spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধকবি অরুণ ভট্টাচার্য : স্তিমিত পৃথিবীর আলো

লিখেছেন : মুহম্মদ মতিউল্লাহ

কবি অরুণ ভট্টাচার্য : স্তিমিত পৃথিবীর আলো

মুহম্মদ মতিউল্লাহ্

তার মৃত্যুর প্রায় ১২ বছর পর নব্বইয়ের দশকের শেষে অরুণ ভট্টাচার্যের ‘নির্বাচিত কবিতা’ প্রকাশিত হয়। সে বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন অশোক মিত্র। অশোক মিত্র অরুণ ভট্টাচার্যের কবিতায় দেখেছিলেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা সরলতা গুণ। অপাপবিদ্ধ সেইসব কবিতার গহনলোক উদ্ধার করে অশোক মিত্র লেখেন ‘আমিও যে একদা পাপহীন ছিলাম, প্রকৃতিতে, পরিবেশে আমার অধিকার ছিল, এখনও আছে, অরুণ ভট্টাচার্যের কবিতা তা যেন প্রায় প্রহারের মতো আমাকে মনে করিয়ে দিল।’ অরুণ ভট্টাচার্যের কবিতা তাঁর মনে হয়েছিল ‘গলা ফাটিয়ে কথা বলে না’। প্রায় কথকতার মত সেই কবিতার গোত্র; সেই কথকতার একমাত্র শ্রোতা যেন কবি নিজেই।
চল্লিশের দশকের কবি অরুণ ভট্টাচার্য। যদিও তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সায়াহ্ন’ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৭২ সালে। ১৯৮৫, ৯ মে কবির মৃত্যু। এই সময়কালের মধ্যে নয়টি একক কাব্যগ্রন্থ এবং দুটি যৌথ কাব্যগ্রন্থ (বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর সঙ্গে) প্রকাশিত হয়। কবিতা- নন্দনতত্ত্ব- সংগীত বিষয়ে অন্তত দশটি প্রবন্ধগ্রন্থের প্রণেতা তিনি। যদিও বৃহৎ কোন পত্রিকা গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা কোনদিন পাওয়ার পথে হাঁটেন নি। বড় কোনো প্রকাশন সংস্থা তার বই প্রকাশও করেনি। নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় আপন কর্তব্যবোধ রীতি-নীতির কাছে দায়বদ্ধ কবি স্বধর্মে স্থিত থেকেছেন। নিজের অভিজ্ঞতার পৃথিবীর বাইরে বেরিয়ে উচ্চকিত উচ্চারণে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারেননি। তাঁর ভাষায়, ‘আমি চমকে দেবার মতো কবিতা লিখিনি… কোনদিন পাঠককে চমকে দিয়ে বা বিচিত্র পাগলামি করে খবরের কাগজের নিউজ হতে চাইনি। এও এক ধরনের অক্ষমতা স্বীকার করি।’
চল্লিশের দশকের সেই অস্থিরতাকালে যুদ্ধ- মন্বন্তর- দাঙ্গা- দেশভাগ— এই টালমাটাল পরিবেশে সমসময়ের কবিদের হাতে উচ্চকণ্ঠের সামাজিক রাজনৈতিক কবিতা লেখা হচ্ছে যখন, সমসাময়িকতা হয়ে উঠছে কবিতার কেন্দ্রভূমি। এমনকি জীবনানন্দ দাশের মত কবি, বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়, ‘চলতি আন্দোলনের আন্দামানে বন্দী’ হয়ে পড়ছেন—। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও অরুণ ভট্টাচার্য তাঁর স্বগতভাষণে আত্মউজ্জীবনের কবিতা লিখে গেলেন। অস্থিতির উচ্চকিত আলোড়নে নিজেকে বিধ্বস্ত করলেন না। আরএই না-করাকেই আলোক সরকারের মতো কবির মনে হয়েছে ‘অরুণ ভট্টাচার্য কবিতাকে কবিতার অর্থেই স্বাস্থ্যবান করে তুলতে চেয়েছেন। সম্পূর্ণ নিখাদ পরিশ্রুত কবিতা এবং তার বেশি আর কিছুই নয়।’
তিরিশের কবিতার পাণ্ডিত্যের ভার থেকে তাঁর কবিতা যেমন দূরত্ব রচনা করেছে তেমনি চল্লিশের দশকের সমসাময়িকতার উচ্চকিত অভিঘাত, পরবর্তীকালে পঞ্চাশের দশকের সঙ্ঘবদ্ধ জীবন যাপনার আবেশ, সঙ্ঘবদ্ধ বন্ধুত্বের ফুটপাত বদল করার আলোড়ন কিংবা ষাট সত্তরের হাংরি অ্যাংরি, দিশাহীন সত্তরের রোরুদ্য সংলাপ—গোটা এই সময় জুড়ে বসবাস করেছেন এই কবি। কিন্তু এসব কিছু থেকে এক সুদূর আগন্তুক অবস্থানে অরুণ ভট্টাচার্য নিজেকে নিবন্ধ রেখেছিলেন, আপাতব্যর্থতার এক সার্থকতায়। যেমনটি জানিয়েছিলেন কবি—
‘আমার দেবতা জানেন, আমি
আজও পর্যন্ত কোন খেলায়
জিততে পারিনি সেই
বালক বয়স থেকে আমার
পিছনের সারিতে বসবার আসন।
সেই কৈশোর থেকে বৃথা স্বপ্ন দেখা।
সেই যৌবন থেকে পরাজয়ের স্মৃতি
আমি বহন করে আসছি।

আমার দেবতা জানেন, আজ আমার
যাওয়ার লগ্ন এল।
এই মুহূর্তে আমি একটা খেলায় জিতেছি,
আমি আমার দেবতাকে বুকের মধ্যে স্থির
দেখতে পাচ্ছি।’
(দেবতা জানেন/ অনন্ত বাসরে যাবো)
তাঁর কবিতা সব সময় একটি অন্তর্লোকের উজ্জীবন। চেতনার একটি গভীর স্তর জীবন যাপনের সহজ স্বাচ্ছন্দ্যের ভেতর দিয়ে তার কবিতায় উন্মোচন পেয়েছে। সেখানে সমকালের কোন তাৎক্ষণিক উন্মত্ততা নেই। সামাজিক কোলাহল নেই। সাময়িকতার আবিল আর্তনাদ থেকে অরুণ ভট্টাচার্য দূরত্ব রচনা করেছেন। জীবনযাপনের এক প্রবহমানতা ঘটনাহীন পরম্পরার ভেতর দিয়ে আতিশয্যহীন উচ্ছ্বাসহীন উজ্জীবনের কথা বলে। এবং এসব উচ্চারণে কবি লিরিক সুরকেই অবলম্বন করেছেন, কোথাও আবার রোমান্টিকতাকে; হয়তো নিন্দিত হবেন জেনেও। তাঁর চেতনাজগতের দোসর খুঁজেছেন অনেক সময় লোকজ বাংলার প্রাচীনতায়। এইসব উচ্চারণ এক নিবিষ্ট সরলতার মন্ত্রে আবিষ্ট। সেই আপাত সরলতার ছদ্মবেশ কখনও পাঠককে সুদূরনিবেশী। যেমন সরলতার সন্ধান পাঠক খুঁজে পান ব্লেকের কবিতায়। উল্লেখ্য লেখছিলেন অরুণ ভট্টাচার্যের প্রিয় কবি উইলিয়াম ব্লেকের কবিতা বিষয়ে তার প্রবন্ধ আমাদের মনে রাখতে হবে সেই সারল্য শেষ পর্যন্ত পাঠককে একগভীর অবলোকনে পৌঁছে দেয়; কখনো বা মিসটেক চেতনায় তার কবিতার সারল্য শেষ পর্যন্ত এক গভীরতার অনুসন্ধান এবং একই সঙ্গে আত্ম চৈতন্যের উজ্জীবন—

‘এমনি এক একটা দুপুর যায়

রৌদ্র আসে যায় ছাতিম তলায়,মেঘ জমে
পুকুর পাড়ে। গা ভাসিয়ে মহিষের দল
স্নান করে দামাল শিশুর মত।
….
ট্রেনের হুইসিল, মাঝ স্টেশনে আচমকা
এঞ্জিনের ধুয়ো ঝাড়া। উড়াল বক পাখির অথৈ শূন্যে
আলগা গা ভাসানো এইসব
জীবন যাপনের খেলা-খেলা।’
(বেলা বয়ে যআয়/চারিদিকে খেলাঘর)
এক মিসটিক সরলতায় একটি দুপুর চিরকালীন দুপুর হয়ে ওঠে, বেলা বয়ে যাওয়ার অনন্ত প্রবাহ।
অরুণ ভট্টাচার্যের কবিতায় যে পৃথিবীর কথা শোনা যায় সে পৃথিবী কর্মমুখর জীবনের ছবি নয়, বরং বিকেলবেলার স্তিমিত পৃথিবীর ছবি এক। বিভূতিভূষণের গল্প যেমন জিইয়ে রাখে প্রবহমান বেদনা। জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত থাকার বেদনা।
‘ সারা জীবন ধরে একটি মাত্র সাদা ফুল তুলতে চেয়েছিলাম
একটি কামিনী ফুল।
আজও তোলা হয়নি।
কামিনী ফুল হাত থেকে শুধু ঝরে যায়।’
(নির্জন বারান্দা থেকে উত্তরসূরি ১৩৮৭)
তাহলে কাকে বলে জীবনের সফলতা? সেখানে কোনদিন পৌঁছানো হয় না তাহলে! ব্যর্থতার ভিতর দিয়ে চলতে পারা চাই। চলার ছন্দে জ্বলে উঠতে পারে আলো। সেও জীবনের একটি পরীক্ষা। সফলতায় পৌঁছানো নয়; ব্যর্থতার পথও কম অর্জন নয় জীবনের। ব্যর্থতা- সফলতার সহজ পথচলার ভেতরে যদি জ্বলে ওঠে প্রেমের আলো—
‘এসো আমরা আলোর জন্য আলো জ্বালাই

পাঁচটি প্রদীপ হাতে নিয়ে প্রেমের জন্য ঘুরে বেড়াই প্রেমই আলো, আলোই প্রেম
বুক ফুলিয়ে সহজ কথা বলে বেড়াই।

এসো আমরা আলোর জন্য আলো জ্বালাই।’
(প্রেমই আলো, আলোই প্রেম /সময়-অসময়ের কবিতা ১৩৮৩)

অরুণ ভট্টাচার্যের আপাতসরল উচ্চারণ শেষ পর্যন্ত গহনলোকের কথা বলে। রহস্যময়তায় বেজে ওঠে সেই সব উচ্চারণ। একইসঙ্গে প্রজ্ঞা ও প্রয়োগের অদ্ভুত সমন্বয়ে  ধ্বনিময় তাঁর কবিতা।  কবিতায় ফিরেফিরে আসে হেরে যাওয়া ব্যর্থতার বিবৃতি। তেমনি জীবনের অনন্ত প্রবহমানতার কথা। আবহমান বেঁচে থাকার ভেতর একটি ব্যক্তিময়তার মর্মছায়া। ব্যক্তির হয়ে ওঠা না- ওঠার পরিসরে বেজে ওঠে পাওয়া- না পাওয়ার আর্তি। একটি গৃহে ফেরার গল্প, ছায়াময় হিমশীতল এক মৃত্যুবোধের গুঞ্জন জেগে থাকে সেই সব কবিতায় —জেগে থাকে অনেক অকথিত ঘন অন্ধকার— কোথাও চলে যেতে হবে অব্যক্ত একটি চাপ, সেইসঙ্গে একটি ঠিকানার অনুসন্ধান এবং কখনো তা হয়ে ওঠে অনন্ত বাসরযাত্রা।

‘বাঁশি বাজলে যেতে হয়।/ যতদূর দেখা যায়/ সামনে কিছু নেই শুধু /দিঘি কালো অন্ধকার।/ অতীতে তাকালে কিছু ক্ষতচিহ্ন।’
অন্ধকার বাড়ি তাঁকে ডাকে। অন্ধকার বাড়িটির চারিদিকে রহস্যময় ঢেউ। জানালার খড়খড়িগুলো বিপন্ন তাঁকে ডাকে, ‘অরুণ বাড়ি আছো, অরুণ’। সেই ডাক জুড়ে থাকে অস্তিত্ব অনস্তিত্বের অকথিত সমাচার। বিপন্ন বিবৃতি। তাঁর প্রিয়তম শব্দ হয়ে ওঠে ‘ঘুম’। কোথাও নিগুঢ় যন্ত্রণার ঠিকানা অপ্রকাশ থেকে যায়। কিন্তু নিভৃত জানান দেওয়ার মতো শোনা যায়—
‘ তোমরা সব জেনে রাখো আমি
চারবছর আঁখিপল্লব বন্ধ করিনি আজ
শুধু ঘুম। এসো, আমার প্রিয়তম শব্দ
ঘুম।রমণীরা উলুধ্বনি দাও আমি
ঘুম যাই।’
( ‘প্রিয়তম শব্দ ঘুম)
‘রমণীরা উলুধ্বনি দাও আমি ঘুম যাই।’ ঘুমাবার আগে যে তপ্ত প্রহর জীবন সেখানে জীবনের সহজতায় যাপন চায়নি কি! প্রকৃত প্রস্তাবে, অরুণ ভট্টাচার্যের কবিতা জীবনযাপনের কবিতা, জীবন থেকে বিযুক্ত থাকার কবিতা নয় কখনোই। তিনি জানান ‘কবিতা ব্যক্তিগত উপলব্ধির ফল’। এই ব্যক্তিগত জীবন ছুঁয়ে থাকতে চায় আর একটি ব্যক্তির হাত। জীবনের সঙ্গে যুক্ত থাকা অথবা যুক্ত থাকতে না পারার বিয়োগফলটুকুও নিশ্চয়ই—
‘ রমণীর মুখে আমি
রহস্যময় ছায়াপথ দেখতে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম
তার দেহবল্লরী একটি নিপুণ ভাস্কর্য
চন্দ্রমল্লিকার লাবণ্য যার ভাঁজে ভাঁজে’…
জীবনকে রূপময় বর্ণবহুল ঐশ্বর্যময় করে তুলতে তার প্রার্থনা বেজে ওঠে ঋকবেদের সূক্তাবলির উচ্চারণে—
‘আমাদের হোক
দুগ্ধবতী ধেনু দ্রুতগতি অশ্ব
আমাদের গৃহে শোভা বর্ধন করুক
সৌন্দর্যশালিনী নারী।’
(ঋগ্ববেদের সূক্ত)
কিন্তু জীবনকে দেখার মধ্যে, যাপনার মধ্যে উচ্চকিত আলোড়ন বুঝি তা নয়! মানুষের সম্পর্কের আসক্তি- অনাসক্তির একটি
যোগবিয়োগ যেন তাকে উদাসীন করে। উচ্ছ্বাসহীন করে। তাঁর চোখে কেবল বিকেল বেলার স্তিমিত পৃথিবীর আলো।
অস্তিত্বের একটি অবস্থান থেকে না-অস্তিত্বের ছায়ানিবিড় দ্বন্দ্ব একটি শূন্যতায় নিয়ে যায় কি! এমন নিরাসক্ত (আসক্তি কি সত্যিই অনুপস্থিত!) উচ্চারণ লিপিবদ্ধ করেন কবি—
‘কলসি ভেঙে রাঙ্গা চিতার জল
ঢালতে কে যে শিখিয়েছিল আমায়
শিখিয়েছিল, পিছন ফিরে
পুনর্বার তাকাতে নেই

আজও আমি পিছন ফিরে
চাইতে পারি না।

ভূতগুলি সব অন্ধকারে হেঁটে বেড়ায়।’
( পিছন ফিরে পুনর্বার/চারিদিকে খেলাঘর)
এসব কবিতা তো একই সঙ্গে জীবনের কবিতা জীবন নদীর এক কবিতা।
‘ততক্ষণ তুমি গালে হাত দিয়ে বসে থাকবে
আগুনের দাউ দাউ শিখাগুলির দিকে চেয়ে
এক পাশে শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধির ধুলো
অন্যপাশে অবন ঠাকুরের।….

থমথমে আগুনের হাওয়া এসে
তোমার রাঙা পাটপাট শাড়ি, ঢেউ তোলা
বিস্রস্ত চুলে এলোমেলো ধাক্কা দেবে।
হয়তো মনে পড়বে, কোনদিন এই কবির সঙ্গে শ্মশান ঘাটে
গঙ্গা ঢেউ গুনেছিলাম এক দুই তিন।’
(ব্যক্তিগত মৃত্যুকে নিয়ে/ চারিদিকে খেলাঘর)

কিন্তু যাওয়া তো সহজ নয়। যাওয়া তো নয় যাওয়া। জীবন রেখে যায় পরবর্তী নতুন জীবনকে। এক হাত অনন্ত শূন্যতায়, অন্য হাত ছুঁয়ে থাকে পরবর্তী প্রজন্মের দিকে। এক উদাসীন চলে যাওয়ার পথে কর্তব্যের আত্মনিবেশী বিশ্লেষণ। আত্মজাকে তার প্রতিনিধি করে সর্বার্থে রেখে যেতে চায়।
‘কন্যা তোকে যৌবন দিয়েছি
দিয়েছি অতুল রূপরাশি।
তোকে পুরুষ দিয়েছি
সহবাসে যার যৌবন উদ্বেল হবে।
কন্যা তোর শরীরের ভাঁজে
অম্লান মিথুন- মূর্তি, তোর
শিশুর আদল প্রপিতামহের মুখে।
কন্যা তোর মুখশ্রী এবার
সমুদ্রমন্থিত
কল্যাণী লক্ষ্মীর।

এবার আমাকে ছুটি দে, আমি
অনন্ত বাসরে যাবো।
(অনন্তে বাসরে যাবো)
এই অনন্ত বাসর যাত্রার আগে কবি নিশ্চিত দেখে নিতে পেরেছেন তাঁর যাপিত জীবনের চরাচর। সাফল্য নয়, অযাচিত প্রাপ্তিযোগ নয়, বরং নিগূঢ় চিনেছেন তাঁর হতাশাগুলি, কিছু স্মৃতি কিছু অপমান, অনেক ব্যর্থতা। সে সবকিছু তাঁর উদাসীনতার স্পর্শে অমলিন স্তব্ধতালোকে ভেসে বেড়ায়। খুব যে গুরুত্ব পায় তা-ও হয়তো নয়। কৃতি বন্ধুদের কিছু তামাশা টিটকারি,’ কিছু উদাসীন মিষ্টি হাসি’-র স্মৃতি মনে পড়ে। ‘আমার জামার দিকে কিছু সাদা উপহাস’। আর এ সমস্ত কিছুকে উদাসীন অবহেলায় কবি ফেলে রেখে দেন সামান্য- অসামান্যের উদ্ভাসন ঝেড়ে ফেলে নক্ষত্রপুঞ্জের স্নিগ্ধতায় অবগাহিত হতে পারেন আপন ঐশ্বর্যে।
‘মধ্যরাত্রে আমি তবু কি এক নেশার ঘোরে
নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে সেই থেকে স্নিগ্ধ চেয়ে আছি।’
তারপর থেকে যায় স্নায়ুচাপহীন নির্বিকার অনাসক্ত এক প্রশ্ন—
‘বন্ধুরা আমাকে আজও কিছু কি দিয়েছে
কিছু উদাসীন মিষ্টি হাসি ছাড়া’।…
সেই চল্লিশে দশক থেকে আশির দশক ১৯৮৫ তে মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত দীর্ঘ কবিজীবনে বস্তুত অরুণ ভট্টাচার্য কবিতা যাপনের বিনিময়ে জনপ্রিয়তার ঝলক, সভামঞ্চ, পুরস্কার কিছুই পাননি। পেয়েছেন উদাসীনতা শুধু। বলা ভালো পাওয়ার চেষ্টা টুকুই করেননি কখনো। কবিতার স্বধর্মে তিনি স্থিত থেকেছেন। খ্যাতির সোপানে পা দিতে দিতে দৈত্য হয়ে ওঠা কবিদের তিনি দেখেছেন তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে। মাঠে ময়দানে মিছিলে বড় বড় পত্রিকার অফিসে রেকর্ডিং রুমে ব্যস্ত…
‘আপনি বড় লেখক। মস্ত বড়’.. প্রায় স্বগতোক্তির মতো তাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন ‘বলতে পারেন কি করে বিশুদ্ধ বিবেকের কথা লেখা যায়?’ আসলে অরুণ ভট্টাচার্য এই বিশুদ্ধ বিবেকিতায়স্থিত থেকেছেন সারা জীবন। কবিতা যাপনের নামে কপটাচার মিথ্যাচার তিনি করেননি। বিবেকিতার সংবেদনা অনুচ্চকন্ঠে বেজে উঠেছে তার উচ্চারণে —
‘আমরা কেউ কেউ কবিতা লিখে থাকি
না লিখে পারিনা বলেই মনে হয়।
কিন্তু স্থির জানি
সারাজীবন ধরে
তিলে তিলে একজন সৎ বিবেকী
মানুষ হয়ে ওঠার পৌরুষ
একটি মহাকাব্যের বেদনা থেকে
কম জরুরি নয়।’
(উত্তরসূরি ১৩৯৫)
‘তরুণতর কবিদের প্রতি আবেদন’ শিরোনামের একটি গদ্যে ‘উত্তরসূরি’ পত্রিকায় লিখেছিলেন অরুণ ভট্টাচার্য,’১৯৩০-৮০ পঞ্চাশ বছরের দিনগুলি পার হয়েছে। বন্ধুগণ! এবার আপনারা র্্যাঁবো বওদল্যএর অথবা এলুয়ার মায়াকস্কি থেকে ফিরে আসুন মহাজন পদাবলী আর রামপ্রসাদের কবিতায়, শ্রীধর কথক এবং নিধু বাবুর গানে। দেশের মাটির গন্ধ বুক ভরে নিন। ধর্মকে আবার স্বরাজ্যে প্রতিষ্ঠা করুন। ধর্ম মানে কুসংস্কার নয়, ধর্ম মানে চিত্তের সুস্থির প্রতিবিম্ব। চৈতন্যের উন্মোচন।’ বস্তুত এ আহ্বান এক আত্মনিবেশী আধুনিক মানুষের আহ্বান। আধুনিকতা যা প্রবাহমানতার কথা বলে, যা আত্মনিবেশের কথা বলে, শিকড়সন্ধানী চেতনার জাগরণ ঘটায়— সেই আধুনিক মানুষের এই উচ্চারণ। তিনি বলতে পারেন, ‘কবিতা কবির দক্ষতা প্রমাণ করে না। কবিকে হৃদয়বান হতে সাহায্য করে। কবিতা ধর্মের নামাবলীও নয়, কবিতা স্বয়ং ধর্ম।’অরুণ ভট্টাচার্য জেনেছিলেন, ‘প্রচারের যুগে বহু অকবি কবির সম্মান পাচ্ছেন এটা দুঃখের। প্রচারসর্বস্বতার যুগে এই নির্মম সত্যকে স্বীকার করেই কবিকে স্বধর্মে আস্থাবান থেকে যেতে হবে।’ অরুণ ভট্টাচার্য স্বধর্মচ্যুত হননি। আজীবন স্বভূমে পরবাসী থেকে গেছেন এই কবি। কেননা নিজের অভিজ্ঞতার পৃথিবীর বাইরে কৃত্রিম পৃথিবীতে পা দেননি তিনি। কবিতার পাঠক হিসেবে সংবেদীর সমালোচক হিসেবে কবি জীবনানন্দ দাশ দেখতে পেয়েছিলেন তাঁর চিত্রবৃত্তির প্রশস্ততা। ১৯৫০ এ এক চিঠিতে জীবনানন্দ লিখেছিলেন তাঁকে, ‘আপনার মতন অল্প কয়েকজন পাঠক থাকলেও আমি নিজেকে সার্থক মনে করব। কাব্যপাঠ সম্পর্কে নিজের চেতনাকে শুদ্ধ ও সম্প্রসারিত করে একটি পরিষ্কার মতামতে পৌঁছুবার আগ্রহ রয়েছে আপনার।’…
অল্প কয়েকজন ‘প্রকৃতপাঠক’ হয়ে এবং অল্প কিছু পাঠকের কবি হয়ে থেকে গেলেন অরুণ ভট্টাচার্য। কলরবের পৃথিবী থেকে, আলোড়ন ক্ষোভ- বিক্ষোভের সাময়িকতা থেকে সরিয়ে নিয়ে এক অনুভূতির জগতে একাকী থেকেছেন এই কবি। কোন বাণিজ্যিক প্রকাশনসংস্থা তাঁর বই প্রকাশ করেনি। তিনিও কোনদিন বাণিজ্যিক কাগজের চাকরিতে যাননি। প্রকাশকের দরজা তাঁর চোখে সব সময় বন্ধ থাকতো। কালীকৃষ্ণ গুহ-র ভাষায় ‘সমস্তরকম প্রচারমাধ্যম ছিল তাঁর জন্য নিষিদ্ধ অঞ্চল।’ আজকের প্রচারসর্বস্বতার কালে, সর্বতো একটি আড়ালের ভেতর অনুভূতি প্রদেশ থেকে আলো এনে, আমাদের অস্তিত্ব-
অনস্তিত্বের অলৌকিক আততি ছুঁয়ে এই জীবন জনপদ কোলাহল কে পিছনে ফেলে, নাগরিক উচ্ছাস দূরে সরিয়ে অরুণ ভট্টাচার্যের মতো সংবেদনশীল কবি ক্রমশ বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন। আমরা খবর রাখলাম না। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ভাষায় ‘সংবেদনের শিল্পায়ন’সেই সব নিভৃত উচ্চারণ যা একই সঙ্গে আমাদের ‘সময়সংস্কৃতির গূঢ় ইতিহাস’ একটি ছায়াঘন হিমশীতল অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে নিল স্বাভিমান অহংকারে। বলেছিলেন অরুণ ভট্টাচার্য, ‘একজন সৎ কবির পাঠক তার মৃত্যুর বহু পরেও জন্মে থাকে।’ নদী- নারী- নক্ষত্র পেরিয়ে ধূলিধূসর নাগরিকতার চাপ পেরিয়ে, মহাকালের দিকে ধাবমান সেইসব অভিমান ভরা বিষন্ন উচ্চারণ গুলি স্বগতসংলাপ হয়ে জায়মান বেজে উঠবে হয়তো প্রকৃত পাঠকের নিভৃতির আয়োজনে—
‘কলসি ভেঙে রাঙা চিতায় জল
ঢালতে কে যে শিখিয়েছিল আমায়,
শিখিয়েছিল পিছন ফিরে
পুনর্বার তাকাতে নেই।…’

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

এ্যাডঃমনিরুল ইসলাম মনু on গুচ্ছ কবিতা : বেনজীন খান
পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা