তৈমুর খান
এই প্রথম সজলকুমার টিকাদারের ‘শান্ত কোলাহল’(জানুয়ারি ২০২৪) কাব্যগ্রন্থখানি পাঠ করার সুযোগ হল। বাংলা কবিতার অজস্র ভিড়ের মধ্যেও সজলকুমারকে আলাদা করে ভাববার অবকাশ হল। কবিতাকে এত নির্ভার করা যায়, এত সহজ স্বচ্ছন্দভাবে লেখা যায় তা তিনি দেখাতে পেরেছেন। কাব্যের নাম ‘শান্ত কোলাহল’ কাব্যের প্রথম কবিতা ‘দুটি হাঁস ও…’-এর মোট চারটি পংক্তির শেষ পংক্তিটি নিয়ে এই নামকরণ। মাত্র দুটি শব্দে বিরোধাভাস অলংকারের মধ্যে দিয়ে এক পরিতৃপ্ত প্রকৃতির খণ্ডচিত্র যা মনকে আরাম দিতে পারে। পুরো কবিতাটিতে হাঁস, দিঘি, মেয়েটি এবং মেয়েটির পায়ে ঘাসের মল যা প্রকৃতিরই ছবি। যে ছবির প্রাণ আছে, সাড়া আছে, স্পন্দিত হবার অবকাশ আছে—তবু সেগুলি মার্জিত প্রসন্ন নিভৃতির পবিত্রতা নিয়ে বিরাজ করেছে। এরকমই ছবি যাদের প্রসন্নতা, মুগ্ধতা, সরলতা কাব্যের ৫৮টি কবিতাতেই পাওয়া যাবে।
‘ঠান্ডা জল’ নামে একটি কবিতায় টগবগ করে ফুটে ওঠা জলের ছবি এবং দু’একফোঁটা ছিটকে এসে শরীরের ছ্যাঁকা লাগা অনুভব করা যায়। কিন্তু কবিতার শেষে যে ব্যক্তিটির পরিচয় দেওয়া হয় তা এইরকম:
“আমি এ পাড়ায় থাকি। রাইস মিলে কাজ করি।
পিন্টু নাম…”
এই ব্যক্তিটির ফুটে ওঠার কারণটিও শেষ বাক্যটিতে পূর্ণ হয়:
“অবসরে ভালবাসি তাকে।”
একটি জীবনের গল্প, অথবা গল্পের ছায়াপাত,যার মূল ধর্মে ঠান্ডা জল কিন্তু ভালোবাসার তাপে ফুটে ওঠা। কত কথাই না না-কথার মধ্যে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। ‘অবসরে’ শব্দটির ব্যবহারও মারাত্মক হয়ে ওঠে। সামান্য মানুষের সামান্য ভালবাসা, ভালবাসার অবসরই বা কোথায়? গুটিকয় শান্ত নিরীহ শব্দে কবিতার পংক্তি সাজানো হয়। উপমা বা বিশেষণের জৌলুস নেই। ভারী শব্দের আমদানি নেই। গভীর কোনো দীর্ঘশ্বাসের পতন নেই। অথচ মর্মভেদী অনপনেয় উপলব্ধির বিন্দু বিন্দু জলকণা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সকালের শিশির বিন্দুর মতো আমাদের মানবীয় জীবন উচ্ছ্বাসের ক্ষরণ কত সাবলীল, কত তীব্র, কত তীক্ষ্ণ হতে পারে তারই পরিচয়। গল্পের উৎস মুখে না-গল্পের আলপনা এঁকে দিয়েছে। কোথাও ছলনা নেই। সরাসরি যা বলার, যা পাওয়ার, যা করার তারই উপস্থাপন আছে। ‘ব্যথাদের বাড়ি-ঘর’ নামে একটি কবিতায় লিখেছেন:
“কাদা-মনের উপর দিয়ে হেঁটে চলে গেছে
এক ধারালো-শিং ষাঁড়!
তার প্রতিটা পদক্ষেপে গর্ত আঁকা হয়েছে
এবং গর্তে গর্তে এখন ব্যথাদের
উচু উঁচু বাড়ি-ঘর!”
এই কবিতা ব্যাখ্যা করার ভাষা থাকে না, কিন্তু অনুভূতির এক বৃহৎ ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। ‘কাদা-মন’ আমাদের প্রত্যেকেরই যেমন রয়েছে, তেমনি অঘটন ষাঁড়ের দৌরাত্ম্যও আমাদের উপলব্ধির বিষয়। ব্যথার তীব্রতা সেই বাড়িঘর নির্মাণেই প্রযুক্ত হয়েছে। ফরাসি কবি সাংবাদিক রাইনার মারিয়া রিলকে ‘একজন তরুণ কবির চিঠি’-তে লিখেছেন:
“If you will stay close to nature, to its simplicity, to the small things hardly noticeable, those things can unexpectedly become great and immeasurable.”
অর্থাৎ তুমি যদি প্রকৃতির কাছাকাছি থাক, তার সরলতার কাছে, খুব কমই লক্ষ করা যায় এমন ছোট জিনিসগুলির কাছে, সেই জিনিসগুলিও অপ্রত্যাশিতভাবে মহান এবং অপরিমেয় হয়ে উঠতে পারে। এই কবিতাগুলিতেও এই মাহাত্ম্য এবং অপরিমেয়তার বিষয়টি ছড়িয়ে আছে। একলা থাকার ভেতর মেঘ বাড়তে থাকা, ব্ল্যাকবোর্ড-আকাশে বিদ্যুতের কাটাকুটি, খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টিশস্য নেমে আসা এবং রবি ঠাকুরের গানের বাগানও কবিতায় চিত্ররূপ পায়।নতুন বইয়ের প্রথম পাতাটির মতো ভোর তার আলো-শব্দ-গন্ধ-অক্ষর আমাদের সামনেও উদ্ভাসিত হয়। রবিবার হরিণের মতো দৌড়বাজ হলেও কবি যে সাংসারিক অরণ্যে প্রবেশ করেন, সেখানেও শান্তশ্রী এক প্রেমিকার সাজে বসে থাকা মানুষীকে দেখতে পান। আর তার হৃদয়ের বাঁশিটিতে ফুঁ দিলে সুর নয়, ভালোবাসা বেজে ওঠে। পাঞ্জাবি-ধুতি পরা বাবার গার্হস্থ্য জীবনের সাদামাটা ছবিটির মধ্যেও অনন্য ব্যক্তিত্বের দেখা পাওয়া যায়। দূরের অলঙ্ঘ পাহাড়ের একটিমাত্র তুলনায় তা বোঝা যায়। তেমনি মায়ের গার্হস্থ্য জীবনের কর্মব্যস্ততায় তাঁকে পাওয়া মানে খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো। তবু অসুখ-বিসুখে পাখির ছানার মতো স্নেহের ডানার নিচে ওম পাওয়াটাই কাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে। সৌন্দর্যের সঠিক সংজ্ঞা খুঁজতে গিয়ে কাঁসার বাটির মতো স্তনে তার দেখা মেলে কোনো নামি শপিংমলে। আমাদের মধ্যেকার সম্পর্ক সংযোগ ছিন্ন হলে যে দুর্ভর একাকিত্বে আমরা নির্বাসিত হই সে-কথা বোঝাতে গিয়েই বলেছেন আমাদের ভেতরের রাস্তাটা ঠিক করা দরকার। আসলে আমরা ভেঙে যাওয়া রাস্তাকে আর মেরামত করি না। কবিতায় ‘রাস্তা’ একটি বহুমুখী ব্যঞ্জজনাশ্রয়ী শব্দ। তেমনি প্রেমও ভোলা যায় না। যে প্রেম সৌন্দর্যের অবয়ব নিয়ে স্বপ্নের ছবি আঁকে, সে প্রেম উদ্বেগও বিলি করে। এরকমই সব কবিতা। কবিতার শব্দগুলির গায়ে সকালের মিহি রোদ এসে পড়েছে। তাই প্রাণের গুঞ্জন উঠেছে। সমুদ্রের তরঙ্গের মতো তা তীব্র উথাল-পাথাল করেনি ঠিকই, কিন্তু অন্তর্ভেদী কম্পনে সত্তাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। কত সহজ, কত সরল, কত স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক এই উচ্চারণ তা না দেখলে বোঝা যাবে না।
শান্ত কোলাহল : সজলকুমার টিকাদার, প্রচ্ছদ: সম্পা সাহা, প্ল্যাটফর্ম প্রকাশন,সিঙ্গুর, হুগলি। দাম ১৫০ টাকা।