আবু রাইহান
রবীন্দ্র-উত্তর বাংলা কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম একজন কালজয়ী কবি। তাঁর জীবনী নিয়ে বর্তমান সময়ে বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি, বিশিষ্ট নজরুল গবেষক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক এবং কথা সাহিত্যিক মজিদ মাহমুদ ‘তুমি শুনিতে চেয়ো না’ নামে একটি অসাধারণ উপন্যাস রচনা করেছেন। এই উপন্যাসে মজিদ মাহমুদ মূলত নজরুল জীবনের দুটি কাল পর্বের ঘটনা প্রবাহকে বিস্তৃতভাবে তুলে ধরেছেন। শৈশব থেকে প্রাক যৌবন পর্যন্ত একটি কাল-পর্ব এবং নির্বাক হয়ে যাওয়া থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অপর কাল-পর্ব। নজরুলকে নিয়ে প্রকাশিত জীবনী গ্রন্থগুলিতে এই দুটি পর্বের খুব বেশি বিবরণ পাওয়া যায় না বলে তিনি এখানে সর্বাধিক আলোকপাত করেছেন। তথ্যর অভাবে জীবনীকাররা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছেন। যদিও বা কিছু বিবরণ পাওয়া যায়, তার মধ্যেও রয়েছে অনেক ফাঁকফোকর অসঙ্গতি। লেখক এই দুটি পর্বের মিসিং লিংকগুলি তথ্য ও মেধাবী গবেষণার মধ্য দিয়ে ভরাট করার চেষ্টা করেছেন। যা পাঠকের কাছে বাস্তবসম্মত বলেই মনে হবে বলেই আমার বিশ্বাস। লেখকের যেহেতু নিজের একটি কবি-জীবন রয়েছে, তার ফলে তাঁর পক্ষে এই মিসিং লিঙ্কগুলোকে জোড়া লাগানো সহজ হয়েছে। মজিদ মাহমুদ নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের জীবন সম্পর্কে আমরা যেভাবে তাঁর শৈশব থেকে জানতে পারি, তার পারিবারিক ইতিহাসের কারণে। কিন্তু নজরুল যখন কবি হয়ে ওঠেননি, ১৯২০ সালের আগে নজরুলের জীবন খুব বিক্ষিপ্তভাবে আমরা জানি। শৈলজানন্দ তাঁর সাথে পড়াশোনা করেছেন, তাঁর লেখা থেকে কিছু কিছু জানতে পারি, কিছু বন্ধু-বান্ধবের বর্ণনা থেকে। আমরা জানি, নজরুল যখন পল্টনে যুদ্ধক্ষেত্রে যান, তাঁর বন্ধু-বান্ধব যা বলেছেন সেসব থেকে জানি। খুব ছোটবেলায় তাঁর বাবা মারা গেছেন, একটি ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম পরিবারের সন্তান। তিনি তখন থেকেই জীবন সংগ্রামের সাথে যুক্ত হচ্ছেন, লেটো গানের দলে যুক্ত হচ্ছেন। তারপর তিনি ময়মনসিংহে চলে আসছেন। আবার শুনি তিনি মাথরুন স্কুল বা নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউটে ভর্তি হচ্ছেন। যেটি চুরুলিয়া থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে। তাহলে এই ঘটনাগুলো কীভাবে ঘটেছে? যাঁর বাবা নেই, পরিবার এতোটা স্বচ্ছল না। আমরা প্রায়শই শুনে থাকে নজরুল একজন বাউন্ডুলে । কিন্তু তথ্য তা বলে না। তাঁর শৈশব বা কিশোর বয়স থেকেই কিছু একটা হওয়ার প্রবল বাসনা ছিল। নজরুল যখন মেট্রিক পরীক্ষা দেবেন বা দশম শ্রেণির ছাত্র। যখন তিনি পল্টনে যাচ্ছেন, এই সময়ে তাঁর যে বয়স তাতে কিন্তু প্রমাণ হয় তিনি কোনো ক্লাস মিস করেননি। প্রত্যেকটি ক্লাসে তিনি পড়েছেন। তাঁর পড়াশোনার মধ্যে সমন্বয় কীভাবে হলো? তা এক আশ্চর্যের ব্যাপার। আমার এই উপন্যাসে তার শৈশব থেকে পল্টন পর্যন্ত ব্যাপকভাবে তুলে ধরেছি। যেখানে যেখানে কোনো তথ্য পাইনি, সেখানে ফিকশনাল সহায়তা নিয়েছি। কিন্তু সেটা লজিক্যাল সিকোয়েন্স হিসেবে এনেছি, ফলে তা বিচ্ছিন্ন হয়নি। আমি কবি নজরুলকে দেখতে চেষ্টা করেছি আমার কবিজীবন কীভাবে গড়ে উঠেছিল- সেটার ভিত্তিতে। আমি দেখিয়েছি পরিবেশ-প্রতিবেশ কীভাবে কবিজীবনকে প্রভাবিত করে। নজরুল যখন চুরুলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ঠিক তার পাশেই জয়দেবের মেলা, তার মতো কবি, চন্ডীদাসের মতো কবি বা কিছুদূর গেলেই রবীন্দ্রনাথের বোলপুর, অর্থাৎ এসবের প্রভাব নজরুল হয়তো ছোটবেলা থেকেই অনুভব করেছেন। অজয় নদীর এপাশে নজরুলের বাড়ি ওপাশে দিলীপ রায় কিংবা সুভাষ বসু ওপারে স্নান করছেন। এসব নজরুলের জীবনে প্ৰভাব ফেলেছে। নজরুলের যখন আট বছর বয়স, তখন ক্ষুদিরামের ফাঁসি হচ্ছে। এই ঘটনা তাঁর মনে প্রবল প্রভাব ফেলেছিলো বলে আমার মনে হয়। তিনি যখন মাথরুন বা নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউটে পড়তেন তখন তাঁর অনেক শিক্ষক সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা নজরুলের কৌতূহল এবং কার্যক্রমের সাথে যুক্ত ছিলেন। নজরুলের মানস গঠনটাই আমি ব্যাপকভাবে লিখেছি। আমি নজরুলের শেষ অংশটা ধরতে চেষ্টা করেছি। নজরুলের যে নীরবতার চৌত্রিশ বছর, ১৯৪২ সালের ৯ জুলাই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন রেডিওতে, তারপর থেকে নজরুলের জীবনে কী ঘটলো, সেগুলো খুব কমই আমাদের নজরুল গবেষণায় এসেছে। আমি ব্যাপকভাবে সেগুলোকে তুলে আনার চেষ্টা করেছি। নজরুলের চিকিৎসা কীভাবে হলো, তাঁর আর্থিক অবস্থা কেমন ছিল, তাঁর সন্তানেরা কীভাবে ছিলেন, ছেলেদের কীভাবে বিয়ে হলো, কখন তারা সংসার করলেন, এসব তথ্য যদি নজরুল গবেষকদের জিজ্ঞেস করেন দেখবেন সেখানে ডার্ক রয়েছে গিয়েছিলো, সেসব এই উপন্যাসে আছে। ছেচল্লিশে যখন মহাদাঙ্গা হলো তখন তাঁর শ্বাশুড়ি গিরিবালা দেবী নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। অনেকেই বলেন নজরুলের শ্বাশুড়ি সংসারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে বৃন্দাবন চলে গেছেন। বরং এটাই স্বাভাবিক যে, গিরিবালা দেবীকে ওই অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ দেখতে পারতেন না, তারা মনে করতেন নজরুলের সাথে মেয়ে বিয়ে দিয়ে তিনি জাতি চ্যুত হয়েছেন। আবার মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষও তাঁকে দেখতে পারতেন না। গিরিবালা দেবীকে আমি পুরো একটা অধ্যায়ে যেভাবে অঙ্কন করেছি সেটা আর কোথাও পাওয়া যাবে না।যে চরিত্রগুলো নজরুলের সাথে যুক্ত হচ্ছেন, তাঁরা কথা থেকে আসছেন সেসব অনুসন্ধান করে করে এগিয়েছি। আর এসব কারণে আমার কাছে অনেক বেশি অজানা তথ্য ধরা পড়েছে। নানান তথ্যের সমন্বয়ে আমার উপন্যাসটি নতুন মাত্রায় প্রকাশিত হবে বলে আমি মনে করি।’
নির্বাক কাল পর্বটি বাংলাদেশের একটি ওয়েব ম্যাগাজিনে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে এবং শৈশবকাল পর্বটি কলকাতার একটি দৈনিকের রবিবারের সাহিত্য পাতায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কলকাতার রবিবারসরীয় দৈনিকে যখন মজিদ মাহমুদের উপন্যাসের শৈশবকাল পর্বটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল নজরুল গবেষক এবং নজরুলের গুণমুগ্ধ পাঠকদের মধ্যে মধ্যে তখন প্রবল উৎসাহ, কৌতুহল,অদ্ভুত এক আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল এবং আবেগ সঞ্চারিত হয়েছিল।নজরুল জীবন ভিত্তিক উপন্যাসটি পুস্তক আকারে প্রকাশিত হওয়ার আগেই কেবল নজরুলের কারণে পাঠক প্রিয়তা লাভ করেতে সমর্থ হয়। এই দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে অসংখ্য নজরুল অনুরাগী পাঠক আমার কাছে বারবার জানতে চেয়েছিলেন, নজরুলের জীবন ভিত্তিক এই ধারাবাহিকটি কবে পুস্তক আকারে প্রকাশিত হবে। নজরুলের মৃত্যুর এত বছর পরেও নজরুলকে নিয়ে মানুষের এই আবেগ ও ভালোবাসা আমাকে আপ্লুত করেছিল। লেখকও চাইছিলেন বইটি তাড়াতাড়ি পাঠকের হাতে তুলে দিতে। কিন্তু এক বছর আগে পান্ডুলিপি প্রস্তুত হয়ে থাকা সত্ত্বেও কিছু সমস্যার কারণে এবছর শেষ পর্যন্ত ঢাকার শীর্ষ প্রকাশনী সংস্থা কথাপ্রকাশ থেকে পুস্তকটি সাড়ম্বরে প্রকাশ পেয়েছে। একুশে বই মেলায় ইতিমধ্যেই বইটি পাঠকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। আমরা কলকাতার পাঠকেরাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি বইটি হাতে পাওয়ার।যেহেতু নজরুলের জীবন ভিত্তিক এই উপন্যাসের একটি পর্ব দৈনিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের ক্ষেত্রে আমি গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম।তাই বইটি নিয়ে আমার গভীর আবেগ জড়িয়ে রয়েছে।নজরুল জীবনভিত্তিক এই মহৎ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি আগাম পড়ার সুবাদে আমি একজন নিমগ্ন নজরুল প্রেমী পাঠক হিসেবে নিশ্চিত,এই উপন্যাস তথা নজরুল জীবনী যা নজরুল গবেষক ও অনুরাগী পাঠকদের উৎসাহিত করবে।অনেক অজানা কৌতূহলের নিরসন ঘটাবে,নতুন নতুন তথ্যর আলোকে নজরুলকে নতুনভাবে জানার সুযোগ করে দেবে।
নজরুল জীবন ভিত্তিক উপন্যাস ‘তুমি শুনিতে চেয়ো না’ উপন্যাসের প্রতিটি পর্ব পড়ে একটি বিষয় নিশ্চিত হওয়া যায় নজরুল জীবন ভিত্তিক উপন্যাস লেখার আগে লেখক মজিদ মাহমুদ নজরুল বিষয়ক প্রায় সমস্ত তথ্যই আত্মস্থ করতে সমর্থ হয়েছেন। অন্যান্য নজরুল গবেষকদের চিন্তায় ফেলে দেওয়ার মতো যথেষ্ট উপাদান রয়েছে নজরুল জীবন ভিত্তিক এই উপন্যাসে। লেখকের লেখার মুন্সিয়ানায় কাহিনীর বুনট এবং ঘটনার ঘনঘটা এতটাই টানটান যে পাঠক বিস্ময়ে অবিভূত না পারবেন না।নজরুলের শৈশব, কৈশোর, যৌবন এবং নির্বাক পর্বের যন্ত্রণাময় কাহিনীগুলি লেখক কাব্যিক ভাষায় যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তাতে বইটি পাঠ করার পর পাঠকের চোখ নিজের অজান্তে অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠবতে বাধ্য।
‘তুমি শুনিতে চেয়ো না’ উপন্যাসের ধারাবাহিক পর্বের সূচনা নজরুলের মৃত্যু দিবসে।এভাবে উপন্যাসের সূচনার কারণ হিসেবে লেখক জানিয়েছেন, ‘বছর দশেক আগে যখন আমি নজরুলকে নিয়ে ভাবছি নানাভাবে, তখন আমার কাছে মনে হলো, একজন মানুষ যিনি লম্বা সময় ধরে অসুস্থ ছিলেন, বঙ্গবন্ধুর আগ্রহে দেশে আসলেন, মারা যাওয়ার পর মসজিদের পাশে কবর দেয়া হলো; যদিও তার একটা গান ছিল ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই’, কিন্তু এটা কোনো সূত্র হতে পারে না। আমি বলেছি এই উপন্যাসে সেই মসজিদটাতো চুরুলিয়ার হাজি পালোয়ানের মসজিদ হতে পারতো। যেখানে প্রমীলা শুয়ে আছে। তাহলে ঘটনাটা কী ঘটলো? এইযে একজন মানুষ আত্মীয় বর্জিত, সন্তানেরা তার জীবদ্দশায় মারা যাচ্ছে; একটি সন্তান বেঁচে আছে, তিনি এখানে আসলেন, এসে পিতার মৃত মুখ দেখতে পারলেন না। সন্ধ্যার পর যখন নজরুলের কবরের কাছে গিয়ে কাঁচা মাটি হাতে করলেন তখন পিতার হৃদয় হুহু করে কেঁদে উঠলো। তখন পিতা পুত্রের সাথে কথা বলতে শুরু করলেন।’ লেখক প্রথম পর্বে নজরুল জবানিতে উত্তরপুরুষে লেখা ঢাকায় নিজের জন্মভূমি থেকে অনেক দূরে সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাধিস্থ হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে মানবিক ভাবে তুলে ধরেছেন। মৃত্যুর সময় সন্তানদের দেখতে না পাওয়ায় নজরুলের পিতৃ হৃদয়ের হাহাকার এবং তৎকালীন দুই বাংলার রাজনৈতিক টানাপোড়েনের পরিপ্রেক্ষিতও অত্যন্ত কুশলী ভাবে লেখক বর্ণনা করেছেন। নির্বাক নজরুল স্বজন বান্ধবহীন হয়ে এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় নজরুলের মানসিক অবস্থার বর্ণনা নজরুল প্রিয় পাঠকদের হৃদয়কে অশ্রুসিক্ত এবং নজরুলের প্রতি প্রবল মায়া জাগিয়ে তোলে।
লেখক গভীর অধ্যবসায়ে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন কবির যোগ সাধনা নিয়ে। সেই সঙ্গে নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ’র মানসিকতার সঙ্গে কবির মানসিক মিল খোঁজার চেষ্টাটাও অসাধারণ।যা দীক্ষিত পাঠক এবং নজরুল প্রেমীদের ভালো লাগবে।ভাষার ব্যবহার, কাহিনি বর্ণনার নাটকীয়তা প্রকৃত উপন্যাসের চরিত্রকে দারুণ ভাবে পরিস্ফুট করেছে। কবির নির্বাক অবস্থার পরিণতি পাঠককে পীড়িত করবে। নজরুল জীবনের এই করুন মর্মান্তিক পরিণতি লেখক অসাধারণ মমতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর মানসিক অবস্থার ব্যাখ্যা পাঠকের চিন্তা চেতনার বোধে ধাক্কা দেবে। পাঠক বুঝতে পারবেন উপন্যাসের নামকরণ ‘তুমি শুনিতে চেয়ো না’ দেওয়ার তাৎপর্য। লেখকের লেখনীর গুনে পাঠক নিজেদের অজান্তে ধীরে ধীরে নজরুল জীবনের অন্দরে ঢুকে পড়বেন এবং লেখকের সঙ্গে চলমান সঙ্গী হয়ে উঠবেন।
নজরুলের চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ও তাঁর অর্থমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, পরবর্তীতে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের অবহেলা এবং তথাকথিত নজরুলের ঘনিষ্ঠ বলয়ের মানুষজনের অসুস্থ নজরুলকে সামনে রেখে তাঁর চিকিৎসার জন্য অর্থ সংগ্রহের নামে আত্মসাৎ করে নেওয়া সহ বিভিন্ন পারিবারিক বিপর্যয় ও বিড়ম্বনার কথা লেখক নজরুল জবানিতে লিখেছেন,যা পাঠককে বিস্ময়ে স্তম্ভিত করে দেবে। ‘আমি যেদিন অসুস্থ হই বাংলার জাতীয় কবির বাড়িতে কোনো টাকা-পয়সা ছিল না। -অগত্যা তাই হোমিওপ্যাথি দিয়ে চিকিৎসা শুরু হয়েছিল।-অনেকেই মনে করে, আমার একদিনেই কথা বন্ধ হয়ে গেছে। আমি আসলে ধীরে ধীরে বাকরুদ্ধতার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। আর সেটি কতটা আমার যোগভ্রষ্টতা আর কতটা ডাক্তারি বিদ্যার ভ্রষ্টতার ফল। ডাক্তার জেনে-শুনে আমার শরীরে দশ লাখ পাওয়ারের পেনিসিলিন পুস করে। পরিণাম কি হবে তা নিশ্চয় ড. বিধানচন্দ্র রায় জানতেন!’ পড়তে পড়তে পাঠকের হৃদয় বেদনায় ভারাক্রান্ত এবং চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠবে । একজন সৃষ্টিশীল লেখকের জীবনে এত রকম বিপর্যয়, এত রকম বাধা-বিপত্তি, এত রকম বিরোধিতা এবং বেঁচে থাকার জন্য এত অসম লড়াইয়ের ঘটনা পড়ে পাঠক মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বেন এবং নজরুলের প্রতি গভীর মায়ার টান অনুভব করবেন। লেখক মজিদ মাহমুদ কঠিন পরিশ্রম সাধ্য গবেষণার মাধ্যমে এইসব তথ্য আমাদের জন্য তুলে এনেছেন, যা নজরুল জীবনের অজানা অচেনা এক দিগন্তকে উন্মোচিত করেছে। পাঠক হৃদয়কে আলোড়িত করবে, কবি ও ব্যাক্তি নজরুল, সেই সঙ্গে নজরুলের পরিবার এবং নজরুলের সঙ্গে গভীর ভাবে সম্পৃক্ত মানুষজনের মন ও মানসিকতাকে নতুনভাবে জানতে সহযোগিতা করবে। পাঠককে ভাবতে বাধ্য করবে, এর আগে নজরুলের এতগুলি যে জীবনীগ্রন্থ লেখা হয়েছে, সেগুলিতে নজরুলের নির্বাক হয়ে যাওয়া পর্ব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়ের ঘটনাগুলি কি সচেতনভাবে লেখকরা এড়িয়ে গিয়েছেন? নাকি তাঁরা নিজেদের মতো করে নজরুলকে উপস্থাপিত করার চেষ্টা করেছেন?
কাজী নজরুল ইসলামের মতো একজন দেশপ্রেমিক স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং উপমহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কবির শুধুমাত্র আর্থিক সংকটের কারণে চিকিৎসা নিয়ে অসহায় বিড়ম্বনা পাঠককে গভীরভাবে ব্যথিত করবে। নজরুল যে ভুল চিকিৎসায় নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন এবং ম্যালেরিয়ার কারণে তাঁর যে এই নার্ভের রোগ দেখা দিয়েছিল এই বিষয়টি জেনে পাঠক একটি বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারবেন নজরুল সিফিলিস রোগের আক্রান্ত হননি। বিধানচন্দ্র রায়ের মত ডাক্তারদের কারণে নজরুলের মতো মহৎ কবিকে এই যৌনরোগের অপবাদ সারাজীবন বইতে হয়েছে। খন্ডিত ভারত যাঁরা দেখতে চাননি সেই দু’জন মহৎ মানুষ নজরুল ইসলাম এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মন-মানসিকতার নতুন বিশ্লেষণ দিয়েছেন লেখক মজিদ মাহমুদ নজরুল জবানীতে। ‘তুমি শুনিতে চেয়ো না’ উপন্যাসের প্রতিটি পর্ব কেবল নজরুল জীবনের বিভিন্ন পর্বের উন্মোচন নয়- দেশকে, দেশের রাজনৈতিক এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসকেও নতুন ভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে সাহায্য করবে।
‘তুমি শুনিতে চেয়ো না’ উপন্যাসের একের পর এক পর্ব পড়ার পর পাঠক নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারবেন লেখক মজিদ মাহমুদ গভীর মমতা দিয়ে নজরুলকে নতুন করে নির্মাণ করেছেন। নজরুল জীবনের যে অংশটা এতদিন পাঠকের অজানাই ছিল।মাকে নিয়ে কি করুন অসাধারণ কবিতা লিখেছিলেন নজরুল। স্ত্রী প্রমীলার মৃত্যুর পর নজরুলের আরো একা হয়ে যাওয়ার করুন বর্ণনা পাঠককেও অসহায় করে তোলে। নির্বাক নজরুলের পারিবারিক জীবনে শিশুর মতো সরলতা নিয়ে বেঁচে থাকা পাঠককে বিষয়ে অভিভূত করে। স্ত্রী প্রমীলাকে নিয়ে নজরুলের নিজের জন্মভূমি চুরুলিয়াতে ফিরে যাওয়ার মায়াময় বর্ণনা এবং মাকে নিয়ে কবির স্মৃতিচারণা পাঠককে দুঃখ ভারাক্রান্ত করে তোলে। সেইসঙ্গে পাঠককের মনে নতুন করে কৌতুহল জাগিয়ে তোলে প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের পিতা স্বাধীনতা সংগ্রামী সৈয়দ আবদুর রহমান ফেরদৌসীর ‘রঙ্গমঞ্চ’ পত্রিকায় লেখা কলকাতা রেডিও স্টেশনে নজরুলের উপর দৈহিক আঘাতের অভিযোগ।উর্দু ভাষার মহাকবি মির্জা গালিবের শেষের দিনগুলির বিড়ম্বিত জীবনের সঙ্গে নজরুলের শেষের দিনগুলির বিড়ম্বনার অদ্ভুত তুলনা টেনে লেখক মজিদ মাহমুদ দুই মহৎপ্রাণ মানুষের শেষ জীবনের এক করুন চিত্র অঙ্কন করেছেন। কালের অমোঘ নিয়মে মোগল সাম্রাজ্যের পতন এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের সাক্ষী এই দুজন মহাকবির সারাজীবন আর্থিক বিড়ম্বনায় পর্যদুস্ত হলেও, মহাকালের ইতিহাসে এঁদের সৃষ্টি অমর হয়ে আছে, এটাই একমাত্র সান্ত্বনা।
‘তুমি শুনিতে চেয়ো না’ উপন্যাসে দেখা যাচ্ছে নজরুল নিজের জবানিতে নিজের কথা বলে যাচ্ছেন। উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে এটি একটি উত্তর আধুনিক স্টাইল। ‘তুমি শুনিতে চেয়ো না’ আধুনিক গদ্য ভাষায় লিখিত একটি অসাধারণ উত্তর-আধুনিক উপন্যাস। জীবন ভিত্তিক উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে এ ধরনের স্টাইল বাংলা ভাষায় নতুন। মজিদ মাহমুদের আগে উত্তর আধুনিক স্টাইলে বাংলা কথাসাহিত্যে এ ধরনের উপন্যাস লেখা হয়নি একথা অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা যায়। নজরুল গবেষক মজিদ মাহমুদ দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় ধরে নজরুল গবেষণা করে অনেকগুলি পুস্তক লিখেছেন। এই গবেষণা গ্রন্থ গুলির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল ‘নজরুল তৃতীয় বিশ্বের মুখপাত্র’। কবি ও গবেষক মজিদ মাহমুদ এই পুস্তকে নজরুলকে আন্তর্জাতিক কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। সেই পরম্পরার মহার্ঘ্য ফসল নজরুল জীবন ভিত্তিক মেধাবী উপন্যাস ‘তুমি শুনিতে চেয়ো না’ ।