মুহম্মদ মতিউল্লাহ্
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সমীপবর্তী সময়ে নানা দোটানোর মধ্যেও শেষ পর্যন্ত জীবনানন্দ বরিশালের পাট চুকিয়ে স্থায়ীভাবে কলকাতায় উঠে এলেন। ইতিপূর্বে কখনও কলকাতায় কখনো বরিশালের যে জীবন— তার এবার সমাপ্তি ঘটল। স্থায়ীভাবে বাসিন্দা হয়ে উঠলেন ভাই অশোকানন্দ দাশের ঠিকানা, ল্যান্সডাউন রোডের বাসায়। পিছনে ফেলে এলেন বরিশালের বিএম কলেজের অধ্যাপনার চাকরি। ছুটি নিয়ে এসেছিলেন কলেজ থেকে। পরে আরও ছুটি বাড়ানোর আবেদন জানিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত জুন মাসে পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দিলেন এবং নানা অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে গেলেন কলকাতায়। ইতিমধ্যে জীবনানন্দের আত্মীয়স্বজনরাও একেএকে বরিশাল ছেড়ে চলে এসেছেন কলকাতায়।
সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও সত্যপ্রসন্ন দত্তের মধ্যস্থতায় এবং তাঁদের আন্তরিক চেষ্টায় জীবনানন্দের একটি চাকরির ব্যবস্থাও হল। ১৯৪৭ সালে ২৬ জানুয়ারি কলকাতার ক্রিক রো থেকে
হুমায়ুন কবির প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্বরাজ’ নামের একটি দৈনিক পত্রিকা। জীবনানন্দ এই পত্রিকার রবিবাসরীয় বিভাগের সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হলেন। কিন্তু সে কাজ স্থায়ী হলনা তাঁর পক্ষে। কয়েক মাসের মধ্যেই ছেড়ে দিলেন সংবাদপত্রের চাকরি। আসলে জীবনানন্দের মানসিক গঠন সংবাদপত্রের কাজের উপযুক্ত ছিলনা, বলাই বাহুল্য। অবশ্য ‘স্বরাজ’ এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়।
যখন বরিশালে বাস করতেন, প্রতিমুহূর্তে জীবনানন্দের মনে হয়েছে জীবনের ঢের কাজের সময়ে, কলকাতা থেকে দূরে বাস করা উচিত নয়। কর্ম সংস্থানের উপযুক্ত ক্ষেত্র হল কলকাতা। বুদ্ধদেব বসুকে একদা চিঠিতে লিখেছিলেন জীবনানন্দ, ‘ কলকাতার অলিগলি মানুষের শ্বাস রোধ করে বটে, কিন্তু কলকাতার ব্যবহারিক জীবনে একটা প্রান্তরের মত মুক্তি পাওয়া যায়, এখন যখন জীবনে কর্মবহুলতার ঢের প্রয়োজন, কলকাতার এই স্বচ্ছন্দ পটভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা চলে না।’ কলকাতায় এসে উঠেছেন তিনি ভাইয়ের বাসায়, ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডের দোতলায়। অল্পকিছুদিনের মধ্যে ভাই অশোকানন্দ দিল্লি বদলি হয়ে যান। সেসময় বাড়ির মালিক অশোকানন্দের বিরুদ্ধে উচ্ছেদের মামলা করেন এবং শেষ পর্যন্ত মামলার নিষ্পত্তি হয়না। মামলা কিছুদিন চলার পর অবশেষে বাড়িঅলার সঙ্গে একটি আপোষ মীমাংসা হয়। এবং জীবনানন্দ দাশকে নিচের দক্ষিণ দিকের বারান্দা সহ চারটি ঘর ভাড়ায় দেওয়া হয়। জীবনানন্দের পক্ষে সে বাড়ি তৃপ্তির হয়ে ওঠে । অশোকানন্দ উঠে যান ১৭২/৩ রাসবিহারী এভিনিউ-এ, তাঁর শ্বশুরালয়ে।
১৯৪৮ এ ২৫শে ডিসেম্বর ভাইয়ের বাড়িতে মা কুসুমকুমারী দাসের মৃত্যু হয়। সংসারিক অসচ্ছলতায় জীবনানন্দ তখন আরো বিচলিত। ১৯৩৫ থেকে ৪৭ সাল পর্যন্ত জীবনানন্দ টানা কাজ করেছেন বরিশাল কলেজে। কলকাতায় এসে তিনি আবার বেকার। আর্থিক অসাচ্ছন্দ্য তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে গ্রাস করেছে। ১৯৫০ এর
২ সেপ্টেম্বর জীবনানন্দ সদ্য প্রতিষ্ঠিত খড়গপুর কলেজে অধ্যাপনার পদে যোগ দেবেন। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে তিনি আবেদন করেছিলেন। দেখা যায় কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিমাংশু সরকার বরিশালের লোক। তিনি নিজে কলকাতায় এসে জীবনানন্দকে কাজে যোগ দিতে রাজি করান। থাকা খাওয়ার খরচসহ নামমাত্র বেতনে সেখানে পড়াতে হতো জীবনানন্দকে। কাজের দিনগুলিতে খড়্গপুরে থাকছেন তখন। কন্যা মঞ্জুশ্রী তমলুকে বোন সুচরিতা দাসের তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করছেন। আর কলকাতায় থাকছেন স্ত্রী লাবণ্য দাশ আর পুত্র সমরানন্দ।
এই সময়ে তার স্ত্রী লাবণ্য দাশ খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। লাবণ্যর অসুস্থতায় উদ্বিগ্ন জীবনানন্দ ১৯৫১ সালে জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে খড়গপুর কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে কলকাতা ফিরে আসেন। লাবণ্য দাশ এই ছুটির মধ্যে সুস্থ হতে পারেননি। পুনরায় খড়গপুর কলেজে ছুটি বাড়ানোর আবেদন জানান জীবনানন্দ। কিন্তু এবারে আর কলেজ কর্তৃপক্ষ ছুটি মঞ্জুর করেননি। ১৯৫১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জীবনানন্দ খড়গপুর কলেজ থেকে বরখাস্ত হলেন। এমনকি সে কলেজ থেকে তাঁর প্রাপ্য বেতনও পুরোপুরি পেলেন না। জানা যায় ছাত্র সংখ্যা কমে যাওয়ায় কলেজের আর্থিক সংকটে জীবনানন্দের পদটি বাতিল করা হয়। এই সময় ঘোরতর আর্থিক সংকটে আছেন জীবনানন্দ। মাঝে কিছুদিন লিভ ভেকেন্সিতে বড়িষা কলেজে অধ্যাপনা করলেন তারপর আবার বেকার। ততদিনে নানা মানসিক অস্থিরতায় পীড়িত। ডায়াবেটি কি আক্রান্ত হয়েছেন এবং শরীর মন একটু একটু করে অবসন্ন হচ্ছে। এরকম বিপর্যস্ত সাংসারিক অবস্থায় হাজার১৯৫২ সালের নভেম্বর মাস থেকে লাবণ্য দাশ শিক্ষকতার চাকরি পান শিশু বিদ্যাপীঠে।এই সময়ে লাবণ্য দাশের উপার্জন সংসার চালানোর ক্ষেত্রে অনেক সহায়ক হয়েছে, সন্দেহ নেই। এই সময়কালে চল্লিশের দশকের একেবারে শেষে হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও জীবনানন্দ লিখে ফেলছেন ‘মাল্যবান’ (১৯৭৩),’ সুতীর্থ’ ( ১৯৭৭), ‘জলপাইহাটি’ (১৯৮৪)-র মত উপন্যাস।
জীবনানন্দ নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও সারা জীবন তাঁর দিনলিপি লিখে রেখে গেছেন খাতার পর খাতায়। আমরা পরবর্তী সময়ে ‘লিটারারি নোটস’ হিসেবে সেগুলির কিছুকিছু অংশ দেখতে পেয়েছি, ভূমেন্দ্র গুহ-র সৌজন্যে। এই সব দিনলিপিতে জীবনানন্দ নিজেকে মেলে রেখেছেন, বলা ভালো, নিজের জন্যই। দিনলিপিতে লিখে রেখেছেন প্রতিদিনের কেজো কথা যেমন, দৈনন্দিনের হিসাবনিকাশ, লেখার পরিকল্পনা, কবিতার কোন লাইন, কোন বইয়ের সম্ভাব্য নামকরণের তালিকা, কবিতার নামকরণের তালিকা, উপন্যাসের খসড়া, প্রার্থিতজনের ঠিকানা, কর্মখআলই বিজ্ঞাপনের তালিকা, পেপার কাটিং। এর পাশাপাশি নিজের পরিবার সহ বন্ধুবৃত্ত আত্মীয়-স্বজন নানাজন সম্পর্কে নোট লিখে রেখেছেন। এমন টেলিগ্রাফিক সাংকেতিক ভাষায় ইংরেজিতে এই দিনলিপিগুলি লিখেছেন যাতে নিজে ছাড়া আর কেউ বুঝতে না পারে। এইসব দিনলিপিতে, আমরা দেখেছি তাঁর সন্দেহ, সংশয় ঈর্ষা, গোপন হিংসা থেকে কেউই নিষ্কৃতি পায়না। তাঁর সময়ের সাহিত্যিকবন্ধু, তাঁর বাবা-মা স্ত্রী কেউ বাদ যাননা তাঁর বিশ্লেষণী বিদ্রূপ থেকে। অনেক সময়েই সেগুলি বহির্জাগতিক সত্য না হলেও জীবনানন্দের জগতে তা সত্য হয়ে থাকে। এমনই সন্দেহ কিংবা বাতিক তাঁকে ‘মাল্যবান’-এর মত উপন্যাস লেখায়; এবং স্বেচ্ছানির্মিত একটি আত্মপীড়নের পৃথিবী তাঁর বাসযোগ্য হয়ে থাকে।
১৯৩০ থেকে ১৯৫৪ সাল অবধি তাঁর দিনলিপির খাতা লক্ষ্য করলে দেখা যায় মৃত্যুর পাঁচ-ছ বছর আগে থেকেই বিপর্যস্ত জীবনানন্দ আর কোনো লেখাই লিখছেন না; নতুন কবিতা দেখা যাচ্ছেনা। এই সময়ের উদ্ধার হওয়া খাতায় দেখা যাচ্ছে শুধুই কাজের কথা। মৃত্যুর ৫-৬ বছর আগে থেকেই তাঁর স্বভাবজাত এতদিনের যে দিনলিপি লেখার অভ্যাস তাও যেন তিনি করতে পারছেন না। এই সময়ের দিনলিপির খাতায় তিনি লিখে রাখছেন মাসের খরচের হিসেব, আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত জীবনানন্দ লিখে রাখছেন ঋণ গ্রহণের খতিয়ান। আরও সম্ভাব্য কার থেকে টাকা ধার পাওয়া যেতে পারে এমন সম্ভাব্য নামের তালিকা। একটি কর্মসংস্থানের উপায় কার থেকে হতে পারে— কারকার কাছে যেতে হবে— সেইসব নামের তালিকা। লিখে রাখছেন চাকরির দরখাস্তের খসড়া, পরিকল্পনাহীন এলোমেলো কোন নোট, সম্ভাব্য নালেখা উপন্যাসের কোন নোট, ছাপা হবে না এমন বইয়ের সম্ভাব্য নামকরণ, সূচিপত্র। ধার চাওয়ায় কিংবা চাকরির প্রার্থনায় তিনি প্রতিদিন নিজেকে নত করছেন আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের কাছে, প্রকাশকের কাছে। কিন্তু কোথাও কোন সুরাহা হচ্ছে না। চাকরির জন্য সব সময় যে তিনি অধ্যাপনার চাকরির কথাই ভাবছেন তা নয়। কখনও ভেবেছেন লাইফ ইন্সুরেন্সের এজেন্ট এর কাজ কিংবা টিউশনি। পেতে চেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতা দেখার কাজ; এমনকি ছাত্র পাঠ্য নোটবই লেখার।এজন্য অনেক অধ্যাপকের পিছনে ঘুরে আবার বিফল হয়ে তাদের সম্পর্কে দিনলিপিতে লিখে রাখছেন শেষ বিদ্রুপ ভরা নানা মন্তব্য। চাকরির জন্য ধারাবাহিকভাবে তিনি ধরে থেকেছেন সে সময়ের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হুমায়ুন কবিরকে। বারবার চিঠি লিখে একটি চাকরির ব্যবস্থার অনুরোধ জানাচ্ছেন। অধ্যাপনা না হোক তাঁর জন্য তাঁর মন্ত্রকে যদি কোন একটি চাকরির ব্যবস্থা হয়। হুমায়ুন কবিরকে লেখা সে সব খসড়া চিঠির কোনটি পাঠানো হয়েছে কোনোটিবা হয়নি। হুমায়ুন কবির তাঁকে দেখা করতে বলেছেন বিধানচন্দ্র রায় কিংবা জ্যোতি বসুর সঙ্গে। কিন্তু জীবনানন্দ স্বভাব সংকোচে এত ক্ষমতাধর ভারি মানুষদের সঙ্গে দেখা করতেযাচ্ছেননা।অধ্যাপনার চাকরিতে তাঁর যে বিরক্তি এবং অপছন্দ তাও গোপন থাকছে না। হুমায়ুন কবিরকে একটি চিঠিতে লিখছেন জীবনানন্দ : ‘ আমি বিশিষ্ট বাঙ্গালীদের মধ্যে পড়ি না, আমার বিশ্বাস জীবিত মাহত্তরে বাঙ্গালীদের প্রায় পাওয়ার মতনও কেউ নই আমি কিন্তু আমি সেই মানুষ যে প্রচুর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রতিটি দ্রব্যকে সোনা বানিয়ে তুলতে চায়। অথবা মহৎ কিছু— যা শেষ বিচারে কোন একটা জিনিসের মতন জিনিস— কিন্তু ভাগ্য এমনই যে, তার খাদ্য জুটছে না। কিন্তু আশা করি, ভবিষ্যতে খাঁটি মূল্যের যথার্থ ও উপযুক্ত বিচার হবে, আমার ভয় হয় সেই ভালো দিন দেখতে আমি বেঁচে থাকব না।
আপনার কথা মতো আমি জ্যোতিবাবুর অথবা বিসি রায়ের সঙ্গে এখনও দেখা করার চেষ্টা করিনি, আমার মনে হয়, আমার মতন লোকের পক্ষে তারা দূরের মানুষ। আমি যেন অনুভব করি, আপনিই আমাদের মতন লোকের জন্য একমাত্র মানুষ ,আপনার উপর আমার গভীর আস্থা আছে।
আমি সর্বদা বিশ্বাস করি যে, আপনার নিজের পরিপূর্ণ শাসনের ভিতরে আছে এমন কোন একটা আমার পক্ষে উপযুক্ত জায়গায় আপনি আমাকে বসিয়ে দিতে পারেন; আমাকে একটা উপযুক্ত কাজ দিয়ে দেবার মতন সুযোগ আপনার সমূহ রয়েছে। আমার আর্থিক অবস্থাটা এখন এতটাই শোচনীয় যে, যেকোন একজন সকর্মক অপর মানুষ যে কাজ করতে পারে, কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে সে- কাজ আমারও করতে পারা উচিত। আমি মনে করি জিনিসটা একজন মানুষকে সেই সম্মানটা দিয়ে দিতে পারে, যা প্রতিটি মানুষ নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে অর্জন করে; তার বেশি আর কিছু আমি চাই না আমার দেশ আমার অস্তিত্বের স্তর মাত্রাটা মনে রেখে সেই যথাযোগ্য সুযোগটা আমাকে দিক যাতে আমি আমার ন্যূনতম জীবনযাপন নিয়ে থেকে যেতে পারি।
প্রাইভেট কলেজে অধ্যাপকের কাজ ক্ষুদ্র কাজ; অধিকন্তু অন্যান্য নানা কারণেও ওই কাজ আমি আর করতে চাইনা। আমার খুবই পছন্দ তেমন কোন একটা মানানসই কাজ, যাতে অনেকটা গবেষণা করতে হয়, লিখতে হয় এবং ভাবনাচিন্তা করতে হয়।’…
একসময় হাওড়া গার্লস কলেজে অধ্যাপনার কাজটি পেয়ে খানিকটা সুস্থিত হচ্ছেন ঠিকই, ততদিনে শরীর মন অবসন্ন। ডায়াবেটিকে আক্রান্ত হয়েছেন। হাওড়া গার্লস কলেজে যাওয়ার দীর্ঘ পথশ্রম— অনেকটা রাস্তা পারাপার তাঁর পক্ষে ক্রমশ অন্তরায় হয়ে উঠছে। কখনও ভাবছেন হাওড়াতেই বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকা যায় কিনা।
ইতিপূর্বে আর্থিক একটু সুরাহা হবে বলেই ইনসিওরেন্সের কর্মী এক মহিলাকে ল্যান্সডাউনের বাসার একটি ঘর সাবলেট করেছিলেন। কিন্তু নাচিয়ে গাইয়ে সেই মহিলা, দিনরাত হইচই করে নাচ গান করে তার মানসিক শান্তি বিঘ্নিত করছে। দিনের পর দিন এই মহিলার উপদ্রবে তাঁর মানসিক সুস্থিতি নষ্ট হচ্ছে। তাকে তুলে দেওয়ার নানা চেষ্টা করে চলেছেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়- সজনীকান্ত দাসের সাহায্য চেয়েছেন; সাহায্য চেয়েছেন অজিত দত্ত- সাবিত্রী প্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। ভেবেছেন তারাশঙ্কর কে বলে যদি পুলিশ দিয়ে তোলানো যায় মহিলাকে। কখনো ভাবছেন নিজে গিয়ে থানায় মহিলার নামে ডায়েরি করবেন। কখনো ভেবেছেন পাড়ার ছেলেদের দিয়ে ভয় দেখিয়ে যদি মহিলাকে তোলা যায়। এমনকি ভাবছেন গুন্ডা লাগিয়ে ভয় দেখিয়ে তাকে তোলানো যায় কিনা। তেমন গুন্ডার খোঁজ করতে হবে। শেষ অবধি ভেবেছেন এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোন ফ্ল্যাটে নিজেই উঠে যাবেন।
এসময় কিছুই লিখতে পারছেননা জীবনানন্দ। পরিকল্পনা করছেন শারদীয়া সংখ্যাগুলিতে লেখা দিতে হবে–’দেশ’, ‘আনন্দবাজার’, ‘জয়শ্রী’ এসব কাগজে। অথচ নতুন লেখা হচ্ছেই না। লেখা বলতে পুরনো কবিতার পরিমার্জনা করছেন কিংবা অখ্যাত বিখ্যাত নানা জনকে লেখা চিঠির খসড়া করছেন। তরুণ সম্পাদকেরা লেখা চাইলে জানাচ্ছেন, নতুন লেখা তাঁর হচ্ছেনা এখন। এক তরুণ সম্পাদককে সে কথা জানিয়ে চিঠিতে লিখছেন জীবনানন্দ: ‘তিন চার বছর আগেও সময় করে বসলে শেষ পর্যন্ত, কিছু না- কিছু লিখতে পারতাম, কিন্তু নানা কারণে অনেকদিন ধরেই মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে—কবিতা লেখা অভ্যাসও নেই অনেকদিন— কিছুই হয়ে উঠছে না। কয়েকটি পূজা সংখ্যায় কবিতা দিয়েছিলাম— ৪-৫ বছর আগের লেখা।’…
২.
১৯৫৪ সাল। ১৩ অক্টোবর আকাশবাণীর একটি কবিসম্মেলন যোগ দিতে হবে। এই নিয়ে কয়েকদিন ধরেই ভাবছেন জীবনানন্দ। একটা চাপা অস্বস্তি তাঁকে ঘিরে আছে, অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তে হবে বলেই কি! বিশ্ব বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে জানালেন, তাঁর সঙ্গে সাহিত্যালোচনা ভালোই লাগবে, কিন্তু তিনি যেন ১৫ অক্টোবরের পরে যেকোনো দিন বিকেল ৪.৩০-৫.৩০ বা ৬টার মধ্যে আসেন। একই ধরনের বক্তব্য জানালেন সুরজিৎ দাশগুপ্তকেও, ১৭ অক্টোবরের পরে কোনো একদিন বিকেলে এলে চিঠি ও প্রবন্ধ নিয়ে কথা হতে পারে। শরীরও যে মোটেই ভাল নয় এবং নানা ব্যাপারে বিব্রত হয়ে আছেন সে কথা লিখেছেন জীবনানন্দ। তাঁর একান্ত সুহৃদ সঞ্জয় ভট্টাচার্যকেও লিখলেন, ‘অনেক দিন থেকে আমার শরীর বিশেষ অসুস্থ।” ক-দিন থেকেই অনাগত নানা দুর্ঘটনার আশঙ্কায় মন তাঁর বিষণ্ণ হয়ে উঠছে। কয়েকমাস আগে সহকর্মী অজিতকুমার ঘোষের সঙ্গে যাচ্ছিলেন কল্যাণী। বাসে উঠে বসে পরামর্শ দিয়েছিলেন জীবনানন্দ, মাঝামাঝি জায়গায় আসন নেওয়া ভালো, কেননা ‘দুর্ঘটনা হলে বাঁচার আশা থাকবে।
আকাশবাণীর কবি সম্মেলনের সম্ভবত আগের দিন, অত্যন্ত বিস্রস্ত অবস্থায় হস্তদন্ত হয়ে চোখে-মুখে উদ্বেগের চিহ্ন ছড়িয়ে জীবনানন্দ হঠাৎ হাজির হলেন ভাই অশোকানন্দ-র বাসায়। চিন্তাক্লিষ্ট অস্থির পদচারণায় যেমন এসেছিলেন, ফিরেও চলে গেলেন তেমনি করেই, কাউকে একটি কথাও না বলে। শুধু খোঁজ করলেন বোন সুচরিতার। তিনি সেদিন বাড়ি ছিলেন না। সব শুনে পরদিনই সুচরিতা ছুটলেন দাদার বাসায়। ‘কাল অমন করে হস্তদন্ত হয়ে গিয়ে আবার তক্ষুনি ফিরে এলে কেন? কি হয়েছে? কোনো কিছু খারাপ সংবাদ নাকি ? জীবনানন্দ বললেন, ‘রাস্তায় আসতে আসতে কাদের যেন বলতে শুনলাম অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, মনে হল তোদের ওই বাড়িতে। তাই দেখতে গিয়েছিলাম তোরা সবাই ভালো আছিস কিনা। তোরা সবাই ঠিক আছিস দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলাম। কাল রেডিয়োতে আমার কবিতা পাঠ, তোদের কুশল জেনে না গেলে সেটা স্বস্তির সঙ্গে করা আমার পক্ষে সম্ভব হত না।”
পরের দিন কবিসভায় গিয়ে জীবনানন্দ প্রায় কারোর সঙ্গেই কথা বলেননি। কেবল সঞ্জয় ভট্টাচার্যকেই বারবার জিজ্ঞেস করেন ‘প্রেমেন এল না কেন?’ সঞ্জয় ভট্টাচার্য সেদিন জীবনানন্দের মধ্যে লক্ষ করেন ‘উদভ্রান্ত এবং সাংঘাতিক অন্যমনস্ক দৃষ্টি। সেই অনুষ্ঠানে ‘মহাজিজ্ঞাসা’ নামের কবিতাটি পড়েছিলেন তিনি।
পরের দিন নিয়মমাফিক সুবোধ রায় গল্প করতে এলে আগের দিন কবিতা পাঠ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়। কখনো কৌতুক মিশ্রিত রসালাপ এবং বলা নিষ্প্রয়োজন, জীবনানন্দই ছিলেন শ্রোতা। এর পরেই সাধারণত তাঁরা দু-জন বেড়াতে বেরুতেন। কিন্তু সুবোধ রায় অনুরুদ্ধ হয়েও ক্লান্তিজনিত কারণে সেদিন আর যেতে চান না। জীবনানন্দও ছাড়বেন না তাকে; ‘না-না, ক্লান্তি আবার কিসের ? হাঁটলেই চাঙ্গা হয়ে উঠবেন। চলুন- অপেক্ষা করছি, আসুন শিগগির।’ শেষ পর্যন্ত একাই বেড়াতে বেরোলেন জীবনানন্দ। অন্যমনস্ক তিনি দেশপ্রিয় পার্কের কাছে পৌঁছে এবার রাস্তা পার হবেন। শুধু অন্যমনস্ক নয়, কী যেন চিন্তায় মগ্ন। হাত পঁচিশ-তিরিশ দূরে চলন্ত একটি ট্রাম এগিয়ে আসছে। লক্ষ্য নেই তাঁর। অবিরান ঘণ্টাধ্বনি আর বারংবার চিৎকার করে সতর্ক করছেন ট্রাম ড্রাইভার। রাসবিহারী অ্যাভিনিউর-র ‘জলখাবার’ দোকানের সামনে রাস্তার ওপর ট্রাম গাড়ি থেমে গেল; প্রচণ্ড এক ধাক্কায় জীবনানন্দের দেহটি ততক্ষণে ট্রামের ক্যাচারে আটকে গেছে। পথচারীরা আর স্থানীয় এর ব্যবসায়ী চুনীলাল দে যখন টেনে-হিচড়ে বের করে আনলেন, জীবনানন্দ তখন অচৈতন্য। সারা গায়ে রক্তের দাগ। দুমড়ে-মুচড়ে গেছে ট্রামের ক্যাচার আঘাতে। ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে জীবনানন্দের বুকের পাঁজর, ঊরুর হাড়। অচৈতন্য দেহটি সবাই মিলে রাস্তার এক পারে তুলে এনে জল বাতাস বরফ দিতেই সংজ্ঞা ফিরে এল।
‘কী হয়েছে? আমি এখানে কেন?’
‘হাঁটতে হাঁটতে মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন।’ কে একজন বললেন।
আপনার নাম ঠিকানা কী?’ আরেকটি প্রশ্ন।
‘জীবনানন্দ দাশ। ১৮৩, ল্যান্সডাউন রোড।’ খানিক এধার-ওধার তাকালেন, আমি এখন বাড়ি যেতে পারি ? ‘তা যেতে… হ্যাঁ যেতে পারেন বৈকি।’ বললেন কে একজন। ততক্ষণে খবর পেয়ে গেছে কবিপুত্র রঞ্জু, প্রতিবেশী সুবোধ রায়। শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল জীবনানন্দকে। সঙ্গে গেলেন ট্রামেরই এক সহযাত্রী, ডোভার লেনের এক কর্তব্যপারারণ তরুণ বিমলেন্দু শীল এবং ‘জলখাবার’ দোকানের মালিক চুনীলাল দে।
শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে রাখা হয়েছে জীবনানন্দকে। সারা দেহ শাদা ব্যান্ডেজে বাঁধা। মুখ ফুলে বিকৃত হয়ে গেছে। ডান চোখের উপর উঁচু হয়ে গেছে মাংসপিণ্ড। খবর গেছে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কাছে। পৌঁছে গেছেন সুচরিতা দাশ। সঞ্জয় ভট্টাচার্যের নির্দেশে কয়েকজন তরুণ ছাত্র কবির সেবাযত্নে নিয়োজিত। আছেন ভূমেন্দ্র গুহ, দিলীপ মজুমদার, সমর চক্রবর্তী, জগদিন্দ্র মণ্ডল, স্নেহাকর ভট্টাচার্য। আর আছেন সিস্টার শান্তি ব্যানার্জি, সেবাপরায়ণ এক সেবিকা। সুবোধ রায় কবির সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁকে দেখে চোখ তুললেন জীবনানন্দ। ঠোঁটের কোণে এক অস্বাভাবিক ম্লান হাসি, ‘এসেছেন? কি সব হয়ে গেল … বাঁচব তো?’
সঞ্জয় ভট্টাচার্য সজনীকান্তের দাসের ব্যবস্থাপনায় ডা. বিধানচন্দ্র রায় এলেন দুই সহকারী চিকিৎসক ডা. অজিতকুমার বসু, ডা. অমলানন্দ দাশকে নিয়ে। অমলানন্দ, জীবনানন্দের আত্মীয়। তাঁকে দেখেই ব্যাকুল জীবনানন্দ বলে উঠলেন ‘কে বুবু? বুবু এসেছিস? বাঁচিয়ে দে… বাঁচিয়ে দে ভাই।” চিকিৎসা চলে। দ্বিতীয় দিনে কবির ছটফটানি কমে না। পরপর কয়েকবার বমি করলেন। চাপ চাপ রক্ত। ডাক্তার ইনজেকশন দিতে গেলে সেদিন সম্পূর্ণ সচেতন জীবনানন্দ ডাক্তারকে নির্দেশ দিলেন, ‘মরফিয়া দেবেন না, আমার ডায়াবেটিস।’
‘ঠিক আছে…ভয় নেই।’ ডাক্তার হাসলেন, ‘মরফিয়া নয়, পেনিসিলিন। “না না, পেনিসিলিনও নয়। লাখ লাখ পেনিসিলিন নিয়েছি কিছুদিন আগে।”
‘কতদিন আগে ?’
‘এই বছর দুই।’ ‘তবে আর কি ? এখন অনায়াসে দেয়া চলে। হাসতে হাসতে সূঁচ বিধিয়ে দিলেন। ডাক্তার।’
এরই মাঝে সুবোধ রায়কে জানালেন জীবনানন্দ, ‘যাঁরা যাঁরা আসছেন, নাম সময় ঠিকানা সব লিখে রাখবেন। যেন ভুল না হয়। লাবণ্যকেও বলেছি। কিন্তু ও তো সবাইকে চেনে না।’ একে একে কবিকে দেখতে আসেন নানা জন। সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সজনীকান্ত দাস, দিনেশ দাশ, অরুণকুমার সরকার, বুদ্ধদেব বসু, প্রতিভা বসু, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বিশ্ব বন্দ্যোপাধ্যায়, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু জীবনানন্দ খোঁজেন ‘প্রেমেন তো এল না’। অতুলানন্দ-কন্যা মিনু দেখতে এল। তাঁকে কাছে ডাকলেন কবি। পিসেমশায় মনোমোহন চক্রবর্তীর লেখা ‘জপোরে আমার নাম ও ব্রহ্মনাম’ গানটা শোনাতে বললেন।
ধীরে ধীরে একটি আচ্ছন্নতা তাঁকে গ্রাস করছে। দর্শনার্থীদের সঙ্গে কথা বলছেন, কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে যাচ্ছেন কখনো। আচ্ছন্নতার মধ্যেই শোনা গেল কয়েকটি কথা:
‘ক’টা বাজে?”
‘ভোর পাঁচটা।’
‘লিখে রাখো আজকের তারিখটিকে। আজ থেকে গত এক বৎসর খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। এখন ভোর না সন্ধে? আমি কি দেখতে পাচ্ছি জানো? বনলতা সেনের পাণ্ডুলিপির রং। ….তেতলায় নিয়ে যেতে পার? আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে, কবিতা বলব, আমার যে রেডিয়ো প্রোগ্রাম আছে।
আস্তে আস্তে নেমে আসে ক্লান্তি, নীরবতা। প্রগাঢ় ঘুমে চুপ করে গেলেন জীবনানন্দ। ২২ অক্টোবর, রাত্রি এগারোটা তখন। মৃত্যুর হিমশীতল স্তব্ধতা শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের দু-নম্বর ওয়ার্ড জুড়ে।
ডায়েরির শেষ লেখায়, মৃত্যুর কয়েকদিন আগে, দুর্ঘটনার আগে, জীবনানন্দ লিখে রেখেছেন সজনীকান্ত দাসের নাম। সজনীকান্ত দাস আর তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। হয়তো তা ছিল ওদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার চেষ্টা, যদিও ডায়েরিতে সেদিনের তারিখটা ভুল লিখে রেখেছিলেন জীবনানন্দ : ১৫ অক্টোবর ১৯৫৪,(‘15.10.54’)। কিন্তু ট্রাম অ্যাকসিডেন্টের ঘটনাটি ঘটেছিল
১৪ অক্টোবর। তাহলে আরো কিছুদিন আগেরই লেখা হবে নিশ্চয়ই। কিংবা এমনও কি হতে পারে,
১৫ অক্টোবর, কাজগুলি করবেন এমন ভেবে রেখেছিলেন জীবনানন্দ? জানা যাবেনা কোনো দিনই আর।
অসুস্থ শয্যায় জীবনানন্দের বিপদের দিনে পাশে এসে পড়েছেন সজনীকান্ত দাস। সেই সজনীকান্ত, এককালে জীবনানন্দের এক একটি কবিতাকে অসাহিত্যিক আক্রমণে বারবার বিধ্বস্ত করেছেন তিনি, ‘শনিবারের চিঠি’র পাতায়।
জীবনানন্দের দুর্ঘটনার পর হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসার সুবিধাজনক সুবন্দোবস্ত যাতে হতে পারে, এই ভাবনা নিয়ে, অনেক সংশয় নিয়েও সজনীকান্তের কাছে খবর পাঠিয়েছিলেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য। সঞ্জয় ভট্টাচার্যের চিঠি নিয়ে তরুণ ভূমেন্দ্র গুহ দেখা করতে যান সজনীকান্তের কাছে। আগেই সঞ্জয় ভট্টাচার্যের নির্দেশে ফোন করেছিলেন সত্যপ্রসন্ন দত্ত, যিনি সঞ্জয় ভট্টাচার্যের বন্ধুই শুধু নন,’পূর্বাশা’ পত্রিকার সহযোগী প্রাণপুরুষও। ভূমেন্দ্র গুহ সঞ্জয় ভট্টাচার্যের চিঠি নিয়ে দেখা করতে গেলে সজনীকান্ত সঙ্গেসঙ্গেই তাঁকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। ভূমেন্দ্র গুহকে জানান সজনীকান্ত, দুর্ঘটনার খবরটা তিনি পেয়েছেন, কিন্তু এতটা সিরিয়াস অবস্থা তিনি ভাবতে পারেননি। সেদিন সন্ধেতেই তিনি ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়কে আনার ব্যবস্থা করেন। এবং ডা.বিধান রায়ের পরিদর্শনকালে তার পাশেপাশে থেকেছেন সজনীকান্ত। ভূমেন্দ্র গুহ লিখেছেন, ‘আধুনিক সাহিত্যের বিশেষত জীবনানন্দের লাগাতার বিরূপতার জন্য যে সজনীকান্ত দাসকে আমর্ম অপছন্দ করেছি এতকাল, আজ এই মুহূর্তে আমরা যেন তাকে নিঃশর্ত পছন্দই করে ফেললুম।’
২২ অক্টোবর ১৯৫৪ রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ জীবনানন্দ মারা গেলেন। তারপর সেই ভাঙাচোরা শরীরে পোস্টমর্টেম হবে– ব্যাপারটা কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিলেন না সুচরিতা দাশ। সেই রাতে আবার সজনীকান্ত দাসের শরণাপন্ন হওয়া। যদি পোস্টমর্টেম না করার কোন উপায় পাওয়া যায়। টেলিফোনে জীবনানন্দের মৃত্যু সংবাদ সজনীকান্ত দাসকে জানিয়েছিলেন সত্যপ্রসন্ন দত্ত। এবং অনুরোধ করেন পোস্টমর্টেমটা যাতে আটকানো যায়— তার কোন ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখতে। রাত শেষ হওয়ার দিকে সজনীকান্ত দাস হাসপাতালে চলে এলেন। তারপর সত্যপ্রসন্নকে খুঁজে নিয়ে,’ তাঁকে সঙ্গে নিয়ে, সিঁড়িতে জুতা খুলে রেখে জীবনানন্দের শয্যাপার্শ্বে মিনিটখানেক দাঁড়ালেন, অত রাতেও তার হাতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা ছিল শয্যাপার্শ্বে রাখবার জন্য’, জানিয়েছেন ভূমেন্দ্র গুহ। শেষপর্যন্ত সজনীকান্ত দাসের ব্যবস্থাপনায় শবদেহের পোস্টমর্টেম আটকানো সম্ভব হল। মুখ্যমন্ত্রীর প্রাইভেট সেক্রেটারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে পোস্টমর্টেম ছাড়াই শবদেহ নিয়ে যেতে দেওয়ার নির্দেশ দেন। হাসপাতাল থেকে মৃতদেহ না বেরোনো পর্যন্ত সজনীকান্ত হাসপাতালেই থেকে গেলেন। কবির আত্মীয়-স্বজন অশোকানন্দ দাশ, নলিনী দাশের সঙ্গে কথা বললেন। লাবণ্য দাশের খোঁজ করে, না পেয়ে সজনীকান্ত বললেন, ‘ওর তো শোকের সীমা পরিসীমা নেই’…
জীবনানন্দের মৃত্যুর পর তাঁর পারলৌকিক অনুষ্ঠান হল দিনকয়েক পরে। দাশ পরিবারের আমন্ত্রণে সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু যেমন, তেমনি সজনীকান্ত দাসও। পারিবারিক আচার অনুষ্ঠান শেষে পরের পর্বে একটি স্মরণ অনুষ্ঠানও হয়েছিল বলা যেতে পারে। পারিবারিকভাবে সেই অনুষ্ঠানে সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণা করেন অশোকানন্দ দাশ এবং সুচরিতা দাশ। তারপর জীবনানন্দের সতীর্থ বন্ধুরা বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র স্মৃতিচারণা করেছিলেন। তাদের স্মৃতিচারণায় ‘কল্লোল’, ‘প্রগতি’র সময় থেকে শুরু করে ‘কবিতা’, ‘পূর্বাশা’, ‘নিরুক্ত’র সময় পেরিয়ে তাঁদের বন্ধুত্বের দিনগুলির কথা, পারস্পরিক সম্পর্কের নানা ছায়াচিত্র উঠে আসে, নানাজনের স্মৃতিকথায়। সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অজিত দত্ত, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, দিলীপকুমার গুপ্ত,বিরাম মুখোপাধ্যায়, আতোয়ার রহমান। ছিলেন অরুণকুমার সরকার, আলোক সরকার, ভূমেন্দ্র গুহ সহ তরুণেরা। আলোক সরকার এবং ভূমেন্দ্র গুহ র স্মৃতি থেকে জানা যায় সেই সভায় বুদ্ধদেব বসু তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘জীবনানন্দ আজ প্রয়াত, কিন্তু তার মরণোত্তর সময় যত খরচ হয়ে যেতে থাকবে, আমরা ততোই উপলব্ধি করতে থাকব যে তিনি কত বড় কবি ছিলেন’।৫ সজনীকান্ত দাস সেদিন তাঁর বক্তব্য রেখেছিলেন অনুশোচনার সুরে। জীবনানন্দ শয্যাশায়ী হওয়ার পর থেকেই তার কন্ঠে ছিল অনুশোচনার সুর। জীবনানন্দের কবিতা তাঁর মতো অরসজ্ঞরা যে ধরতে পারেননি আগেই স্বীকার করে নিয়েছিলেন সজনীকান্ত।
পারলৌকিক সেই সভায় সঞ্জয় ভট্টাচার্য একটি প্রস্তাব পেশ করে বলেন, ‘ জীবনানন্দ যেহেতু আধুনিক কবিতার বয়োজ্যেষ্ঠ কবি ছিলেন, এবং প্রথম প্রয়াত, সুতরাং দলমত নির্বিশেষে তাঁর সম্মানে একটি শোকসভার আয়োজন করা হোক। বিশেষত একারণেও যে তাঁরা যারা এইমুহূর্তে উপস্থিত আছেন একদিন একে একে প্রয়াত হবেন। সততা পরিশ্রম আর নিষ্ঠার প্রতি সম্মান জানানোর একটা প্রথা’ জীবনানন্দকে দিয়েই শুরু হোক’। এই ছিল সঞ্জয় ভট্টাচার্যের বক্তব্য।৬
সঞ্জয় ভট্টাচার্যের বক্তব্য শেষ হতেই বুদ্ধদেব বসু উঠে দাঁড়ালেন এবং প্রস্তাবটিকে সর্বান্তকরণে সমর্থন জানালেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটি শর্ত আরোপ করলেন সেই সভায়। এমনতর শোকসভার আয়োজনের জন্য যে কমিটি গঠিত হবে সেখানে যেন সজনীকান্ত দাসের নাম না থাকে। ভূমেন্দ্র গুহর ভাষায় বুদ্ধদেব বসু
‘কেটে কেটে স্পষ্ট করে’ বললেন, শেষ পর্যন্ত যদি সজনীকান্তের নাম সেই প্রয়াসের মধ্যে থাকে তাহলে সেই ব্যাপারে বুদ্ধদেব বসু থাকবেন না, জানিয়ে দিলেন।
বুদ্ধদেব বসুর এমনতর বক্তব্যে সভার যেন সুর ছিন্ন হয়ে গেল। সজনীকান্ত দাস এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন, এবং অপমানিত বোধ করে তারা দুজনেই সভাস্থল ছাড়লেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই উঠে গেলেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য। এবং বাইরের গেট পেরিয়ে বাড়ির বাইরে বকুলতলায় এসে দাঁড়ালেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের হস্তক্ষেপে সবাইকে পুনরায় সভাঘরে হাজির
করানো হল ঠিকই, তবে সভার আর প্রাণ ফিরে এল না। পরিবেশটাকে ফিরিয়ে আনার জন্য অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত চেষ্টা করে গেলেন। তাঁর বক্তব্যে জীবনানন্দের সঙ্গে তাঁর নানা সময়ের সাক্ষাতের টুকরো টুকরো সংলাপ সরসতার সঙ্গে বলতে থাকেন।তারপর সংক্ষিপ্ত জলযোগ পর্ব..।
বিষন্ন মনে সেদিনের মতো যে যার সভাস্থল ত্যাগ করলেন। সেই শোকসভা তথা পারলৌকিক সভা ছন্দহীন ভাবে শেষ হল সেদিন। তরুণ ভূমেন্দ্র
গুহ-রা বুঝতে পারছিলেন না এই অবস্থায় তাদের কী করণীয়!
এরপর নভেম্বর মাসে ‘শনিবারের চিঠি’র পাতায় সজনীকান্ত দাস লিখলেন এক বিষন্ন বার্তা । এতদিনের জীবনানন্দ বিরোধিতায় যে ভুল ছিল স্বীকার করে নিলেন সজনীকান্ত। এবং সেই অসাহিত্যিক অন্ধ বিরোধিতার জন্য অনুশোচনা জানালেন সেই লেখায়—
‘কবি জীবনানন্দের কাব্যের প্রতি আমরা যৌবনে যথেষ্ট বিরূপতা দেখাইয়াছি, তাহার দুর্বোধ্যতাকে ব্যঙ্গ করিয়া বহু পংক্তি উদ্ধৃত করিয়া তাহাকে হাস্যাস্পদ করিবার চেষ্টা করিতেও ছাড়ি নাই। তিনি প্রধানত ‘কল্লোল’- ‘প্রগতি’- গোষ্ঠীর লেখক ছিলেন, সুতরাং তাঁহাকে বিপক্ষ দলে ফেলিয়া লড়াইয়ের ধর্ম অনুযায়ী আক্রমণেই আমাদের আনন্দ ছিল। আজ কালধর্মে আমাদের মতি ও বুদ্ধির পরিবর্তন হইয়াছে, তিনিও সকল নিন্দা ও প্রশংসার ঊর্ধ্বে চলিয়া গিয়াছেন। পুরাতন যাবতীয় অশোভন বিরূপতা সত্ত্বেও এ কথা আজ স্বীকার করা কর্তব্য মনে করিতেছি যে রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্য সাহিত্যের তিনি অন্যতম গৌরব ছিলেন, তিনি অকপটে সূদৃঢ় নিষ্ঠার সহিত কাব্য সরস্বতীর সেবা করিয়া গিয়াছেন, তাহার প্রকাশ ভঙ্গিতে অস্পষ্টতা থাকিলেও সাধনায় বিন্দুমাত্র ফাঁকি ছিল না।…. সহৃদয় ব্যক্তিরা তাঁহার বক্তব্যের চাবিকাঠি খুঁজিয়া পাইয়া আনন্দ লাভ করিতেন, যাঁহারা তাহা পাইতেন না তাঁহারাই বিমুখ হইতেন। আমরা এই শেষোক্তদের দলে ছিলাম। কিন্তু তাই বলিয়া কবি জীবনানন্দের কাব্য সম্পদ কিছু বাতিল হইয়া যায় নাই। আমরাই বরং
সহৃদয়তার সাধনা করিয়া তাহাকে বুঝিবার চেষ্টা করিতেছি।’
মনে রাখতে হবে সেই ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকার ‘সংবাদ সাহিত্য’ বিভাগে এই বক্তব্য লেখা হল, যেখানে ১৯২০-র শেষ থেকে ১৯৩০ এর দশক পর্যন্ত জীবনানন্দের উপর একের পর এক বিদ্বেষপূর্ণ আক্রমণাত্মক লেখা ছাপা হয়েছিল ধারাবাহিকভাবে।