১.
ট্যানারি
আলোঝলমলে উড়ালসড়কে ট্রাকটি পৌঁছে গেলো
উপরে উঠতেই লালকালো রক্তজল ছলাৎ করে রাস্তায় এসে পড়লো
সব পথচারী ভেবেছিলো—অবশ্য ভাবারই কথা—
ভেবেছিলো ট্যানারির কাভার্ড ভ্যানভর্তি পশু-চামড়ার স্তূপ
তবে চতুর সাংবাদিকেরা লক্ষ্য করে দেখলেন এগুলো কোনও পশুর নয়—
মানুষের ত্বক—বৃক্ষের বাকলের মতো তুলে ফেলা হয়েছে শরীরের ছাল।
মানুষের চামড়ার দাম ততো নয়
বেশ সুলভে পাওয়া যায়—আধুনিক এই বিশ্বের যত্রতত্র।
প্রশান্তের পার থেকে মানব জুয়ারিরা ছড়িয়ে পড়ছে আফ্রিকা মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার মরুভূমিতে—স্বাধীনচেতা নগরগুলোতে
গড়ে তুলছে স্যাটানিক ঘাঁটি, আর সুরক্ষিত ঘাঁটির ছায়ায় আধুনিক মানব ট্যানারি।
২.
নার্সিসাস
এই যে বিশাল প্রতিকৃতি দেখছ এটি আমার
আমার শৌর্যের—বীর্যের
ওই দূরের প্রতিকৃতিটাও আমার
যে লেকটি এ শহরটিকে দুভাগ করেছে সেই লেকটি আমার নামেই প্রতিদিন প্রবাহিত হয়
দেখেছ তো রাস্তাটা পুরোটা ফাঁকা—
এভাবেই সব ফাঁকা হয়ে যায়
এ রাজ্যে যত ফুল ফোটে তা আমারই অপরুপ সৌন্দর্য
বিলবোর্ডগুলোতে আমার অগণিত প্রতিকৃতি শোভা পাচ্ছে। রাতের আলোকসজ্জাগুলো আমার মহান কীর্তি সবাইকে স্মরণ করে দেয়
টিভি চ্যানেলগুলোতে আমার মহান গুণের কীর্তন চলে—চলতে থাকে অবিরাম
প্রিন্ট মিডিয়ায় আমিই একচ্ছত্র অধিপতি
আমার আড়াই লক্ষ আবক্ষ মূর্তি শোভা পাচ্ছে প্রতিটি কর্মস্থলে- সড়কদ্বীপে
আমার ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড প্রতিটি বৃক্ষের গোড়ায়
নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে থাকো আমারই স্বরুপ দেখবে দুপাশে
যেখানে কোনো দ্বিমত নেই
ভিন্ন কোনো অভিলাষ নেই।
৩.
অন্ধ রাষ্ট্র
আমার লাশটি ভাগাড়ের ডানপার্শে পড়েছিলো। অত্যন্ত অযত্নে পড়েছিল দীর্ঘক্ষণ। সকালে কে একজন গাড়ীর জানালা খুলে একটি ময়লার ব্যাগ ছুড়ে মারলে সেটি আমার শরীরে ধাক্কা খায়
আমি অনুভব করি—ঠিক অনুভব করি হতভাগা কোনো নবজাতকের বস্তামোড়া লাশ।
আর, আমি কুঁকড়ে পড়ে থাকি। আমার শরীর হিম হতে থাকে।
এই অশান্তির করোনাকালেও আমি খুন হতে পারি!
আমার পকেটে বড়জোর ৩৫ হাজার টাকা ছিলো
হ্যাঁ, মাত্র ৩৫ হাজারের লোভেই আমাকে বাসা থেকে ডেকে নেয়া হলো
চায়ের সাথে মিশিয়ে দেয়া হলো ঘুমের ঔষধ
তারা জানতো আমি দুধ চা ভালোবাসি
আমার কাছে তা ছিলো অমৃত
আমি একবারও বুঝতে পারিনি। আহা আমি কতো মনভরেই না খাচ্ছিলাম আর অমৃত চায়ের প্রশংসা করছিলাম। আমার গলায় তার পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করা হয়েছিল
আমার কষ্ট হচ্ছিল তবে
আমি নিজেকে বাঁচানোর কোনো চেষ্টা করিনি
আমি, শুধু লজ্জিত হয়েছিলাম
আমরা কীভাবে ধীরেধীরে—ধীরেধীরে একটি চক্ষুষ্মান রাষ্ট্র থেকে একটি বোধশূন্য অন্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হলাম!
৪.
আয়না
নতুন রাজার অভিষেক
বিশাল জনতা জড়ো হলো সময় চত্বরে
সকলেই বেশভূষায় পরিচ্ছন্ন, স্মার্ট
সুন্দর মুখশ্রী, পরিপাটি চুল
রাজা বললেন আমার তরফ থেকে ছোট্ট উপহার আছে
সকলের জন্য
এই বলে রাজা প্রতি নাগরিককে সুদৃশ্য মোড়কে একটি করে ঘূর্ণমান আয়না উপহার দিলেন
যে আয়নার একপাশে দেখা যায় মুখাবয়ব অপরপাশে হৃদয়ের সাদাকালো চিত্র
রাজা শুধু সাদা হৃদয়ের মানুষগুলোকে পরদিন আসতে বললেন
একই চত্বরে একই সময়ে
রাজা বেদিতে দাঁড়িয়ে আছেন
অপেক্ষা করছেন পরিপাটি জনতার
সময় পেরিয়ে গেলো
অথচ সুবিশাল সময় চত্বরে কাউকে দেখা গেলো না।
৫.
কোন মানুষ ছিলো না
প্রকৃতি ও প্রাণীকুলের মতো পাখিরাও খোলে গ্রিনবুক অ্যাকাউন্ট
পাখিদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টে সম্মতি দেয় নদী, ঝর্ণা, পাহাড়, জ্যোৎস্না
সম্মতি দেয় ফুল, ফল, বৃক্ষ
বাঘ, হরিণ, জিরাফ, ময়ূর
বন্ধুত্বের ঘ্রাণ ছড়াতে ছড়াতে নিখিল তরঙ্গে এক বিশাল সবুজ কমিউনিটির পর্দা দুলে ওঠে
প্রশান্তের ঢেউ তোলা এই সামাজিক বলয়ে নিজেকে যুক্ত করার প্রচন্ড ইচ্ছে জাগে মানুষেরও
পাখিদের অনুরোধের অপেক্ষা করে সে
তবে না আসে কোন অনুরোধ না আসে কোন আমন্ত্রণের বার্তা
আশায় থেকে থেকে হতাশ মানুষ অবশেষে নিজেই বন্ধু আবদার পাঠায় পাখিদের কাছে
পাখিরা নোটিফিকেশন পাবার সাথে সাথে তা ডিলিট করে দেয়
একে একে প্রকৃতি ও প্রাণীকুলের সকলেই মানুষের পাঠানো রিকোয়েস্ট প্রত্যাখ্যান করতে থাকে
ডিলিট হতে হতে মর্মাহত মানুষ কুকুর প্রজাতির দ্বারস্থ হয়
এই সমাজটির উপর কিছুটা আস্থা তার
এই প্রজাতির অনেক স্বভাব সে ইতিমধ্যেই আত্মস্থ করেছে
চিন্তামগ্ন কুকুর প্রজাতি গোপনীয় সভা করে
সর্বসস্মত সিদ্ধান্ত নেয়
অতঃপর গুরুর আবদার খারিজ করে দেয়
নির্বাক মানুষ বসে থাকে
মাথা নিচু করে বসে থাকে
নোটিফিকেশনের শব্দে সম্বিত ফিরে পায়
এক দুরন্ত টিনেজার বানর সদ্যতোলা তার এক ভেংচি দেয়া সেলফি মানুষের ইনবক্সে পোস্ট করে
মানুষেরা দীর্ঘ শোক র্যালী করে
তবে মানুষের শোক র্যালীতে কোন মানুষ ছিলো না।
৬.
হৃদয়
আমি গ্রামটিতে প্রবেশ করলাম
মলিন চেহারার মানুষগুলো ভাঙা হৃদয় হাতে নিয়ে
বসে আছে ধূসর মাটিতে
হৃদয়ের পিঠে অগণিত কাটা দাগ
আমি শীতলক্ষ্যার ইতিহাসের মতো দাগগুলো
দ্রুত মুছে ফেলতে চেষ্টা করলাম
প্রতিবারই ব্যর্থ হলাম
অবশেষে উপলব্ধি করলাম
নদীর ইতিহাসের মতো হৃদয়ের কাটা দাগও
মুছে ফেলা যায় না
ভাঙা হৃদয় জোড়া লাগাতে প্রয়োজন
আরেকটি অকৃত্রিম হৃদয়।
৭.
ঈগলবালক
উর্বরা দেহ জুড়ে বেড়ে উঠেছে আয়েশি পালক
ন্যুব্জ ঈগলের পুরুষ্টু পালকের মতো কৃষ্ণ স্ফীত
পাহাড়ের চূড়ায় বসে একাকী নিমগ্ন আমি
ক্রিস্টাল বাতাসের ঘ্রাণ—মেশক সুরভিত
নাতিদীর্ঘ ভোগজীবনে নয় নির্বোধ মড়ক
আমি বেছে নেই চিরসবুজ কালের সড়ক।
একে একে উপড়িয়ে ফেলি দাঁতাল পালকের শিকড়
ধারাল পাথরে ছিন্ন করি অহংকারী চঞ্চুর ফলা
গভীর জলে ডুবে যেতে দেখি নিজ ভাস্কর্য খোদাই পাথর
বিলাসী স্বপ্ন সাজানো বিত্ত পিরামিড শিল্পকলা
আমার বরফদৃষ্টি ত্বকহীন রক্তাক্ত ধর
ধমনী থেকে নেমে আসে বিষের নহর।
বালিয়াড়িতে পড়ে আছে হৃদয়ের বর্বরতা সব
নতুন পালকে আবৃত রুপান্তরিত সোনালী ত্বক
মেশকসমুদ্রে স্নান শেষে নব সূর্যের সূচনায়
পুনর্জন্ম নেই আমি এক দুরন্ত ঈগলবালক।
৮.
চন্দ্রবালিকা
কুয়াশার শাল গায়ে বিবসনা রাত
মেঘ সিঁড়ি ভেঙে নামে শীতের প্রপাত
লেকপাড়ে চুল ঝাঁকে দেবদারু গাছ
নীল শাদা ক্যানভাসে জ্বলে তারা মাছ।
বালিকার এক হাতে মাছ ধরা জাল
আর হাতে ধরে আছে আকাশের ডাল
দলছুট মেঘ এসে ঘিরে ধরে তাকে
কমনীয় তনু জুড়ে আলপনা আঁকে।
চাঁদের কোমর ছুঁয়ে রাখে আবদার
মন চিরে দেখো তুমি কষ্ট—আমার
বোঝে না বোঝে না কেউ মানসিক ব্যথা
বেদনা পাহাড় হয় জমে নিরবতা।
চাঁদের বালিকা খোঁজে শিশিরের নাও
ভিজে ভিজে চলে যায় ভিনদেশী গাঁও।
৯.
জ্যোৎস্না
জ্যোৎস্না রাতে ঘুম ভেঙে গেলে
দেখি কবিতার শরীরে জ্যোৎস্না লেপ্টে আছে
আমি বিছানা ছেড়ে নদীর ধারে আসি
নদীর জলে মিশে যায় অজস্র জ্যোৎস্নাকণা
রাত্রি গভীর হলে জ্যোৎস্না দুই ভাগ হয়ে
পৃথিবীতে নামে
এক ভাগ প্রবেশ করে নদীর শরীরে
অপর ভাগ শুষে নেয় নারীর দেহ
প্রেমিক পুরুষেরা জ্যোৎস্নার ঠোঁটে ঠোঁট রাখে
কবিরা কলমে ভরে নেয় নদীর জ্যোৎস্নাজল
পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই এভাবে
জ্যোৎস্না দুই ভাগ হয়ে যায়
দুই ভাগ হয়ে পড়ে রাত্রি গভীর হলে
নদী ও নারীর জলজ দেহে মিশে যায়।
১০.
চন্দ্রাবতী
নতুন কর্মস্থলে কাজ শেষ ক’রে চন্দ্রাবতী
হেঁটে যেতে থাকে তার নতুন আবাসের দিকে
এদিকটায় আঁধার কিছুটা বেশি
একপাশে শ্মশান অপরপাশে জীর্ণ কবর
রাস্তায় ছড়ানো ছিটানো মৃতের চোয়াল
চন্দ্রাবতী ভয়ে ভয়ে হাঁটে। তার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে
কে যেন ফেলে রেখে গিয়েছে বালিকার রক্তস্নাত লাশ গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে রক্তজল গড়িয়ে পড়ছে
চন্দ্রাবতী রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতে থাকে…
অবশেষে প্রতিক্ষিত আলোর দেখা পায়
মানুষের কন্ঠস্বরে নিমিষেই দূর হয়ে যায়
যত ভয় যত দুঃস্বপ্ন
চন্দ্রাবতী বন্দী হয়ে পড়ে আলোর মাঝে
চারদেয়ালের মাঝে
চারদিকে পেশীবহুল জোড়া জোড়া বাহু
চারদিকে কামাখ্যা ভয়ংকর চোখ…
চন্দ্রাবতীর দেহ পড়ে থাকে নির্জন পথের পর
যে পথে কোনো আলো নেই, জ্যোৎস্না নেই
চন্দ্রাবতী উঠে দাঁড়ায়
ধীরেধীরে হেঁটে যেতে থাকে গভীর আঁধারের দিকে
তার একটাই ভয়, যদি কোনো আলো দেখা যায়
আবার যদি মানুষের কন্ঠস্বর শোনা যায়।
…..
সামুয়েল মল্লিক। জন্ম ১০ নভেম্বর ৬৮ জয়পুরহাট। ধানমন্ডি গভঃ বয়েজ হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি আইইবি, বিএসটিকিউএম ও বিএসএইচআরএম-এর ফেলো মেম্বার। বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অপারেশন্স প্রধান। ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্যের পলিমাটিতে বিচরণ। প্রথম কবিতা ‘কর্পূর শুদ্ধি’ প্রকাশিত হয় এপ্রিল ১৯৯৩ সালে কবি আল মাহমুদ সম্পাদিত পাক্ষিক পালাবদল-এ। শখ ট্রাভেলিং ও কবিতাপাঠ। ভালোবাসা সত্য, সুন্দর ও সততায়। ভালোবাসা দেশ, প্রকৃতি ও মানুষে। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ৬ টি। শিশির ভেজা ভোরের চুম্বন (২০০৬), আধুনিকতা ছুঁয়ে যায় উন্মুক্ত ঊরুদেশ (২০০৮), বদলে যাও বদলে দাও (২০০৯), আমার একটি দুর্ভিক্ষ চাই (২০১৯), বিষন্ন গোলাপের উদ্ধৃতি (২০২০), জলকবিতার তীরে (২০২১)। প্রকাশিত টেকনিক্যাল গ্রন্থ ১০টি। তিনি সাহিত্য ম্যাগাজিন ‘সকালপত্র’-এর সম্পাদক।