spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যনাসের হোসেন : বর্ণের পাশে থাকে বর্ণহীনতা

লিখেছেন : মুহম্মদ মতিউল্লাহ

নাসের হোসেন : বর্ণের পাশে থাকে বর্ণহীনতা

মুহম্মদ মতিউল্লাহ

‘কবিতা পাক্ষিক’-এর সূত্র ধরেই নাসেরদার সাথে আমার পরিচয়। নব্বইয়ের দশকে ‘কবিতা পাক্ষিক’ প্রথম প্রকাশের সেই কাল— আমি তখন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। প্রভাত চৌধুরী সবাইকে এক সূত্রে গাঁথতে চান, কবিতা চর্চাকে কেন্দ্র করে। নবীন প্রবীণ সময়মনস্ক সব কবিকেই আহ্বান জানাচ্ছেন প্রভাতদা। অবশ্য সব কবিকেই নয়। প্রকৃত কবিকে। সময়মনস্ক ‘আপডেট’ কবিকে। এরপর প্রতি পনেরো দিন অন্তর ‘কবিতাপাক্ষিক’-এর অবিরল আত্মপ্রকাশ। কবিতাপাক্ষিকের অনুষ্ঠান হচ্ছে কখনো কলকাতায়, বাঁকুড়ায়, কখনো বর্ধমানে, বহরমপুরে, কখনো কাটোয়ায়। বর্ধমানের অনুষ্ঠানেই নাসেরদার সাথে আমার প্রথম মুখোমুখি আলাপ। এবং নিমেষে আপন করে নেওয়া। একজন তরুণ কবি অগ্রজ কবির কাছে যে সহমর্মিতা ও সহানুভূতি প্রত্যাশা করে নাসের হোসেন ঠিক তারই এক অমূর্ততা! নাসেরদার ব্যক্তিত্বে একটি মায়াবী আকর্ষণ আছে। উচ্চকিত নয়, নিবিড় এক অভিনিবেশ ভরা ব্যক্তিত্ব। কবিতার জন্য দেখেছি অবিরাম তার পথচলা। একই সঙ্গে নাসের হোসেন কলকাতার এবং মফসসলের। মফসসলের তরুণ অনতিতরুণ সব কবির সঙ্গেই তার হৃদ্যতা। তাদের নিবিড় বন্ধু। এই বন্ধুদের দিকে প্রসারিত তার উদার একটি হাত। অন্য হাতটি ছুঁয়ে থাকে কলকাতার নাগরিক জীবন। আলোক সরকার কিংবা অলোকরঞ্জন কিংবা শঙ্খ ঘোষ— সর্বত্র অবারিত।

তার কাছে লিটল ম্যাগাজিন গুরুত্বপূর্ণ। লিটল ম্যাগাজিনের দায়িত্বশীল পরীক্ষা নিরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। তাই লিটল ম্যাগাজিনের একনিষ্ঠ লেখক তিনি। সম্পাদকেরা তার বন্ধু। আবার বাণিজ্যিক কাগজের বহুল প্রচার ক্ষমতাকে তার মান্যতা। লেখার শেষে পাঠকের, বৃহত্তর পাঠকের কাছে পৌঁছানোর সুযোগকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন না। তাই বাণিজ্যিক কাগজ তার কাছে অচ্ছুত  নয়।

কবিতা সাহিত্য শিল্পকে কেন্দ্র করে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠা তার কাছে অনেক বড় ব্যাপার। বন্ধুত্বের পিছনে সময় ও পরিশ্রম দিতে নাসেরদা অকৃপণ। বন্ধুত্বের নিবিড় আবেশে তাকে বলতে শুনি, ‘কারো হয়তো-বা চল্লিশবার সাহায্যে লেগেছি, একচল্লিশতম বেলায় গরহাজির হওয়ায় সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। আমার সঙ্গে অবশ্য শেষমেষ সকলেরই বাড়তি প্রণয় ঘটে। কেউ সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাইলেও আমি তো সেটা হতে দিতে পারি না। কেননা বিয়াল্লিশতম বেলায় তার সমস্ত কাজই আমি করে দিতে প্রস্তুত।’ এমনতর উচ্চারণ আর কে করতে পেরেছেন আমি জানি না। তাকে বলতে শুনি, ‘জীবন আর কবিতা, কেউ কারো থেকে বড়ো নয়, দুটিই মহান।’ আর এজন্যই তার কাছে বেঁচে থাকা রোমাঞ্চকর। পৃথিবী তার কাছে সুন্দর। জীবন ও শিল্পের পারস্পরিকতায় তার শিল্পশোভন বেঁচে থাকা।

কবিতাকর্ম সবসময় যে নিভৃত প্রার্থনা করে এমন ধারণা আমার ভেঙে গেছে প্রভাত চৌধুরীকে দেখে। যে কোনো লৌকিক তৎপরতার মধ্যেই তার কবিতা, রচনার স্পর্শময়তা পেতে অসুবিধেয় পড়ে না। নাসের হোসেনের মধ্যেও দেখেছি সেই গুণ। অবশ্য বাইরে থেকে নাসেরদাকে দেখলে বোঝা যায় না। বইমেলার ভিড়ের ভিতরে একটু নিজের মতো আড়াল খুঁজে নিয়ে নাসেরদাকে আমি লিখতে দেখেছি। হয়তো একটু আগেই কোনো তরুণ সম্পাদককে কবিতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

প্রায় বছর পাঁচেক নাসেরদার সঙ্গে আমার মুখোমুখি দেখা হয়নি। ধরে নিতেই পারি এখনো কোনো সম্পাদককে এভাবেই কবিতা কিংবা গদ্য লিখে দিচ্ছেন। সে খবরটা হয়তো পেয়ে যাই সম্পাদক বন্ধুদের থেকেই। আলোক সরকার খুঁজতেন নাসের হোসেনকে। বিদেশ থেকে কলকাতা ফিরেই যেমন খুঁজতেন অলোকরঞ্জন। কখনোবা নতুন কবির বই প্রকাশ করাতে, কিংবা কোনো সম্পাদকের নতুন সংখ্যা প্রকাশ করিয়ে দিতে সম্পাদককে নিয়ে যাচ্ছেন শঙ্খ ঘোষের বাড়ি।

কত অনায়াস বিবেকিতা ও সরলতায় ভরা তার এই কবিতার দিনযাপন। সহজতায় ভরা কবিতার দিনযাপন। সরলতা কিন্তু সে সরলতা অবশ্যই অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুর সরলতা নয়। সরলতার পাশাপাশি বাস করে ক্রমউন্মোচনশীল এক রহস্যময়তা। নাসের হোসেনের কবিতা আমাদের সেই রহস্যের সন্ধান দেয়, যা একই সঙ্গে সহজতায় ভরা, রহস্যময়তায় ভরা। রহস্যমেদুর সহজতায় তিনি লেখেন—

“জঙ্গলের গভীর থেকে উঠে আসে সরু, নিভৃত আঁকাবাকা কুয়াশা, ওই

কুয়াশার মধ্যে কিছু নীল হলুদ বিন্দু আছে যা ঠিক আমার সুপরিচিত নয়…”

এইভাবে নাসের হোসেন তার কবিতায় ‘দেখার পৃথিবী’র সঙ্গে ‘না দেখা পৃথিবীকে’ মিলিয়ে দেন। এবং সেই স্বকৃত জগতে বর্ণের পাশে থাকে বর্ণহীনতা, জাগতিকতার পাশে থাকে মহাজাগতিকতা। গার্হস্থ্যের পাশে থাকে শূন্যতাশাসিত ঘরবাড়ি। থাকে স্বপ্ন-স্মৃতি।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ