spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদকবিতাদেশপ্রেমের ১০ কবিতা : জাকির আবু জাফর

দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : জাকির আবু জাফর

অন্ধকারের মানচিত্র

ভোরের ঘোমটা খুলে চিনেছিলাম আলোর মুখ
চিনতে চিনতে চিনে গেছি আলোর ছায়া
ছায়া থেকে ছায়ার গোপন এবং
গোপন থেকেই আড়ালের গুপ্ত বিধান
একদিন আড়ালেই দেখি অদৃশ্যের বাজার
অদৃশ্যেই দেখি অন্তহীন সংগুপ্তের লীলা
এসব লীলায় জীবন মৃত্যুর রেখাটি আঁকেন কেউ
আঁকেন আলো ও অন্ধকারের মধ্যবর্তী ইংগিত
এমনি ইংগিতে দিন হয় রাতের নেকাব
রোদ খেয়ে আমার আত্নাটি পরিপুষ্ট খুব
তবুও আত্নার ঝিলিক বিদ্যুতের বুকে
অথচ রোদ ও বিদ্যুৎ এক রেখার নয় কখনো
তাই আমার আত্নার ফলা রোদোর্ধ বিদ্যুৎ সিনায়
সকলেই বলে- সত্যের প্রকাশ নাকি রোদের বিজ্ঞাপন
তবে কি অন্ধকারের কোনো ভাষা নেই!
রাতের মুদ্রণে কেনো তবে ছাপা হয় নক্ষত্রের পাণ্ডলিপি
একদা রোদের ফেরিওয়ালা ছিলাম আমি
উষ্ণতার দম বিলিয়েছি শীতল বুকের দিকে
দেখিয়েছি কেমন কৌশলে হয় রোদের শরবত
কোন কায়দায় দিতে হয় রোদের কস্তূরী
জীবনের ঝোল শুকিয়ে গেলে রোদই
রান্না করে নতুন স্বাদ
যত বিজ্ঞাপন দেই রোদের
কিছু চোখ কেবলই জানতে চায় অন্ধকারের দাম
কেনো? কি আছে অন্ধকারের কাছে?
বলে- সতর ঢাকার পোশাক তো এই একটিই, অন্ধকার
এবং অন্ধকারেই ডুবে যায় মানুষের চোখ
তুমি শুধু রোদের নকশাই আঁকো চিরদিন
অন্ধকারের মানচিত্র নিয়ে ভাবোনি কিছুই!

চিরন্তন

নতুন দিনের উত্থান যদি বোঝো
স্বাধীন জাতির মর্যাদা তবে খোঁজো।
মাটির গন্ধে বুকে লেখো তার নাম
রক্তের চেয়ে আরও বেশি তার দাম।

আরো বেশি তার গৌরব বুঝেছেন
ফাঁসির কাষ্ঠে দাড়িয়ে সূর্যসেন
কিছুতেই যারা মানেননি অধীনতা
সেই মেয়েটিই নাম তার প্রীতিলতা

সাহস জ্বালিয়ে স্মরণীয় কত বীর
ইতিহাস খ্যাত নেসার আলী তিতুমীর।
সংগ্রামী যারা চিনেছে অগ্নিপথ
বাহাদুর এক সেই হাজী শরীয়ত।

মানুষের পথ এখনও রক্তে লাল
কেনো নেই তবু তেমন শাহজালাল
দুঃখ যাতনা এতো অশ্রুর বান
কোথায় খালিদ কোথায় খান জাহান !

সব অচেতন সকলের চোখে ঘুম
আসবে না বুঝি আর শাহ্ মাখদুম।
লুট হয়ে গেছে মানুষের অধিকার
তবু কেনো আর আসে না বখতিয়ার!

হয় তো আঁধার দীর্ঘ একথা ঠিক
সকল আঁধার পৃথিবীতে সাময়িক।
তারেক মুসারা হয় না কখনো শেষ
ঘটবে নতুন সূর্যের উন্মেষ।

কিছু রোদের গল্প

মানুষের চোখে যখন সংহতি এবং
ভালোবাসার রোদ ঠিকরায়
সাধ জাগে – রোদগুলো কুড়িয়ে রাখি বুকের কাছে

কুড়াতে কুড়াতে যখন বৃক্ষের কাছে যাই
দেখি- পাতার শরীর জুড়ে সবুজ রোদের কম্পন
ছায়ার ভেতর নিঃশব্দ শীতল রোদের আরাম
এবং শিশিরের গন্ধের ভেতর রূপালি রোদের চিক!

গোলাপের পাঁজর থেকে ছড়ানো গোলাপী-রোদ ছুঁয়ে ফিরতেই দেখি তোমার ঠোঁটে খলখলে হাসির রোদ
শর্ষের ফসল ভরা হলুদ রোদের বিস্তার এবং
মৌমাছির গুঞ্জণে পবিত্র রোদের সংগীত!

গন্ধ নিতে নিতে বুনোফুলের বন হয়ে ওঠে মন
হেনার ঝোঁপে জোনাকি রোদে বুক ভরাই
চাঁপা কিংবা ছাতিমের চিত্তে সুরভি উজান এবং
কামিনী ঝোঁপের কিনার ঘেঁষা সাদা রোদের বুনন
এভাবে রাতের শহর জুড়ে কালো রোদের লীলা

এই তো আমার ব্যক্তিগত পাঠাগারে রোদ-সমগ্র
এ সমগ্র থেকেই —
অপ্রতিরোধ্য তীব্রতায় উদ্বোধিত সাহসের রোদ
জুলুমের বিরুদ্ধে উত্থিত মুষ্টিবদ্ধ প্রতিবাদী রোদ
শেকল ভাঙার প্রচণ্ড দ্রোহে ছিটানো রক্তের রোদ
এসকল দীপ্ত উষ্ণতা আমার স্বাধীনতার রোদ

তোমরা কি জানো স্বাধীনতার শেষ অর্থ কি
স্বাধীনতার শেষ অর্থ হলো–
মানুষের প্রভুত্ব থেকে মানুষের মুক্তি
সেই মুক্তি-মন্ত্রের মহৎ রোদের দিকে হাঁকিয়ে দাও
মানুষের মিছিল!

দুর্দম

বিবেক এখন গাধার পিঠেই হাটে
শেয়াল সহসা সিংহের গাল চাটে।
হস্তীর চেয়ে পিঁপড়েরা বেশী ভারী
অন্ধ এখন দৃষ্টির ধ্বজাধারী।

মিথ্যে এখন সত্যের চেয়ে দামী
বিদ্বান সব মুর্খের অনুগামী!
প্রাজ্ঞরা চুপ অজ্ঞরা বলে সব
ঘোড়ার ডেরায় বাস করে গর্দভ!

যেখানে থাকার কেউকি সেখানে আছে
ময়ূর পুচ্ছে দাঁড়কাক খুব নাচে
বাইরে নায়ক ভেতরে নিন্ম খল
মানুষের ঘাড়ে মানুষ জগদ্দল!

সকল খেলার শেষ আছে সে তো জানো
হোক জমপেশ জমকালো চমকানো
উড়ে গেলে সব ধৈর্যের সঞ্চয়
তখন সাহস উদ্যাম নির্ভয়।

সূর্যের মুখ খামচায় ঠাঁসা রোষে
সাগরের বুক তুলে আনে এক কোষে!
রক্তের নুন চিবিয়ে চুবিয়ে খায়
পাহাড় বনানী সহজেই টপকায়!

ফিসফিস সেও হয়ে যায় গমগম
দুহাত তখন দুর্মর দুর্দম!
বাঘের চোখের তীব্রতা ছেঁকে আনে
মৃত্যুকে শুধু জীবনের দিকে টানে।

কারা অমানুষ

সাগর কুড়িয়ে কেউ বুকে তোলে মর্যাদার পানি
কেউ শুধু ভোগবাদী মোটাদাগে লোভের কেরানি
খ্যাতির তকমা নিতে কেউ আঁকে চাতুর্যের ছক
আমি চাই ঝলোমলো রাজকীয় আলোর পদক

খাঁটি হলে অন্ধকারে জ্যোতি মাখা খাদহীন তিল
গভীর মনন আর প্রজ্ঞাপূর্ণ মুক্ত চিন্তাশীল
আধুনিক প্রলোভনে হয় না যে একদম কাত
তেমন চোখের দিকে থেকে যাক চির পক্ষপাত

তুমি তো ডোবার জলে আমি শুনি সমুদ্রের গান
বুকের গহনে বাজে মোহগ্রস্ত আশার আজান
আমার দুয়ারে কোনো হতাশার নাম গন্ধ নেই
জানি রাত দীর্ঘ তবু একদিন ভোর আসবেই

স্বপ্নের জল্লাদ কারা সব পথে কারা পাতে ফাঁদ
চিনি সেই জগদ্দল চোরা মুখ মঞ্চের উন্মাদ
কারা ভাঙে কারা গড়ে জেনে যায় মানুষের বুক
সভ্যতার পিঠে কারা বেরহম চালায় চাবুক

প্রতিটি যৌবন মেশে বার্ধক্যের জীর্ণতায় আহা
সাজিয়ে কে দিতে পারো জীবনের অঙ্কের সুরাহা
পৃথিবী পেলেই তবে সব পায় একথা কি ঠিক
জীবন তো আরো বড়ো আরো আরো মৃত্যুর অধিক

সুযোগ পেলেই ওরা মুছে ফেলে সততার হুস
মানুষ হলেই তুমি জেনে যাবে কারা অমানুষ

পায়ের নীচেই দেখো

মেরুদণ্ড বোঝো নাকি! কাকে বলে! ঋজু হয়ে থাকা
স্বাধীন স্বত্তার দিকে প্রয়োজনে মৃত্যুকে ডাকা!
বুক ফুলে সত্য বিনে তুচ্ছ ভাবো জগতের সব
আঙুলের ডগা থেকে তুলে আনো নদীর উৎসব
অধিকার বুঝে নিতে বীরদর্পে দৃঢ করো হাত
তাদের ঠেকিয়ে দাও যারা সব করে আত্মসাৎ!

সহসা জিজ্ঞাসা জাগে তুমি আমি কে কেমন আছি
আমার হৃদয় ফুলে আবেগের ওড়ে মৌমাছি
তুমি কি তেমন কিছু নাকি শুধু ভোগবাদী ঠক
টিকটক নায়িকা নাকি ডিজিটাল লাইকি নায়ক
নাকি কোনো দলবাজ পরজীবি গোপন শুশুক
চলতি ধারার স্রোতে ভাসমান সুশীল মিথ্যুক!

তরুণ তুর্কিরা যদি বুঝে যায় তোমাদের সার
কালের অক্ষর লিখে বলে দেবে কারা গাদ্দার
কারা ভুল ইতিহাসে, সব ঠেলে কারা থাকে ঠিক
সবাই তাদের চেনে, যারা কিনা খাঁটি মুনাফিক!

অমরত্বে লিখে যাবে দিকজয়ী বীরদের নাম
গোপন ইচ্ছের তোড়ে হবে রোজ মন হ্যান্ডসাম
সুখ হবে পাহাড়িকা মন হবে আগুনের খিমা
বুক থেকে উড়ে যাবে পৃথিবীর নব অরুণিমা

ভাগ্যের নখর যদি আঁচড়ায় ঝরে তাজা খুন
হৃদয়ে হৃদয় ঘষে সহসাই জ্বালাও আগুন
সাহস শুকিয়ে গেলে পাহাড়ের বুকে রাখো মন
পাঁজরে বারুদ রাখো বুকে রাখো ঝাড়া বিস্ফোরণ!

রক্ত চিরকুটে আঁকো সততার খরস্রোতা স্বর
পায়ের নীচেই দেখো শুয়ে আছে তোমার কবর

এমনই আত্মঘাতি

নদীকেই যদি শেকল পরাতে চাও
নদী কি মানবে তাকে!
তরঙ্গ কিগো পকেট বন্দি হয়
বুকে তার দ্রোহ ভাঙনের সুর আঁকে

তুমি কি পড়োনি সাগরের সেই বুক
মোহনা-গ্রন্থখানি
জীবনের সব গভীর গল্প লেখা
জলের গন্ধে চিরদিন সম্মানী

পাহাড়কে তুমি পাহাড়ের কাছে রাখো
মেঘেদের দিকে শূন্যতাটুকু থাক
ফসলের মাঠ ফসলের হয়ে হয়ে
ফুলের গন্ধ হৃদয়ের দিকে যাক

সূর্যের মুখ লুকিয়ে রাখা কি যায়
হৃদয়ে আগুন তাওকি তোমরা বোঝো না
বৃক্ষের শুধু পল্লব চেয়ে দেখো
বুকের ভেতর ছায়াটুকু আর খোঁজো না

আকাশ যখন দেখবে তুমিও যদি
খোলা মাঠে তবে আসো
ঘুলঘুলি বেয়ে নীলান্ত দেখে দেখে
কী করে বলছো উদারতা ভালোবাসো!

তুমি কি দেখোনা পাখিদের খোলা ডানা
সুদূর বিশারী প্রেরণার সেকি সাধ
কে করে হরণ স্বাধীনতা তার বলো
ঝর্ণা কি মানে তার মুখে কোনো বাঁধ

সারাটা পৃথিবী হাতছাড়া তবু তুষ্ট
আহারে অবোধ জাতি
নিজের ছোরায় নিজেদের বুক ফাঁড়ে
এ জাতি আমার এমনই আত্মঘাতি।।

আধুনিক

পুঁজির ঠোঁটেই চঞ্চল সব প্রপাগাণ্ডার ঝুল
ভোগের আড়ালে হারিয়েছে আজ সত্যের আঙ্গুল।
মানবাধিকার গৃহহীন আজ উদম শরীরে হাটে
মাথা গোঁজানোর ঠাঁই নেই তার পৃথিবীর তল্লাটে।

স্বাধীনতা আজ হত যাযাবর বিষণ্ণ তার মন
রাজ-রাজড়ার ছলচাতুরীর জ্বলজ্বলে প্রহসন।
গণতন্ত্রের ভাউচার লেখে স্বৈরাচারীর হাত
দখলদারির থোক বরাদ্দে সবকিছু বাজিমাত।

নগদ স্বার্থ ধরিয়ে দিলেই সুশীল হারায় হুস
আভিজাত্যের পোশাকে ফোটান তকোমার জৌলুশ।
চাকচিক্যের নতুন প্রাসাদে ষড়যন্ত্রের ঘের
মানবিক রসে যত রঙ জ্বলে পুরোটাই মিথ্যের।

তোষামোদ এর শিরোপা মেটায় বিশ্বস্তের দায়
বোধ বিশ্বাস ঐতিহ্যও বিক্রির তালিকায়।
সেবক বাহক দানবীর আরো কত প্রশংসা ঢের
অথচ যতটা চাষবাস হয় সবটাই স্বার্থের!
ঘৃণার বাজারে হরদম দেখি হৃদয়ের দাম কম
সত্যের চেয়ে মাসোহারা আর তোষামোদ উত্তম।

সকল বুকেই দহনের শিস পাওয়া না পাওয়ার জ্বালা
তুমি হয়ে যাও এই বুনো পথে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা।
যাও যাও তবে দৃঢতার সাথে যাওয়া যায় যতদূর
চলতি ধারার উঠোন পেরুলে সামনে স্বপ্নপুর।

দরোজায় ঝোলে ভাগ্য নোটিশ তাই তারা পড়ে নিক
তুমি হয়ে ওঠো কালের পথিক আগামীর আধুনিক।

পেয়ে যাবে রোদ্দুর

কোটারী ভুক্ত হয়ে যায় যদি মন
দিতে থাকো যদি খ্যাতির বিজ্ঞাপন
পদ-পদবির তৃষ্ণায় হবে বুঁদ
বেদ বাইবেল কিবা পড়ো তালমুদ
বিশ্বাসে যদি কোরআন থাকে তবু
বিদ্বেষী হলে মুক্তি মিলে না কভু

বুকে থাকে যদি স্বার্থ শিকারী মন
রঙচঙা করো জীবনের জংশন
রমরমা যতো খবরদারীর হাত
সহজ লভ্যে সবকিছু বাজিমাত

তারা কি দেখে না আকাশের খোলা বুক
দেখে না সেই সে, যে কেবল উজবুক
ভাবে না রোদ্র কিংবা ছায়ার দিক
কার বন্ধন ছড়ানো চতুর্দিক

ভেতর বাইরে এক হতে যদি পারো
মনের পৃথিবী বিস্তৃত হবে আরো
মুছে যাবে সব বেনামী ঋণের ভার
দুরন্ত হবে আত্নার অভিসার।

সংশয় ছেড়ে ভাঙো জীবনের জট
শিগগির কেটে যাবে সব সংকট
স্বপ্নের পথে যদি হও বাহাদুর
দুর্গম পথে পেয়ে যাবে রোদ্দুর
সকল দুয়ার রুদ্ধ হলেও হোক
নতুন দরোজা খুলবে ঊর্ধলোক ।

একটি ব্যাগ ও উন্নয়ন গণতন্ত্র

রাজধানীর ধুন্ধুমারী চাকচিক্য ব্যাগে পুরে
একদা ফিরতাম গ্রামে, মায়ের কাছে।
হাতের ব্যাগটি আগ্রহ ভরে টেনে নিতেন মা
বলতেন – এতো ভারী? কি আছে এর ভেতর?
বলতাম খুলেই দেখো!
কৌতুহল জ্বেলে ব্যাগের বুক খুলতেন মা
বলতেন– হ্যা আমার পছন্দের ফ্রুটস তো এনেছিস, ঔষধ আছে, সঙ্গে দরকারী কাপড় চোপড়ও
কিন্তু এসব?
এই বলে তিনি বের করতেন —
রাজপথ তাঁতানো কিছু হরতাল
আগুনঝরা কিছু প্রতিবাদ
এবং জনজীবন রুদ্ধ করা কিছু ধর্মঘট

গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামগুলো নিতে নিতে বলতেন-একদিন অবিচারের ঘের থেকে মুক্ত হবে মানুষের অধিকার
একদিন আমাদের দেশ হবে মুক্ত মানবিক
শাসকেরা দেশের সম্পদ নিজের করে তুলবে না কেউ
তোর কণ্ঠ ফিরে পাবি তুই

যানজটে নাকাল বিমর্ষ কিছু চোখ তুলে বলতেন- আমরাও সভ্য হয়ে উঠবো একদিন
একদিন মানুষ হয়ে উঠবে আবার মানুষ

আশায় চকচকে তার দুটি চোখ যেনো
আমার ভবিষ্যতের সূর্য ফুল
দেখতাম তার কালো চোখ থেকে উড়ে যাচ্ছে
রক্তাক্ত একাত্তরের পাখি
ভ্রু বেয়ে উড়ছে স্বাধীনতার পতাকা
গোটা মুখ যেনো স্বপ্নগন্ধী বাংলাদেশ

এখনো শহর থেকে মাঝে মাঝে ফিরি গ্রামে
নগরাক্রান্ত গ্রামে সেই ঝিম সবুজের আগুন আর নেই
আমার ব্যাগেও থাকে না তেমন কিছুই
না হরতাল, না প্রতিবাদ না প্রতিরোধ আর না সাহসের কোনো উত্তাল মিছিল

থাকে শুধু দুঃস্বপ্ন তাড়িত ধূসর কিছু চোখ
আশা নিরাশায় শংকিত কিছু মুখ
কিছু প্রহসন আর বিশাল উন্নয়ন গণতন্ত্র

চিরতমা বাংলাদেশ

আমিও গাঁয়ের শিরা থেকে বেড়ে ওঠা
লকলকে লতার ফাগুন
রক্তবর্ণ কৃষ্ণচূড়ার উদাত্ত হৃদয় এবং
ঢিবির নিতম্ব থেকে ঝিঁঝিঁর রাগ- সংগীত

আমার নিকুঞ্জে জ্বলে পলাশের ঘোরলাগা রঙ
বনানীর বুকে বুকে তাপহীন শিমুল আগুন
ডুমুর ডালের তলায় সবুজ জলে আমি বৃক্ষের মুখ

আমার বুকের ভেতর ঘাসের সংসার
শরীর জুড়ে করঞ্জার নিকুঞ্জ
চোখের সারাটা জুড়ে শর্ষের পতাকা এবং
হাতের রেখায় ধেয়ে চলা নদীর উজান

আমি বসন্তের ঝোল ঢালি গ্রীষ্মের পেয়ালায়
বৃষ্টির হৃদয় থেকে শীতল স্বভাব তুলে ভরে দেই
শিউলি ও ছাতিমের বুক
কুমারী বাতাস ঢালি ঢাকার জনজটে
দুর্বাঘাস থেকে শিশিরের নকশা তুলে গুঁজে রাখি
রাজপথের সিনার ভেতর
মতিঝিলে রুয়ে দেই এক টুকরো ধানের সবুজ

কাঁঠাল তলার করে নেই ধূসর দোয়েল চত্বর
বাতাবী নেবুর ছায়ায় ভিজিয়ে দেই শাহবাগ মোড়
কবিতার আড্ডা থেকে দীর্ঘ শ্বাস তুলে বুকে রাখি
পাতার সুবাস

ফসলের দীর্ঘ দীর্ঘ মাঠ আমার বাংলা অভিধান
মটর দানার দেহে আমার শব্দের পেলব
সূর্যমুখি পাঁপড়ির খাঁজ আমার বর্ণমালার অ আ
মটরশুঁটির ক্ষেত আমার ভাষার বিতান

শিশিরের ফোটাগুলো মুক্তোময় শব্দ আমার
কুয়াশার ঘোর ঘোর রহস্য কাহিনী
সমগ্র সবুজ আমার প্রেমের উপাখ্যান

পৃথিবীর বুকে বুকে চোখ তুলে দেখো আমি এক
অনস্বর চিরতমা বাংলাদেশ!

বুকে রাখি বাংলাদেশ

বিজয় বিজয় বলে আমিও উত্তাপ আঁকি
সূর্যের বুকের মতোন
আমিও হৃদয় খুলি জ্বলজ্যান্ত রোদের উদ্যানে
পৃথিবীর মুখের কাছে মুখ রেখে বলি
এ আমার চির আনন্দের বাংলাদেশ
এ আমার চির বন্ধনের বাংলাদেশ

যখন আমার চোখের ভেতর অজস্র পাখির চোখ
মনের পাঁজর জুড়ে ঝাঁক ঝাঁক পাখির ডানা
দৃষ্টিজুড়ে আদিগন্ত সবুজ সম্ভ্রান্তি
হৃদয় তখন শর্ষের মাঠের মতো ছড়ানো বাংলাদেশ

অকস্মাৎ দেখি বুকের বিবরে ধুকপুক
বিজয়ের তোপধ্বনি
যেনো বন্দিত্বের দেয়াল ভাঙা থরোথরো মুক্তির কম্পন
নির্যাতিত মানুষের বুক বেয়ে উদ্ধত মুক্তির মিছিল
এবং একাত্তরের সেই উত্তাল ক্ষণের অগ্নিবত স্লোগান

ডুমুর পাতার ফাঁকে চেয়ে থাকা নিভৃত ছায়ার পাশে
ঢেউখেলা ধানের জগৎ
ঘুমঘুম নিঝুমতায় ছিটানো গ্রামগুলির বিনম্র নিভৃতি কোথাও হেলান দেয়া দিগন্তের যেনো নীল হরিণীর পিঠ
এসব গ্রামের ভাঁজে ভাঁজে পাখিগুলো রেখে যায় বিজয়ের গান

জগতের সব ফুল থেকে রঙ তুলে
সাজাই বাংলাদেশ, লিখি বাংলাদেশের নাম
ভোরের তারুণ্যে সে বিস্ময় যুবতী
নববধূ বুঝি ঘোমটা উজিয়ে
ঠোঁটে মাখে রোদের লিপস্টিক
হঠাৎ ভিজিয়ে রাখে টুপটাপ শিশিরের জল
প্রজাপতি মুখ ধুয়ে ফুলে লেখে বিজয় চুম্বন

তোমার চুলের মতো কালো ভোমরের গুঞ্জন
এঁকে হৃদয় যখন পাতার বাঁশি
শালিকের সুরে তখন হৃদয় মুক্তির গান
হৃদয়ের গান হৃদয় ব্যতিত কে আর গায়
আমার হৃদয়ে আজ বাংলাদেশের গান
এবং
বিজয় বিজয় বলে বুকে রাখি বাংলাদেশ

আফসোসের বাজার

তিনিও আধুনিক ঘুষভোজী ডিজিটাল কারিগর অপসম্পদ-ভোগীদের গুপ্ত দোকানী
অকাতর যৌবন খরচকারীরাই তার খদ্দের
মানুষের চোখ থেকে দৃষ্টি তুলে বসাতেন ক্ষমতার জলসা

এখন শরীরে বার্ধক্যের দাঁত কাটে জীর্ণতার রেখা
তিনি আফসোসগুলো জমিয়ে দেখেন-
কীভাবে অঙ্গ থেকে মুছে গেছে যৌবনের রঙ
কোন পথে উড়ে গেলো ক্ষমতার পাখি

ভাবেন- কই সেই তারুণ্যের মখমল দীপ্তি
যে তারুণ্য উদ্দীপ্ত উল্লাসের প্রবল উদগম
যা অকারণ মুহূর্মুহু বাজি রাখার বীজ
এখন শুধুই হতাশন শুধুই দীর্ঘশ্বাসের জ্বর
কটি দীর্ঘশ্বাসে প্রস্তুত হয় জীবনের সমাপ্তি!

মানুষেরা বৃদ্ধ হলে আফসোস বৃক্ষটি উঁচু হয় বেশ!
ডালে ডালে হারানোর বিষাদ মাতম
এই পথে সবই হারায় একদিন
হারিয়েও জীবনকে উর্ধে তোলার পিপাসা
তীব্রতর মানুষের

সময়কে সময়ের কাছে বিক্রির নমুনা অহরহ
যারা ভবিষ্যৎ বিক্রি করে সামান্য ভোগায়োজনে
বিশ্বাস বিক্রিতে তারাই পারঙ্গম

মানুষের দীর্ঘশ্বাসগুলো নিলামে তোলার কেউকি আছেন!

একদিন বসবে আফসোসের অন্তহীন বাজার
সমস্ত কর্মের দাগও সচিত্র হবে সেদিন
প্রকাশ্যতায় জ্বলজ্বল হবে সমস্ত গোপন
চোখ থেকে চোখ, মুখ থেকে মুখ, মা থেকে সন্তান
এবং পুত্র থেকে পিতার পলায়ন কি নির্মম!
সেদিন নিজের হাত চিবিয়ে নিজেই খাবে সহসা
নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বলবে –
হায় আফসোস! হায় আফসোস!

মুখবই

হাতে হাত রেখে বললেন তিনি –
ফের দেখা হবে আমাদের
দেখা হবে মুখবইয়ের মাহফিলে
যেখানে ছবির জলসায় বসে ইচ্ছের আসর
যেখানে নিলাম থাকে চোখকাব্যের আয়না এবং
সামাজিক তরঙ্গে ভাসে হৃদয়-ইজারাদার!

চেনো তো ফেসবুকের অলিগলির মানচিত্র!

ও হ্যা তুমি তো ডিজিটাল যুগের এটর্নি
বিরহের শুনানিতে সহসা পরিয়ে দেবে প্রেমের হিজাব

তবে শোনো হে যুগসন্ধির পথিক –
ফেসবুকের যেমন দল নেই, তেমন তলও নেই
নেই সত্য মিথ্যার সুরক্ষিত কোনো আমানত
নিশ্চিত বৃদ্ধাও রঙচঙা তরুণীর লাবন্যে মুখর
যেমন খুশি তেমন ছবির বিরাট বাজারে
খোলা রেখো চোখ কান
নইলে নিখোঁজ হবে জীবন টার্মিনাল

নেটবন্দি জীবনের গৃহকোণ থেকে
উঁকি দেয় হৃদয় পক্ষের বঁধু
বকেয়া প্রেমের অন্ধ অঙ্গীকারে থাকে
তৃপ্তিহীন প্রশংসার ভুষভুষি
লাইক কমেন্ট এর চাবি খোলে হৃদয়কেন্দ্রের তালা

জানোই তো লুকোচুরির ঝিলমিলে মুখবইয়ের মুদ্রণ
দেখো ফটোপত্রের কোষাগারে শুধু
চার চোখের আলেয়া
যাপনের কিছু মানবিক নিঃসঙ্গতা
মৃতদিনের কিছু নির্জনতা
এবং চোখ ও মন কষাকষির কিছু নগদ স্মৃতি
বাকি সব পারস্পরিক মন রক্ষার চুলকানি

যখন মুখবই জীবনের এক অন্তরিন আদালত
যখন প্রতিটি মন এ আদালতের প্রধান বিচারক
হৃদয়ের শেষ পাতায় তখন কে ছাপে ছবিশিল্পের রায়
এভাবে পছন্দ অপছন্দের ছোরায় যখন কাটা হয়
হৃদয় আপেল
তখন তো অনায়াসে বলা যায় –
মুখবই নিরংকুশ ইচ্ছের বউ
আকাংখার স্বামী
মনের গিন্নী অথবা খ্যাতির হাসবেন্ড

ছবিবোর্ডে ঝরাস্মৃতির বিজ্ঞাপনে শুরু
সুখধন ঘাটতির তামাশা
তারপর ঘুমব্যাংকে নিঃশেষ প্রশান্তির ব্যালান্স
যৌবনের রঙ নিভে গেলে প্রসাধনের রঙ
তাকে কী করে ফেরায়

যখন বোধহীনও বোধের শিক্ষক
যখন হৃদয়হীনও হৃদয়-বণিক
তখন বলতেই হয়-
মুখবই এক উন্নত বিভ্রান্তির মুখোশ
এবং একটি মহতি ছোঁয়াচে উদ্যোগ
একের তৃষ্ণায় জাগে অন্যের পিপাসা

সব ডুবে গেলে ভেসে ওঠে সবুজ বাতির জ্বর!

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ