spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদবই নিয়েতার 'নাচের শব্দ' এখনো শোনা যায়

লিখেছেন : ফয়সাল আহমেদ

তার ‘নাচের শব্দ’ এখনো শোনা যায়

ফয়সাল আহমেদ

কবি সুরাইয়া খানম। প্রয়াণের মাত্র দেড় দশকেই প্রায় বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাওয়া এক মানুষে পরিণত হয়েছেন। আমরা তার কাছে নানাভাবে ঋণী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও রয়েছে তার উজ্জ্বল অংশগ্রহণ। মুক্তিযুদ্ধের সময় সুরাইয়া খানম কমনওয়েলথ স্কলারশিপে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন। এ সময় সেখানেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। দিনের পর দিন বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে জনমত গঠনে কাজ করেছেন। ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক অভ্যুদয়ের পর লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে বাঙালির বিজয় উৎসবে লাল-সবুজের জাতীয় পতাকাটি তিনিই উত্তোলন করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে যেদিন লন্ডনে যান, সুরাইয়া খানম সেদিন ফুলের মালা হাতে ক্ল্যারিজেস হোটেলে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন।

গত দেড় দশকেই হারাতে থাকা দেশপ্রেমিক এই কবি সুরাইয়া খানমকে আমাদের মধ্যে নতুন করে প্রকাশ করলেন গবেষক, সাহিত্যিক ও সম্পাদক ইসরাইল খান। সম্পাদনা করলেন ‘সুরাইয়া খানমের গ্রন্থিতঅগ্রন্থিত কবিতা’ বইটি। বইটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের কিছুটা হলেও ঋণমুক্ত করেছেন। এ সুযোগে সম্পাদক ইসরাইল খানের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখলাম। আমরা কীর্তনখোলা নদীপাড়ের সন্তান কবি সুরাইয়া খানমকে জানতে চাই।

সুরাইয়া খানমের জন্ম ১৩ মে ১৯৪৪, যশোরে। শৈশব কাটে নদীঘেরা বরিশালে। আর তখনই কবিতার যাত্রা শুরু। তার এ কবিতা লেখায় অভিভাবকরা অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তারা তাকে শাসন করেছেন। কিন্তু তিনি দমে যাননি। শৈশবে মনের মধ্যে গেঁথে যাওয়া কবিতার বীজ ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হতে থাকে। পরবর্তীকালে যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ষাটের দশকে। বরিশালেই স্কুলের পাঠ। পরে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক পড়ে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে লন্ডনের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে ফিরে ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। একই সঙ্গে তিনি শামসুন নাহার হলের হাউস টিউটর ছিলেন। এ সময়ে লিখতে থাকেন তখনকার বিখ্যাত সব কাগজে। বিচিত্রা, সন্ধানী, সমকাল, রোববারসহ বিভিন্ন পত্রিকায় তার কবিতা ছাপা হতে থাকে। একই সময়ে তিনি অভিনয় ও মঞ্চে কবিতা পড়ে আলোড়ন তোলেন। তখনকার বাংলাদেশের কবিতার ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য সংগঠন ‘পদাবলী’ ও ‘কবিকণ্ঠে’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। কবিতার মতোই রূপসী ছিলেন সুরাইয়া খানম। তার ‘নাচের শব্দ’ এখনো শোনা যায়। সেই কাব্যগ্রন্থেরই ‘তৃতীয় বিশ্ব’ কবিতাটি—মনে হয় যেন সদ্য লেখা; ‘একটি কালো মানুষের আর্তনাদ/ কেউ শুনল না,/ কেউ জানল না;/ অন্য কালো মানুষের দল/ শিকল গলায় পড়ে ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে এলো!/ একটি কালো মানুষের আর্তনাদ/ কেউ জানল না’

তার প্রতিটি কবিতাই আত্ম ও চরিত্রে স্বতন্ত্র। মানুষ, প্রাণপ্রকৃতি তার কবিতার অংশ। ‘নাচের শব্দ’ কাব্যগন্থের প্রথম কবিতা ‘ভ্রষ্টলগ্নে ম্যানিফেস্টো’। কবিতায় তিনি গাছ, পাথর, দেয়ালকে তার কবিতা শোনার আহ্বান জানাচ্ছেন।

‘সুরাইয়া খানমের গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত কবিতা’তে রয়েছে ১৯৭৬ সালে সন্ধানী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘নাচের শব্দ’ কাব্যগ্রন্থের ৫১টি কবিতা। রয়েছে তার অপ্রকাশিত আরও ৩৩টি কবিতা। কবিতা ছাড়াও যুক্ত হয়েছে কবিকে নিয়ে তিনটি স্মৃতিচারণ, একটি সাক্ষাৎকার, কবির কাব্যভাবনা ও বেশ কিছু দুর্লভ আলোকচিত্র। গুণী সম্পাদক ইসরাইল খান চেষ্টা করেছেন এক মলাটে কবিকে পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরতে।

কবিতা কেন লেখেন? উদ্দেশ্য কী? এমন এক প্রশ্নের জবাবে সুরাইয়া খানম বলেছিলেন, ‘তবু কেন যে কবিতা লিখি? না লিখে পারি না, মাথা ধরে, অসহায় বোধ হয়, দম বন্ধ হয়ে আসে! এটাকে কি Creative Spell বলা যায়? স্বপ্ন না দেখলে, না ঘুমালে মানুষ কি মানসিক সুস্থ থাকে। আমি পাঠকের সঙ্গে কথা বলতে চাই। অবিরত কথা বলতে চাই। মনে করুন পৃথিবীর এক প্রান্তে ছোট্ট একটি শিশু কাঁদছে, কেউ তাকে স্নেহ দিলে সে তো কান্না থামিয়ে ফেলবে, কিন্তু সেটা কি আর সামান্য ধন? সবসময় পাওয়া যায়? যায় না। যখন পাওয়া যায় মনে হয় নিজেকে বড় সুখী। অবশ্য মাঝেমধ্যে পাঠককে ধাক্কা দিয়েও আমি কথা বলি। এটা আমার জিদ। আমার জিদও অনেকে ভালোবাসেন। হৃদয় এবং মেধার সঙ্গে সাধনা মিশ্রিত হলে জিদ বড় শক্তিশালী হয়। ও হ্যাঁ, বাংলা কবিতা লিখি বাংলাদেশের প্রেমে পড়ে, হ্যাঁ আমি আমার শিকড় খুঁজে লিখি কবিতা। বড় দুঃখ, মায়া ও মমতা লেগে আছে আমার কবিতার শরীরে। কখনো মনে হবে বড় যন্ত্রণাকাতর। পাঠক সেটি বুঝলেই খুশি হই। থাকগে, সব পিতামাতার কাছেই তার নিজের শিশুটি বড় প্রিয় থাকে। এটা কোনো কথা নয়।’ [সাক্ষাৎকার গ্রহণ : ইসরাইল খান, মনসিজ, কুমিল্লা ১৯৮০, সম্পাদক : কাপালিক সরকার]

সুরাইয়া খানম ১৯৮২ সালে আবার দেশ ছাড়েন। এবার যান যুক্তরাষ্ট্রে। ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে সেখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে অধিষ্ঠিত হন। তারপর দীর্ঘ প্রবাস জীবন। সে অর্থে আর ফেরা হয়নি তার মাতৃভূমিতে। আজ এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বাংলাদেশের কবিতার ক্ষেত্রে কবি সুরাইয়া খানমের উপস্থিতি ছিল ‘আলোর ঝলকানির মতো’। তার কবিতার কলাকৌশল ছিল স্বতন্ত্র এবং মানবিক। যে কারণে তিনি শুরুতেই কবিতাপ্রেমীদের নজরে পড়েন। তাদের হৃদয়ে সুরাইয়া খানম এখনো আছেন বলেই হয়তো আমরা তার গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত কবিতার সন্ধান নতুন করে পেয়েছি। তিনি কবিতা লিখেছেন হৃদয়ের রক্ত দিয়ে। কবিতা লিখতে না পারলে যার মাথা ধরে, অসহায় বোধ হয়, দম বন্ধ হয়ে আসে। তিনি কবিতাকে কতটা ভালোবাসতেন তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই, তবে তাকে পাঠ করতে হবে নদীর মতোই অবিরল, অবিরত। আলোচ্য গ্রন্থটি সেই পথই নতুন করে উন্মোচিত করে দিল। জার্নিম্যান প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এ বইটির মূল্য ৪৮০ টাকা। 

কৃতজ্ঞতায় : কালবেলা 

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
সাজ্জাদ সাঈফ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on ১০ টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ