বাংলা রিভিউ: আপনার প্রথম প্রকাশিত বই কোনটি? কবে প্রকাশিত হয়েছিল? প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি কেমন ছিল?
মুহম্মদ মতিউল্লাহ্ : আমার প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। তখন আমার বয়স ২০ বছর। সদ্য কলেজে ভরতি হয়েছি। বইটির নাম ‘অন্ন জলে ভালোবাসায়’। কবিতার বই। কলেজে পড়ার সময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত আমার কবিতা প্রকাশিত হত। সেই অনুষঙ্গে খানিকটা তারুণ্যের চাপল্যে সেই বয়সেই আমি নিজের বই প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম। আমার বাবা ছিলেন এ ব্যাপারে খুবই উৎসাহী। মূলত তাঁরই উৎসাহে কবিতার জগতে এবং প্রবন্ধের জগতে আমার আসা। বই প্রকাশের খরচ বাবাই দিয়েছিলেন। আর আমি ছাত্রজীবনে বেশ কয়েকবার স্কলারশিপ পাই। সে সময়ে পাওয়া স্কলারশিপের টাকা প্রথম বই প্রকাশে কিছুটা খরচ হয়েছিল। প্রথম বই, এখন মনে হয়, সে আমার নিজস্ব বই নয়। নানা কবির প্রভাব সে বইয়ে আছে। লেখাগুলি যেমনই হোক, কিন্তু সেই বয়সেই একটি গ্রন্থের প্রণেতা হিসেবে বন্ধু মহলে আমার বেশ খাতির জমে উঠেছিল। তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নীরা সিরিজ আমাদের আকন্ঠ মাতিয়ে রেখেছে। পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘কথোপকথন’ আমাদের হাতে হাতে ঘোরে । সে সময় বেরিয়েছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাব’। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা আমাকে আবিষ্ট করে রেখেছে। বাংলাদেশের আবদুল মান্নান সৈয়দ এর কবিতা পড়ছি ‘কাফেলা’ নামের একটি পত্রিকায়। আবদুল মান্নান সৈয়দের লেখা আমাকে ভেতরে ভেতরে একটি ঘর তৈরি করে দিচ্ছে। আমার নিজের লেখালেখির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন এই সব কবিদের আমার অধ্যয়ন। সে বই প্রকাশের পরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বইটির রিভিউ-ও প্রকাশিত হল। আবদুল আজীজ আল আমান সম্পাদিত ‘কাফেলা’ পত্রিকায় আমার বইটি নিয়ে একই সংখ্যায় দু-তিনজন লিখেছিলেন। এবং তাঁরা কেউই আমার কবিতার নিন্দা করেননি। মনে আছে কবিতার শব্দপ্রয়োগ এবং আঙ্গিক সচেতনতা নিয়ে প্রশংসা করেছিলেন। বলাবাহুল্য সে বয়সে এসব প্রশংসা শুনতে মন্দ লাগত না।
বাংলা রিভিউ: সাহিত্যে আপনি কার উত্তরাধিকার বহন করেন?
মুহম্মদ মতিউল্লাহ্ : সাহিত্যে অবিমিশ্র মৌলিক বলে কিছু হয়না।
একটি পরম্পরার ভেতর দিয়ে একজন কবি উঠে আসেন। কবিতা লেখার সময় আমি আমার বলার কথাটিই বলতে চাই। বলার কথাটি তো এই—এই পৃথিবীটা সুন্দর। বেঁচে থাকা সুন্দর। বন্ধুত্বের দিকদিগন্ত সুন্দর। অনেক না-পাওয়ার আনন্দ-বেদনাগুলি সুন্দর। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ভাষায় ‘নিয়ে গেলাম সব মাধুরী দিতে পারলাম না’। এই বিস্ময়ের ভেতরে ,অপার রহস্যময়তার ভেতরে নিজেকে দেখতে পাওয়া , দেখতে চাওয়া, একটি ঠিকানার অনুসন্ধান—এই অন্তর্জাগরণ, বিস্ময়ের জাগরণ, আনন্দ-বেদনার অশ্রুত ধ্বনি— এই আবিষ্কারেই তো কবিতা লিখতে চাওয়া। লিখতে চাওয়ার পাশাপাশি কবিতা পড়া। কবিতার পরিপার্শ্বকে চিনে নেওয়া। ছোটোবেলা থেকেই অক্ষয়কুমার বড়ালের কবিতা আমাকে টানে। রবীন্দ্রনাথ, অমিয় চক্রবর্তী, অরুণ ভট্টাচার্য, আলোক সরকার,আল মাহমুদ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, কালীকৃষ্ণ গুহ, কবিরুল ইসলাম এঁদের কবিতা পড়ে আসছি। আবহমান বাংলার লোকজ ঐতিহ্য অধ্যয়নের চেষ্টা করেছি। কোনো একক কবির নয়,বাংলা কবিতার এই আবহমান ধারা, আমার ধারণা, আমার কবিতায় প্রভাব ফেলেছে।
বাংলা রিভিউ: এ যাবৎ সর্বমোট আপনার ক’টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? এর মধ্যে কোনটি বা কোন-কোন কাজকে বা কোন বইকে আপনি আপনার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করেন?
মুহম্মদ মতিউল্লাহ্ : আমার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা (একটু দেখে নিয়ে হিসেব করে বলতে হচ্ছে) ৩০টি। ১৫টি কবিতাগ্রন্থ। এবং প্রবন্ধ ও সম্পাদনাগ্রন্থ মিলিয়ে ১৫টি। কবিতা লেখার মুহূর্তটি একটি কঠিন সময়। নিজেকে ভেঙেচুরে তছনছ করে একটি কবিতা সম্পূর্ণতা পায়। ভেতরে ভেতরে চলে অনিঃশেষ এক ক্ষরণ। ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে।’ একটি কবিতা লেখা হলে অতৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস আরও লম্বা হয়। মনে হয় যা বলতে চেয়েছিলাম তা বলা হল কই? ফলে কবিতার একটি বই প্রকাশ হলে প্রতিটি অক্ষরে জড়িয়ে থাকে আমার অতৃপ্তি আর ব্যর্থতার আনন্দ-বেদনা। তখন আলাদা করে কোনো বই প্রিয় হয়ে ওঠেনা। সব বইয়ের ভেতরেই থেকে যায় সমান যন্ত্রণা। সমান দুর্বলতা। ফলে কোনো একটি বই নিয়ে দুর্বলতা হয়তো থাকেনা। তবু যদি বলতেই হয় তাহলে আমি ‘আকাশ বলছে, না’ কাব্যগ্রন্থটির কথাই বলব।
কবিতা লেখার পাশাপাশি কবিতা পাঠেরই গরজে আমাকে অনেক সময় প্রবন্ধও লিখতে হয়। আসলে একজন শিল্পী সাহিত্যিক তার বলার গরজে এক-একটি শিল্পমাধ্যম গ্রহণ করেন। আমার বক্তব্য বিষয়টি কবিতা ধারণ করতে পারলে সে হয়ে ওঠে কবিতা। নয়তো তাকে বিষয়ের প্রয়োজনে ধারণ করতে হয় গদ্য মাধ্যম— প্রবন্ধ। আমি অবশ্য উপন্যাস বা গল্প তেমন লিখিনি। উপন্যাস তো নয়ই।
তবু ‘কবির গল্প’ হিসেবে গল্প লেখার ফরমাশ আসে সম্পাদকবন্ধুদের থেকে। সে আমন্ত্রণ নিশ্চয় লোভনীয়। অবশ্য সে ভবিষ্যতের কথা।
পড়াশোনার গরজে পুরনো ফেলে আসা সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ আমাকে খুবই টানে। যাকে বলে গবেষণাধর্মী কাজ, তার প্রতি আমার একটি নিবিড় আকর্ষণ আছে। একারণে সম্পাদনার কাজে হাত দিতে আমার ভালো লাগে। ‘অগ্রন্থিত রবীন্দ্র পত্রাবলি’, ‘বুদ্ধদেব বসুর একগুচ্ছ পত্র’,’শতভিষা সংকলন’, জীবনানন্দ দাশের ‘বাংলার ত্রস্ত নীলিমা’ এ ধরনের বেশ কিছু বই সম্পাদনা করেছি। জীবনানন্দ দাশের স্ত্রী লাবণ্য দাশকে নিয়ে অনেক সত্য- মিথ্যা গল্প চালু আছে। অনেক অভিযোগ আছে। এগুলি আমার কৌতূহল বাড়ায়। তারপর বিষয়টি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। জীবনানন্দ- লাবণ্য দাশ সম্পর্কের নানা উচ্চাবচতা নিয়ে লেখা হয়ে যায় ‘কবিপত্নী লাবণ্য দাশ’ বইটি। এবং পাঠকের কাছে সেটি খুবই গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে প্রকাশকের থেকে জানতে পারি। বইটি লিখতে পেরে আমি নিজেও খানিকটা তৃপ্তি অনুভব করি।
বাংলা রিভিউ: সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার নতুন বই সম্পর্কে বলুন।
মুহম্মদ মতিউল্লাহ্ : গত দুমাসের মধ্যে আমার তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে একটি বইয়ের তৃতীয় মুদ্রণ— ‘আপাতত হস্টেলে আছি’ নামের তন্বী একটি বই। বইটির প্রথম সংস্করণ বেরিয়েছিল ১৯৯৩ সালে। যাইহোক এটি নিয়ে কিছু বলছিনা। দ্বিতীয় যে বইটি সেটির নাম ‘প্রেমের কবিতা’। আমার সবকটি কবিতার বই থেকে সংকলন করে এ বইটি নির্মাণ করেন ‘আলোপৃথিবী’ নামের প্রকাশক। এরা এখন পরিকল্পনা-সমৃদ্ধ অনেক বই খুব শিল্পসম্মত ভাবে প্রকাশ করছেন। তাদের একটি পরিকল্পনা হল নব্বইয়ের দশকের নির্বাচিত কিছু কবির প্রেমের কবিতা তারা প্রকাশ করবেন। আমার বইটি তাদের এই সিরিজের প্রথম বই। তৃতীয় যে বইটির কথা বলছি সেটি আমার একটি সম্পাদনাগ্রন্থ। পঞ্চাশের দশকের কবি আলোক সরকার এবং মিনু সরকারের পত্রবিনিময়। আলোক সরকারের মতো একজন আত্মনিবিষ্ট কবি যাকে কখনো কোনো ব্যক্তিগত পরিসরে পাওয়া যায় না, পাঠকের কৌতূহলের শেষ নেই যাকে নিয়ে, কেননা তিনি নিজেই বলেছেন তার কবিতার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত জীবন মেলেনা। ব্যক্তিগত পরিসরে কখনও তিনি পাঠকের কাছাকাছি আসতে চাননি, তাঁর চিঠিপত্রে উদভাসিত সেই ব্যক্তিগত পরিসরেই কবিকে পাঠক খুঁজে পাবেন এই পত্রগুচ্ছে। প্রায় পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর আগের লেখা সেই পত্রগুচ্ছের উদ্ধারকাহিনিটিও কম কৌতূহল উদ্দীপক নয়। যাইহোক আমার এই তিনটি বই খুব সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলা রিভিউ: আপনি নিজেকে কোন দশকের কবি বলে মনে করেন? কেন?
মুহম্মদ মতিউল্লাহ্ : দশক বিভাজনের কথা উঠলে একটু অস্বস্তি তো হয়ই। আসলে একজন সৃষ্টিশীল কবি শুধু একটি দশকের হতে পারেনা। তিনি সব দশকেরই কবি। অন্তত যে দশক পর্যন্ত তিনি লিখে চলেছেন। ততদিন অবধি তিনি সজীব সৃষ্টিশীল জীবিত। তবু আলোচনার সুবিধের জন্য আমরা কবিদের দশক বিভাজনে আস্থা রেখে আসছি। সেই হিসেবে আমাকে নব্বইয়ের দশকের কবি বলেই ধরা হয়। যদিও আমার প্রথম বই বেরিয়েছে আশির দশকের অন্তিমে,১৯৮৭ তে। তবু আমার অধিকাংশ লেখালেখির প্রকাশ নব্বইয়ের দশকেই। সেই হিসেবে আমি নিজেও, আপনার এই প্রশ্নের উত্তরে মনে করছি, আমাকে নব্বইয়ের দশকের কবি হিসেবে ধরাটাই সঙ্গত।
বাংলা রিভিউ: আপনার সমকাল নিয়ে কিছু বলুন।
মুহম্মদ মতিউল্লাহ্ : নব্বইয়ের দশক এমন একটি সময়-পর্যায় যখন গোটা বিশ্ব জুড়েই একটি পরিবর্তনের জোয়ার এসেছে। অন্তত আশির দশকের পর এই দশকেই একটি বিশ্বজনীন উন্মুক্ততা দেখা দিয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার,কম্পিউটার ইন্টারনেটের দিগ্বলয় মানুষের জীবনের যাপনায় এবং মনোভঙ্গিতে একটি দ্রুতি এনেছে। কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চা ততদিনে অনেক বেশি মফস্ সলমুখি হয়েছে। সাহিত্যচর্চা কবিতা পত্রিকার প্রকাশ এগুলি এই সময়কালে একটি মাত্রা অর্জন করে। আমরা নব্বইয়ের কবিরাই বোধহয় শেষজন যারা ট্রেডল মেশিনে বই-পত্রপত্রিকা ছাপা দেখেছি। তারপর থেকে দ্রুত নতুন মুদ্রণ পদ্ধতির প্রসার। পত্রবিনিময় ছিল আমাদের প্রিয় একটি অনুষঙ্গ। আমি ভাগ্যবান কত খ্যাত অখ্যাত মানুষের সঙ্গে আমার চিঠিপত্র বিনিময় হয়েছে। আমি আমার প্রিয় ঐশ্বর্য ভেবে সেগুলি আজও আগলে রেখেছি। আমাদের পরের প্রজন্মের কবিরা মেসেজ ইমেইল এর কালে এসে পত্র সাহিত্যের ব্যাপারটা আর ভাবতেই পারেনা। এসবই বোধ হয় নব্বইয়ের দশকেরই উজ্জ্বল এক শেষ ঐশ্বর্য।
বাংলা রিভিউ: সাম্প্রতিক কালে কারা ভালো লিখছে বলে মনে করেন?
মুহম্মদ মতিউল্লাহ্ : কবিতা নিয়ে দুই বাংলাতেই খুব আশাব্যঞ্জক কাজ হচ্ছে। প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ কবিরা উঠে আসছেন যাদের অনেকের মধ্যেই দিগ্বলয় প্লাবিত করার মতো প্রতিভা আছে। আলাদা করে আমি আর কারো নাম বলছি না। তবে মনে রাখতে হবে ভালোবাসাময় অনুশীলন সব চেয়ে বড় কথা। ইদানিংকালে সস্তায় বাজিমাত করারও একটা প্রবণতা কবিতা লিখতে আসা তরুণদের মধ্যে প্রায় লক্ষ্য করা যায়। অনুশীলনের আগেই আত্মপ্রকাশের প্রতিযোগিতা শুরু করে দেন। এটা ইদানিং সময়ের একটি অসুস্থতাও বলা যায়। তবে আশার কথা নতুনদের অনেকেই এখনও এই প্রতিযোগিতায় গা ভাসায়নি। আত্মনিবিষ্টতা তাঁদের একাগ্র করেছে। কবিতার কলম তাদের জন্য স্বর্ণাভ অপেক্ষায় আছে।
বাংলা রিভিউ: কোথায় আছেন? কি করছেন? পারিবারিক পরিচিতি জানতে চাই।
মুহম্মদ মতিউল্লাহ্ : আমি পশ্চিমবঙ্গের কাটোয়া এবং বর্ধমান দুই শহরেই বাস করি। আমি এবং আমার স্ত্রী রত্না মুখোপাধ্যায় দুজনেই শিক্ষকতা করি।
একসময় আমারও একটি স্বপ্নের মতো গ্রামের বাড়ি ছিল। সেখানে শৈশবের কৈশোরের অনেক দিন কেটেছে। সেসময় যদিও আমি খুব পরাধীন ছিলাম…পারিবারিক কঠোর অনুশাসনে ছিলাম, তবু দিগন্তবিস্তৃত সুদূর সবুজ মাঠ ছিল আমার দূরের বন্ধু। স্বপ্নময় নীল আকাশ, চেনা-অচেনা পাখি, অজয় নদী— নদী-বাঁধের ধারে একটি নিঃসঙ্গ জামগাছ ছিল আমার বন্ধু, সেখানে কোনোদিন আমার যাওয়া হয়নি। আর ছিল একদল কিশোর । গ্রীষ্মের দুপুরে তারা আমাকে ডাকতে এসে জানালার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকত, অপেক্ষায়। একসময় ক্লান্ত হয়ে তারা ফিরে যেত। আর আমার বেরোনোর অনুমতি মিলত না। সেইসব দিন… আমার সেই গ্রামের বাড়ি হারিয়ে গেছে। ‘এখন বিচূর্ণ বসবাস নাগরিক শরণার্থী শিবিরে’।
বাবা ছিলেন স্বাস্থ্য বিভাগের আধিকারিক। ছুটি পেতেন কম। আমাদের অভিভাবক ছিলেন আমার ব্যক্তিত্বময়ী মা। বাবার আগ্রহে অনুপ্রেরণায় ছোট বেলা থেকেই
নানা পত্রপত্রিকা পড়ার এবং ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পেয়েছি। বাবার সংগ্রহে ছিল সেকালের ‘প্রবাসী’,’ভারতবর্ষ’,’সওগাত’, মোহাম্মদী’, ‘শনিবারের চিঠি, বুদ্ধদেব বসু-র ‘কবিতা’,সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘পূর্বাশা’, হুমায়ুন কবিরের ‘চতুরঙ্গ’, আবদুল আজীজ আল আমান সম্পাদিত
‘কাফেলা’-র মতো পত্রিকা। খুব ছেলেবেলা থেকেই এসব পত্রপত্রিকার সঙ্গে আমি পরিচিত ছিলাম। কবিতা লিখে বাবাকে, কখনও বড়দি-কে দেখাতাম। বাবা উৎসাহিত করতেন। বাবা ছিলেন প্রবন্ধজগতের মানুষ। তেরো-চোদ্দটি ভাষা জানতেন। এসব ভাষা সাহিত্য থেকে অনেক অনুবাদের কাজ করেছেন। আমি বাবার প্রত্যক্ষ সাহায্য নিয়ে সাঁওতালি কবিতার অনুবাদ করেছি একসময়। ছাত্রজীবনে ইংরেজি পাঠ্য কবিতার অনুবাদ করে বাবাকে দেখাতাম। খুব খুশি হতেন। ক্লাশ পরীক্ষায় বরাবর ফার্স্ট হয়ে এসেছি। সে সময় বাবা অনেক বই উপহার দিতেন। বড়বড় করে গোটা হরফে নাম লিখে দিতেন। এইসব নিয়ে আমরা খুব আনন্দে থাকতাম। এখন বাবা-মা নেই। আমার ছেলে সৌম্যদীপ বড় হচ্ছে। ও এখন ইংলিশ-এ এমএ করছে। এই হল মোটামুটি আমার পারিবারিক জীবনযাপন।
বাংলা রিভিউ: আপনি কি কখনো বাংলাদেশে এসেছেন? আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাচ্ছি।
মুহম্মদ মতিউল্লাহ্ : বাংলাদেশ আমার আজও যাওয়া হয়নি। তবে বাংলাদেশ নিয়ে আমার আগ্রহের শেষ নেই। ’ওপারে যে বাংলাদেশ এপারে সে বাংলা।’ আমি একটি বাংলাদেশ মনেমনে লালন করি, সে বাংলাদেশে ঢাকা শহরে বসে রাণু সোম (প্রতিভা বসু)কে গান শেখাচ্ছেন নজরুল। কিংবা সেখানে আছে বুদ্ধদেব বসু-র পুরানো পল্টন। কাজি আবদুল ওদুদের ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে’র পটভূমি। মিস ফজিলাতুন্নেসার কাছে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত নজরুলের কাছে সান্ত্বনার চিঠি পাঠাচ্ছেন কাজী মোতাহার হোসেন…….. । বাংলাদেশ মানে আমার কাছে জীবনানন্দ দাশের বরিশাল। বাংলাদেশ মানে জসীমউদ্দীনের লোকজসাহিত্যের মায়ামেদুর উড়াল… আবুল ফজলের মানবতন্ত্রী বাংলাদেশ। বাংলাদেশ মানে হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্যে স্মৃতিকথনে উদভাসিত পশ্চিমবঙ্গের কথা… এইসব। অবশ্য বর্তমান বাংলাদেশ পরিবর্তনশীল উন্নয়নমুখি এক নাগরিক স্বপ্নের নাম হতে চায় যেন।
বাংলা রিভিউ: বাংলাদেশের সাহিত্য পড়েন? আপনার প্রিয় বা পছন্দের বাংলাদশী সাহিত্যিক কে-কে বা কারা? কেন?
মুহম্মদ মতিউল্লাহ্ : বাংলাদেশের সাহিত্য খুব ছেলেবেলা থেকেই আমি পড়ি। অবশ্য এটা জানবেন পশ্চিম বঙ্গের বইপত্র যত সহজে বাংলাদেশে পাওয়া যায় এখানে তত সহজে বাংলাদেশের বই পাওয়া যায় না। ফলে বইপত্র পাওয়ার একটা সমস্যা থেকেই যায়। তবু এখন সে পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগে বাংলাদেশের বই কলকাতায় পেতাম ‘পুঁথিপত্র’ কিংবা ‘নয়াউদ্যোগ এর ব্যবস্থাপনায়। এখন অবশ্য বাংলাদেশের বই পাওয়ার অনেক মাধ্যম হয়েছে।
বাংলাদেশের লেখক কবিদের মধ্যে ’আল মাহমুদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ,শহীদ কাদরী, আমার প্রিয় কবি। হাসান আজিজুল হক, শামসুল হক এদের গদ্য আমার ভালো লাগে। সাম্প্রতিক তরুণকবিদের কবিতা মনোযোগ দিয়ে পড়ি। অবশ্যই।
বাংলা রিভিউ: বাংলাদেশ এবং ভারতীয় বাংলা সাহিত্যের মিল ও তফাৎ — কোথায়? কি-কি?
মুহম্মদ মতিউল্লাহ্ : একই বাংলাভাষার সাহিত্য দুই বাংলায়। বাংলাদেশ তো খুব অল্প সময়ের মধ্যে তার সাহিত্য সংস্কৃতি এবং ভাষাকে নিয়ে আবেগঘন অগ্রবর্তিতা দেখাতে পেরেছে। অবশ্য দুবাংলার বাংলাভাষা সাহিত্যে কিছু পার্থক্য থেকেও গেছে। বাংলাদেশের সাহিত্যের ভাষা এবং পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা ভাষা হয়তো নিবিড় পর্যবেক্ষনে এক নয়।
বাংলাদেশের সাহিত্য— কথাসাহিত্য মাটির কাছাকাছি। কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা অনেকাংশে নগরকেন্দ্রিক। বাংলাদেশের অন্তরাত্মায় যে লোকজ বাংলা প্রোথিত সে অনেক বেশি শিকড় অভিলাষী। বাংলাদেশের সাহিত্যের যে ভাষা সেখানে মুসলিম জনজীবনের দৈনন্দিনতার শব্দাবলি সজীব হয়ে সহজ ব্যবহার্য হয়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষা যা সহজ করতে পারেনি। সেখানে মুসলিম জনজীবনের প্রচ্ছায়া ভাবনাগতভাবে এবং ভাষাগতভাবে সুদূর। চল্লিশের দশকে মৃত্যুর কিছু আগে রবীন্দ্রনাথ আবুল ফজলকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, চাঁদের একপৃষ্ঠায় আলোক না পড়লে সে আমাদের অগোচরে থেকে যায়, তেমনি বাংলা সাহিত্যে আমাদের সমাজজীবনের একাংশের ছবি যদি না ফুটে ওঠে সেও দুর্ভাগ্যক্রমে থেকে যাবে আমাদের অগোচরে। রবীন্দ্রনাথ আশা ব্যক্ত করেছিলেন আবুল ফজলের মতো
কথাসাহিত্যিকদের হাতে সে অভাব একদিন পুরন হবে। আজ বাংলাদেশের সাহিত্য সে অভাব পুরন করেছে। এই দিক থেকে তার ভাষারও একটি নতুন প্রবণতা তৈরি করেছে পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা ভাষা থেকে তার প্রাণস্পন্দন একটু পৃথকই। তৎসমতার প্রবণতা অনেকাংশেই তার কম। ভাষা তাত্ত্বিকেরা আরও ভালো বলতে পারবেন। বাকিটা তো সবটুকুই মিল, সবটুকুই সম্মিলন। এই ভাষাতেই ‘গেয়ে গান নাচে বাউল গান গেয়ে ধান কাটে চাষা’।
বাংলা রিভিউ: এই দুই দেশের সাহিত্যিক মেলবন্ধন উন্নয়নে কোন-কোন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনার মনে হয়?
মুহম্মদ মতিউল্লাহ্ : দুই বাংলার সাহিত্যিক মেলবন্ধনে দুদেশেই অনেক কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়ে আসছে। বাংলাদেশের কবিরা পশ্চিমবঙ্গে আমন্ত্রিত হচ্ছেন তেমনি পশ্চিমবঙ্গের কবিরাও যাচ্ছেন বাংলাদেশ। কলকাতায় তো এখন বাংলাদেশের বইমেলা সারা বছরে অনেকবারই হয়ে থাকে তেমনি বাংলাদেশেও দেখি একুশের বইমেলায় পশ্চিমবঙ্গের কবিদের আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন সাহিত্য গোষ্ঠী পত্রিকা পারস্পরিক দুদেশের কবিদের লেখা প্রকাশ করে আসছে এগুলি শুভ লক্ষণ। কার্যকরী পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপ দিনেদিনে আরো বাড়ছে। দু’দেশের কবিদের মত বিনিময় সেমিনার পর্যালোচনা সেগুলিও চলছে। পশ্চিমবঙ্গের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের সাহিত্য আলাদাভাবে পড়ানো হয়। আমি জানিনা বাংলাদেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন পদক্ষেপ চালু আছে কিনা।
বাংলা রিভিউ: আপনি কখনো কি কোন পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন অথবা সংকলন সম্পাদনা করেছেন? বিস্তারিত বলুন।
মুহম্মদ মতিউল্লাহ্ : আমি নয়ের দশকে ‘ঋতু’ নামের একটি কবিতাপত্রিকা সম্পাদনা করেছি। অনিয়মিতভাবে হলেও বেরিয়েছে দীর্ঘদিন। ট্যাবলয়েড আকারে। নব্বইয়ের দশকের তরুণ কবিরা অধিকাংশ জন সে কাগজে লিখেছেন। নব্বইয়ের কবিদের কাগজ হিসেবে উল্লেখ থাকলেও প্রবীন কবিদের, প্রতিষ্ঠিত কবিদের কবিতাও আমরা সসম্মানে ছেপেছি। আবহমান বাংলা কবিতার কাগজ হিসেবেই সে পত্রিকা সব ধরনের কবিতাকে গুরুত্ব দিয়েছিল।
‘ঋতু’ প্রকাশিত হয়েছে সম্পাদকের ব্যক্তিগত উদ্যোগে। কোনো বিজ্ঞাপনের বদান্যতা তার ছিল না। ছিলনা কোনো সাংগঠনিক বিলিবণ্টন ব্যবস্থা। খুবই নিঃসঙ্গ ছিল তার যাত্রাপথ। আলোক সরকারকে নিয়ে একটি বিশেষসংখ্যা বেরিয়ে ছিল। আর একটি বিশেষ সংখ্যা হয়েছিল কবিতার নির্মাণের উপর। আগামীতে ‘ঋতু’ হয়তো আবার বেরুবে এই স্বপ্ন দেখে চলেছি।
বাংলা রিভিউ: লিটল ম্যাগাজিন এর সংজ্ঞা কি? এ নিয়ে আপনার ভাবনা বলুন।
মুহম্মদ মতিউল্লাহ্ : লিটল ম্যাগাজিন একটি স্বপ্ন-অভিযানের নাম। প্রতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক পত্রিকার স্থিতাবস্থার বাইরে দাঁড়িয়ে লিটল ম্যাগাজিন সবসময় একটি এক্সপেরিমেন্টাল পরিকল্পনার রূপায়ন চায়। প্রচলিত ভাবনার বাইরে বেরিয়ে একটি আদর্শকে সামনে রেখে তার অগ্রযাত্রা হবে সুদূরাভিসারী। এর জন্য অনেক প্রতিকূলতার সঙ্গে তাকে লড়াই করতে হয়। ইদানিং কালে অবশ্য অনেক ছদ্ম লিটলম্যাগাজিন প্রকৃত লিটলম্যাগাজিনের মধ্যে থেকে একটি তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে, দেখছি। কলেবরে ঢাউস এইসব কাগজ বাণিজ্যিক কাগজের সব প্রবণতার অনুসারী থেকেও নিজেদের লিটল ম্যাগাজিন বলছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে লিটল ম্যাগাজিন নাম নিয়েও বাণিজ্য করা যায়!
বাংলা রিভিউ: অনলাইন ম্যাগাজিন বা ওয়েব ম্যাগাজিন চর্চাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
মুহম্মদ মতিউল্লাহ্ : অনলাইন ম্যাগাজিন বা ওয়েব ম্যাগাজিন তো সময়ের দাবি। প্রযুক্তির উন্নতির ফলে এই সুযোগ হাতে এসেছে এখন। তাকে স্বাগত জানাতেই হবে। তবে আমি এখনো বই ছুঁয়ে পড়তেই ভালোবাসি। তেমনি প্রিন্ট ম্যাগাজিনে লিখতে এখনও বেশি ভালো লাগে। এটা আমার সময়ের সঙ্গে নিজেকে প্রস্তুত করে তুলতে না পারার অক্ষমতা হয়তো। আগামীদিনে ওয়েব ম্যাগাজিন একটি বড় ভূমিকা নেবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলা রিভিউ: আগামী দিনের সাহিত্য কেমন হবে? আপনার কল্পনায়।
মুহম্মদ মতিউল্লাহ্ : সাহিত্য প্রকাশের মাধ্যম হবে ইবুক, ওয়েব ম্যাগাজিন — বোঝাই যায়। আগামী দিনের তরুণেরা আরো বেশি সময় সচেতন সাহিত্যের, কবিতার জন্ম দেবে সন্দেহ নেই। কবিতার ক্ষেত্রে আমি লিরিক কবিতার পক্ষে। সেই সংখ্যাটি ক্রমশ কমে আসছে। এবং লিরিক কবিতা নিন্দিত হচ্ছে, দেখতে পাই। সময়ের সংকটে কবিতা হয়ে উঠছে anti poetry. হয়তো আগামীদিনে এমন কবিতাই লেখা হবে। সমাজমনস্ক স্বল্পকালিকতার কবিতা লেখা হবে। তবু মনে করি কবিতা শেষ পর্যন্ত একটি বিশেষ সুরের এবং চিরকালের বাণী বহন করে। এই চিরকালীনতার পথে লিরিক কবিতা কোনোদিন হারিয়ে যাবে না।
গ্রহণে সাজ্জাদ বিপ্লব
ডিসেম্বর ০৭, ২০২৩