spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধআপোষহীন আধুনিক কবি সামসুল হক

লিখেছেন : আবু রাইহান

আপোষহীন আধুনিক কবি সামসুল হক

আবু রাইহান

বাংলা কাব্য জগতে এক আপসহীন আধুনিক কবির নাম সামসুল হক! তাঁর বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ও আশ্রয় ছিল কবিতা! যিনি বিশ্বাস করতেন জীবনকে যা সুন্দর করে গড়ে তোলে তাই কবিতা! নিজের কাব্য ভাবনা নিয়ে তাঁর অভিব্যক্তি ছিল– ‘আমার কবিতার উৎস দুঃখ! দুঃখময় জীবন ও পৃথিবী! আমার জীবন চর্চা এবং আমার কবিতা একই প্রকৃতিতে, একই মাটিতে, একই শ্রেনীর কিছু ভিন্ন গোত্রের দুটি গাছের মতন! একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত! আমি সেই কবিতা লিখতে চেয়েছি যা আমাকে আরেকটু সুন্দর করবে! যা আমার প্রেমের পূর্ণতা দেবে! আমার পরিবেশকে আরো একটু সুস্থ করে তুলবে! কবিতা এমন এক লোকে পৌঁছে দেবে, যা তথাকথিত বাস্তব জীবনকে ছুঁয়ে ও বৃহত্তর কোন বাস্তব লোকে যাবার প্রস্তুতি হিসেবে অন্য একটি লোকে পৌঁছে দেবে!’

‘তবু জানি, ফুলের চেয়ে পাখির চেয়ে নদী
এবং আলোর চেয়েও গভীর জাতক
সুরস্মিতা নিবিড় থেকে নিবিড়তরভাবে
করে শুদ্ধস্নাতক!
তাকে যদি কবিতা বলি- না জানা নির্ঝর-
একটি সুঠাম নিবিড়তম কবিতা ঈশ্বর!’

কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, সামসুল হক একজন জেদি কবি! কাকদ্বীপে বসেই সে বাংলা আধুনিক কবিতার জগতে নিজস্ব যুদ্ধ চালিয়ে গেছে! কাকদ্বীপে বসেই সে প্রকাশ করেছে পত্রিকা ,ছাপিয়েছে একটার পর একটা নিজের কবিতার বই! তার কোনোটিতেই গ্রাম্যতার ছাপ নেই! তাঁর রাশ ও দৃষ্টিভঙ্গি রীতিমতো নাগরিক! অথবা বলা যায় বিশ্ব মানবিক! সামসুল হক কখন ও হার স্বীকার করেননি! তাঁর কবিতার মধ্যে একজন ঝকঝকে তেজী মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায়! সমস্ত পৃথিবী সম্পর্কে যার চোখ কান খোলা, শব্দ ব্যবহারে যে যথেষ্ট সচেতন!
কবি রফিক উল ইসলাম সামসুল হকের শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় লিখেছেন, শামসুল হক বাংলা ভাষার এমন একজন কবি যিনি তাঁর প্রয়াণের প্রায় এক যুগ আগেই লিখে ফেলেছিলেন– ‘আমার কবরের জায়গা বিক্রি করে আমি স্বাধীনতা কিনব!’ এই বাক্যটিতে যেন মিশে আছে তাঁর সার্বিক জীবনবোধের অন্তর্গত ধ্বনি! কবরের মতন তীব্র নির্জন এক আত্মপরিধির ভেতর উন্মুক্ত স্বাধীনতার অন্বেষণ করতে চেয়ে ছিলেন তিনি!নিজেকে স্বেচ্ছানির্বাসনের কঠোর বৃত্তে স্থাপন করে কবি শামসুল হক উপভোগ করতে চেয়ে ছিলেন ভিন্নমুখী আর ব্যতিক্রমী এক স্বাধীনতা! তিনি চেয়েছিলেন নিজেকে সংস্থা বিহীন কিংবা উপাধি বিহীন করে তুলতেও!আসলে তিনি তো ছিলেন স্বেচ্ছা ক্রীতদাস! এইসব চেনাজানা হয়তো তেমন কিছুই নয় তাঁর সমগ্রতার নিরিখে! যাঁর খন্ড শরীর আজও ভেসে আছে ব্যক্তিগত পাপ-পুণ্যের গাঙুড়ের জলে, আর ভেসে ভেসে যাচ্ছে আমাদেরই ভারতবর্ষের দিকে!

‘দস্যু লিরিক তুমি আমার তন্ত্রবিদ্যার স্বাধীনতা হরণ করে নাও
এসো আমার দিনযাপনের নীল লব কুশ মধ্যরাত্রে আমার অশ্বমেধের ঘোড়া ধরো
ভাঙো শরীর বেহুলা-লক্ষিন্দরে দু’খন্ড হও ভাসো ভাসো ব্যক্তিগত পাপ-পুণ্যের গাঙুড় জলে
ভাসো শরীর ভাসতে-ভাসতে ঘাট পেরিয়ে পৌঁছে যাচ্ছ ভারতবর্ষে!’
কবি জয় গোস্বামীর তাঁর কবিতা থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে ‘ঈশ্বর ও প্রেমিকের সংলাপ’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন! আর কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাকে নিয়ে কবিতা লেখেন–
‘এক কবি ছিপছিপে
থাকেন কাকদ্বীপে
হাজার টোপ দিয়েও তাঁকে
গাঁথা যায়না ছিপে!’

সাহিত্যিক তপন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, বিডিও হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে কাকদ্বীপে পাঁচ বছরের বসবাস সব দিক দিয়েই আমার জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়! কবি সামসুল হকের সান্নিধ্যে থেকে যেমন কবিতা চর্চায় উৎসাহ পেয়েছি! তেমনি সুন্দরবনের মতো দুর্গম ও প্রাকৃতিক বৈচিত্রে গ্ল্যামারাস পটভূমিতে বাস করার সুবাদে পরবর্তীকালে লিখতে পেরেছি ‘নদী মাটি অরণ্য’ নামের তিন খণ্ডের ন’শো পৃষ্ঠার উপন্যাস! যাতে বিধৃত করতে পেরেছি সুন্দরবনের জনপদ গড়ে ওঠার একশ বছরের ইতিহাস ও সেখানকার মানুষের এক আশ্চর্য জীবনযাপন! যে জীবনের কথা শহুরে মানুষেরা দূর কল্পনাতেও ভাবতে পারবেন না! কবি সামসুল হকের কথা ভেবে কাকদ্বীপে পোস্টিং না নিলে হয়তো লেখাই হতো না এই বই! আপাদমস্তক কবি বলতে যা বোঝায় সামসুল হক ছিলেন এমনই একজন! কাকদ্বীপ শহরের ঠিক মাজা ফুঁড়ে কালনাগিনী নামের একটি ছোট খাল প্রবাহিত! যার কিনারার কাছেই অদ্ভুত গড়নের দোতলা বাড়িতে সামসুল হক কাটিয়েছেন বহু বছর! কবি সামসুল হকের জীবনে কবিতা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো প্যাশন ছিলো না! দোতলার ছোট্ট ঘরটিতে বসে সারাদিন শিক্ষকতা সময়টুকু ছাড়া ব্যস্ত থাকতেন কবিতা লেখায়, পত্রিকা ও বই প্রকাশের ভাবনায়! তাঁর কবিতায় সর্বদায় নিহিত থাকে এক ধরনের সাংকেতিকতা! যা কবিতাটির বাইরের অর্থের মোড়ক পাঠ করে অনুভব করা যায় না! তাঁর কবিতার অর্থ উপলব্ধি করতে হলে আরো গভীর দৃষ্টি দিয়ে পড়তে হবে, বোঝার চেষ্টা করতে হবে প্রতিটি শব্দের ভিতরকার অর্থ!

‘শ্মশানের মৃতশিশুর মুখে লেগে থাকা হাসির মতো
গোপন যন্ত্রণা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে
রক্তস্রোতকে অন্য তারল্যে রূপান্তরিত করে
আর সে সময় পদ্মের একান্ত সাপ
স্তব্ধ পথিকের পায়ের আঙ্গুলে
মহান শিল্পীর নিপুণতায় ছিদ্রের ভাস্কর্য গড়ে তোলে’—

কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্ত লিখেছেন, কবি সামসুল হককে অনেকে চিত্রিত করেছেন প্রতিবাদী সমাজমনস্ক কবি হিসেবে! এটা শুধু তাঁর একাংশ মাত্র! আসলে তিনি শ্লেষ, তির্যক, ব্যঙ্গ প্রভৃতির সহায়তা অস্ত্র নিয়ে সমাজের অসাম্য অন্যায়কে ছেদন করতে চেয়েছেন এও যেমন সত্য তেমনি তাঁর অন্যাংশে ছিল লাবণ্য অন্বেষণের জন্য প্রবল আর্তি! তাই তাঁর কবিতায়, ‘ভিখিরি বালক শেষ রাত্রির স্বপ্নে /ভাত খেতে খেতে বলে উঠল /চাঁদ দেখবো মা!’ কিংবা অন্য একটি কবিতায় কবি নিজেই বলে ওঠেন, ‘জ্যোৎস্নায় ফোটাবো ফুল /বল কার প্রতিবাদ আছে!’ অসম্ভব আত্মসন্ধানী কবি আত্মবিক্রয় করতে পারেন না! তাই তিনি নিজের প্রতি গভীর প্রত্যয়ে লেখেন-

‘কিনে নয় কেটে নিতে পারো আমার মাথাটা
তাতে দূর হবে কি পথের যাবতীয় কাঁটা
রেখে যাবো হাসির আঁচড় তোমার দেয়ালে
তার থেকে প্রেত বের হবে রহঃক্রীড়াকালে!’

কবি সামসুল হকের জন্ম ১৯৩৬ সালে ১৬ ডিসেম্বর দক্ষিণ ২৪ পরগনার টেকপাঁজা গ্রামে মামার বাড়িতে! শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবনের সূচনা, আমিতো শিক্ষকতায় করেছেন কাকদ্বীপের সুন্দরবন আদর্শ বিদ্যামন্দির এ! সম্পাদনা করেছেন ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘পাক্ষিক বাংলা কবিতা’, ‘সিসিফাস’, ‘জল’, ‘ষাটের দশক’ ইত্যাদি সাহিত্য পত্রিকা! কবি সামসুল হকের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ২১ টি! এছাড়া দশটি ছড়াগ্রন্থ, একটি অনুদিত কবিতা গ্রন্থ এবং একটি কাব্য নাটকের গ্রন্থ এবং দুটি গল্পগ্রন্থ ও রয়েছে!
১৯৬৪ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘হৃদয়ের গন্ধ’ প্রকাশিত হয়! ১৯৭৯ সালে এই কাব্যগ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করার সময় কবি গ্রন্থটির নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘চন্দনবিল’! অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ গুলি হল– ‘নিজের বিপক্ষে’(1965),‘প্রোটোপ্লাজম’(1966),‘বাংলাদেশের জন্য’(1971),‘চলচ্চিত্র’(1972),‘ডায়েরী’(1973),‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়:এই পৃথিবী’(1974), ‘নিভন্ত মোমবাতির তলায় সাদা ঘোড়া’(1975), ‘সোনার ত্রিশূল’(1978), ‘পাপপুণ্য’(1980), ‘খোকা ভাত খাবি আয়’(1982), ‘কবির ভ্রমণ’(1985), ‘তিনি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’(1985), ‘ইডেনের তৃণমূল’(1986), ‘গ্রুপ থেরাপি’(1988), ‘চড়ুই পাখির বিচার’(1989), ‘ত্রসরেনু’(1990), ‘সুটকেসের ওপর বসে আছি’(1991), ‘প্রক্ষিপ্ত প্রহর’(1992), ‘আবহাওয়ার মুদ্রাদোষ’(1994), ‘নিঃস্বপ্ন পার্বণে যাবো না’(1997)!

কবি সামসুল হক ১৯৫৮ সালে বিএ পাস করার পর পুরন্দরপুর হাই স্কুলে শিক্ষকতার কাজে যোগ দিয়েছিলেন! ওই স্কুলের শিক্ষিকা নীলিমা দের একমাত্র কন্যা ভালো গান জানা কলেজ পড়ুয়া করবী দের প্রেমে পড়েন! কবি সামসুল হক ও করবী দে পরস্পরকে ভালোবেসে রেজিস্ট্রি করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৬০ সালে! ১৯৬৫ সালে বি টি পাশ করার পর কবি সামসুল হক কাকদ্বীপের উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় সুন্দরবন আদর্শ বিদ্যামন্দির এ শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন! বহু পরে করবী দে নিজে থেকেই করবী হক হয়ে মুসলিম ধর্মের বিভিন্ন নিয়ম কানুন মানতে শুরু করেন! ২০০২ সালে মৃত্যুর পরে তাঁকে (করবী হক) কাকদ্বীপের এক কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়! কবি সামসুল হক ও কবিপত্নী করবী হকের একমাত্র সন্তান কবিরুল হক তথা ওথেলো হকের জন্ম হয় ১৯৬২ সালে!
কবি সামসুল হকের কবিতা বাংলার সমস্ত প্রথম শ্রেণীর কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে গুরুত্ব সহকারে! দেশ পত্রিকার সুবর্ণজয়ন্তী কবিতা সংকলনে(1933-1983)পর্যন্ত পঞ্চাশ বছরের বাছাই করা আধুনিক বাংলা ভাষার কবিদের তালিকায় সামসুল হকের নামও রয়েছে! এই সংকলনে কবি সামসুল হকের ‘একই তরবারি নামক’ একটি কবিতা রয়েছে!

‘কেন ওই একই তরবারি দিয়ে সুন্দরকে জাগাতে হয় প্রতিদিন
কেন প্রতিদিন ওই একই জ্যোৎস্নার পাথর গলায় বেঁধে দিয়ে
অন্ধ ভিখারিনীকে লাল দীঘির জলে নামাতে হয়
রামমোহনের স্ত্রীকে কেন
প্রতিদিন সহমরণে যেতে হয়
‘ঈশা বাস্যমিদং সর্বম’-এর চিতায়’-

বাংলা ভাষার অত্যন্ত শক্তিশালী কবি সামসুল হকের একাধিক কবিতা বিদেশী ও প্রাদেশিক ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রায় দুই শতাধিক কবিতা সংকলন পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে!
বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচক সুমিতা চক্রবর্তী কবি সামসুল হক ও তাঁর কবিতাকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেছেন, কবি সামসুল হক নিতান্ত মধ্যবিত্ত এক জীবনযাপন করেছিলেন আর্থিক সঙ্গতি ও সামাজিক স্তর বিন্যাসের দিক থেকে! কিন্তু চিরকাল তিনি মগ্ন থেকেছেন নিজের সাহিত্য সৃষ্টি কর্মে এবং সাহিত্য সংক্রান্ত অন্যান্য কর্মোদ্যোগে! বিপণনযোগ্য সাহিত্য সৃষ্টিতে তিনি সচেষ্ট হননি! কবিতার আকাশকে বিস্তৃততর ও নির্মলতর করে তোলবার জন্যই তিনি দান করেছিলেন তাঁর সারা জীবনের সব প্রয়াস! তিনি সেই কবি যাঁকে পাঠক সহজে ভুলতে পারেন না! কবি সামসুল হক তাঁর কবিতা লেখার দিনগুলি কাটিয়েছেন কলকাতার বাইরে অনেক দূরে কাকদ্বীপে! কলকাতা শহরের নিত্য উজ্জ্বলিত সংস্কৃতি মঞ্চের পাদপ্রদীপের আলো তাঁর উপরে পড়েনি! সারা জীবন ধরে শক্তিশালী এই কবি বাংলা ভাষায় উল্লেখযোগ্য কবিতা লিখে গেলেও স্বীকৃতি যোগ্য কোনো পুরস্কারই পাননি, কোথাও তাঁকে তুলে ধরেনি কেউ! তা সত্ত্বেও কবি সামসুল হককে কবিতা প্রিয় পাঠক মনে রেখেছেন তাঁর কবিতার জন্য! কবি সামসুল হক জীবনের সুগভীর বোধ এবং বধির কবিতা লিখে গিয়েছেন! কবিতায় একটি দর্শন থাকা দরকার এমন মনে করেন যে কবিরা তাঁদেরই একজন তিনি!

‘কাজলের মতো কেউ ঢিল ছোঁড়ে দুপুরের চন্দনের জলে!
নিচু হয়ে উড়ে গেলো বেনেবউ! কিছু টলে ঘাটের কাছেই-
সুরমার বিয়ে জষ্টিমাসে, তাই বুকে সাবানের ফেনা তুলে
ঘষছে নাড়ছে-স্তন দুটো যেন স্বচ্ছ শ্বেতপদ্মের করোক!
পাড়ের উপরে দুটো তালগাছে এগারোটি বাবুইয়ের বাসা
বাতাসে দুলছে বেশ! অন্যদিকে চড়ুইয়েরা জুড়েছে তামাশা!
আমিও দেখিনি কোনো চন্দনের বিল- তার কল্যাণীয়া রূপ
কেবল এঁকেছি আমি প্রাণভ’রে ঈশ্বরের সস্নেহ নির্দেশে:
আমিও ঈশ্বর আজ দুপুরের চেতলার নিবিড় নির্জনে
রঙ তুলি জল নিয়ে চন্দনবিলের কথা ভেবেছি দুজনে!’
(চন্দনবিল)

কবি সামসুল হকের কবিতায় কোন কেন্দ্রীয় বিন্দু আছে কিনা তার সন্ধান করা সহজ নয়! বহু বৈচিত্র্যের চিত্তাকর্ষক তাঁর কবিতা! জীবনের ও পৃথিবীর প্রগাঢ় সমগ্রতায় ডুবে যেতে যেতে অস্তিত্বের প্রতিটি পরতের দংশন ও শুশ্রূষার স্বাদ পেতে পেতে জীবনে বহুমুখী আকর্ষণের সংবেদনায় সাড়া দিতে দিতে তিনি যেভাবে জীবনকে জেনেছিলেন তাঁর সত্তার গভীরে-সেই উপলব্ধিকেই তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর কবিতায়! সেই সংবেদীতা কখনো নৈরাশ্যের,কখনো চরিতার্থতার,কখনো অস্থিরতার,কখনো প্রশান্তির! কখনো যন্ত্রণা আর কখনো রহস্যের সব জড়িয়ে গরল আর অমিয় মিশ্রিত এক পূর্ণ জীবনানুভব!

‘গ্রহণ আমার সামনে প্রসারিত! যে-কোনো যে-কোনো উপলক্ষে
ভালোবাসা দেওয়া যায়! ভালোবাসা,তোমাকে ঘুমের প্রয়োজনে
না-লাগিয়ে একমাত্র ঘরে আনি অস্তিত্বের জাগরন বলে;
জাগরণ একা-একা ঘটে যায়!
– এবার যখন
অন্ধকারে ফুলদানির অবয়ব দেখতে যাবো,ভালোবাসা,তুমি
বাঁচার প্রতিমা হয়ে বলে যেয়ো আমাদের দায়িত্বের কথা!’
(বাঁচার প্রতিমা)

কবি সামসুল হকের কবিতা রচনাশৈলীর আরেক নিজস্বতা তাঁর পঠন ও মননের স্বাক্ষরে! সরল বচন তাঁর নয়! প্রতীক চিত্রকল্পে গূঢ় এবং সেই নিহিত আভায় উজ্জ্বল তাঁর কবিতা সেই সঙ্গে জগৎ-ব্যাপ্ত,জ্ঞানের ভুবন,পূর্ব সঞ্চিত সাহিত্য- শিল্প- সংস্কৃতির পরিসর এবং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে তুলে আনা বিষয়োল্লেখ তাঁর কবিতায় যথেষ্টই! আধুনিক কবিরা সকলেই মেনে নিয়েছেন এই রীতির যৌক্তিকতা আর তা প্রয়োগও করেছেন নিজেদের প্রয়োজন মতো!
কবি সামসুল হক এর কাব্যভাষা সম্পূর্ণ নাগরিক!কবি দেশ সচেতন এবং মানব সচেতন নাগরিক!

‘কারা তাকে অন্তহীন ক’রে তোলে অনন্ত নিজেও
জানে না, জানেনি- তারা কুকুরকে বেঁধেছিলো চাঁদের মতোন,
কুয়াশার জন্য রথ পাঠায়-পাঠিয়েছিলো,আর,
নিজেরা অশ্বথ হয়ে মধ্যমাঠে প্রতীক্ষায় ছিল!
তারা কি মানুষ সুদ রেস কেরানি ও মহিলার লৌকিক গঠনে-
মানুষের মতো তারা শ্মশানকে শিখিয়েছে মাছেদের খেলা,
তবু তারা একদিন ভুলে যায়-পৃথিবীতে তারা এসেছিলো!
পৃথিবীতে এসেছিলো ভুলে গিয়ে ঘর খোঁজে-ঘর পেয়ে যায়,
আর,ঘর মানুষকে রেখে দ্যায় সাপের মাথায়!’
(হৃত অলৌকিকতা)

কবি সামসুল হক তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে অকপটে বলেছেন- ‘কবিতার কোন বাঁধাধরা ডেফিনেশন দিতে চাইনা! আমি চাই কবিতা আমাকে এক পরমতায় পৌঁছে দেবে! যদিও জানি সর্বাংশে তা সম্ভবপর নয়! গভীর নিদ্রা থেকে কবিতা আমাকে জাগিয়ে তুলবে! আবার দীর্ঘ অনিদ্রা থেকে এনে আমাকে ঘুম পাড়াবে! আমাকে উত্তেজিত করবে,ক্ষতিকর উত্তেজনার উপর শীতল প্রলেপ দেবে! আমার জীবনচর্চা এবং আমার কবিতা একই প্রকৃতিতে,একই মাটিতে, একই শ্রেনীর কিন্তু ভিন্ন গোত্রের দুটি গাছের মতোন! একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত! গাছটি চেহারায়ও ধরনে দেবদারু বা ঝাউয়ের মতোন-শঙ্কু আকৃতির! তবু কোন রক্ত-মাংসের মানুষের পক্ষে সুপ্রিম কোন কবিতা লেখা সম্ভব নয়! অগত্যা,আমাদের মেনে নিতে হয়,কবিতা কোন সৃষ্টি নয়,একটা নির্মাণ মাত্র!’ এই নির্মাণের খোঁজে তার সম্পূর্ণ কবি জীবন কেটেছে!

‘নিজের বিপক্ষে হলে প্রতিবাদ কিছুই আসে না!
নিজের বিপক্ষে বলা সবচেয়ে নিরাপদ! দ্যাখো,
বাতাস পশ্চিম থেকে পূর্বে এলে আকাশের বক্তব্য থাকে না;
বাগানের তর্জনী ওঠেনা
যখন হলুদ ফুল লাল হয়! আসল রহস্য,
নিজের বিপক্ষে সব প্রতিবাদ! নিজের পাতাল-
প্রবেশের জন্য সব প্রতিবাদ! স্ত্রী আত্মীয় বন্ধু
স্বরের ব্যাপারে শুধু সহায়তা করে,কিন্তু আমার প্রতীকী অনিদ্রার
প্রতিবাদ করে না! যে-রাজ্যপাট উল্টে দিয়ে আমি বেপরোয়া,
তার সিংহাসন নিজে মাথায় বহন করে যাই,
অথচ কোথায় প্রতিবাদ?’
(নিজের বিপক্ষে)

‘স্বর্গ থেকে বিদায়ের যন্ত্রনাকে ভালবাসি ব’লে
বারান্দার সীমারেখা পার হয়ে ঘরে ঢুকতে যাই,
তখন বারান্দা ক্রোধে হা-হা ক’রে হেসে উঠলো জোরে!
বিদায় স্বজন শব্দ,বিদায় সুনেত্রা প্ররোচনা,
বিদায় ঘরের সীমারেখা,
এখন স্বর্গের ঠিক বিপরীতে চলে যাওয়া ভালো,
হাসি তো স্বর্গের বিপরীত,
আমি ও বারান্দা জোরে একসঙ্গে হেসে চলে যাই!’
(স্বর্গ থেকে বিদায়)
‘পর্দার আড়াল থেকে কার কন্ঠে ডেকে উঠল ‘রানু’,
গভীর আদ্রতা থেকে কার কন্ঠ ডেকে উঠলো ‘মণি’,
পর্দার আড়াল থেকে ছড়ালো কে অসংখ্য বীজাণু-
কে যেন আমাকে ডাকছে:ফাসিঁকাঠে ঝোলাবে এখনি!
‘মৌলকণ্ঠ’ পরিহাস, ঘরময় বিশ্রী মাতামাতি;
পোকার দাপটে জীর্ণ হয়ে গেছে বৃক্ষ-লতাপাতা!
কয়েকটি মানুষ পথে সরে যাচ্ছে, গলায় প্রভাতী;
পাহাড়ের শীর্ষে উঠে কার কণ্ঠ গায় শোকগাথা!’
(বীজাণু)
‘কে তোকে সমুদ্রে যেতে বলেছিলো – সময় না ফুটন্ত গোলাপ?
কে তোকে পাথর ভাঙতে পাহাড়ে পাঠালো রাত্রি? বৈষ্ণব কবিতা?
আমি একা,- কী ক’রে সামলাবো দীর্ঘ প্রশ্নচিহ্নে বিদীর্ণ ফুলদানি;
কীভাবে ওঠাবো মাথা অগ্নি-পরীক্ষার পরে যদি আসে সীতা!
সমুদ্র কি আশৈশব নর ছিলো ? মানুষ কি আশৈশব সেলফিশ জায়ান্ট ?
নাকি, আমি নোয়া-র প্লাবন পূর্ব যুগ থেকে নিজে তৈরি করেছি ললাট
পাহাড়ে সমুদ্রে একা যাবো ব’লে?’
(একা যাবো ব’লে)
‘আপনি শুধু শান্ত থাকতে বলেন আমায়,বিশুদ্ধ থাকতে!
ফুল যে ভালো, যাহোক তবু শিখিয়ে দিলেন,
আমি তো হায় রক্তরাঙা ছুরিটাকেই ফুল ভেবেছি;
চাঁদের আলোই গন্ধরাজের গাছের নিচে
ঐ আপনার কাপড় থেকে
বেরিয়ে এসে সত্যকে না মহত্ত্বকে কামড়েছিলো শান্ত বিছে,
আমি তবু চেঁচাইনি!
ভীষণ ভীষণ ঘুমের বড়ি তখন আমার হাতে ছিল?’
(আপনাদের আমি ঘেন্না করি)
‘জাগার সময় শাদা কাগজ শূন্য রাখতে ভালো লাগে?
গাছ-গাছালির সারা বাতাস বুকের ভিতর বিপুল ভাঁজে
রক্ষা করতে ভালো লাগে?
জাগার সময় রাজ্যপাটের খবর কিংবা কোষাগারের
গোপন চাবি
নিপুল ভুলে শান্ত থাকতে ভালো লাগে?
ক-জন নারী বুঝতে পারে আমার জাগা,জাগার ভাষা?’
(গোপন চাবি)
‘তুমি লোনাজলমাখা নাবিক-সমস্ত শরীর জুড়ে উজ্জ্বল ফসফরাস,
এগিয়ে গেলেই আলেয়ার আলো মরে যাবে;
তুমি সমুদ্রের সবচেয়ে পরিচিত-সমস্ত শিরার মধ্যে প্রবল গর্জন,
এগিয়ে গেলেই ভুতুড়ে গির্জার ঘণ্টা ডুবে যাবে;
তুমি মানুষ,
তোমার জাগ্রত নিশ্বাসে ঠিক গোলাপের গন্ধ মিশে আছে!’
(স্থলভূমির দিকে যাত্রা)
‘ঘৃণা দিয়েই একটা জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়
অন্য-জীবন ভালোবাসায়
দুহাত দূরে আরো কাছে হাসির জন্যে দোকানদারি
পায়ের নিচে থলথলে চাঁদ ওৎ পেতে রয় গভীর নিনাদ
ঘৃণার বুটি ফুটিয়ে দ্যাখো কেমন দেখায় বুকের শাড়ি
হাঁটা-চলার আরো নিয়ম পালন করে পায়ের পাতা
বসার ভঙ্গি মুখের রেখায় পিছলে পড়ে পরিত্রাতা
ঘৃণা দিয়েই এখন জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়
তখন জীবন ভালোবাসায়’
(অন্য জীবন ভালোবাসায়)
‘ভয় দ্বিধা ও পুলক আর ভুল বোঝাবুঝি হয় মেধা ও শ্রমের প্রথম মিলনে
মেধার ভিতরে থাকে বাবা-মার বিছানার স্মৃতি
আর্যদের পঠনবেদীর মতো সুদূর বিছানা ভেসে ওঠে
আর ভূর্যপত্রের খসখস শব্দ শ্রমের সায়ায়
মেধার স্নায়ুর লতা ভীষণ জড়িয়ে যায় নিঃশ্বাসের হরিণের শিঙে
শ্রমের ভিতরে থাকে শস্যাধার জাতকের স্বপ্ন
ঠোঁটে স্তনে তলপেটে আষাঢ়ের বৃষ্টির প্রবাহ
পায়ের পাতায় তার মেঘের পাথর ভাঙা গোপন বিদ্যুৎ
শ্রমের নিতম্ব জুড়ে লাঙল চালায় ভারতীয় কৃষকেরা’
(প্রথম মিলন)
‘অর্ধেক আকাশ গ্রামকে দান ক’রে বাকি অর্ধেক নদীকে দেবে ব’লে
নিজের অধিকারে রেখেছে পূর্ণিমা
বুনো কচু পাতায় চারফোঁটা শব্দ টলমল করতে করতে
ঘাসের ঠোটে ভেঙে পড়লো
বাতাস মেলায় তার সর্বস্ব দান ক’রে একবস্ত্রে ফিরে যাচ্ছে ওই
শুধু সরস্বতী নদী থেকে উড়ে-আসা একটা ছায়া
কানপেতে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে
কে কখন কাকে বলবে খোকা ভাত খাবি আয়’
(খোকা ভাত খাবি আয়)
‘পাখিদের সংসার মানে কি ধ্রুপদী সাম অথবা সে ঠোঁট-ছোঁয়ানো পায়ের
আলতা কিংবা জলের-ভিতর-শোনা বৃষ্টিপতন তা-ই যদি হয় তবে পর্ণা বললো
কেন চিড়িয়াখানায় মাছরাঙাদের শ্রোতৃ বৃন্দ অনুপস্থিত তা-ই যদি হয় তবে
কেন সাধারণতন্ত্রদিবসে লালকেল্লায় সালিম আলি পতাকা উত্তোলন করতে
আসেন না বা থাক সে কথা কথা হলো শীত-বসন্ত পাখিদের কি পরামর্শ নেয়
কখনো কিংবা পাখি কখনো কি ওই পর্নার চোখের জলের সঙ্গে জল বিষয়ে পরামর্শ করেছিলো এখন ভীষণ গদ্যকথা শোনার আগেই পার্থ জয়দ্রথের দিকে এগিয়ে যায় তবু
পাখিদের সংসার নিয়ে আমরা শুধু সালিম আলির সঙ্গে কথা বলবো’
(সালিম আলির সঙ্গে বলবো)
‘নিরক্ষরকে তিনি বললেন পড়ো
মগ্ন গুহাও কেঁপে ভেসে যায় পাথরে শান্তি শান্তি
নিরক্ষরকে তিনি বললেন অন্ধকারের বাতাসের লেখা পড়ো
বাতাস নিমেষে লিপি হয়ে যায় বাতাস বিচ্ছুরিত
কাঁপা ভাঙ্গা গলা স্বরের ক্ষরণ
জানি না বাচন জানি না
বুকে বুক রেখে বললেন তিনি পড়ো
ঝ’ড়ো নীল ভেজা স্বরের ক্ষরণ
জানি না বাচন জানি না
পাঁজরে পাঁজর রেখে বললেন পড়ো
মাটি আগুনের যৌগে বলেন পড়ো
মগ্ন গুহায় চৌচির ঢেউ আঁধারে শান্তি শান্তি
আর তারপর বাচন নিরক্ষরের
সব সর্জন
প্রটোপ্লাজম
মানুষ
কলম
জ্ঞান
মহাঝরনার জল’
(প্রথম পাঠ)
‘খুনিও কবিতা লেখে হঠাৎ-ই সে লেখে
‘সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!’
জীবনানন্দের এই লাইনটি তুমি কেন লিখলে আবার
শুনে খুনি ঝড়ের ভিতর থেকে আন্তরিক বিস্মিত হয়েছে
খুনি ও কবিতা লেখে
বলেছিলো অন্য এক খুনি
শুনিয়েছিলো অন্য এক খুনি
যে প্রতি রাত্রি তার কবরের শূন্য থেকে উঠে এসে
খুন করে কিশোর কবিকে’
(খুনি)
‘প্রেমিকা খেয়েছি পুত্র খেয়েছি স্ত্রী খেয়েছি এবার
বন্ধুরা আমাকে খাচ্ছে ওরা না-জেনেই জীবজন্তুসহ অন্ধকার খায়
না জেনে মানুষসহ দিনমান খায়
দুপুরে কলকাতা খেয়ে তার রক্ত বান্ধবীর আঁচলে মুছেছি সন্ধ্যাসমুদ্রের ধারে
-এই তো সৃষ্টির কথা এই তো দ্বন্দ্বের কথা মিলনের কথা
কবির মৃত্যুর কথা কবিতার জন্মকথা এই’
(কবিতার জন্মকথা)
‘আমি পৃথিবীতে আছি এটাই কি আমার যথেষ্ট নয় অরু
পৃথিবীতে শুয়ে-থেকে-জাগা আছে পাখিদের ঠোঁটে
খরকুটো থাকে জলে নুন থাকে হেমন্তে কুয়াশা
এখনো পুকুরে ভোরে জাল ফেললে শালুক মৌরালামাছ ওঠে
সেই সঙ্গে গত শীতে হারানো আধুলি
-মাঠে ধান-কুড়োনিকেকে দেখে খুব ঈর্ষা করে মেঠো ইঁদুরেরা
আমিও ঈর্ষায় বাঁচি পৃথিবীতে ঈর্ষা তো শিশুর স্তন্যপান
আর খুব ভালো লাগবে যদি তুমি নিজেই পৃথিবী হয়ে যাও’
(পৃথিবী)
‘আমিও মরিয়া যাব একদিন বৃষ্টিরাত্রে চলে যাব মৃত্যুর ওপারে
সেখানে রয়েছে এক পুঁইমাচা পৃথিবীর সমান বয়সী
তবে লকলকে কিশোরী
আমিও চলিয়া যাবো দেবযানে
দেবযান থেমে যায় যেখানে রয়েছে মন্দাকিনী
তাহারও অতীত দিয়া বহে যায় ইছামতী ইন্দ্রানী দ্যাখেনি সেই নদী
আমি সেই নদী ধ’রে কার খোঁজে যাবো
এবারে এসেছে মিছিনদী
তার নাম শোনে নাই কেহ
শুনিয়াছে আছে পৃথিবীর আদিম মানবী
(ভালো আছেন তো বাবুজী)

কবি সামসুল হকের জীবিত অবস্থায় ১৯৯১ সালে তাঁকে নিয়ে কাকদ্বীপ থেকে ‘কবিতা এবং কবিতা’ পত্রিকা প্রথমবার একটি সংখ্যা বিশেষ প্রকাশ করেছিলো! কবিতা এবং কবিতা পত্রিকার কবি সামসুল হক সংখ্যাটি সম্পাদনা করেছিলেন তাঁর অনুরাগী ছাত্র কবি দেবদুলাল পাঁজা! এই বিশেষ সংখ্যায় কবি সামসুল হকের দেওয়া প্রথমবারের মতো কবিতা ও নিজের কবিতা যাপন নিয়ে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিলো!আর তাঁর মৃত্যুর দেড় দশকেরও বেশি সময় পরে ২০১৫ সালে ‘সাংস্কৃতিক খবর’ পত্রিকার উদ্যোগে কলকাতা থেকে কবি কাজল চক্রবর্তীর সম্পাদনায় কবি সামসুল হককে নিয়ে ‘প্রামাণ্য সামসুল হক’ নামে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়! জীবিত এবং মৃত অবস্থায় এখন ও পর্যন্ত মাত্র এই দুটি পত্রিকা সামসুল হকের মত বাংলা ভাষার প্রধান শক্তিশালী কবিকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে কবিতা প্রিয় পাঠকের কাছে কবির স্মৃতিকে কিছুটা হলেও বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে!
কবি সামসুল হক কাকদ্বীপে শিক্ষকতার সূত্রে তিন দশকেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন! ব্যক্তিগত জীবন চর্চায় কেউ কখনো তাঁকে কোনো ধর্মীয় আচার মানতে দেখেননি! কিন্তু শুধু নামের কারণে প্রতিবেশী মানুষজনের কাছে পছন্দসই ঘর ভাড়া পেতে সারা জীবনই তাঁকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে! শিক্ষকতার সূত্রে যে অর্থ পেতেন তার বেশিরভাগটাই তিনি খরচ করে ফেলতেন নিজের কবিতার বই প্রকাশ এবং সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশে! এর ফলে সারা জীবনই তাঁকে আর্থিক অস্বাচ্ছন্দ্যতায় জীবন কাটাতে হয়েছে! সারা জীবন শিক্ষকতা করেও নিজের স্থায়ী বাসস্থানের জন্য একখণ্ড জমি তিনি সংগ্রহ করতে পারেননি আর্থিক সমস্যার কারণে! তাই সারা জীবনই তাঁকে ভাড়া বাড়িতে কাটাতে হয়েছে! কাকদ্বীপে বসবাস কালীন তিনি চারটে ভাড়া বাড়িতে কাটিয়েছেন! যে ভাড়াবাড়ি গুলি কোনটাই তার তাঁর মতো শক্তিশালী কবির জন্য পছন্দসই বাসাবাড়ি ছিল না! কাকদ্বীপের তাঁর আর এক অনুরাগী ছাত্র এবং তাঁর ‘সুটকেসের উপর বসে আছি’ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশক কবি সৌমিত বসু শুধু ধর্মীয় নামের কারণেই বাড়ি ভাড়া না পাওয়া নিয়ে কবির বিড়ম্বনায় ব্যথিত হয়ে ‘ঘর চাই, একখানা, খোলামেলা’ নামক কবিতায় লিখেছেন–

‘এখন আপাতত ট্রলার শব্দহীন,বাতাসের চুল্লীহীন একখানা তকতকে ঘর
কবির জন্য চাই এই কাকদ্বীপে,কেনা নয় ভাড়া
কোন মুসলমানের জন্য নয়,কোন হিন্দুর জন্যও নয়
একজন কবির জন্য!
আজি এই অস্ফুট সন্ধ্যায় মনে হয়
তুমি কি আদৌ মুসলমান ছিলে
তাহলে কিভাবে লিখতে পারলে
‘আমার মায়ের কবরের উপর একফোঁটা জল রেখে আসি’
মুসলমান তো কোনদিন কবরে কাঁদে না
কোন মহৎ উদারতা কম্বলের মতো ঢেকে দেয় আমাদের রোমকূপ
কোন ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে অ-হিন্দুকে ঘর ভাড়া দিতে কেঁপে ওঠে পায়ের পাতা’

কবি সামসুল হকের স্নেহধন্য অনুরাগী সাহিত্যিক অভিজিৎ সেনগুপ্ত কবির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ক্ষোভের সঙ্গে লিখেছেন, আজ এতদিন পর সময়ের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে মনে জাগে একজন কবি বিশেষ করে সামসুল হকের মতো একজন কবির জীবনে বা মৃত্যুতে শেষ অবধি তাহলে কি পাওয়ার থাকে? আমি জানি আলমারিতে তিনি তাঁর সমস্ত গ্রন্থ, সমস্ত পাণ্ডুলিপি সুচারু ভাবে গুছিয়ে রেখেছিলেন! আমায় বলেছিলেন যদি হঠাৎ কখনো তাঁর মৃত্যু ঘটে তাহলে তারা যাতে হাতের কাছে সব পেয়ে যান, এ জন্য তিনি এ ব্যবস্থা করে গেলেন! পান্ডুলিপির সঙ্গে নাকি যথাযোগ্য সব নির্দেশ রেখেছেন যাতে সেগুলো সুবন্দোবস্ত করা যায়! হায় সে একমাত্র কবিরাই হয়তো হতে পারে এরকম দুর্মম আশাবাদী,এরকম কাণ্ডজ্ঞানহীন! কোন প্রকাশক আজ এগিয়ে এসে তাঁর কবিতা ছাপবে যিনি যে কোনো কারণেই হোক জনপ্রিয় হতে পারেননি? সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত লোকালয়ে ভাঙাচোরা মাকড়সার ঝুলে ভরা এক জীর্ণ ছাপাখানায় বসে বাংলা ভাষার শুদ্ধতা রক্ষার জন্য একজন মানুষের যে প্রায় পাগলামি স্তরে উঠে আসা কৌতূহল উদ্দীপক একক সংগ্রাম,তাতে কোটি কোটি জনগণের কি এসে যায়? রোটি কাপড়া মাকানের কোন সমস্যা মেটাতে পারে শুদ্ধ কবিতা? তাহলে শামসুল হক অর্বাচীনের মতো কেন তাঁর জীবনের সব আহ্লাদ,পারিবারিক সুখ,স্বচ্ছলতা আহুতি দিলেন সেই সর্বনাশা শুদ্ধতার পায়েই? কেন তিনি বঞ্চিত করলেন নিজেকে,নিজের পরিবারকে?
কবির স্নেহধন্য অনুজ কবি রফিক উল ইসলাম লিখেছেন,কবি সামসুল হকের প্রকাশিত গ্রন্থ গুলির প্রায় অধিকাংশই নিজে উদ্যোগে আর আর্থিক সামর্থ্যে প্রকাশিত! দীর্ঘতর রুগ্নতায় আচ্ছন্ন কবির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কবিপত্নী করবী হক কবির বইপত্তর এবং সম্পাদিত পত্র পত্রিকা ঝোলায় চাপিয়ে বছরের-পর-বছর সকাল-সন্ধ্যে কলকাতা সহ বিভিন্ন অঞ্চলে দৌড়েছেন! কখনো কোন কবির বাড়িতে কিংবা পত্র-পত্রিকার দপ্তর গুলিতে! আজীবন আর্থিক সচ্ছলতার প্রসঙ্গই ওঠেনি কখনো! ফলত জীবনের সুদীর্ঘ কাল কাটানো গঞ্জশহর কাকদ্বীপে তাঁর জন্য এক ফালি কবরের ভূমি সংগ্রহ করা বাস্তবিকই অর্থেই অসম্ভব হয়ে উঠেছিল! কাকদ্বীপ থেকে কবির মরদেহ অবশেষে বহুদূরে তাঁর মামার বাড়ির গ্রামে এনে কবরস্থ করতে হয়েছে! কবিতা আর জীবন এভাবেই একাকার হয়ে গেছে কবি শামসুল হকের,ভাবলে শিহরণ জাগে,নির্বাক হতে হয়!
১৯৯৭ সালের ১৪ মার্চ মৃত্যুতেও কবি সামসুল হকের জীবনের বিড়ম্বনার শেষ হয়না! মামার বাড়িতে টেকপাঁজা গ্রামে কবিকে কবরস্থ করার পর কবির পরিবারের তরফে তাঁকে বিষ প্রয়োগে মেরে ফেলা হয়েছে পুলিশের কাছে একটি অভিযোগ জমা পড়ায় কবিকে কবরস্থ করার দুদিন পর কবর থেকে তুলে আবার পোস্টমর্টেম করা হয়! তারপর দ্বিতীয় বার কবরস্থ করা হয়!
কবি সামসুল হকের মৃত্যুর প্রায় দুই দশক পরে তাঁর কবিতার অনুরাগী আশির দশকের বিশিষ্ট কবি রফিক উল ইসলামের সম্পাদনায় কলকাতার প্রতিভাস প্রকাশনী থেকে ‘সামসুল হক শ্রেষ্ঠ কবিতা’র সংকলন প্রকাশিত হয়! এই সংকলনের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, কবি,সাহিত্যিক,শিল্পীগণ বুঝি মৃত্যুর পরও বিবিধ অনুষঙ্গে মারা যেতে পারেন! বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ কবি সামসুল হক তাঁর মৃত্যুর এক- দেড় দশকের মধ্যেই আবারও কবরস্থ হয়েছেন কোন এক অলৌকিক ধাঁধায়! মুদ্রিত পৃথিবীর সামান্যতম কোন অংশে ও তাঁকে আর জীবিত রাখা যায়নি! এ-এক বেদনাময় পরিহাস! এই পরিহাস শুধু আমাকেই কেন বহুহৃদয়জীবীকেও জর্জরিত করে,অসহায় করে তোলে! কিছু একটা করে ওঠার, জ্বলে ওঠার প্রেরণা জোগায়! কবি শামসুল হকের কবিতা সংকলন করার অদ্ভুত রোমাঞ্চ আর স্বপ্নকে সঙ্গী করে কবি রফিক উল ইসলাম শেষপর্যন্ত অসাধ্য সাধন করেন! তাঁর প্রচেষ্টায়কবি সামসুল হকের শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলন শুধু নয়, কবি সামসুল হক যে একজন শক্তিশালী ছড়া লেখক ছিলেন, তাঁর ছড়া প্রিয় বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে তুলে ধরতে কবি সামসুল হকের ছোটদের ও বড়দের দুটি ছড়া সংকলনও সম্পাদনা করেছেন!যা কলকাতার আবিষ্কার প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে! প্রকৃত কবিরা হয়তো এভাবেই অনুজ কবিদের হৃদয়ের ভালোবাসায় ফিনিক্স পাখির মত বাংলা ভাষার কবিতা প্রিয় পাঠকের কাছে নতুন করে আবিষ্কৃত হয়ে আবারও আলোচনার বৃত্তের ফিরে আসেন, জীবিত হয়ে ওঠেন এবং বেঁচে থাকেন!

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

এ্যাডঃমনিরুল ইসলাম মনু on গুচ্ছ কবিতা : বেনজীন খান
পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা