মুহম্মদ আবদুল বাতেন
বায়োসেন্ট্রিক বিশ্বচেতনা একুশ শতকের বিজ্ঞান ও দর্শনকেন্দ্রিক ভাববিশ্ব। আমাদের লোক সংস্কৃতির ভেতর আগে থেকে এর অন্তর্গত দর্শন চেতনা বিদ্যমান ছিল। বাংলাদেশের লোক সংস্কৃতি, লোক দর্শন ও সাহিত্যের ক্রমবিকাশের মধ্যে মানবিক বোধ, আধ্যাত্মচেতনা, প্রকৃতি প্রেম ও মরমীভাবের মধ্যে ওই চেতনা নিহিত রয়েছে। একটি সংমিশ্রণ ও সমন্বয় তত্ত্বের মধ্যে এর বিকাশ ঘটেছিল। যাকে বলা হয়, সর্বপ্রাণবাদ (Animism) । এর তাৎপর্য হলো মানুষ প্রাণময় ও সংবেদী, সেই অর্থে বস্তুবিশ্বের সব বস্তু সমগ্রকে জীবন্ত ও চেতন বলে ধারণ করা। লাতিন animus থেকে Animism এসেছে , যার অর্থ দাঁড়ায় soul, life। সুফী দর্শনে বিশ্বপ্রেমের বাণী মৌলিক ধারণা সর্বপ্রাণবাদে নিহিত রয়েছে।
আমরা কিভাবে মহাজাগতিক বোধকে ধারণ করবো এবং নিজেদের এসবের অংশ হিসাবে অনুভব করতে সক্ষম হবো? কিভাবে অনুভব করবো সর্বপ্রাণবাদ? এজন্য বস্তুর গঠন বিধি ও প্রমাণিত তত্ত্বসমূহ বোঝা প্রয়োজন। যেমন বিদ্যুৎ ছাড়া আমাদের চলে না- কিন্তু আমাদের জানা দরকার এই শক্তিটি আসলে কী? এ বিষয়ে আমাদের জ্ঞান হবে নগদ প্রাপ্তির মতো- এরফলে আরো অনেক বিষয় সহজেই বুঝতে পারবো। আমাদের অর্জিত এসব ধারণাসমূহ আমাদের চিন্তা ও মননে ‘জগত সম্পর্কিত ভিন্ন ধারণা গড়ে তুলবে যা আমরা সাধারণভাবে কখনোই প্রত্যক্ষ করি না। আমাদের না দেখার জগত এত বিশাল- যে আমরা ওই জগত সম্পর্কে চিন্তা কিংবা কল্পনা করারও সুযোগ পাই না। কান্টীয় জ্ঞানতত্ত্বে ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয় বহির্ভূত জগত এ কারণে আলাদা। ইন্দ্রিয় বহিঃর্ভূত জগতের অনুভূতি স্পন্দিত হওয়ার মাধ্যমে পরম বাস্তবের অনুভূতি অর্জন করি। আমরা কখনো ‘আত্মা’ বলে যে সত্তাকে বুঝাতে চাই সেটি হলো অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত জুড়ে সমভাবে বিরাজমান একটি একক অবস্থা। সেটি আমাদের সৃজন স্ফুরণ ঘটায়। এক পেয়ালা পানিতে যেমন আকাশের সূর্য প্রতিফলিত হয়, তখন বিশাল সেই নক্ষত্রকে ওই পেয়ালায় দেখতে পাই। এর অর্থ এই নয় যে, সূর্যকে এনে ওই পেয়ালায় রাখা যাবে। আত্মা হলো সেই প্রতিফলক, যার সম্পর্ক অসীম এক জগতের সঙ্গে। আমরা জানি পরমাণু অতি ক্ষুদ্র, অথচ সেই সূক্ষ্মতর জগতেও অসীম শূন্যতা, সেখানে নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরছে ইলেকট্রন, যা নিজ আয়তনের অন্তত ১০ হাজার গুণ দূরত্ব বজায় রেখে ঘুরছে। এই রহস্যময় অথচ বাস্তব পর্যবেক্ষণযোগ্য সত্যটি জানতে মানব সভ্যতাকে দুই হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমরা যে পরম বিশ্বজগতের কল্পনা করি, সে বিষয় আমাদের যে অধিবিদ্যার ভাবনা, তা আর অসংগত মনে হয় না। কেননা এখনো আমরা জানি না যে, ‘আমরা কী জানি না’। এখনো আমরা কল্পনা করতে পারি না, ‘যা কল্পনার অতীত’। যদিও আমরা আমাদের জানার বাইরের বিষয় নাকোচ করে দেই, যদিও আমরা জানি না কী বিষয় আমরা নাকোচ করছি। চোখের দৃষ্টিশক্তি ইলেকট্রনের অস্তিত্ব ধরা পড়ে না। যদি বলি আরো সূক্ষ্ম পার্টিকেল যা কখনোই পরীক্ষণ ছাড়া গবেষণাগার ছাড়া দেখা যাবে না- আমরা কী তাও নাকোচ করে দেব। বিজ্ঞান তা করে না বলেই আরো গভীরতর রহস্য উন্মোচন করতে চায়। ধর্ম কিংবা দর্শনের এ ক্ষেত্রে বিরোধের কিছু নেই। এসব সৃষ্টি কৌশল ও রহস্য জানা কেবল বস্তুকেই জানা নয়, নিজেকেও জানা যে, আমি তাহলে কে? আমিই কী এসবের পর্যবেক্ষক? স্টিফেন হকিংয়ের মতো আমাদেরও সেই একই জিজ্ঞাসা- ‘কাঁচের জারে আবদ্ধ আমরাও কোন গোল্ডফিস কী-না?’
একুশ শতকের বিজ্ঞানের গতিমুখের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে দর্শন, ভাষাদর্শন, ধর্মতত্ত্ব, আধ্যাত্মিকতা- এমনকি মানুষের মন যারা ভাবে, চিন্তা করে এবং সৃষ্টি করে নতুন কল্পলোক। আমাদের ভাবনায় মূল প্রক্ষেপ হওয়া উচিত ভবিষ্যৎ, আগামী পৃথিবী, মানুষ, মন, প্রকৃতি। আমরা অতীতের পরিবর্তনের বিষয় যেমন সকলেই বুঝতে পারি, যে কারণে প্রতিটি মানুষ পরিণত বয়সে নিজের শৈশব, কৈশোর কল্পনা করে, রোমন্থন করে- পরিবর্তন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আগামী শতকের মানুষের কাছে চিন্তা, মনন ও সৃজনের মূল্য কী দাঁড়াবে এর একটি অনুমিত হিসাব থাকা প্রয়োজন- যা আমাদের চিন্তা ও সৃজনের গতিমুখ নির্দেশ করবে। খাবার যখন পর্যাপ্ত হয়, তখন অপচয়ও ঘটে, খাবারের যখন অভাব দেখা যায়, তখন উচ্ছিষ্টও তুলে নেয়া হয়, সময় যতো দ্রুত পরিবর্তন হয়, ইতিহাসের ঘটনাবলীও ততোটাই বেশি মাত্রায় চাপা পড়ে। পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছানো এবং বিমানে পৌঁছানো এক নয়, এতে সময়ের ছয়মাস- ব্যবধান ছয় ঘণ্টার সমতুল্য হয়ে যায়। সবেমাত্র ন্যানো কারিগরি বিদ্যার জগতে প্রবেশ করেছে মানব সভ্যতা- যদিও এখন বিজ্ঞানের দৃষ্টি আরো গভীরে- সিঙ্গুলারিটিতে, লক্ষ্য প্রকৃতির চারটি বলের মিলন মুহূর্তের দিকে। পৃথিবীতে চাঁদের আলোয় আমরা মুগ্ধ হই, অজ্ঞেয় আনন্দে উদ্বেলিত হই, কিন্তু এখন জানি, জগতে আমরা যে চাঁদকে একক ভেবে আপন করে নিয়েছি, কেবল সেটিই নয়, এমন কোটি চাঁদের কল্পনা করলেও তা মিথ্যা হবে না। এ কারণে মনের কল্পনার স্তর নিজস্ব সৌরলোক ছাড়িয়ে যায় মহাবিশ্বের দিকে। কল্পনা ও সৃজনের উৎস যে প্রকৃতি, আজ তা অসীম বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত। আমরা যতো ক্ষুদ্রকেই ধারণ করি তা বৃহতের অংশ। তাই প্রেমের অনুভূতি কাক্সিক্ষত বস্তুর বাস্তব সীমা ছাড়িয়ে যায়; কবিতার আশ্রয় নিয়ে বর্ণাঢ্য বর্ণনা করা যায়, কিন্তু অনুভব প্রকাশ সম্পূর্ণ হয় না। মনের জানালা অসীমের দিকে, তাই প্রতীক বস্তু ভেদ করে দৃষ্টি চলে যায় অসীমের দিকে। মন বদলে গেলে দৃষ্টি বদলায়, বয়স বেড়ে যেতে যেতে কোষ ক্ষয় হয়, দেহকোষের পারমাণবিক জগতে জৈব রাসায়নিক সক্রিয়তা কমে যায়, অভ্যন্তরীণ এই পরিবর্তন দেখা যায় না, যদিও এক মুহূর্তের জন্যেও এই পরিবর্তন থেমে থাকে না।
॥ এ্যানিমিজম ॥
সৃজনশীলতা সর্বকালেই যুক্তির সীমার বাইরে থাকে। যুক্তির সীমা যতোই বাড়বে সৃজন চিন্তার জগত ততোটাই সম্প্রসারিত হবে। এটি মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ তত্ত্বের মতো। চেনা জগতের সীমা যতো বাড়বে অচেনা জগতের সীমাও ততো সম্প্রসারিত হবে। যখন অভিকর্ষ বল সম্পর্কে জানা ছিল না, তখন এটাও জানা ছিল না যে, আপেল কেন গাছ থেকে নিচের দিকে পড়ে। তেমন আইস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব ছাড়া- এখন এই দৃশ্যমান জগতকে বোঝা যাবে না। জ্যোতির্বিজ্ঞান, কোয়ান্টাম তত্ত্ব, ন্যানো প্রযুক্তি, জিন গবেষণা, নিউরো সায়েন্স- এসব একুশ শতকের একটি যৌক্তিক জগত তৈরি করবে- জীবন ও মহাবিশ্বের ধারণার একটি নতুন বিশ্ববোধ গড়ে তুলবে; যেখানে জড় ও জীবের ভেতর অভিন্ন সম্পর্ক সূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে। একটি দেহকোষ ও এই মহাবিশ্ব সমতুল্য হয়ে উঠবে।
সর্বপ্রাণবাদের (Animism) প্রথম সূত্রায়ন করেন স্যার এডওয়ার্ড টেইলর। ১৮৭১ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘Primitive culture’ গ্রন্থে এ্যানিমিজম সম্পর্কে বলেন, ‘The general doctrine of souls and other spiritual beings in general’ । এই সর্বপ্রাণবাদ সুফী দর্শনের ধারণা। প্রাচ্যের ভাবজগতে এই বোধ বহু আগে থেকেই ধর্ম, লোকজীবন ও মরমী চেতনায় বিদ্যমান রয়েছে। এই সর্বপ্রাণবাদে পরবর্তীকালে বিজ্ঞানের যুক্তি ও গবেষণায় গ্রহণযোগ্যতা পায়; যদিও এই ধারণা ধর্মীয় দিক থেকে অসঙ্গত নয়। ধর্ম সব সৃষ্টিকে ¯ শ্রষ্টার অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করায় সর্বপ্রাণবাদ সাহিত্যেতত্ত্ব আকারে না আসলেও অন্যতম প্রভাবক হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে। একুশ শতকের ভাব পরিমন্ডলে নতুন বিজ্ঞান দর্শনে প্রাণকেন্দ্রিক এক মহাবিশ্বের ধারণা বিকশিত হচ্ছে। এ বিষয়টি সামনে এনে আমেরিকান নিউরো বিজ্ঞানী রবার্ট লানজা বায়োসেন্ট্রিক মহাবিশ্বের প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
রবার্ট লানজা ২০০৭ সালে এক নিবন্ধে (The American scholar) ‘বায়োসেন্ট্রিজম’ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। দুই বছর পরে তিনি অ্যাস্ট্রোনমার ও লেখক বব বারম্যানের সম্পাদনায় তাঁর Biocentrism : ‘Hwo life and consciousness are the keys to uuunderstanding the true Nature of the Universe’ বইয়ে বায়োসেন্ট্রিক ধারণা ব্যাখ্যা করেন।
॥ সত্য কেবল একটিই হতে পারে ॥
রবার্ট লানজা বায়োসেন্ট্রিক ধারণা পেয়েছেন, দেকার্ত, কান্ট, লেবনিজ, বার্কলি, শোপেনহাওয়ার ও বার্গসন থেকে। তিনি মনে করেন স্থান ও কাল প্রাণের সচেতনতার মূল কারণ। তিনি হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি (Uncertainty principle) সহ বিজ্ঞানের অনেক রহস্য ও জিজ্ঞাসা বায়োসেন্ট্রিক ধারণায় সম্পৃক্ত করেন।
রেনে দেকার্ত ‘ডিসকোর্স অন মেথড অ্যান্ড মেডিটেশনস অন ফাস্ট ফিলোসপি’তে ধর্মতত্ত্বের প্রতি তার শ্রদ্ধা বজায় রেখেই বলেছেন- এতে যে রহস্যের অজ্ঞেয় জগত উন্মোচন, এটিকে যুক্তিবোধের দুর্বলতার কাছে সমর্পণ সমীচীন নয়। তিনি বলেছেন, আমি দর্শন সম্পর্কে তেমন কিছুই বলতে চাই না- শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে জ্ঞানীজনের সৃষ্টি-তর্কও সন্দেহযুক্ত। কেননা এসব মতের মধ্যে একটির বেশি ‘সত্য’ হতে পারে না।’
I was not at all so presumptuous as to hope to fare aû better there thean the others; and that, considering hwo maû opinions there can be about the very same matter that are held by learned people without there ever being the possibility of more than one opinion being true, I deemed everything that was merely probable to be well-nigh false.
(Rene Descartes, Discourse on method and Meditations on Firsh philosophy. Page-9)
পরবর্তীতে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও সেটি অনুসন্ধানের একটি গতিমুখ হয়ে দাঁড়ায়।
আইনস্টাইনের ইউনিফাইড ফিল্ড থিউরির সাফল্য পেতে বিজ্ঞানীরা পদার্থ বিজ্ঞানে সকল তত্ত্ব একত্রীকরণে নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। রবার্ট লানজা ও লেখক বব বারম্যান বায়োসেন্ট্রিজমকে এরই সম্পুরক একটি অভিন্ন উপায় হিসাবে উপস্থাপন করেন। একুশ শতকের বিজ্ঞানের অগ্রগতি বিশ শতকের অর্জনকে এতটাই ডিঙ্গিয়ে যাবে যে, সেটি অভিনব ও বিস্ময়কর। এরফলে মানুষের জাগতিক চিন্তা ও মানসলোক বদলে যাবে। রহস্যভেদী এ বিজ্ঞান পরম ক্ষুদ্রজগত এবং মহাবিশ্বকে অভিন্ন সম্পর্ক সূত্রে আবদ্ধ হিসেবেই দেখতে পাবে।
মানবদেহের রক্তে লোহা কিংবা পটাশিয়াম যা অনিবার্য উপাদান সেটি তৈরি হয়েছিল আমাদের সূর্যের পূর্ব উত্তরাধিকার কোন সুপার নোভা বিস্ফোরণে। অর্থাৎ আমার সৃষ্টির জন্য যে উপাদান সমূহ তা সৃষ্টিতে মহাবিশ্বের আদি থেকে ক্রমবিকাশের ঘটনাবলী অপরিহার্য ছিল। সর্বক্ষেত্রেই আমাদের ভেতরে ও বাইরে টিকে থাকার জন্য এই মহা জাগতিক প্রেক্ষাপট ও প্রতিবেশ অপরিহার্য। প্রাকৃতিক চারটি বলের মিথষ্ক্রিয়া ছাড়া পরমাণুর অস্তিত্ব সম্ভব নয়। সেটি না হলে কোন বস্তুর গঠন সম্ভব নয়। জগতের সমস্ত বস্তুসমূহ এবং এই মানবজগত এসবের মূল উপাদান পরমাণু। মানুষের সঙ্গে জগতে এই অভিন্ন সম্পর্ক প্রত্যক্ষ অনুধাবনে সকল সৃষ্ট বস্তু গঠনে পরম ও অভিন্ন নীতির প্রতিফলন ঘটছে। কোয়ান্টাম জগতের কার্যবিধি জানার আগে মানুষের কাছে এ ধারণা ছিল কল্পনারও অতীত।
আমার চেতনার জগত কী কেবল আমার জ্ঞানগত ও দৃশ্যমান সীমায় আবদ্ধ? আমরা যখন ভাবি কিংবা কল্পনা কিংবা চিন্তা করি তখন আমরা দেশকালের সীমা পেরিয়ে যাই কীনা সেটা আমরা যাচাই করে দেখলে বুঝতে পারবো যে, আমরা এমন সব ভাবনা ও কল্পনার জগত ভ্রমণ করি; সেটি বাস্তবে প্রত্যক্ষণযোগ্য নয়। আমরা সকলেই হাজার মাইল দূরের কোন দেখা দৃশ্য কল্পনা চোখের সামনে টেনে আনি, আবার কখনো যে জনপদ কখনো দেখিনি, সেটির একটি কাল্পনিক অবয়ব গড়ে তুলি। স্বপ্নে আমরা যা প্রত্যক্ষ করি, ওই অবস্থায় সেইটিই বাস্তব প্রতীয়মান হচ্ছে। যদিও ঘুম ভেঙে গেলে সেটি বাস্তব মনে হয় না। আমরা কী এমন একটি দেশকাল কল্পনা করতে পারি? যেখানে আমাদের উপস্থিতি এই বর্তমানকেও স্বপ্ন হিসাবে প্রতীয়মান হবে। কান্টের ইন্দ্রিয় বহির্ভূত যে জগত, সেটি কী কেবল দার্শনিক অনুধাবন নাকি জগতের দেশকালের পরিবর্তন- সেটি এখন বিজ্ঞানের পরীক্ষণ বিষয়।
গাণিতিক সম্ভাব্যতাকে আমরা প্রমাণিত হিসেবে ধরে নেই। কল্পনা ছাড়া বিজ্ঞান এগোতে পারে না; সাহিত্য ও চিত্রকলার এটি প্রধান অবলম্বন। বিজ্ঞান, সাহিত্য ও দর্শন এবং ধর্মতত্ত্ব এসবেই লক্ষ্য হচ্ছে প্রকৃত সত্যকে উদঘাটনের নিরলস প্রয়াস। জীবন ও জগতের রহস্য ভাবনা যদি না থাকতো তাহলে কোন সৃষ্টির অপরিহার্যতা থাকতো না। জড় ও জীবনের মধ্যে সচেতনতা যে ব্যবধান তৈরি করেছে সেটি আবার সীমাবদ্ধতাও তৈরি করছে। এজন্য আমি আমার আদি উপাদানকে দেখতে পারছি না। আমি ভাবছি, কিন্তু কে কিভাবে আমার ভাবনার রসায়ন তৈরি করছে সে কার্যপ্রণালী থাকছে অগোচরে। বিশ্বতত্ত্বের ক্ষেত্রে যে পরম ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বের অনিবার্য উপস্থিতির ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা, আমাদের একটি দেহকোষ তৈরিতে সেই ভাবনার সন্নিবেশ ঘটেছে। একুশ শতকের সাহিত্য, শিল্প, দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব এ বিষয় প্রায় নিকটবর্তী ধারণা কিংবা অভিব্যক্তি তুলে ধরছে। আমরা সাধারণত অতীতকে অধিকতর, বলা যায় একমাত্র চিন্তার বিষয় হিসেবে হাজির করি। আমরা ভাবিনা ষাট কিংবা একশ’ বছর পরের মানুষের ভাবনা কি হতে পারে; সেটিও কল্পনার কিংবা বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। এতে আমরা নতুন বিশ্বপট দেখতে পাবো। বায়োসেন্ট্রিজম চেতনার সেই দরোজা, যা দিয়ে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে তাকানো যায়।
আমরা যে জীবনকাল বেঁচে থাকি, কেবল সেটিই কী অস্তিত্বের সীমা? যে উপাদানের সংশ্লেষণে জীবন গঠিত হয়েছে সেই উপাদান অবিনশ্বর নয়? আমার উপাদানসমূহের ক্ষয় নেই, ধ্বংস নেই, আছে কেবল রূপান্তর। তাহলে কী আমার রূপান্তরিত অস্তিত্ব রয়েছে। রবার্ট লানজা বলেছেন, না মৃত্যুই আমাদের শেষ নয়; জন্মের আগেও কী আমার আদি উপাদানসমূহ কোন না কোন অবস্থায় বিরাজিত ছিল না? একই সমুদ্রের পানি কখনো বাতাসে, কখনো পুকুরে, কখনো নদীতে। আমাদের অস্তিত্ব সেভাবেই বিভিন্ন অবস্থায় বিরাজিত ছিল! প্রাচ্যের চিরায়ত দর্শন ও ধর্মতত্ত্বে- এই অভিন্নতা ও পরম ঐক্যের কথা রয়েছে। সুফীদের কাছে ওই পরম ঐক্যের হেতু হলো পরমাত্মা। পানি যখন গড়িয়ে সমুদ্রে পতিত হয়; তখন সেটিও সমুদ্রের অংশ। অতএব এইজগত সেই পরম সত্য ভিন্ন কিছু নয়; আমি কে? এ প্রশ্নের উত্তরে ‘আমি’ হলাম সেই যা আগেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে- তবে এই ‘আমি’ থাকবো না।
রবার্ট লানজা যে মৃত্যুহীনতার কথা বলেছেন, সেটি বিজ্ঞানের যুক্তিতে, কিন্তু এর দার্শনিক যুক্তি তিনি নিয়েছিলেন দেকার্তের কাছ থেকে।
I have always thought that two issues namely, God and the soul are chief among those that ought to be demonstrated with the aid of philosophy rather than theology. For although it suffices for us believers to believe by faith that the human soul does not die with the body and that God exists, certainly no unbelievers seem capable of being persuaded of aû religion or even of almost aû moral virtue, until these to are first proven to them by natural reason.
( Meditations on First philosophy, Rene- Descartes)
রবার্ট লানজা প্রস্তাবিত বায়োসেন্ট্রিজম গ্রীক বায়োস (bios) অর্থাৎ জীবন (life) এবং কেনট্রন (kentron) বা কেন্দ্রিক (center) শব্দদ্বয়ের সমন্বয়ে গঠিত। এ থেকে বায়োসেন্ট্রিক ইউনিভার্স, বায়োসেন্ট্রিজম এবং বায়োসেন্ট্রিক বিশ্ব ভাবনা বিকশিত হয়েছে। সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ধর্মতত্ত্ব প্রাণও মহাবিশ্ব কেন্দ্রিক ধারণার জগতে প্রবেশ করেছে। মহাবিশ্বে প্রাণ ও অতি পারমাণবিক জগতের বিধিসমূহ উন্মোচিত হওয়ার যে অগ্রসরমানতা সেটিই পৃথিবীর মানুষের সামনে একটি নতুন চিন্তা জগতের উন্মেষ ঘটিয়েছে। বিশ শতকের সাহিত্যে প্রাধান্য পেয়েছে রাজনীতি, সমাজ বাস্তবতা, অবক্ষয়, দ্বন্দ্ব, অনিশ্চয়তা, যৌনতা এবং এ সবের ভেতর দিয়ে আন্তর্জাতিকতাবোধ গড়ে তোলার চেষ্টা। রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তির মধ্যে সংঘাত, সংশয় এবং মানবীয় বাসনার বর্ণনামূলক ভাষিক প্রতিচিত্রই এর মুখ্য অনুধ্যান। বিশ শতকের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, জ্যোতিবিদ্যার বিশাল অগ্রগতি, প্রযুক্তির অকল্পনীয় নবায়ন ভেতরে ও বাহিরে মানুষের মনের ভেতর যে পরিবর্তন এনেছে, সেটির প্রকাশ পেতে শুরু করে একুশ শতকের যাত্রারম্ভে। নিজের অজান্তেই মানুষ শেকড় সন্ধানে নেমেছে, নতুন জিজ্ঞাসা সৃষ্টি হয়েছে, ভাবতে শুরু করেছে নতুন করে। চাঁদ যে কেবল রুটির উপমাই নয়, তার বাস্তব অস্তিত্ব সম্পর্কে এখন সবারই ধারণা আছে, যা গত শতকের সাধারণ মানুষের কাছেও ছিল কল্পনার বস্তু। আমাদের দৃষ্টি অতলান্তের দিকে মনোজগতে, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা, ভাষা ও সচেতনতার জগত সম্পর্কে বিস্ময়বোধ জাগ্রত হয়েছে। পৃথিবীর পরিবেশ সম্পর্কে, জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে আমাদের এই ধারণা হয়েছে যে, কেবল এককভাবে মানুষ টিকে থাকতে পারবে না- গোটা পৃথিবীর পরিবেশ-আমাদের বেঁচে থাকার অনিবার্য শর্ত। কেবল তাই নয়, আমরা যে পৃথিবীতে বাস করি সেটি একক বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। পৃথিবীর অস্তিত্ব মহাবিশ্বের নিয়মের সাথে যুক্ত। এ প্রতিসাম্যের বিভ্রাট এ গ্রহের অস্তিত্বের অবসান ঘটাতে পারে। সৌর কেন্দ্রিক পৃথিবীর ভাগ্য নির্ভর করে সূর্যের গতি প্রকৃতির ওপর। সূর্যের গতি প্রকৃতি নির্ভর করে মিল্কিওয়ের ওপর। মানুষ ও মহাবিশ্ব অভিন্ন সম্পর্কযুক্ত। মানুষ যদি প্রকৃতি উৎস সন্ধানে নামে তাহলে বিশ্বের রাষ্ট্রিক কাঠামোর দ্বন্দ্ব, সংঘাত, লড়াই, গৌণ হয়ে যায়। মানব সভ্যতা হাজার বছর ধরে কেবল যুদ্ধ, শোষণ ও আত্মহননের পারস্পরিক লড়াইয়ে নিরব থাকবে? না কি গোটা পৃথিবীর মানুষ একটি বিশ্ব পরিবারে পরিণত হবে, সেই ভাবনার বৈজ্ঞানিক অবলোকন রয়েছে বায়োসেন্ট্রিজমে। কিন্তু এই ভাবনাটি কেবল বিজ্ঞানেরই নয়, বিজ্ঞানের প্রস্তাবিত বর্তমান এই বিশ্ব ভাবনার নানা উপকরণ আগেই সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনে উপস্থাপিত হয়েছে। মানুষের চেতনার জগতে রয়েছে মহাবিজ্ঞানের আধান, তাই কল্পনার, অধিবিদ্যাগত ভাবনায়, ধ্যানে, অন্তরদৃষ্টিতে, সুফীদর্শনের মর্মে মানব ও মহাবিশ্বের অখন্ড অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে। সেই কল্পনার পথ ধরেই বিজ্ঞান অগ্রসর হয়, কেননা বিজ্ঞান সত্যকে প্রমাণযোগ্য করে তুলতে চায়- এ কাজে বিজ্ঞান যতো অগ্রসর হয়, কল্পনা ও রহস্যের পরিধি ততোটাই বাড়তে থাকে। অষ্টাদশ শতকে জ্ঞানতত্ত্ব শাখায় বিভাজিত হওয়ায় আমরা অসম্পূর্ণতার মধ্যে হেঁটেছি। পরস্পর বিরোধী দার্শনিক তত্ত্বের মুখোমুখি হয়েছি। তাই সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন কিংবা ধর্মতত্ত্ব পরস্পরকে নাকচ করে নয়, এসব শাখার গ্রহণযোগ্য উপাদানসমূহকে ব্যবহার করে একটি অভিন্ন লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রয়াসে নিবিষ্ট রয়েছে। আমরা যদি সকলেই সত্যের অনুসন্ধান করতে চাই তাহলে মতবাদের দ্বন্দ্ব ও বিরোধকে পেছনে রাখতে হবে, আমাদের চিন্তার গতিপথ হবে ভবিষ্যত। আমরা জগত সম্পর্কে কোন আশানুরূপ ধারণা না নিয়েই জীবনকালের সীমা পাড় করতে পারি, কিন্তু আমি জানবো না আমি কে? আমার গন্তব্য কোথায়? আমি অতি পারমাণবিক স্তরে কিংবা স্থানকালের পটভূমিতে ফিরে যাবো? তাহলে এই চেতনারই বা অর্থ কী দাঁড়ায়। আমি জানলাম-আমার জন্ম হয়েছে, আমার মৃত্যু হবে, তাহলে আমার এই জন্মের আবশ্যকতা কী? আমি একখন্ড পাথর কিংবা একটি বালু কণা হয়ে থাকলেই বা ক্ষতি কি ছিল? বিশ্বজগতে মানুষ ভিন্ন অন্যকোন সচেতন প্রাণী কি নেই, যারা আমাদের মতোই চিন্তা করতে পারে–আবেগ-অনুভূতি, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বাসনা ও উদ্ভাবনায় আমাদেরই মতো। মহাবিশ্বের প্রাণের সন্ধান পাওয়া যাবে কীনা, যদি প্রাণের সন্ধান মিলে তাহলে আমাদের ভাবনার স্তরে আবার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটবে কী-না; এসব ভাবনা একুশ শতকের বিজ্ঞানেরই ভাবনা নয়, এসব ভাবনা সকল মানুষের। আমরা যদি একশ’ বছর আগে আমাদের জানার ও সচেতনতার বিষয় অবলোকন করি তাহলে বাস্তব ফারাক আমরা সহজেই দেখতে পাবো। মানুষের ইতিহাস কেবল রাজনৈতিক ইতিহাস নয়, এটি আধ্যাত্মচেতনারও ইতিহাস। অতীত থেকে বর্তমান যে ভিন্ন চেহারা ধারণ করে, অতীত থেকে বর্তমান যে আলাদা হয়ে যাচ্ছে- সে কারণে আমাদের অতীত স্মৃতি আমরা রোমন্থন করি। হারানো অতীত স্মৃতিও কল্পনায় দেখতে পাই। আজ যা বর্তমান, আগামী দিনে তা অতীতের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে, অনাগত সেই ভবিষ্যতের পৃথিবী বর্তমানের মানুষের বাস্তব আস্বাদনের সুযোগ পাবে না, তবে আমরা বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা থেকে অনুমান করতে পারি, তখন জগতের আরো অনেক রহস্য উন্মোচিত হবে। বস্তর গঠন ও প্রকৃতির চারটি বলের মিথষ্ক্রিয়া হয়তো ঐক্যবদ্ধ একটি তত্ত্বে পরিণত হবে। তখনও প্রশ্ন থাকবে, কেন এই শক্তির প্রকাশ ঘটলো। দৃশমান এই বস্তুবিশ্বে মানুষই এখন একমাত্র দর্শক। মানুষের সমস্ত জিজ্ঞাসার জবাব তাকেই খুঁজতে হচ্ছে– রবার্ট লানজা তাই মানবকেন্দ্রিক এই বিশ্ব দৃষ্টিকে ‘বায়োসেন্ট্রিজম’ আখ্যায়িত করেছেন। এই বিশ্বদৃষ্টিকে কেন্দ্রে রেখেই সাহিত্য ও দর্শন ভাবনা নতুন মাত্রা পেতে যাচ্ছে; যে জ্ঞান শাখাতেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হোক না কেন- তা সৃষ্টি উৎসের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। সাহিত্যে মরমীবাদ, ভাববাদ, রোমান্টিসিজম– বস্তুবাদ সবই এসব প্রশ্নের কাছে প্রপঞ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একুশ শতক এমন এক চিন্তার জগতে প্রবেশ করেছে, যে চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও জানার জগত প্রসারিত হওয়ায় কল্পনার মাত্রাও পরিবর্তিত হবে। এটি আমরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় লক্ষ্য করি সায়েন্স ফিকশনের ক্ষেত্রে। সায়েন্স ফিকশনের ব্যাপকতা এখন পাঠকপ্রিয়তা আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি এবং এ ধরনের ফিকশনের বৈজ্ঞানিক কল্পনা অভিনব, যা গত কয়েক দশক আগে ছিল না। এখন সায়েন্স ফিকশনে বিজ্ঞানের ভবিষ্যত কাল্পনিক প্রস্তাবনা চলে আসছে। মহাজগতে পরিভ্রমণ, ভিন্নগ্রহের কোন বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব লাভ করার কল্পনা- একই সঙ্গে এসেছে নভো পদার্থবিদ্যার তত্ত্বীয় সমীকরণে বাস্তব মহাবিশ্বের কল্পনা। মরমীবাদে যে দেহকেন্দ্রিক কল্পনা সেটি এখন বিজ্ঞানের বাস্তবতায় দেখার সুযোগ হয়েছে। অচিন সত্তা- দেহের মাঝে আছে এসব ধারণা- কোষকলার গঠন, কার্যপ্রণালী ডিএনএ ও জেনোমসিকুয়েন্স থেকে আন্দাজ করতে পারি। একুশ শতকের আধ্যাত্মিক জীবনবোধ এসব রহস্য ও উদ্ভাবনাকে আরো সতেজ ও বলিষ্ঠ করে তুলছে। একুশ শতকের মানবকল্পে আছে প্রবাহমান আধ্যাত্ববাদ ও বিজ্ঞানের বাস্তবতার সমন্বয়। ধ্যানের মাধ্যমে, অবচেতন মনের সাধনায় আমরা এক অসীমের সন্ধান পাই, দেহের ভেতর সেই শক্তি তরঙ্গ জেগে ওঠে, যা অনন্ত এক বিশ্ব প্রকৃতির সঙ্গে অনুরণিত হয়। যুক্তি যে সত্যের নাগাল পায় না, বিজ্ঞান যাকে প্রমাণ্য করে তুলতে পারে না, কল্পনা সেই দুর্গম অবচেতন জগতের ভেতর দিকে এক বিশ্বকে দেখতে পায়। মাধ্যম বদলে গেলে আকার ও রূপ বদলে যায়; মানুষের প্রকাশের ভাষা বদলে যায়, অবচেতনের ভাষা কবিতায় অগোম্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হয়। একুশ শতকের ভাষায় প্রকাশের মাধ্যম হয়ে আসছে সমীকরণ, নতুন পরিভাষা, যেখানে বহুদূরের খোঁজ করতে প্রয়োজন আলোর গতি। কেবল সবুজ চেনা প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রেম কবিতায় প্রথাগত বর্ণিত না হয়ে আজ জৈব রাসায়নিক সংশ্লেষণ আসছে ইনফারেড আলোক তরঙ্গের ভাব বিনিময়। আসছে কোয়ান্টাম জগতের বিরহ ও মিলনের বিমূর্ত পরম আনন্দ। সংগমে ঘটছে পরা-পারণবিক প্রলয়। দূরের কোন সুপার নোভা বিষ্ফোরণের তাপ এসে লাগছে আমাদের দেহের কোয়ান্টাম জগতে। প্রতি মুহূর্তে, অবিরত ক্রিয়াশীল অতি ক্ষুদ্রের জগত আমাদের সচল করে রেখেছে। যদিও আমরা ওই মহা জৈব রাসায়নিক কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করি না। আমরা প্যাথলজিস্টদের কাছে যাই, যে সব পরীক্ষা করি, সেই স্তরে আমাদের সাধারণের জ্ঞান অতি সীমিত। এমনকি বাস্তবে আমরা বিজ্ঞানের যে কল্যাণ ভোগ করি এর তাত্ত্বিক বিষয়গুলো জানি না। আমরা যে বাস্তবে বাস করি, সেই সময়ের দুরুহতাও আমরা ভেদ করতে সক্ষম নই; সে ক্ষেত্রে অবচেতনের ভাষা- যা প্রকাশ করে তার সামান্যই মাত্র আমরা বুঝতে পারি। একুশ শতক ফ্যান্টাসি থেকে সেই বাস্তবতায় ছুটছে, তত্ত্বীয় প্রণালী কল্পনার মাধ্যম হয়ে উঠছে। আমরা হাস্যকর অলীক কল্পনা করছি না– আমরা যে কল্পনা করছি, এর সম্ভাব্যতার গাণিতিক ভিত্তি রয়েছে।
বায়োসেন্ট্রিক এই বিশ্বভাবনা– মহাবিশ্বকেন্দ্রিক এক মানব অস্তিত্বের ধারণা দেয়। রবার্ট লানজা এই মানব অস্তিত্বে বিনাশ মানেন না। তিনি বলেন, অস্তিত্বের কোন মৃত্যু নেই।
লানজা বলেন, ‘ carry space and time around with us Like ‘turtles with shells.’
লানজার মতে, ‘জীবন’ পদার্থ বিজ্ঞানের রীতিতে দুর্ঘটনাজনিত কোন বাই প্রোডাক্ট নয়।
খুব ভালো আলোচনা।