spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যগ্রন্থের শক্তি এবং জাতির বুদ্ধিমত্তা

লিখেছেন : কাজী জহিরুল ইসলাম

গ্রন্থের শক্তি এবং জাতির বুদ্ধিমত্তা

কাজী জহিরুল ইসলাম

সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ভারত উপমহাদেশে বৈদিক সভ্যতার সূচনা করেন ভিনদেশিরা। মেসিপোটেমিয়া থেকে, মিশর থেকে, গ্রীস থেকে মানুষ এসে নতুন একটি সভ্যতার আলো জ্বালেন ভারতের বুকে। তারা রচনা করেন বেদ। তৈরী করেন তিনটি অভিজাত শ্রেণী, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য এবং এই তিন শ্রেণীর, অর্থাৎ ভিনদেশি মানুষের, সেবা করার জন্য স্থানীয়দের কাজে লাগান, তারা স্থানীয় মানুষের জন্যও একটি নিচু জাত নির্মাণ করেন, যার নাম দেন শূদ্র। কেন ভিনদেশিরা এত শক্তিশালী ছিলেন? কেন তারা নেটিভদের পায়ের নিচে রাখতে পেরেছিলেন? কী অস্ত্র ছিল তাদের কাছে? বৈদিক সভ্যতার কয়েক হাজার বছর আগেই উত্তর-পশ্চিম ভারতে (বর্তমান পাকিস্তানে) পৃথিবীর প্রথম সভ্যতা গড়ে ওঠে, যেটি মেহেরগড় সভ্যতা নামে পরিচিত। মেহেরগড় সভ্যতা বিলীন হয়ে যাওয়ার পরে এখানেই, সিন্ধু নদীর অববাহিকায়, গড়ে ওঠে মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা সভ্যতা।  মেহেরগড়ের লোকেরা কতটা শক্তিশালী ছিল, যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী ছিল কি-না সেই তথ্য পাওয়া না গেলেও আমরা ইতিহাস ঘেঁটে জেনেছি মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা সভ্যতা যথেষ্ঠ উন্নত ছিল, তাদের যুদ্ধবিদ্যার কৌশল জানা ছিল এবং প্রচুর সৈন্য সামন্তও ছিল। বড়ো বড়ো দূর্গ ছিল, বিশাল প্রাচীর ও পরিখা ছিল। তবু কেন ভিনদেশিরা এসে মহেঞ্জোদারো-হরপ্পার লোকদের  পরাজিত করতে পারলো এবং তাদের ওপর প্রভুত্ব করতে সক্ষম হলো। অস্ত্রবিদ্যার চেয়েও শক্তিশালী এক অস্ত্র তাদের কাছে ছিল, সেটা হচ্ছে বর্ণমালা। তারা লিখতে জানত এবং পড়তে জানত। হরফের চেয়ে শক্তিশালী কোনো অস্ত্র নেই, সেটা এই ভিনদেশিরাই প্রমাণ করে দেয়। তারাই রচনা করে ধর্মগ্রন্থ বেদ। নেটিভরা যাতে এই শক্তির স্পর্শ না পায় সেজন্য বেদ পাঠ এবং শোনা নেটিভদের জন্য, মানে শূদ্রদের জন্য, নিষিদ্ধ করে। কারণ তারা জানত নেটিভরা যদি বিদ্যাশিক্ষা গ্রহন করে তাহলে তাদের আর দাবিয়ে রাখা যাবে না।

পরবর্তিতেও আমরা দেখেছি যারাই গ্রন্থ রচনা করেছেন তারাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি বলে বিবেচিত হয়েছেন। অসির চেয়ে মসি যে অধিক শক্তিশালী তা বহুবার, বহুভাবেই প্রমাণিত। বেদের কিছুকাল পরে, প্রায় কাছাকাছি সময়েই, রচিত হয় তওরাত। এর কিছুকাল পরে রচিত হয় ইঞ্জিল বা বাইবেল এবং এর কিছুকাল পরেই রচিত হয় কোরআন। এইসব ধর্মগ্রন্থের অসুসারীরা ক্রমশ পৃথিবীতে প্রভুত্ব করতে শুরু করে এবং গ্রন্থের অনুসারী নয় যারা, আদিবাসী বা ধর্মহীন (প্রকৃতপক্ষে গ্রন্থহীন) মানুষেরা, তারা ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে থাকে।

আজ, এই তৃতীয় সহস্রাব্দে এসেও এই চিত্রের সামান্যতমও ব্যতিক্রম ঘটেনি। এখনও যে দেশের বা যে জাতির মানুষ যত বেশি বই পড়েন সেই জাতি বা জাতির মানুষ তত বেশি উন্নত। বই পড়ার দিক থেকে পৃথিবীর সেরা ৫টি দেশের নাম যদি উল্লেখ করি তাহলে তালিকাটি দাঁড়াবে এরকমঃ সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই দেশের মানুষ বছরে ২,৭৫,২৩২টি বই পড়ে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে চীন। এই দেশের মানুষ বছরে ২,০৮,৪১৮টি গ্রন্থ পাঠ করে। তৃতীয় অবস্থানে আছে ইংল্যান্ড, তাদের পঠিত বইয়ের সংখ্যা ১,৮৮,০০০। চতুর্থ অবস্থানে আছে জাপান এবং পঞ্চম অবস্থানে আছে জার্মানী। জাপানীদের পঠিত বইয়ের সংখ্যা ১,০৩৯,০৭৮, জার্মানীর সঠিক সংখ্যাটি জানা যায়নি। যদি একটু লক্ষ করেন দেখবেন মোট জিডিপির দিক থেকেও এই পাঁচটি দেশই পৃথিবীর শীর্ষে। সবচেয়ে বড়ো জিডিপির দেশ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং দ্বিতীয় অবস্থানে আছে চীন। সামরিক শক্তি, গ্রহ-নক্ষত্রে বিচরণের শক্তিও এই দুটি দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে।  

অনেকে বলেন ভালো বই পড়তে হবে, আজে-বাজে বই পড়লে হবে না। কথাটা ঠিক, কিন্তু আমি বলি কেউ যদি আজে-বাজে বই পড়ে মজা পায়, মানে আনন্দ পায়, তাহলে তাকে আজেবাজে বই পড়তে বাঁধা দেবেন না। আজেবাজে বই পড়তে পড়তেই তার বই পড়ার একটা অভ্যাস গড়ে উঠবে এবং ধাপে ধাপে সে ভালো বইয়ের দিকে অগ্রসর হবে। কেউ যদি শুধু পর্ণোগ্রাফির বই পড়তে চায়, আমি বলি তাকেও বাঁধা দেবেন না, গালমন্দ করবেন না। পাঠকের ভালো বই পড়ার একটা দায় তো জাতির জন্য, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আছেই, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি দায় লেখক সম্প্রদায়ের, তার ভাষার মানুষের জন্য মানসম্মত বই রচনার একটা বিরাট দায়িত্ব লেখকের ওপর আপনা থেকেই বর্তায়, যদি কেউ নিজেকে লেখক মনে করেন। পৃথিবীর অনেক জাতির লেখকের মধ্যেই জনপ্রিয়তার মোহ থাকে, এই মোহে তারা গণমানুষের আগ্রহের জায়গাটিকে পুঁজি করেন, গণমানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য বই রচনার দিকে ঝুঁকে পড়েন।  ভারতের বিখ্যাত লেখক খুশবন্ত সিং তার সারা জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে ৯৮ বছরে বয়সে লেখা ‘লেসন্স লার্ন্ড ফ্রম মাই লাইফ’ গ্রন্থে লেখকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘কখনোই পাঠকের স্তরে নেমে লিখবেন না, আপনি লিখবেন আপনার লেখা’।  এটি লেখকদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পরামর্শ। একটি জাতির গড় বুদ্ধিমত্তা যেখানে আছে, সেখানে নেমে আপনি যদি বই লেখেন সেই বই বেশি মানুষ কিনবে, যদি তার চেয়ে সামান্য ওপরে উঠে লেখেন তাহলে পাঠক কিছু কমে যাবে, যদি তার চেয়ে অনেক ওপরে উঠে লেখেন তাহলে হয়ত সেই জাতির লোকেরা আপনার বই পড়বেই না। এক্ষেত্রে লেখক হিসেবে আপনি কি করবেন?  বাংলাদেশের মানুষের গড় বুদ্ধিমত্তা হচ্ছে ৭৪.৩৩। সাধারণত ৮৫ থেকে ১১৫ হলো মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তা। ১১৫র চেয়ে বেশি যাদের তাদেরকে মেধাবী বলা হয়। ৮৫-র চেয়ে নিচে যাদের তাদেরকে স্বল্পবুদ্ধির মানুষ বলা হয়। বাংলাদেশের গড় বুদ্ধি স্বল্পবুদ্ধির পর্যায়ে পড়ে। গড় বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ অবস্থানে যেসব দেশ আছে সেগুলো হচ্ছে জাপান, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, হংকং প্রভৃতি। এসব দেশের মানুষের গড় বুদ্ধিমত্তা ১০৪ থেকে ১০৬।

বাংলাদেশের মানুষের গড় বুদ্ধিমত্তার কথা জানার সঙ্গে সঙ্গেই নিশ্চয়ই পাঠকদের একটা আগ্রহ তৈরী হয়েছে প্রতিবেশি দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মানুষের গড় বুদ্ধিমত্তা কত? হয়েছে না? বলছি, এই দুটি দেশও আমাদের প্রায় কাছাকাছি, তবে সামান্য ওপরেই আছে। ভারতের গড় বুদ্ধিমত্তা হচ্ছে ৭৬.৭৪ এবং পাকিস্তানের ৮০.০০।

এখন কথা হচ্ছে বাংলাদেশের লেখকেরা যদি ৭৫ বুদ্ধিমত্তার গ্রন্থ রচনা করেন তাহলে জাতির গড় বুদ্ধিমত্তা খুব সহজে ওপরে উঠবে না। লেখকদের কিছুকাল ৮০, এরপর ৯০, এরপর ১০০ এবং আস্তে আস্তে আরো ওপরের স্তরের বুদ্ধিবৃত্তিক গ্রন্থ রচনা করতে হবে। এটি হচ্ছে লেখকদের একটি বড়ো দায়বদ্ধতা। নিউইয়র্কে বইমেলা শুরু হচ্ছে, সাপ্তাহিক আজকাল পত্রিকার সম্পাদক মনজুর আহমদ অনুরোধ করেছেন আমি যেন বই নিয়ে একটি গদ্য লিখে দেই। লেখাটি লিখতে গিয়ে এই কথাগুলোই মনে এলো।

ম্যানহাটন, নিউইয়র্ক। ১১ জুলাই ২০২৩

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ