spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যযেভাবে অনুবাদ হলো রুমি

লিখেছেন খালিদ সাইফ

যেভাবে অনুবাদ হলো রুমি

খালিদ সাইফ

১.

মহাকবি জালালুদ্দিন রুমির কবিতার অনুবাদের সাথে জড়িত হই আকস্মিকভাবে। হঠাৎ করেই রুমির প্রেমের কবিতার ইংরেজি অনুবাদের খোঁজ পাই। ঢাকার ধানমন্ডি সাতাশের “ইটিসি” নামক স্বল্পস্থায়ী একটি সুপারসপে ২০০৭ সালে সংকলনটি নজরে আসে। সেটিই ছিল আমার রুমির সৃষ্টিকর্মের সাথে প্রথম পরিচয়। 

ওই বছরই যে ইউনেস্কো ঘোষিত “রুমি-বর্ষ” তা আরও পরে জানতে পারি। সে দোকানে বসেই কয়েকটি কবিতা পড়ে রুমির রচনার প্রতি আকৃষ্ট হই। এক অপার্থিব ভালো লাগায় আপ্লূত হয়ে পড়ি। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি: এই ভালো লাগাকে ছড়িয়ে দিতে হবে বাঙালি পাঠকের মাঝে। আমেরিকায় মুদ্রিত মাত্র চার ফর্মার কবিতার বইটির দাম তখন ছিল বাংলাদেশী টাকায় এগারো শত টাকা। সে মুহূর্তে বইটি খরিদ করতে না পারলেও পরে আজিজ মার্কেটের “একুশে” নামক একটি দোকান থেকে আগের মূল্যের চেয়ে কম দামে বইটি ক্রয় করি। 

বইটি ক্রয়ের পর তিনটি কাজ শুরু হয়, ১. কবিতাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়া; ২. ধীরে ধীরে অনুবাদের প্রস্তুতি এবং ৩. অনুবাদের ধরন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও পড়াশুনা। 

ইংরেজি অনুবাদটির পাশাপাশি খুঁজতে থাকি রুমির কবিতা বাংলা ভাষায় আর কেউ তর্জমা করেছেন কিনা। হতাশ হতে হয় — মনিরউদ্দীন ইউসুফ ও মোস্তাফা জামান আব্বাসী কিছু ভাষান্তর করেছেন — তা যথেষ্ট নয়। মোস্তাফা জামান আব্বাসী “রুমির অলৌকিক বাগান” (১ম প্রকাশ ২০১০) গদ্য-সংকলন রুমির উপর এক অনন্য কাজ হলেও কবিতার অনুবাদে মন ভরল না। ছৈয়দ আহমদুল হকের রুমির কয়েকটি কবিতার তর্জমা হাতে আসে। হক সাহেবের অনুবাদের সংখ্যা কম হলেও তিনি মূল ফারসি থেকে অনুবাদ করেছেন। তাঁর তর্জমা বেশ সাবলীল — আশাবাদী হই আমি। গদ্যে রুমির উপর বেশকিছু ভালো লেখা পাওয়া গেল। সেগুলো থেকে রুমির জীবন ও কবিতা সম্পর্কে অনেক তথ্য জানলাম; বিশেষ করে মোহম্মদ বরকতুল্লাহ“পারস্য প্রতিভা” এ-বিষয়ে একটি ধ্রুপদি গ্রন্থ। এছাড়া বাংলা ভাষার মরমি-সুফিবাদী ও অধ্যাত্মিক কবিতার ধারা সম্পর্কেও অধ্যয়নে রত হই। এ-পঠনপাঠন ও অনুসন্ধানের একটাই উদ্দেশ্য, রুমির বৈশিষ্ট্য যেন খানিকটা বুঝতে পারি এবং ভাষাটাকে সেই উপযোগী করে গড়ে নিতে পারি। কতটুকু পেরেছি সে বিচারের ভার পাঠকের। 

২.

অনুবাদের কাজ চলতে থাকে। অনলাইন-অফলাইন এবং মুদ্রিত বই আর ই-বই নেড়ে-চেড়ে অসম্পূর্ণতাগুলো ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করি। ওই সময় কেবল ছাত্রজীবন শেষ হয়ে আমার কর্মজীবন শুরু হয়েছে। দুপুরের পর অফিস থেকে ফিরে আর কোনো কাজ নেই। পড়াশুনা আর আড্ডা দিয়েই কাটত সময়। বন্ধু  বলয়ে ছিল তরুণ কবি-লেখকেরা, তর্জমা হলেই তাদের দেখাই, মতামত নেই, পরিমার্জনা করি। এভাবে কিছুদিনের মধ্যেই ওই প্রেমের কবিতা সংকলনের অধিকাংশ কবিতার ভাষান্তর সম্পূর্ণ হয়। দু-একটি কবিতা অবশ্য বাদ দেওয়া হয়, দু-একটি নেওয়া হয় অন্য-কোনো অনুবাদ গ্রন্থ থেকে। এক সময় তর্জমাগুলো একটি মানে পৌঁছলে সেগুলো দেখাই আমার প্রথম প্রকাশক অস্ট্রিক আর্যুকে। তিনি পাণ্ডুলিপি সংশোধনের কিছু পরামর্শ দিলেও ছাপতে রাজি হন। 

বাংলায়ন থেকে ২০০৮ সালে “জালালুদ্দিন রুমি : প্রেমের কবিতা” শিরোনামে বাংলা ভাষায় প্রথম মননশীল পাঠকের উপযোগী রুমির কবিতার অনুবাদ প্রকাশিত হলো। ২০০৭ সালের “রুমি-বর্ষ” বিশ্ববাসীর সামনে রুমিকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়। রুমির পশ্চিম জয়ের খবর বাঙালি পাঠকের কাছে আস্তে আস্তে পৌঁছতে থাকে। আমার টেবিল ভরে যায় রুমির ইংরেজি কবিতার অনুবাদ-গ্রন্থ দিয়ে। প্রেমের কবিতা প্রকাশিত হলেও অন্যান্য লেখার পাশাপাশি  চালিয়ে যেতে থাকি রুমির অনুবাদও। দ্বিতীয় সংস্করণে যোগ হয় অল্প কয়েকটি নতুন কবিতা এবং তৃতীয় সংস্করণে এর সাথে যুক্ত হয় আরও কিছু কবিতা। বইটির চতুর্থ সংস্কণে এটি আমূল বদলে যায়। এবার বইটির নাম রাখা হয় “জালালুদ্দিন রুমি : নির্বাচিত কবিতা” (প্রকাশক: মুক্তদেশ; ২০১৮; মুক্তদেশ ৪র্থ মুদ্রণ ২০২৩)। এ-পর্যন্ত এর মুদ্রণ হয়েছে সাত বার। আগের প্রেমের কবিতা-সহ এ-সংস্করণে যুক্ত হয় অসংখ্য নতুন অনূদিত কবিতা। পূর্বের সংস্কণের অধিকাংশ কবিতা ছিল মূলত প্রেমের কিন্তু এবার যুক্ত হয় রুমির নানা বিষয়ের কবিতা। প্রাচ্য-প্রতীচ্যের প্রায় অধিকাংশ প্রতিনিধিত্বকারী অনুবাদকের ইংরেজি থেকে কবিতাগুলোর বাংলা করা। চতুর্থ সংস্করণের বেশিরভাগ কবিতা প্রথমে প্রকাশিত হয় আমার ফেসবুক পাতায়। জানামতে, বাংলায় আর কেউ একসাথে তর্জমা করে নি রুমির এতবেশি কবিতা। ফেবুর পাঠকদের আলোচনা-সমালোচনা তর্জমার উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে আমার অনুবাদ পড়ে লেখক, ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ও বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ স্যারের ইতিবাচক মন্তব্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ে।

৩.

পশ্চিমে যার অনুবাদে রুমি ইংরেজি-ভাষাভাষী জগতকে নতুন করে জয় করেন তিনি কোলম্যান বার্কস। বার্কসের গুরু একবার তাঁকে বলেছিলেন এ. জে. আরবেরি ও রেনল্ড এ. নিকলসনের অনুবাদের খোলস থেকে রুমিকে বের করে আনতে। এ. জে আরবেরি ও রেনল্ড নিকলসনের অনুবাদ কেমন তা বাঙালি পাঠক একটি উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবেন। শ্রদ্ধেয় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও ওমর খৈয়ামের অনুবাদ করেছিলেন, কিন্তু ভাষাবিজ্ঞান ও সাহিত্যের পণ্ডিত হিসেবে বাঙালি শহীদুল্লাহকে অনিবার্যভাবে নিলেও তাঁর খৈয়ামের তর্জমা চলে নি। কোলম্যান বার্কস সাহেব এ. জে আরবেরি ও রেনল্ড নিকলসনের পাণ্ডিত্যের খোলস থেকে বের করে আনেন রুমিকে। বার্কসের অনুবাদে পশ্চিমে রুমির পুনর্জন্ম ঘটে, বিশ্বের বহুল পঠিত কবিতে পরিণত হন রুমি। আমার যতদূর জানা, বার্কস ফারসি জানেন না। তবুও তাঁর পরিবেশনার মধ্যে আছে এমন এক জাদু যা আকৃষ্ট করেছে সারা দুনিয়ার ইংরেজি জানা পাঠককে। বাংলায় নিজের সীমাবদ্ধতা নিয়েও এই কাজটিই আমি করার চেষ্টা করেছি। বাংলায় পাঠক আমার অনুবাদের চেয়ে বরং রুমির নাম দেখে বইটি বেশি কেনেন। তবুও এর মাধ্যমে স্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রতি রুমির প্রেম যদি বাঙালি পাঠকের মধ্যে অনুরণিত হয় তাহলেই এ-অনুবাদ সার্থক। এ-তর্জমা যদি আরও যোগ্য লোককে রুমি-তর্জমায় প্রাণিত করে থাকে তাহলেও এ-অনুবাদ সার্থক। বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর ও কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর মতো বিদগ্ধজন যখন রুমি অনুবাদ করেছেন তখন মনে হয়, এ-অভাজনের তর্জমা একেবারে ব্যর্থ হয় নি।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

এ্যাডঃমনিরুল ইসলাম মনু on গুচ্ছ কবিতা : বেনজীন খান
পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা