়ারের হেমলেট এবং ম্যাকবেথ নাটকে দেখতে পাই।  

 ২

ইংরেজিতে লেখাপড়া করা, ইংলিশ মেজাজ মর্জি ধারণ করা, ইউরোপে সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতাদানকারী বুদ্ধদেব তার শ্রেণী, শিক্ষা, দীক্ষা, রুচি এবং ইউরো-আধুনিকতার খণ্ড মানদণ্ড দিয়া নজরুলকে দেখছেন। সবাই জানেন যে বুদ্ধদেবের কিশোরকাল এবং তারুণ্য মানে তার লিটেরেরি ফিল্ড দখল এবং নির্মাণ করছিল উপনিষদ ভাব-স্নাত এবং ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের সৌম্য, শান্ত, প্রতিবাদহীন, ঘুমঘুম অলস, ছায়া সুনিবিড় সরল ভাবগম্ভীর, কাব্য জগতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন। তাই নজরুলের আচমকা আগমন, তার দ্রোহ তার আগুন এবং তার থেকে সৃষ্ট নতুন ভাষাগত নান্দনিক শব্দচয়ন বা ডিকশন তিনি তার লিমিটেড অভিজ্ঞতা এবং বদ্ধ মন নিয়া গ্রহণ করতে পারেন নাই। এইটা ছিল তার কাছে কালচারাল শকের মত। ইতিহাসে নতুন সৃষ্টিকে মানুষ কখনোই প্রথমে গ্রহণ করে নাই। একটা নতুন প্যারাডাইম তৈরি করতে যেমন একজন অন্যন্য প্রতিভা লাগে তেমনিভাবে সেইটাকে হজম করার জন্য মানুষকে নতুনভাবে তৈরি হইতে হয়। পৃথিবীর আর্ট, কালচার, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ধর্ম এবং দর্শনে এরকম উদাহরণ ভুরি ভুরি আছে। বুদ্ধদেব তার যৌবনে শিক্ষা এবং রুচিবশত আপন করে নেন ইউরোপীয় আধুনিক কবিদের- ক্ষয়িষ্ণু , রুগ্ন, এক ঘেয়ে যৌনতা নির্ভর, লক্ষ্যহীন, দায়ীত্বহীন একা নিঃসঙ্গ কাব্য রচিয়তাদের কবিতা। তার সবচেয়ে প্রিয় কবি বলা যায় বোদলেয়ার। আধুনিক বোদলেয়ারের অসুখ এবং পীড়া, নিরাশ এবং নিঃসঙ্গতা, তার ‘ক্লেদজ কুসুম’ -এই সবই তিনি ভালোবাসছেন। বিশ্বাস করছেন এবং অন্তরে ধারণ করছেন।  তাই তো তার কাছে নজরুলের সাবলাইম সাফারিং, তার ব্যাক্তি এবং সমাজ মুক্তি আন্দোলনের মহৎ অঙ্গীকার এবং তার থেইকা গড়া বিশ্ব দ্রোহকে মনে হইছে চড়া ‘সুরের’ এবং কাব্যিক নির্মাণকে মনে হইছে অপচয়!

 ৩

এই যে তিনি এইভাবে নজরুলকে বিচার করলেন তার মধ্যে দুইটা ভুল আছে। একটা হইল সাহিত্যিক ভুল আর একটা হইল বিচারিক ভুল। সাহিত্যিক ভুল হইল নজরুলের কাব্যের জিনিওলজি এবং এসথেটিকস এর ওপর অবিচার। আর্ট, কালচার বিষয়ক প্রথম নন্দনতত্ত্ব দিছিল দুই গ্রীক দার্শনিক প্লেটো এবং এরিস্টটল। প্লেটো বলছিল সব আর্টই কপি বা নকল(ইমিটেশন), অরিজিনাল বা আদর্শ কিছুর নকল। তাই সন্দেহজনক। সেই সময় হোমারের ইলিয়াড মুখে মুখে বলা হইত। হোমার অনেক গাল-গল্প ইমিটেট করছিল। তাই এইগুলিরে বিশ্বাস করার জন্য প্লেটো পাঠকদের/শ্রোতাদের মানা করছিল। কিন্তু এরিস্টটল তার পোয়েটিকস বইতে ইমিটেটেড আর্টকে ডিফেন্ড করছিল এই বইলা যে এই আর্ট মানুষকে যুগপৎ আনন্দ এবং শিক্ষা দেয়(ট্র্যাজেডি)। কিন্তু উনিশ এবং বিশ শতকে আইসা আর্ট কালচার, বিশেষ কইরা সৌন্দর্য বিচারে যে তত্ত্বটা বেশি জোড়দার হইছিল সেইটা হইল দার্শনিক ইমানুইয়েল কান্টের নিউ এসথেটিকস (নতুন নন্দনতত্ত্ব)। তার মতে কোনো শিল্পকে বিচার করতে হইলে কেবল এইটাকে ইউনিকলি বিচার করতে হবে। এর সামাজিক, নৈতিক মূল্য ধর্তব্য না। যার ফলে ‘আর্ট ফর আর্টস সেইক’ সমালোচনা যুগ  শুরু হইয়া গেল। সে মতে- মানুষের ঐতিহাসিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ব্যক্তিগত মূল্যবোধ যোগ কইরা আর্ট বিচার করা চলবে না। নজরুল ইসলামের কাব্যকে বুদ্ধদেব সেই সংকীর্ণ নন্দনতত্ত্ব থেকে বিচার করছেন। যার ফলে এর ভাষা এবং শব্দগত ডাইমেনশন, এর মনোগত এবং নৃতাত্ত্বিক শেকড় এবং সাবলাইম আর্ট হিসাবে এর উচু মানের ভাষা ও শৈলীর কথা তিনি ধরতে পারেন নাই বা পারলেও বলেন নাই। কিন্তু বিশ শতকে চালু যথাক্রমে কাঠামোবাদি এবং উত্তর কাঠামোবাদি সমালোচনায় একটা কবিতা বা লেখাকে শ্রেফ একটা কাজ না মনে কইরা একটা টেক্সট হিসাবে বিবেচনা করার দিন শুরু হয়, যেখানে লেখাটাকে একটা উন্মুক্ত রচনা ভাইবা একে বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে ব্যাখা করা হয়। এইটাকে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, ঔপনিবেশিক, উত্তর ঔপনিবেশিক মার্ক্সিস্ট, ফেমিনিস্ট ইত্যাদি তত্ত্বে্র আলোকে দেখা এবং আলোচনা করা হয়। সব চেয়ে বড় কথা এই সূত্র মোতাবেক লেখাকে একটা ভাষিক নির্মাণ মনে করা হলেও এর সাথে এর উন্মুক্ত পাঠ বিবেচনায় আনা হয়। তার ফলে লেখাটা তখন বেশ জীবন্ত হইয়া ওঠে, বেশ বহুমুখী হইয়া ওঠে।  সে হিসাবে নজরুলের অগ্নিবীনা(১৯২২), দোলনচাঁপা (১৯২৩), বিষের বাঁশি (১৯২৪), চক্রবাক (১৯২৯), সিন্ধু-হিন্দোল (১৯২৭) ইতাদি কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি পাঠ করলে আমরা বুঝতে পারব তিনি কিভাবে কবিতার নতুন ভাষা, আঙ্গিক, শিল্প-কলার সাথে ইতিহাস, ঐতিহ্য, মিথ, এবং দেশি, বিদেশি ইন্টারটেক্সচুয়ালিটির মিশ্রণ অন্তন্ত দক্ষতার সাথে ঘটাইয়া এইগুলিরে কালোত্তীর্ণ করছিলেন।  এইটা শুধুমাত্র সম্ভব একজন শক্তিশালী কবির যুগে আর একজন শক্তিশালী কবির আগমনের মাধ্যমেই। বিচারিক ভুল হইল তিনি যখন এই সমালোচনা করছেন তখন নজরুল ইসলাম অলরেডি ডেড মানে মানসিকভাবে। তার আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ ছিল না।  

 ৪

আমরা জানি পোস্টমর্ডান এবং উত্তর কাঠামোবাদি দার্শনিক মিশেল ফুকো তার ‘ডিসিপ্লিন এন্ড পানিশ’ বইতে ডমিনেন্ট ডিসকোর্সের কথা বলছেন। মানে আপনি যদি সমাজে আপনার একটা ব্যাখ্যা/ মতামত শক্তিশালীভাবে দাঁড় করাইতে পারেন, তাহলে সেইটা সমালোচিত লেখক, কাল, সভ্যতা, বিশ্বাস, আচার, ব্যবহার সম্পর্কে চুড়ান্ত মত বা বিচারের উদাহরণ হইয়া দাঁড়াবে। নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রেও তাই হইছিল। বুদ্ধদেবের করা সেই ত্রুটিপূর্ণ বিচার বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে একটা ডমিনেন্ট ডিস্কোর্স হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাইছে এবং কোনো কোনো মহলে তা আজো তাই টিইকা আছে। এই ধারার নতুন কোনো কবি আসলে তাকেও এই ডমিনেন্ট ডিস্কোর্স দিয়া বিচার করা হয় এবং হইবো।  কিন্তু আমাদের এইটাও মাইনা নিতে হবে যে শিল্প সাহিত্য সম্পর্কে বিচার এবং মূল্যায়ন চিরকালীন একই রকমের থাকে না। যুগের তালে তালে অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় জীবনের সাথে মিথস্ক্রিয়ার ফলে মানুষের মতের যেমন আদান প্রদান হয়, অদল বদল হয়, যে ঘাত প্রতিঘাত, যোগ বিয়োগ হয় এবং এইটাকে কেন্দ্র কইরা মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক বিন্যাস, সমাজ এবং সভ্যতা যেমন বদলায় তেমনিভাবে মানুষের রুচিবোধ, শিল্পবোধ তথা নন্দনতত্ত্বও বদলায়। তাই আজ নজরুলের কবিতা সাহিত্যতত্ত্বের বিভিন্ন এঙ্গেল থেইকা দেখা হইতেছে এবং যতই দিন যাইতেছে নজরুলের কাব্য-চেতনা, তার কাব্য-নৃতত্ত্ব নতুনভাবে আবিস্কার হইতেছে। এর সামাজিক এবং রাজনৈতিক উপযোগিতার সাথে সাথে এর কাব্যিক শিল্পমূল্যকেও পাঠক মাথা করে রাখছে।  আজকে বাংলাদেশের মানুষ নজরুল ইসলামের কবিতা, গান এবং গজল যেভাবে গ্রহণ করছে তা প্রমাণ করে যে নজরুল ইসলামের প্রতিভা এবং সৃষ্টি গতীশীল এবং ম্যাচিউরড(পরিণত)। তিনি ক্রমশ আত্মশিক্ষা, পরিশ্রম এবং পড়াশোনা করার মাধ্যমে যে সাহিত্যিক নর্ম এবং ভ্যালুজ আহরণ এবং তৈরি করতে পারছিলেন তা ইউরোপীয় মন মানসিকতার, বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষাকেন্দ্রীক কবি সাহিত্যিকদের কাছে ছিল অকল্পনীয়।

 ৫

বুদ্ধদেব তার ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ এবং ‘নজরুল ইসলাম’ প্রবন্ধে নজরুল বিষয়ক যে সব অভিযোগ উত্থাপন করছেন সেইগুলির মধ্যে সবচেয়ে ভ্রান্ত, অদূরদর্শী এবং একপেশে বিচার হইল- নজরুল ইসলাম সারাজীবন একই ধরণের কবিতা লিখছেন, বালকের মতো লিখছেন, তার কাব্য জগৎ আর বেশি একটা সামনে আগায় নাই- ইত্যাদি। এইটা তিনি কোন বিচারে সাব্যস্ত করলেন? আমরা যদি পৃথিবীর বড় বড় কবি সাহিত্যিকদের দিকে তাকাই তাহলে দেখব ক্ষণজন্মা, অকালে মৃত্যুবরণকারী, কবি সাহিত্যিকগণ সারাজীবন প্রায় একই সাইকি, একই ভাব এবং ভাবনার জগতে বিচরণ করছেন। তাদের  মনোজগত, ভাবনার পরিপ্রেক্ষিত একটাই, কিন্তু অভিজ্ঞতা বদলের কারণে তাদের বিষয় আশয়, শব্দ, ডিকশন, প্রকরণ শৈলী ভিন্ন হইছে। কিটস, বায়রন এবং শেলীর কাব্যভুবন তাদের জীবন কালীন একটা বলয়েই সীমাবদ্ধ ছিল। ইংলিশ রোমান্টিক কবি জন কীটসের ‘ওড টু নাইটিঙ্গল’ এবং ‘ওড টু গ্রেসিয়ান আর্ন’র মধ্যে ভাব এবং বিষয় বস্তু দিয়া তেমন একটা পার্থক্য নাই। তেমনিভাবে শেলীর ‘ওড টু দ্যা ওয়েস্টার্ন উইন্ড’ এবং ‘টু এ স্কাইলার্ক ‘ এর ভাব এবং বিষয় একই। শেকশপিয়রের মত বড় নাট্যকার  রাজা বাদশাহদের জীবন ঘটনা, উত্থান পতন নাটকায়ন করার নামে মানব মনের গভীরে লুকানো, অসুখ, অস্থিরতা, বিষন্নতা, পাগলামি, ঈর্ষা, অনুরাগ ভালোবাসা, প্রেম এবং বিশ্বাসঘতকতাকে দর্শকদের সামনে তুলে ধরছেন। তাই কিং লিয়র আর হেমেলেটের পাগলামি এবং অস্থিরতা একই। ভিন্ন নাটকে ভিন্ন বিষয় এবং চরিত্র আসছে কিন্তু ম্যাসেজ প্রায় একই।  নজরুলের সমসাময়িক কবি জীবনানন্দ দাশের কাব্যভুবন সারাজীবনই এক। তার ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ থেকে শুরু কইরা শেষ কাব্য গ্রন্থ পর্যন্ত একই ভূবনের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। একমাত্র ‘রূপসী’ বাংলা ছাড়া তার কাব্যভুবনের পটভূমি- এক নির্জন  অতীত যুগ- ইতিহাসে এক নিঃসঙ্গ, যুগ যন্ত্রণাকাতর, লিবিডো তাড়িত মানুষের মনোলগ আর কিছুই না। তাই নজরুলকে বালকসুলভ প্রতিভা বলে অপবাদ দেওয়ার পেছনে বুদ্ধেদেবের প্রচ্ছন্ন কাব্যিক অসততা এবং নজরুলকে তার নতুন কাব্যবলয় এবং কাব্যভাষাকে স্বীকৃতি না দেওয়ার শিক্ষিত, ক্ষমতাপ্রাপ্ত, বুর্জোয়া মানুষের বিচ্ছিন্নতা এবং দায়িত্বহীনতাই কাজ করছে বইলা ধারণা করা যায়।

বুদ্ধদেব বসু কবিতায় আধুনিকতার জয়গান গাইছেন। ডমিনেন্ট ডিস্কোর্সের সুবিধা নিয়া বাঙ্গালি আধুনিক কবিদেরকে প্রমোট করছেন কিন্তু চির আধুনিক কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সুইটভাবে গালমন্দ করেছেন। আমরা ইউরোপীয় আধুনিকতার স্বভাব চরিত্রটুকুর দিকে গভীরভাবে মনোনিবেশ করলে দেখতে পাবো নজরুল ইসলাম তার সময়ে সবচেয়ে বেশি আধুনিক। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ, সাম্প্রদায়িকতা এবং শ্রেণিভেদ-শাসিত পৃথিবীতে নজরুলের মতো মুক্তমনা, অসাম্প্রদায়িক, উদার, বিশ্বমানবতবাদী কবি আর একজনও ছিল না। তিনি জাতপাত, শ্রেণীভেদ, বর্ণভেদ এবং সর্বপ্রকার অন্যায় আধিপত্যের বিরুদ্ধে সোচ্চারকণ্ঠ কবি। মানুষের কল্যাণ কামনাই আধুনিকতা। আধুনিকতা যদি জীবন এবং যৌবনের প্রগতি, বিজ্ঞান মনস্কতা, দ্রোহ, নারীর মর্যাদা তথা মানুষের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কল্যাণ কামনা বোঝায় তাহলে নজরুল ইসলাম তার সময়ের সবচেয়ে বেশি আগুয়ান এবং আধুনিক কবি। সমস্যা হইল বুদ্ধদেব তার মনের মত করে ‘আর্ট ফর আর্ট সেইক’ মানব-সভ্যতা রহিত একপেশে নন্দনতত্ত্ব দিয়া নজরুলের কবিতা বিচার করতে গেছেন। সাহিত্য সমালোচনায় তখনো পোস্টমর্ডান লিটেরি নন্দনতত্ত্ব দেখার ভাগ্য বুদ্ধদেবের ছিলো না। থাকলে হয়ত তিনি দেখতে পাইতেন, নজরুলের কাব্যভাষায় কিভাবে এ্যান্টিফর্ম, ভাষিক নৈরাজ্য, বিনির্মাণ, বাসনা, বিরোধাভাস, বয়ান এবং আন্তর্বয়ান, ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি জায়গা করে আছে। কিভাবে সাব অল্টার্ন, তথা পেরিফেরিতে থাকা, উপনিবেশিক শাসনে জর্জড়িত মানুষের ভাষা নজরুলের কবিতায় তাদের কন্ঠস্বর পাইয়া গেছে। পণ্ডিত বুদ্ধদেবের প্রয়োজন ছিল নতুন নন্দনতত্ত্ব দিয়া নজরুলকে বিচার করা, তার সমালোচনা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য সেই সময় এবং মন কোনটাই তার ছিল না।       

____________________________________________________________________

 সহায়ক গ্রন্থ

১। প্রবন্ধ সংকলন, বুদ্ধদেব বসু, দেজ পাবলিশিং ১৯৯১

২। নজরুল রচনাবলী, বাংলা একাডেমী ঢাকা ১৯৯৩

৩। নির্বাচিত প্রবন্ধ, শ্বাসত বঙ্গ, কাজী আবদুল ওদুদ, স্কাই পাবলিশার্স ঢাকা ২০১২

 ৪। Discipline and Punish The birth of the prison, Michel Foucault, Second Vintage Books Edition, May 1995

৫। The complete works of Aristotle, Jonathan Barnes, Princeton University Press,1984

৬। Literary Theory, An Introduction, Terry Eagleton, Blackwell Publishers Ltd, 1996

০২/০৬/২০২৩

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on বাংলা একাডেমির মুখোস উন্মোচন
কাজী জহিরুল ইসলাম on বাংলা একাডেমি এবং আমার গ্লানি
কাজী জহিরুল ইসলাম on ‘প্রথম আলো’র বিকল্প
পথিক মোস্তফা on মানবিক কবি ফররুখ আহমদ
মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন on ক্রান্তিকাল
এ্যাডঃমনিরুল ইসলাম মনু on গুচ্ছ কবিতা : বেনজীন খান
পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা