spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধআনওয়ার আহমদ

লিখেছেন কাজী জহিরুল ইসলাম

আনওয়ার আহমদ

কাজী জহিরুল ইসলাম

১৯৯৬ সালের মে/জুন মাস। মাত্র বিয়ে করেছি। মুক্তি আর আমি মুক্ত বিহঙ্গ, উড়ে বেড়াই, ঘুরে বেড়াই সারা শহর, সারা দেশ। একদিন বিকেলে আতাহার ভাই বলেন, জহির, একজন কবি তার সব বই পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যান, তার সাথে কথা বলে আসেন। ভালো একটা রিপোর্ট চাই। মুক্তিকে বলি, চলো, একজন পাগলের কাছে যাই। আমরা উড়তে উড়তে, ঘুরতে ঘুরতে টিকাটুলি থেকে লালমাটিয়ায় গিয়ে হাজির হই। ছায়াঘেরা পুরনো একটি বাড়ির তিনতলায় থাকেন সেই পাগল, কবি আনওয়ার আহমদ। দরোজার বেল বাজছে না। আমরা কাঠের দরোজায় ধাক্কা দিতে থাকি। কিছুটা ভয়ে ভয়েই দরোজা ধাক্কাচ্ছি। যে লোক তার সব বই পুড়িয়ে ফেলার ঘোষণা দিয়েছেন তার পক্ষে যে কোনো কিছুই করে ফেলা সম্ভব। আমরা একজন পাগলের মুখোমুখি হওয়ার  কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। 

লুঙ্গি পরা, গেঞ্জি গায়ে এক লোক দরোজা খুললেন। মুখে কবিসুলভ নিবিড় অরণ্য নেই, মাথার চুলও সুন্দর করে ছাঁটা, কিন্তু তার চোখে ঘোর, মাদকতা, পাগলামি, ওইখানেই কবি বাস করেন। আমরা পরিচয় দিতেই তিনি দরোজা খুলে আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। তিন বেডরুমের বেশ বড় সড় একটি এপার্টমেন্ট। সব ঘরেই বই। অসংখ্য বইয়ের তাক, সেগুলো ঠাঁসা তার নিজের এবং অন্য লেখকের বইয়ে। তিনি ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বের করে আমাদের খেতে দেন। নিজেই উঠে দোকান থেকে চা আনতে যেতে চাইলে আমরা বাঁধা দেই। এতো বড় বাসায়  তিনি একাই থাকেন। দুই দশকের অধিক সময় ধরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। তার স্ত্রী বেবী আনওয়ার দুই ছেলেকে নিয়ে উত্তরায় থাকেন। উত্তরায় নিজেদের বাড়ি। বড় ছেলে রূপমের নামে ‘রূপম’ এবং অন্য আরেকটি ‘কিছুধ্বনি’, এই দুটি সাহিত্যের ছোটোকাগজ তিনি সম্পাদনা করছেন দীর্ঘদিন ধরে। বেবী আনওয়ারও তার এই শিল্প-পাগলামির সঙ্গী ছিলেন অনেককাল। আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে এ-আক্ষেপের কথা তিনি বললেন। আমি বলি, আনওয়ার ভাই, একবার চেষ্টা করা যায় না, আমরা ভাবীর কাছে যাই, কথা বলি? তিনি রেগে যান। ‘তোমার কি মনে হয় না ইতিপূর্বে আরো অনেকেই সেই চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন?’ আমার মনে হয় দীর্ঘদিন নিঃসঙ্গ থাকার কারণেই তাঁর এই হতাশা। তিনি হো হো হো হো করে ঘর কাঁপিয়ে হাসেন। ‘আমি ভালো আছি, খুব ভালো’।

আমি সাপ্তাহিক পূর্ণিমায় এই পাগল কবিকে নিয়ে রিপোর্ট করি। 

আনওয়ার ভাই আমাদের পরম বন্ধু হয়ে ওঠেন। আমরা থাকতাম মোহাম্মদপুরে, জাকির হোসেন রোডে। হাঁটাপথের দূরত্ব। আমার অফিস ছিল ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোডে, তখন আমি সেইভ দ্যা চিলড্রেন-ইউকে-তে কাজ করি। যখন-তখন আমরা তাঁর বাসায় যাই, দিনের বেলায় তিনি হুট হাট আমার অফিসে চলে আসেন। এসেই বলেন, চলো, অমুক জায়গায় যাই। আমি বলি, আনওয়ার ভাই, আমার আফিস। রাখো তোমার অফিস, তুমি কিসের কবি, সারাদিন কেরানিগিরি করো। আনওয়ার ভাই ছিলেন কাস্টমস ইন্সপেক্টার, ইচ্ছে হলে অফিসে যেতেন, ইচ্ছে না হলে যেতেন না। সেই সময়ে কাস্টমসে কাজ করতেন আরো কয়েকজন কবি, একজন মাহবুব বারী, তিনিও “সূর্য” নামে একটি ছোটো কাগজ সম্পাদনা করতেন। সেটি তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। আলী আহমেদ থাকতেন বনানীতে, দিন-রাত কবিতা লিখতেন, কবিতার জন্য দুই হাতে টাকা বিলাতেন কিন্তু তার কবিতাগুলো কবিতা হয়ে উঠত না। সৈয়দ হায়দার ভালো কবি ছিলেন, তিনিও কাস্টমসে চাকরি করতেন। মাহবুব বারীর কথা জানি না, অন্য তিনজনের কেউই আজ বেঁচে নেই। তাদের সকলের সঙ্গেই আমার নিবিড় সখ্য ছিল।

একদিন দুপুরে আনওয়ার ভাইয়ের বাসায় গিয়ে দেখি অল্প বয়সী একটি কালো মেয়ে, ভারী মিষ্টি মুখ মেয়েটির। যতদূর মনে পড়ে মেয়েটির নাম মুনমুন। আনওয়ার আহমদকে চাচা, চাচা, বলে ডাকছে। এরপর মুনমুনকে দেখেছি, প্রায় রোজই আনওয়ার ভাইয়ের জন্য খাবার নিয়ে আসত। শুধু মুনমুন একা না আরো অনেক নারীই আনওয়ার আহমদের জন্য খাবার রান্না করে নিয়ে আসত। সেইসব খাবারে আমিও মাঝে-মধ্যে ভাগ বসিয়েছি। একেক দিন একেক নারীর খাবার খেয়ে তিনি কি খুব তৃপ্ত ছিলেন? হাসতেন, আমি জানি এই হাসির আড়ালে একটি গভীর কান্না লুকিয়ে ছিল। মুনমুনের সাথে আনওয়ার ভাইয়ের সম্পর্ক আরো গভীর, আরো নিবিড়, তা বুঝতে আমার বেশ কিছুদিন সময় লেগে যায়।

বাংলা সাহিত্যের অনেক বিখ্যাত লেখক/লেখিকার অনিয়ন্ত্রিত যৌন জীবনের অনেক গল্প তিনি আমাকে বলতেন। তাদের কেউ কেউ তারই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আজ এই রচনায় তাদের নাম উল্লেখ করে কাউকে বিব্রত করতে চাই না, তাদের অনেকেই এখনও বেঁচে আছেন, অনেকেই বেঁচে নেই। উল্লেখ্য যে লেখকদের অনিয়ন্ত্রিত বা অনিয়মতান্ত্রিক যৌন জীবনের কথা উঠত তাঁর নিজের জীবনের প্রসঙ্গ ধরেই।

কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ ছিলেন তার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু এক পর্যায়ে তাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায়। আনওয়ার ভাই যে কেমন পাগল ছিলেন তার একটি উদাহরণ দিই। তিনি আমাকে বলতেন, যদি মান্নানকে ফোন করে শুয়োরের বাচ্চা বলতে পারো তোমাকে বিরিয়ানি খাওয়াবো। মান্নান ভাইয়ের সাথে আমার সুসম্পর্ক, আমি কেন এটা করতে যাবো? ফোনে রুমাল দিয়ে বলবে, চিনতে পারবে না। আমি বলি, না, আমি তা করব না। কিন্তু তিনি করেন। ওপাশ থেকে মান্নান ভাই ফোন ধরলেই তিনি চিৎকার করে বলেন, ‘শুয়োরের বাচ্চা, শুয়োরের বাচ্চা’। পরে আবার ভেউ ভেউ করে কাঁদেন, কষ্টে। মান্নান ভাই কেন তার সঙ্গে কথা বলেন না, এই দুঃখে তার বুক ভেঙে যেত। 

তিনি শুধু ‘রূপম’, ‘কিছুধ্বনি’ না, অনেকের বইও বের করে দিয়েছেন। নাসরীন জাহানের প্রথম বই (সম্ভবত বিচূর্ণ ছায়া) আনওয়ার ভাইই বের করে দেন। ‘সব বই পুড়িয়ে ফেলব, সব বই পুড়িয়ে ফেলব’ একথা আমাকে বহুবার বলেছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বই পোড়াননি। আমাকে প্রথমবার তো বটেই, পরেও অনেকবার দুই ব্যাগ ভর্তি বই দিয়েছেন। নিজের বই, অন্যের বই, রূপম, কিছুধ্বনি। আমি সে-সব বই অনেককে উপহার দিয়েছি।

আনওয়ার আহমদের বাড়ি ছিল বগুড়ায়। তিনি বগুড়ার কবি/লেখকদের প্রতি বেশ উদার ছিলেন এবং তাদের প্রতি তার এক ধরণের পক্ষপাত ছিল। শেখ ফিরোজ আহমদ নামের এক কবির সাথে আমার পরিচয় হয় আনওয়ার ভাইয়ের মাধ্যমে। তার বাড়িও বগুরায়।  ফিরোজের সাথে আমার বেশ সখ্য গড়ে ওঠে। একদিন এক হালকা/পাতলা, ছোটো-খাটো তরুণকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, এর নাম চঞ্চল আশরাফ, ঝাল মরিচ। দুর্দান্ত লেখে। আরো অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে, নাম জেনেছি আনওয়ার ভাইয়ের মাধ্যমে। ১৯৯৮ সালে আমাদের দুজনের দুটি পকেট বই বের করি। নিজেরাই টাকা দিয়ে বের করি। আমারটির নাম ভালোবাসার শব্দগুল্ম, নামটা মুক্তির দেয়া। আনওয়ার ভাইয়েরটার নাম ভুলে গেছি।  

১৯৯৯ সালের মার্চ মাসে আমি বের করি ‘কাজীর কাগজ’, আনওয়ার আহমদের ওপর। কভারে তার অস্পস্ট ছবি, ওপরে লাল কালিতে বড় করে লেখা ‘একজন পাগলের কথা’। তার অনেক অনুরোধ সত্বেও ছাপা হওয়ার আগে আমি তাকে কভার দেখাইনি। ছাপা হওয়ার পরে কভারটি দেখেই তিনি রেগে আমাকে মারতে আসেন। আমি তোমাকে খুন করে ফেলব। আমাকে পাগল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছ? পরে অবশ্য তিনি বুঝতে পেরেছেন, এই শিরোনামের গভীরতা অনেক। এবং আমাকে বলেন, তুমি তো আমাকে কিনে ফেললে।  

কাজীর কাগজের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান হয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে, ১৩ মার্চ। সেদিন ছিল আনওয়ার ভাইয়ের জন্মদিন। মোড়ক উন্মোচন করেন কবি শামসুর রাহমান। শামসুর রাহমান বলেন, আনওয়ারকে একজন সৃজনশীল সম্পাদক হিসেবেই জানতাম। এখন দেখছি ও কবি হয়ে উঠেছে।

এর পরের মাসেই আমি বিদেশে চলে যাই। ফিরে আসি, আবার যাই। আবার ফিরে আসি ২০০৩-এর এপ্রিলে। এসে আর আনওয়ার ভাইয়ের সাথে আগের মতো আড্ডা হচ্ছিল না। আমার প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব বেড়েছে, সংসারের দায়িত্ব বেড়েছে। হঠাৎ একদিন, ২৪ ডিসেম্বর, শুনি আনওয়ার ভাই আর নেই। নিজের ঘরেই, রাতে। খুব কষ্ট হচ্ছিল, খুব ইচ্ছে ছিল, অন্তত আবার একটা দিন, সারাদিন তার সঙ্গে কাটাব, নিবিড় সান্নিধ্যে, হলো না।      

হলিসউড, নিউ ইয়র্ক।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on দু’টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on পাখিমানুষ