আবু তাহের সরফরাজ
ছাতিম গাছটার নিচে আমি দাঁড়িয়ে আছি। ঝকঝকে রোদ চারদিকে। ছাতিম ফুলের নেশাধরানো ঘ্রাণ আমার ভালো লাগছে। বুক ভরে বাতাস টেনে নিয়ে আমি সেই ঘ্রাণ অনুভব করছি। ভালো লাগছে। কী রকম ঝিমঝিম লাগছে। এই মাত্র কিছুক্ষণ আগে আমি এখানে এসেছি। কোত্থেকে এসেছি, আমি জানি না। হেঁয়ালি নয়, সত্যিই আমি জানি না আমি কোত্থেকে এসেছি। আমি কে, এটাও আমি জানি না। অবশ্যি জানাটাও বিশেষ জরুরি নয়। এসব জেনেও বা কী এমন লাভ! সব মানুষই তো জানে সে কে, এরপরও কী এমন লাভ তারা পায়? সেই একই রকম ছকেবাঁধা জীবন। হোঁচট খাচ্ছে, আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। অতকিছু ভেবে কাজ নেই। আনন্দই যখন আসল কথা, তাহলে আমি এই মুহূর্তে আনন্দে আছি। ছাতিম ফুলের মাদকতায় আছি।
আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার পাশ দিয়েই একটা রাস্তা। বেশ চওড়া আর পাকা। আরদিকে মাঠ। মাঠের ওদিকে একটা স্কুলঘর। মাঠের ওপর দিয়ে এসে ঝিরঝির হাওয়া আমাকে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আমার ভালো লাগছে। এই যে এখানে চুপচাপ বসে বসে এসব দেখে আমি আনন্দ পাচ্ছি। এই আনন্দেই ভুলে থাকা যায়, আমি কে। এসব যখন ভাবছি, ঠিক তখন শুনতে পেলাম কীরকম ঘ্যাড়ঘ্যাড় আওয়াজ। দেখি, একটা শাদারঙের জিপগাড়ি আসছে রাস্তা দিয়ে। জিপটা এসে থেমে পড়ল একেবারে আমার সামনে। দরজা খুলে নেমে এলেন মাঝবয়েসি এক পুরুষ। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। মাথার তালু টাকপরা। চোখে চশমা। বললেন, গাড়িতে উঠে এসো।
আমি অবাক হলাম। বলে কী লোকটা! তবে কেন যেন, মানুষটাকে দেখে আমার ভালো লাগল। কী স্পষ্ট উচ্চারণ, আর কথা বলার ভঙ্গি! কিন্তু আমাকে গাড়িতে উঠতে হবে কেন, তা তো বুঝতেছি না। আমি তার চোখের দিকে তাকালাম। দেখলাম, তিনিও চেয়ে আছেন আমার দিকে। বললেন, আমার সঙ্গে গাড়িতে চলো। আমি তোমাকে নিতে এসেছি।
আমি যে এখানে আছি, আপনি জানলেন কি করে?
তোমাকে দেখে।
আমাকে দেখে মানে!
গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখলাম তোমাকে। দেখে মনে হলো, তুমি খুব নির্জন একটা মানুষ। আর নির্জন বলেই, তুমি খুব একা। জগতে এইরকম একা হয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে কেন যেন আমার ভাল্লাগে। তাই ভাবলাম, নিয়ে যাই সঙ্গে করে। তোমার যেতে আপত্তি নেই তো?
মানুষটার মুখের দিকে এবার আমি ভালোমতো দেখলাম। কী সহজ-সরল একটা ভাব! জগৎ-সংসারে একা হয়ে যাওয়া একটা মানুষ কীরকম হয় দেখতে?
একা হয়ে যাওয়াটা কী যে ভয়ঙ্কর, তাই না?
আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। তিনি জিগেশ করলেন, তুমি কি এখানে থেকে যেতে চাও?
এর জবাব আমি খুঁজে পেলাম না। তবে বুঝলাম, গেলেই বা কী এমন! ছাতিম গাছের নিচে এখন যে আছি, এটাও একটা থাকা। আর ওনার সঙ্গে গেলেই আরেক থাকা। এখানে আর কতক্ষণই বা থাকব? আরকিছু না ভেবে আমি এগিয়ে গেলাম। তিনি জিপের পেছনের দরজা খুলে ধরলেন। আমি উঠে বসলাম। দেখলাম, ফুটফুটে দেখতে চাঁদের মতো ছোট্ট একটা মেয়ে সেখানে বসে আছে। মেয়েটি আমার দিকে চেয়ে আছে। কী যে মিষ্টি দেখতে, আমার আদর করে দিতে ইচ্ছে হলো!
গাড়ি ছুটে চলেছে, আর আমার চোখমুখে এসে লাগছে হু হু হাওয়া। মেয়েটার চুলের ভেতর আঙুল চালিয়ে আমি জিগেশ করলাম, কী নাম তোমার মামণি?
মেয়েটি একটু মিষ্টি হেসে জবাব দিলো, শঙ্খমালা।
বাহ, কী মুগ্ধকর একটা নাম! যেন রূপকথার রাজকন্যা পুরনো বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসে এখন আমার পাশে বসে আছেন!
মেয়েটি জিগেশ করল, তোমার নাম কি?
ধাক্কা খেলাম। আরে, তাই তো! আমার যেন কী নাম! অনেক ভেবেচিন্তেও নাম বের করতে পারলাম না। আরে, এটা কী রূপকথার জগৎ নাকি! আমি আমার নাম মনে করতে পারছি না! কীরকম শিরশির করে উঠল আমার সারা দেহে। আমি নিজেকে ঠিক মেলাতে পারছি না। এই যে ঘটনা ঘটছে, এসব কি গল্প? কেউ একজন লিখছে? তাহলে কেন আমার একটা নাম দিচ্ছে না? তাহলে কি আমি নামহীন কোনো চরিত্র? এই যে দুজন এখন আমার সঙ্গে, সম্ভবত পিতা ও কন্যা, তাদের সঙ্গে আমার যোগসূত্র কোথায়? আমি তো ছিলাম ছাতিম গাছের নিচে। সেখান থেকে এখন কোথায় যাচ্ছি? আর কেনই যাচ্ছি? আবারও সেই শিরশির ভাবটা উঠল আমার সাড়া দেহ ঝাঁকিয়ে। আমার কীরকম যেন ভয় হতে শুরু করল। মনে হলো, আমার সামনে বিপদ! সাঙ্ঘাতিক কিছু একটা ঘটবে আমার জীবনে। ঠাণ্ডা একটা স্রোত আমার পিঠের ওপর দিয়ে যেন বয়ে গেল! আমি চিৎকার করে উঠলাম, গাড়ি থামান, এই যে গাড়ি থামান…
গাড়ি থামলো না। লোকটি বলে উঠলেন, কেন?
আমি কাঁপা কাঁপা স্বরে জিগেশ করলাম, আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?
লোকটি বললেন, আমাদের বাড়িতে।
কেন?
আমাদের সঙ্গে তুমি থাকবে, তাই।
আমি কেন আপনাদের সঙ্গে থাকব?
তুমি থাকতে না চাইলে থাকবে না। তুমি কি এখানেই নেমে যেতে চাও?
আমি বলে উঠলাম, হ্যাঁ, আমাকে এখানেই নামায়ে দ্যান।
তিনি গাড়ি থামালেন। দরজা খুলে আমি নেমে এলাম। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, তোমাকে একা ছেড়ে দিতে ভালো লাগছে না। স্বস্তি পাচ্ছি না। আমার এই মেয়েটাকে তোমার সঙ্গে রাখো। তাহলে আমার কিছুটা ভাল্লাগবে।
একটু অবাক হলাম। আমার প্রতি লোকটার এই টানটা কিসের? হিশেব মেলাতে পারলাম না। জিগেশ করলাম, আচ্ছা বলেন তো, আমাকে একা ছেড়ে দিতে কেন আপনার ইচ্ছে হচ্ছে না? কিসের এই টান?
লোকটি বললেন, জগতে কিছু গোপন কথা থাকে। এ ব্যাপারটাও ধরে নাও সেরকম একটা। আমি চলে যাচ্ছি। শঙ্খমালা রইল তোমার সঙ্গে। যাও মা শঙ্খ…
শঙ্খমালা গাড়ি থেকে নেমে এলো। দরজা লাগিয়ে দিলে লোকটা গাড়ি টেনে চলে গেলেন। শঙ্খমালা আমার একটা হাত ধরে বলল, চলো।
আমি জিগেশ করলাম, কোথায়?
সে বলল, আমাদের বাড়িতে।
আবার সেই ধাঁধার গাড্ডায় পড়ে গেলাম। শঙ্খমালাও আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়। তাহলে গাড়ি থেকে আর নামলাম কেন! গাড়িতে চেপেই তো যাওয়া যেত!
আমার মুখের দিকে চেয়ে শঙ্খমালা জিগেশ করল, আচ্ছা বলো তো, আমাদের বাড়িতে তুমি যেতে কেন চাইছো না? তোমার কি আর কোথাও যাবার কথা আছে?
আমি ভাবলাম, ঠিকই তো। আর তো কোথাও যাবার কথা আমার নেই। তবে কেন শঙ্খমালাদের বাড়িতে যাচ্ছি না? কোনো কারণ ছাড়া ভয় পাওয়া কি ঠিক? এরা পিতা-কন্যা খুবই ভালো মনের মানুষ। এতক্ষণ এদের সঙ্গে থেকে এটা আমি বুঝে গেছি। আমার কী ক্ষতিই বা এরা করতে পারবে! শঙ্খমালার হাত ধরলাম আমি, চলো শঙ্খমালা, তোমাদের বাড়িতে যাই।
দুপুরের কড়কড়ে রোদ চারদিকে। আমরা হাঁটছি। ঘেমে উঠেছি আমি। শঙ্খমালাও ঘামছে, আর ফ্রকের কোণা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে জিগেশ করলাম, তোমার নাম কে রেখেছিল শঙ্খমালা?
আব্বু।
বেশ সুন্দর তোমার নামটা। রূপকথার কোনো রাজকন্যা যেন! তুমি রূপকথা পড়েছ?
কত্ত! আমাদের বাড়িতে অনেক বই। আব্বু তো সারাক্ষণ বইটই পড়ে। আর কী যেন সব ল্যাখে। আমার সবচে পছন্দের বই, ঠাকু’মার ঝুলি।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা আমবাগান পেরিয়ে এলাম। এরপর ছোট্ট একটা পুকুর। শানবাঁধানো ঘাট। তার সামনে পুরনো দিনের একতলা একটা বাড়ি। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন শঙ্খমালার বাবা। আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন। একটু হেসে বললেন, এই হচ্ছে আমার ঘরগেরস্তি। এইখানে তোমাকে অভিবাদন।
মানুষটার কথা বলার এই ভঙ্গি আমার ভালো লাগলো। আমিও একটু হেসে বললাম, আপনার বাড়িটা বেশ নিরিবিলি। চারপাশে কত গাছ! আর পুকুরটাও সুন্দর। অনেক গভীর বুঝি?
হ্যাঁ, সারা বছর এখানে পানি থাকে। তুমি চাইলে পুকুরে নেমে গোছল করে আসতে পারো। তবে আগে ভেতরে চলো। একটু জিরিয়ে ন্যাও। নিশ্চয়ই তোমার খিদে পেয়েছে?
খিদে শব্দটা শুনেই আমার খিদে পেয়ে গেল। হ্যাঁ, আমার তো সত্যিই খিদে পেয়েছে। এতক্ষণ টের পাইনি। মানুষটার পেছনে পেছনে আমি আর শঙ্খমালা ভেতরে ঢুকলাম। ছিমছাপ সাজানো ঘর। একদিকে বইয়ের তাক। রাজ্যের বই সেখানে। আরদিকে জানলার কাছে খাট। দেয়ালঘেঁষে পুরনো দিনের কয়েকটা চেয়ার। এসবের সামনে চওড়া একটা টেবিল। তাতে রাজ্যের বইখাতা। সবকিছুই জোড়ায় জোড়ায়। কোনোটাই এই ঘরে একটা নেই। যা আছে, তার আরেকটিও এ ঘরে রয়েছে। আবার সেই ধাঁধার গাট্টা! যেন ঠিক মাথার পেছনে এসে ছোট্ট করে গাট্টা মেরে এসব ধাঁধা কেউ উসকে দিয়ে যায়। একই জিনিস দুটো করে থাকবে কেন? এসব কি তাহলে রূপকথা? এই যে আমি, আমি কে? ওই মানুষটি আর ছোট্ট মেয়েটি? কী রকম ধাঁধার মতো লাগছে আমার। কী হচ্ছে এসব!
মানুষটার দিকে ফিরলাম আমি। তিনি আমার দিকেই চেয়ে ছিলেন। জিগেশ করলাম, এই ঘরের সবকিছু জোড়ায় জোড়ায় কেন?
তিনি জবাব দিলেন, তুমি দেখছ বলে।
জিগেশ করলাম, মানে কি একথার?
তিনি বললেন, কোনো মানে নেই। তুমি সবকিছু জোড়ায় জোড়ায় দেখছ তার মানে এই নয়, আরকেউ সেসব সিঙ্গেল দেখবে না। এক এক মানুষের দ্যাখার জগৎ এক এক রকম। তুমি তোমার দ্যাখার জগৎটা তোমার অনুভূতি দিয়ে মিলিয়ে ন্যাও।
ঠিক কথা তো! আমি আমার উপলব্ধির ভেতর ডুব দিলাম। কেবল ডুবেই যাচ্ছি, কোনো তল পাচ্ছি না। বাইরে পাখিদের ডাকাডাকি, এছাড়া আর কোনো শব্দ কানে আসছে না। আমি আমার অনুভূতির শীর্ষমূলে পৌঁছতে চাই। কিন্তু কোনো তল পেলাম না। কতক্ষণ ডুবে ছিলাম, জানি না। যখন জেগে উঠলাম তখন দেখি, মানুষটি নেই। আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের কাছটায় এলাম। এইখানে একটা পুরনো দিনের নিমগাছ। বেশ ঝাকড়ানো। গাছের নিচে বাঁশ কেটে বানানো একটা দোলনা। আমি দোলনায় গিয়ে বসলাম।
ঝিরঝির হাওয়া দিচ্ছে। দোলনায় দুলতে দুলতে আমার ভালো লাগছে। বাড়িটা ঘিরে নানা রকম পাখিদের কিচিরমিচির। দোল খেতে খেতে হঠাৎ মনে হলো, কেউ যেন আমাকে পেছন থেকে দোল দিচ্ছে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, শঙ্খমালার বাবা। তিনি জিগেশ করলেন, কী, কেমন লাগছে এখানে?
আমি জিগেশ করলাম, শঙ্খমালা কোথায়? ওকে তো কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।
মানুষটা হাসলেন। দিগন্তের দিকে চেয়ে বললেন, আছে কোথাও। জানো, ও খুব দুষ্টু। সারা দিন খালি টইটই…
ও স্কুলে পড়ে না?
নাহ। স্কুল তো সামাজিক প্রতিষ্ঠান। আর আমরা অসামাজিক। শঙ্খমালাকে আমি বাড়িতেই পড়াই। পড়ার বইয়ের তো আর অভাব নেই আমার সংসারে।
এটা আবার কী কথা! ভারি অবাক লাগলো আমার। জিগেশ করলাম, অসামাজিক পরিচয় দিতে গিয়ে মনে হলো বেশ একটু গর্ব হলো আপনার! অসামাজিক হওয়া কিন্তু মোটেও কাজের কথা নয়। বরং সামাজিক থাকাই সুবিধে।
মানুষটা ঘাড় নাড়লেন। বললেন, হবে হয়তো। আমি অতসব ভাবি না। একটাই তো জীবন। এই বেশ ভালো আছি।
চারপাশটা চোখ বুলিয়ে দেখে নিলাম। আশপাশে কোত্থাও কোনো বাড়িঘর চোখে পড়লো না। জিগেশ করলাম, কোথাও তো বাড়িঘর দেখছি না। এখানে আপনারা থাকেন কিভাবে?
তিনি জবাব দিলেন, আমরা তো এখানে থাকি না! তুমি এখন আছ বলেই আমরা এখন আছি।
মানে কী এ কথার! আবরও ধন্দে পড়ে গেলাম আমি। শিরশির কাঁপুনি দিয়ে উঠল আমার গায়ে। জিগেশ করলাম, মানে কি এ কথার?
তিনি বললেন, মানে নেই বুঝি! না থাকলে নেই।
দোলনা থেকে নেমে আমি তার মুখোমুখি দাঁড়ালাম। চোখে চোখ রেখে জিগেশ করলাম, কী ঘটছে কী, বলেন তো? আমি তো এখানে কিছুক্ষণ আগে এসেছি। এর আগে আপনারা এখানে ছিলেন না?
মানুষটা হাসলেন, ছিলাম না তো। তুমি এলে, তাই শঙ্খমালাকে নিয়ে আমিও এলাম। আসলে তুমি আছ, তাই আমরা আছি। তুমি না থাকলে আমরাও নেই।
আপনাকে আমার একজন চক্রান্তকারী মনে হচ্ছে। এসব কী ঘটছে, বলেন তো!
মানুষটা কাঁপা কাঁপা স্বরে বললেন, একটা সাপ লেজ থেকে নিজেকেই খাচ্ছে।
জিগেশ করলাম, মানে কি এ কথার? একটা সাপ লেজ থেকে নিজেকেই কেন খেতে থাকবে? তাহলে তো সাপটা খেতে খেতে নিজেকে পুরোপুরিই খেয়ে ফেলবে। এরপর খাবে কি?
লোকটি রহস্যময় একটা হাসি ছড়িয়ে বললেন, নিজেকে খাওয়া শেষ হয়ে গেলে সে আবার তার শরীর ফিরে পাবে। আবার সে লেজ থেকে নিজেকে খেতে শুরু করবে। এটা কোনো চক্রান্ত নয়, এটা জীবনচক্র।
এসব কথা আমার হেঁয়ালি মনে হলো। আরও মনে হলো, লোকটা মহা ধুরন্ধর। আমার সঙ্গে সাঙ্ঘাতিক একটা খেলা সে খেলছে। কিন্তু শেষমেশ খেলাটার পরিণতি কী দাঁড়ায়, সেটা দেখতে আমার ইচ্ছে হলো। মনের ভেতর ভেসে উঠল শঙ্খমালার টুকটুকে মুখখানা। মেয়েটার মাকে তো এ পর্যন্ত কোথাও দেখলাম না? তিনি কি এ বাড়িতে থাকেন না? আমি জিগেশ করলাম, আপনার স্ত্রী কোথায়? তাকে তো দেখলাম না।
তিনি বললেন, আমাদের এই গল্পে কি তার উপস্থিতি খুব জরুরি?
আমাদের গল্প মানে? আমরা কি গল্পের চরিত্র? এই যে আমরা কথা বলছি, এটা কি কোনো গল্প?
একথার জবাব না দিয়ে তিনি বললেন, তোমার খিদে পেয়েছে, চলো কিছু মুখে দেবে।
হ্যাঁ, টের পেলাম আমার খিদে পেয়েছে। কিন্তু মুখে কিছু বললাম না। লোকটা আমাকে হাত ইশারা করে ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। আমি তার পিছু পিছু সেই জোড়া ঘরটায় এলাম। দেখলাম, টেবিলে এরই মধ্যে কেউ খাবার সাজিয়ে গেছে।
ইশারায় চেয়ার দেখিয়ে মানুষটা বললেন, খেতে বসো। আমি একটু লিখতে বসবো। একটা গল্প লেখা শুরু করেছিলাম, বুঝলে। মনে হচ্ছে, সেটা এখনই শেষ করে ফেলতে হবে।
আপনি বুঝি গল্প লেখেন?
এই একটু-আধটু। ঘরের ওদিকে বেসিন আছে, তুমি হাতটা ধুয়ে এসো। এই বলে তিনি খাটের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে খাতায় গল্প লিখতে শুরু করলেন। আমি খেতে বসলাম। কিন্তু শঙ্খমালা কোথায় যে গেল! লোকটাকে জিগেশ করতে ইচ্ছে করছে না। কী জানি, আবার কোন হেঁয়ালি শুনতে হয়। যদিও জানি, জগতের সবকিছুর মানে খুঁজতে নেই। খুঁজলেও অনেক কিছুর মানে খুঁজে পাওয়া যায় না। সেসবের কোনো পণ্ডিতি প্রমাণও জগতে নেই। সে শুধুই গোপন, আর গোপন।
খাওয়া শেষ করে দেখলাম, লিখতে লিখতে মানুষটা ঘুমিয়ে পড়েছেন। বালিশে আলতোভাবে কাৎ হয়ে আছে তার মাথাটা। জানলা দিয়ে ছুটে আসা ঝিরঝির হাওয়ায় খাতার একটা পাতা ফরফর করে উড়ছে। গামছায় হাত মুছতে মুছতে আমি খাটের কাছে এসে দাঁড়ালাম। ডাকলাম, এই যে, আপনি কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?
সাড়া নেই।
আবার ডাকলাম।
সাড়া নেই।
কী গভীর ঘুম রে বাব্বা! তার কাঁধে একটু নাড়া দিয়ে ফের ডাকলাম, এই যে, আপনি কি ঘুমিয়ে পড়লেন?
এবারও কোনো সাড়া নেই। কী হলো! আমি তার কাঁধ ধরে দেহটা সোজা করে বিছনায় শুয়ে দিলাম। নিথর দেহ! নাকের কাছে আঙুল নিয়ে দেখলাম, নিশ্বাস বন্ধ!
থ হয়ে গেলাম। হঠাৎই ভীষণ শীত শীত করতে শুরু করল আমার। অথচ বাইরে ঝা ঝা রোদ। রোদে চকচক করছে বাইরের প্রকৃতি, গাছপালা। জানলার ওপাশে একটা গাছে কী একটা পাখি ডেকেই যাচ্ছে কুকরু কুক কুকরু কুক… আমার কেন যেন মনে হলো, জগৎ-সংসারে আমি খুবই একা। এই মুহূর্তে আমি ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। এই বেঁচে থাকা কি কোনো দণ্ড? বুঝতে পারলাম না। খাতাটা তুলে নিলাম হাতে। ঝকঝকে মুক্তার মতো মানুষটার হাতের লেখা। গল্পটার নাম, একটি সাপ লেজ থেকে নিজেকেই খাচ্ছে। এই কথাটাই তো তিনি তখন আমাকে বলেছিলেন। আরও বলেছিলেন, এটাই নাকি জীবনচক্র।
আমি পড়তে শুরু করলাম, ছাতিম গাছটার নিচে আমি দাঁড়িয়ে আছি। ঝকঝকে রোদ চারদিকে। ছাতিম ফুলের নেশাধরানো ঘ্রাণ আমার ভালো লাগছে। বুক ভরে বাতাস টেনে নিয়ে আমি সেই ঘ্রাণ অনুভব করছি। ভালো লাগছে। কী রকম ঝিমঝিম লাগছে। এই মাত্র কিছুক্ষণ আগে আমি এখানে এসেছি। কোত্থেকে এসেছি, আমি জানি না…
কোত্থেকে এসেছি, আমি জানি না…
কোত্থেকে এসেছি, আমি জানি না…
কোত্থেকে এসেছি, আমি জানি না…