spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যআলভী স্যার

লিখেছেন : রফি হক

আলভী স্যার

রফি হক

আলভী স্যার। শিল্পী, অধ্যাপক আবুল বারক্ আলভী। তাঁর আরেকটি মহান পরিচয় আছে। তিনি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। আগরতলায় দুই নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনে, ঢাকা ক্র্যাক প্লাটুনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ক্র্যাক প্লাটুনের জন্যে আগরতলার দুই নং সেক্টরের arms. ammunition supply point (ASP) থেকে সেগুলো নিয়ে গোপনে ঢাকা ঢুকতেন। এবং ঢাকার নির্দিষ্ট স্থানগুলোতে আর্মস, অ্যাম্যুনিশন, এক্সপ্লোসিভস dump করে আবার গোপনে ফিরে যেতেন আগরতলায়। ফিরে যাবার সময়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ইচ্ছুকদের সঙ্গে করে আগরতলা নিয়ে যেতেন।

.

ঊনিশ শ একাত্তরে ছোটখাটো ঊনিশ/কুড়ি বছরের আবুল বারক্ আলভী এই কঠিন দায়িত্ব পালন করতেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ! এ আমার কাছে বিষ্ময়কর ব্যাপার। অধ্যাপক শিল্পী আবুল বারক্ আলভী আমার শিক্ষক। আমি তাঁকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। তিনি ছাত্রদের ধমক দিয়ে কথা পর্যন্ত বলতে পারেন না। তিনি প্রবল লাজুক, কিন্তু  বন্ধুবৎসল, স্নেহশীল একজন অসাধরণ মানবিক মানুষ ।

.

তাঁর আগরতলায় ফিরে যাবার কথা ৩১ আগস্ট সকালে। তিনি পাকিস্তান আর্মির হাতে ধরা পড়লেন ৩০ আগস্ট গভীর রাতে, ক্র্যাক প্লাটুনের আরেক বিখ্যাত মানুষ খ্যাতিমান সুরকার আলতাফ মাহমুদের শহীদবাগের বাসায়। অথচ আলভী স্যারের সে-রাতে থাকার কথা গোপীবাগে অন্য আরেক বন্ধুর বাসায়। কিন্তু বেশ রাত হয়েছিল বলে তিনি সেখানে থেকে গিয়েছিলেন। 

.

আলতাফ মাহমুদের বাসার উঠোনের মাটির নিচেও ক্র্যাক প্লাটুনের আর্মস অ্যাম্যুনিশন ডাম্প করা ছিলো। সে তথ্য পেয়ে পাকিস্তান আর্মি সে রাতে সুরকার আলতাফ মাহমুদ উঠোন থেকে অস্ত্রশস্ত্র খুঁড়ে বের করে এবং সুরকার আলতাফ মাহমুদ, আবুল বারক্ আলভী আর আলতাফ মাহমুদের শ্যালককে ধরে নিয়ে যায়। সে রাতে মুক্তিযোদ্ধা আজাদ, বদি, জুয়েল, জাহানারা ইমামের ছেলে রুমি সহ প্রায় কুড়ি বাইশ জন ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধা ধরা পড়েছিল। ক্র্যাকপ্লাটুনেরই কারও বিশ্বাসঘাতকতায়। বিশ্বাসঘাতকতা বলা যায় কিনা জানি না, শোনা যায়,  ক্র্যাকপ্লাটুনের  একজন মুক্তিযোদ্ধা ধরা পড়েছিলেন, তিনি মৃত্যুর ভয়ে জেরার মুখে অন্যদের অবস্থান জানিয়ে দেন। যুদ্ধে নাকি এরকমের ঘটনা ঘটে, এটা স্বাভাবিক।… যিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন–তিনি আবার মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য “বীরপ্রতীক” পদক পেয়েছিলেন।…  

.

অকথ্য নির্যাতনের কথা আলভী স্যার কখনই মুখে বলতে পারেন নি। শুধু বলেছেন, এর বিবরণ দেয়া সম্ভব নয়। দুহাতে আঙুলের নখ উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল, প্রতিটি আঙুল থেৎলে দেয়া হয়েছিল।… এতুটুকু পর্যন্ত স্যার বলেছেন আমাকে। এই তো গত ২৯ ডিসেম্বর আর্ট কলেজের ৭৫ তম বার্ষিকীতে স্যার ও আমি কথা বলছিলাম এই বিষয়টি নিয়েই।… আলভী স্যার বলেছেন, তিনি কী করে, কীভাবে ছাড়া পেয়েছিলেন সেটা তাঁর কাছেও বিস্ময়ের।… কয়েকদিন অবিরাম ভয়াবহ রকমের অত্যাচারের পর তাঁকে ছেড়ে দেয়া হলে—তাঁরও বিশ্বাস হয়নি যে তিনি মুক্ত !!  আর ছাড়া পেয়েছিলেন সুরকার আলতাফ মাহমুদের শ্যালক। আলতাফ মাহমুদ সহ  ধরা পড়া ক্র্যাক প্লাটুনের বাকিসব মুক্তিযোদ্ধারা আর ফিরে আসেন নি।…

.

আলভী স্যারকে শিক্ষক হিসেবে আমি পেয়েছি বন্ধুর মতো। 

কখনও কখনও বন্ধুরও অধিক। তাঁর সঙ্গে একাধিক আর্টক্যাম্প ও আর্ট ওয়ার্কশপে গিয়েছি। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে।

স্যার আমার বিয়ের অনুষ্ঠানেও ছিলেন। আমার পাশে বসেছিলেন বিয়ের আসরে। স্যারকে কাছে পেয়ে যেন আমার অভিভাবক পাওয়ার মতো আনন্দ হয়েছিল। এখনও আসেন, সময় করতে পারলে, গুলশানে এলে আমার অফিসে অবশ্যই এসে চা পান করে যান।… আমার বিয়ের পর আমার মগবাজারের বাসায় আসতেন, ধানমন্ডির বাসাতেও আসতেন ।  নানা বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। হলিফ্যামিলিতে আমার মেয়ে রূপকথার জন্মের দিন স্যার হাসপাতালে আমার পাশে ছিলেন । আমি খুবই নার্ভাস ছিলাম। স্যারের সেই থাকাটুকুর অনুগ্রহ আমি কখনও ভুলব না। তিনি আমাকে কতভাবে যে ঋণী করেছেন—আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সে কথা স্মরণ করি। আমার শিক্ষকের কথা আমি বলতে খুব ভালোবাসি। কেননা তাঁরা প্রত্যেকেই গুণীজন। এটা আমার ভাগ্য।

আমি তাঁর ছাত্র হিসেবে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।

.

কয়েকদিন আগে দেখলাম, স্যারের জন্মদিন পালন করছে ডিপার্টমেন্টের সকলে। সেখানে শিল্পী অধ্যাপক রফিকুন্ নবী, আর্ট কলেজের ডিন নিসার হোসেন সহ তাঁর সহকর্মীরা ছিলেন। অবাক বিষয়– আমি তাঁর সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ ছিলাম অনেকগুলো বছর– কিন্তু আমি তাঁর জন্মদিনটি জানতাম না। এবারই প্রথম জানলাম। আমাদের সময় কখনও তাঁর জন্মদিন পালন করা হয়নি। আর তিনি এত লাজুক…

স্যারকে আমার হৃদয়ের গভীর থেকে জন্মদিনের অতল শুভেচ্ছা । 

স্যার, আমি প্রার্থনা করি আপনি শত বৎসর বাঁচুন।

.

রফি হক : শিল্পী, ছাপচিত্রী, শিল্পলেখক, সম্পাদক। ভিজিটিং আর্টিস্ট এন্ড লেকচারার, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো। 

বৃহঃবার, ৪ জানুয়ারি, ২০২৪

২০ পৌষ, ১৪৩০ । ঢাকা।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ