আবু রাইহান
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে কথা সাহিত্যিক রবিশংকর বলের “দোজখনামা” উপন্যাসটি একটি অসাধারণ সংযোজন।বইটির ফ্লাপে লেখা রয়েছে, ‘১৮৫৭র মহাবিদ্রোহ থেকে ১৯৪৭ এর দেশভাগ, দাঙ্গা এই কাল পর্বের ভিতরে ভারত ও পাকিস্তানের কবরে শুয়ে থেকে তাঁদের বৃত্তান্ত বলে যাচ্ছেন মির্জা গালিব ও সাদাত হাসান মান্টো। ইতিহাসের দুই দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে দুটি উচ্ছিন্ন জীবন। পরস্পরের আয়নায় দেখে নিতে চাইছে নিজেদের। তাঁদের ঘিরে বুনে উঠছে কত কিসসা,কত কল্পকথা, আর ইতিহাসে জায়গা না পাওয়া অনামা সব মানুষের আখ্যান। উপন্যাসের এক নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত করেছেন রবি শংকর বল তাঁর ব্যতিক্রমী উপন্যাস দোজখনামা’য়।’ কবরে শুয়ে আলাপ, গল্প বলা, নিজেদের জীবনের নানা ঘটনা ও স্মৃতিচারণ করে যান কবি মির্জা গালিব ও গল্পকার সাদাত হাসান মান্টো।এরকম একটা আইডিয়ায় উপন্যাস লেখায় লেখক রবিশংকর বল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
ইতিহাসের পট পরিবর্তনের বিভিন্ন বাঁকে দুই শতকের দুই জন কবি ও গল্পকারের সময় কি করে দোজখখানা হয়ে ওঠে তার চিত্রায়ন আসে ‘দোজখনামা’য়।১৮৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন থেকে বৃটেনের রানীর হাতে শাসনের হাত বদলের কালে ভারতবর্ষ জুড়ে খুন, যখম চুড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছায় নবাবপন্হী বিদ্রোহী বনাম বৃটিশ সেনাবাহিনীর মধ্যে । সেই কথন ফুটে ওঠে গালিবের বিবরণীতে এবং ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পটভূমি আসে মান্টোর বয়ানে।মান্টোর সম্বোধন ‘মির্জাসাব’ আর গালিবের সম্বোধন ‘মান্টোভাই’য়ে সংলাপ প্রাণবন্ত রূপ ধারণ করেছে।
সাদাত হাসান মান্টো আর মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ খান গালিব উপমহাদেশের দুই নক্ষত্র, দুই ভিন্ন সময়ে ভারতে জন্ম নিয়েছিলেন, গালিবের সময় মুঘল শাসন একটু একটু করে নিভে যাচ্ছিল, ব্রিটিশদের অধিকারে যাচ্ছে ভারতবর্ষ। আর মান্টোর জীবন কেটেছে যখন, ইংরেজ সাম্রাজ্য ভারতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছে, দেশভাগের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে উপমহাদেশের লক্ষ কোটি মানুষ। দুই পট পরিবর্তনের ঘূর্ণিপাকে চিরে খেয়েছে দুজনকেই। ছোটগল্পের জগতের প্রবাদ পুরুষ মান্টো আর গজল-কবিতার জগতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী গালিবকে নিয়ে ‘দোজখনামা’ উপন্যাস। ‘দোজখনামা’ উপন্যাসের বুনন বেশ অদ্ভুত। কবরে শুয়ে গালিব আর মান্টোর কথোপকথন চলছে, যেখানে রুক্ষভাবে তাদের জীবনের ঘটনাগুলো বলে যাওয়ার ব্যাপারটি ছিল না। বরং মসলিনের পিঠে যেমন কারুকার্য ফুটে উঠে ঠিক তেমন করেই পরতে পরতে লেখক মান্টো আর গালিবের জীবনের দুঃখ, একাকীত্ব, পারিবারিক জীবন সব তুলে ধরেছেন।
উপন্যাসে আছে একটি পরাবাস্তব আবহ, মান্টো আর গালিব কেউই সমকালীন ছিলেন না, দুজনের দেখা হওয়ার প্রশ্নই আসে না। একজন শুয়ে আছেন দিল্লীতে আরেকজন কাঁটাতারের ওপারে পাকিস্তানের লাহোরে। তবে মান্টোর আজীবন সাধ ছিল গালিবকে নিয়ে কিছু একটা করে যাওয়ার। সেখান থেকেই লেখক উপন্যাসের শুরুটা এমন নাটকীয়তায় করেছেন, পড়ে মনে হয় মান্টো যেন সত্যিই গালিবকে নিয়ে উপন্যাস লিখে রেখেছেন। কিন্তু মান্টো তো উপন্যাস লিখেননি, তিনি ছোটগল্পের জাদুকর, জীবনের বাকে বাকে পোড় খাওয়া এই গল্পকারের কবরের ফলকেই লেখা আছে-“সাদাত হাসান মান্টো এখানে চিরনিদ্রায়। তার সাথে গল্প লেখার সব রহস্যও কবরে চলে গেছে। মাটির নীচে শুয়ে সে ভাবছে, কে বড় গল্প লেখক, মান্টো না খোদা?”
গালিব এবং মান্টোর জীবন নিয়ে ‘দোজখনামা’ উপন্যাস কেন লিখলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে লেখক রবিশঙ্কর বল জানিয়েছিলেন- ‘ছায়াপুতুলের খেলা’ থেকে আমার লেখার গতিপথটা বদলাতে থাকে। আমি এর আগে অনেকদিন ধরে যে গল্প-উপন্যাসগুলো লিখে যাচ্ছিলাম সেই গল্প উপন্যাসগুলোর মুখোমুখি বসে আমি কোথাও এই লেখালেখিগুলোর এক ধরনের লিমিটেশন দেখতে পাচ্ছিলাম। লিমিটেশনগুলো এমন যে—সেই লেখাগুলোর মধ্যে হয়তো অনেক রকম ক্রাইসিস আছে, কোয়েস্ট আছে কিন্তু সাম হাউ সেটা একটা মিডলক্লাস পরিমণ্ডলের মধ্যে আটকে আছে।এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে আমার লেখার ধরনটা এমনকি ন্যারেটিভটাও বদলাতে শুরু করে। সেখানে একটা চ্যাপ্টার আছে সিপাহি বিদ্রোহের পর পর,যেখানে দিল্লী যখন অধিকার করে ফেলেছে ইংরেজরা তখন মির্জা গালিব তার এক বন্ধুকে চিঠি লিখছে- ‘আমি কী করে এই দিল্লিতে বেঁচে থাকবো?আমার তো কোনো বন্ধুবান্ধব নেই। নবাবরা মারা গেছে। তাদের বিবি বাচ্চারা রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে, এ কি একটা জীবন?’ এরকম একটা চ্যাপ্টার ছিলো। আর সে সময় আমি গালিব নিয়ে খুব বুদ হয়ে ছিলাম। গালিবের জীবনটাকে দেখছিলাম উল্টেপাল্টে নানাভাবে, তার চিঠিপত্র পড়তে পড়তে, তার বায়োগ্রাফি পড়তে পড়তে, তার গজল পড়তে পড়তে। কোথাও গালিবকে নিজের সঙ্গে একটা আইডেন্টিফাই করতে পারছিলাম। এই কলকাতা শহরটা তো বদলে যাচ্ছে— যেই কলকাতা শহরকে আমি আমার জন্মের পর থেকে আমার শৈশব থেকে মোটামুটি আশি সাল অব্দি আমার পরিচিত কলকাতাকে দেখেছিলাম— সেই কলকাতা বদলে যাচ্ছে। কোথাও গালিবের সঙ্গে আমার একটা সাদৃশ্য অনুভব করছিলাম। মানে তার মানসিকতার সঙ্গে। তখন আমি ভাবলাম যে গালিবকে নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার চেষ্টা করি। তো সেই লেখাটা অনেকটা লেখাও হয়। তো লিখতে লিখতে সেই সময় আমি আবার ফের মান্টো পড়তে শুরু করি। মান্টোর বায়োগ্রাফি ইত্যাদি খুব ডিটেইলে তখন পড়তে থাকি। দেখতে পাই যে মান্টোরও খুব প্রিয় কবি ছিলেন গালিব। গালিবকে নিয়ে একটা সিনেমা হয়েছিলো ভারতবর্ষে। সেখানে ভারতভূষণ গালিবের চরিত্রে অভিনয় করেছিলো, সুরাইয়া। সেই সিনেমাটা প্রথম ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পায়। কিন্তু ছবিটা যখন রিলিজ করে মান্টো তখন পাকিস্তান চলে গেছে। তখন আমার মাথায় এলো, আচ্ছা এমন কিছু ভাবা যায় কিনা যে, মান্টো একটা উপন্যাস লিখছেন গালিবকে নিয়ে আর সেই উপন্যাসের বয়ানটা লিখছি আমি। ফলে আগের লেখা যতোটা লেখা হয়েছিল সবই আমাকে ফেলে দিতে হলো।’
উপন্যাসে যতোখানি সিপাহি বিদ্রোহ বা দেশভাগের কথা বলা হয়েছে— এই প্রসঙ্গটা কিন্তু গালিব এবং মান্টোর জীবনের শেষের দিকে— পরিণতির দিকে। উপন্যাসের শেষের দিকে হয়তো শেষের ২০ পৃষ্ঠার মধ্যে এই ঘটনাগুলো এসেছে যে, ভারতবর্ষ ওলটপালট হয়ে গেল— দুজনের জীবনেই। তা থেকে ধারণা করা যায় যে এই উপন্যাসে আপনি শুধুমাত্র গালিব আর মান্টো এই দুটো জীবনকেই বুঝতে চেষ্টা করেছেন— ততটা সিপাহি বিদ্রোহ বা দেশভাগ নয়।এই প্রশ্নের উত্তরে লেখক জানিয়েছিলেন- ‘হ্যাঁ, বুঝতে চেষ্টা তো করেছিই, তাছাড়া আমার কাছে আরো একটা বিষয় ছিলো যে, এরা দুজনেই ক্রিয়েটিভ আর্টিস্ট। এই দুজন ক্রিয়েটিভ আর্টিস্ট তাদের সময়ে যে ক্ষমতার প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল এই ক্ষমতার প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বারা কীভাবে নিগৃহীত হচ্ছে এবং সেই ক্ষমতার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কনফ্রন্ট করেও কীভাবে তাদের লেখা চালিয়ে যাচ্ছে, সেটা আমার কাছে বোঝা জরুরি বিষয় ছিলো।’
কথাসাহিত্যিক রবিশংকর বলের ‘দোজখ্নামা’ উপন্যাসে প্রধান চরিত্র দুইজন। একজন ফারসি কবি মির্জা গালিব (১৭৯৭-১৮৬৯), অন্যজন উর্দু সাহিত্যের অন্যতম ছোটোগল্পকার সাদাত হাসান মান্টো (১৯১২-১৯৫৫)। উপন্যাসে দুইজনেই মৃত হিসেবেই হাজির হয় আর কবরের মধ্যে বসেই একে অন্যকে নিজেদের কাহিনী বলতে শুরু করে। অনেকটা পরাবাস্তব কি জাদুবাস্তব মনে হলেও রবিশংকর বল সেখানে জাদুবাস্তবতা না ঢেলে স্বাভাবিকভাবেই দুইজনের আড্ডার বিবরণ দিয়ে গেছেন তাঁর দক্ষ ভাষাশৈলীতে।
আঠারোশো সাল থেকে শুরু করে উনিশশো পঞ্চাশ- প্রায় দেড়শ বছরের ইতিহাস এই উপন্যাসের মধ্যে উঠে এসেছে গালিব আর মান্টোর বয়ানে। উপন্যাস শুরু হয় এক উত্তম পুরুষের গল্পে। পেশায় সংবাদপত্রের কলম পেষা লোক। লখনউতে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখা পায় জনৈক ফরিদ মিঞার সাথে। তার কাছ থেকে যোগাড় হয় সাদাত হাসান মান্টোর একটা অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি। একটা দস্তান বা উপন্যাস। মান্টো জীবনে কখনো উপন্যাস লিখেননি। মির্জা গালিবের কঠিন ভক্ত ছিলেন মান্টো। গালিবকে একটা কোনো লেখায় ঠিকঠাক তুলে ধরতে চেয়েছেন অনেকদিন ধরে। এটাই হয়তো সেই কাজ। উত্তম পুরুষ নিজে উর্দু জানেন না। মান্টোর উপন্যাসটা অনুবাদ করতে গেলে আগে উর্দু শেখা প্রয়োজন। তবসুম মির্জা নামের একজনের কাছে উর্দু শেখার জন্য যেতে হয়। তবসুমের মুখের অনুবাদ বাংলায় লিখে লিখে প্রকাশ হতে থাকা মান্টোর উপন্যাস আমরা রবিশংকর বলের কাছ থেকে পাই। রবিশংকর বল এই ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার সময় নানান বইয়ের সাহায্য নিয়েছেন। মান্টোর লেখা উপন্যাসে মান্টোর লেখা একটা ভূমিকা ও থাকে। সেই ভূমিকার শেষে তারিখ লেখা আঠারো জানুয়ারি, ১৯৫৫; মান্টো মারা যান এই দিনেই।
“মির্জা এবার আমার সঙ্গে কথা বলবেন, আমরা কথা বলে যাব অনর্গল, মির্জা যা সারা জীবন কাউকে বলতে পারেননি,আমি যে কথা কাউকে বলতে পারিনি,সব- সব কথাই এবার আমরা বলব, কবরের ভিতরে শুয়ে শুয়ে। মির্জা শুয়ে আছেন সেই দিল্লিতে, নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগার কাছে সুলতানজীর কবরে, আর আমি লাহোরে মিঞাসাহেতার কবরে। এক সময় তো একটাই দেশ ছিল, উপরে যতই কাঁটাতারের বেড়া থাকুক, মাটির গভীরে তো একটাই দেশ,একটাই পৃথিবী। মৃতের সঙ্গে মৃতের কথাবার্তা কেউ আটকাতে পেরেছে? কাকে বলে হেমন্ত? আরা কাকেই বা বলে বসন্তকাল? সারা বছর আমরা খাঁচার ভিতরে বেঁচে থাকি, এখনও বিলাপ করি, এক সময় আমরা উড়তে পারতাম। একটা গজলে মির্জা এইসব কথা লিখেছিলেন। মির্জা কখনও উড়তে পারেননি, আমিও পারিনি। কিন্তু এবার কবরের অন্ধকারে আমরা ডানা লাগিয়ে নেব,বন্ধুরা, আমরা এইসব কিসসা বলে যাব, যা আপনারা কখনও শোনেননি,সেই সব পর্দা সরিয়ে দেব, যার ওপারে কি আছে, আপনারা দেখেননি। মির্জা কে বাদ দিয়ে মান্টো নেই, হয়তো মান্টোকে বাদ দিয়েও মির্জা নেই। কবরের ভিতরে তাহলে কথাবার্তা শুরু হোক। আদাব।
সাদাত হাসান মান্টো
১৮ জানুয়ারি ১৯৫৫”
মোঘল সাম্রাজ্যের শেষ বড় কবি হিসেবে ধরা হয় মির্জা গালিবকে। আগ্রায় তাঁর জন্ম। পরে স্থিতু হন দিল্লীতে। তের বছর বয়সে উমরাও বেগমকে বিয়ে করেন। গালিবের উশৃঙ্খল জীবনযাপন, তার বেদনা, অর্থকষ্ট, সম্মান, অপমান সব কিছুই গালিব নিজের ভাষ্যে এই উপন্যাসে হাজির করেন। জীবনের শেষের দিকে খেতে না পেয়ে, রোগে ধুকে ধুকে অন্ধ হয়ে মারা যান মির্জা গালিব। মান্টো কবরে বসে মির্জা গালিবের জীবনের শুরুর দিকে কাহিনী নিজেই বলা শুরু করে। উপন্যাসে মান্টোর বয়ান অগোছালো। মান্টো ক্ষণে ক্ষণে নিজের বদনামি করে, নিজেকে খিস্তি দেয়। “আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, কোথা থেকে কোথায় চলে যাই।” গালিবের শের শায়েরীতে মান্টো শুনতে পেয়েছেন একজন পরাজিত মানুষের গল্প। মান্টো নিজে সারাজীবন গরীব, মুটে, দেহোপজীবিনীদের সাথে কাটিয়েছেন। পরাজিত মানুষদের নিয়েই তার কারবার। গালিবকেও এদের দলে দেখে মান্টো নিজেকে স্থির রাখতে পারেন না। গালিবের কাশীর জীবন, কলকাতা পর্ব সবকিছুই উঠে এসেছে রবিশংকর বলের উপন্যাসে। গালিবের জীবন যাপনের মধ্যে তার ভেতরকার দর্শন ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন রবিশংকর। গালিব ও মান্টোর জীবনী এই উপন্যাসের মূল। ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনায় ইতিহাসের যতোটা কাছাকাছি থাকা যায়, ততোই ভালো। গালিব বা মান্টোর ক্ষেত্রে তাদের আসল ইতিহাস হাজির করা কিছুটা দুরুহ। কারণ এরা দুইজনেই কাহিনীকার। গালিবের, মান্টোর রচনার মধ্যে নিজেদের জীবন, আক্ষেপ, আনন্দ, আশেপাশের মানুষের কথা এসেছে। কতোটা আসল, কতোটা কল্পনা- সেটা মাপা প্রায় অসম্ভব। গালিবের চিঠিপত্রেও নানান খোয়াব, কল্পনা, বাস্তব, চিন্তাভাবনা বিচিত্র গতিতে নানা মাত্রায় এসেছে। রবিশংকর বল গালিবের চিঠিপত্রের বিবরণকেও উপন্যাসে স্থান দিয়েছেন।
বেপরোয়া, দুর্বিনীত, মদ্যপায়ী মান্টো তার বিচিত্র জীবনের কথা বলেছে উদ্দাম গতিতে। মান্টোর জন্ম পাঞ্জাবে। এক কাশ্মিরি পরিবারে। বাবার সাথে সম্পর্ক ভালো ছিল না মান্টোর। মান্টোর অন্যান্য ভাইয়েরা ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করলেও মান্টোর ম্যাট্রিক পর্যন্ত যেতেই কালঘাম ছুটে গেলো। মদের নেশা শুরু হয় সেই সময় থেকে, জীবনের শেষে গিয়েও যা থেকে মুক্তি মেলেনি। মান্টো নিজের জীবনকে বলতেন কুত্তার জীবন। “আমি খোয়াবের ঘোরে ঘুরে বেড়াই, রাস্তার কুকুরদের সাথে ভাব হয়ে গেল, ওদের সঙ্গে বসে থাকতাম, আদর করতাম, ওরা আমার গা চেটে দিত।” অনেকটা গ্রীক দার্শনিক ডায়োজিনিসের মতো। ডায়োজিনিস বাজারে একটা টিউবের মধ্যে থাকতেন। কুকুরের সাথে নিজের জীবনের মিল খুঁজতেন। দিনের বেলায় হারিকেন জ্বালিয়ে সৎ মানুষ খোঁজার স্ট্যান্টবাজিও করতেন ডায়োজিনিস। মান্টো আরাম, আয়েস, প্রাচুর্য এইসবকে দূরে ঠেলে নোংরামি, কদর্যতা, দারিদ্র্য এসবের মাঝেই নিজেকে ডুবিয়ে রেখে রচনা করে গেছেন জীবনের গান। মান্টোর উপন্যাস বারবার অশ্লীল বিবেচিত হয়েছে, আদালতে হাজিরা দিতে দিতে অস্থির হয়ে উঠেছেন একসময়। কিন্তু নিজের লেখার পথ থেকে সরে আসেননি। মান্টো যে জ্বলন্ত সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে নির্মমতা, ক্রুরতা, অমানবিকতা নৈমিত্তিক ছিল। মান্টো সেগুলোর কাহিনীই লিখেছেন। “শালা, শুয়োর কাহিকা, ‘ঠাণ্ডা গোশত’ লেখো, এতো বড়ো কাফের তুমি? কী বলে ওরা, শুনেছ? শুধু নারী-পুরুষের মাংসের গল্প লিখেছ, রেড লাইট এরিয়া ছাড়া আর কী আছে তোমার লেখায়। হাত তুলে দিলাম মির্জাসাব, না কিছু নেই। হত্যা আছে, ধর্ষণ আছে, মৃতের সাথে সঙ্গম আছে, খিস্তির পর খিস্তি আছে- আর এইসব ছবির পেছনে লুকিয়ে আছে কয়েকটা বছর- রক্তে ভেসে যাওয়া বছর- ১৯৪৬, ১৯৪৭, ১৯৪৮- আছে নো ম্যানস ল্যান্ড, দেশের ভেতরে এক ভূখণ্ড যেখানে টোবা টেক সিং মারা গেছিল।”
মান্টো কখনো স্বস্থিতে থাকেন নি। বলা যায় স্বস্তিতে থাকা তার দায় ছিল না। তিনবারের চেষ্টায় ম্যাট্রিক পাশ করেন মান্টো। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে তার টিবি ধরা পড়লো। জম্মু-শ্রীনগর হাইওয়ের ওপর বাতোতের এক হাসপাতালে গেলেন চিকিৎসার জন্যে। বেগু নামের এক পাহাড়ি মেয়ের প্রেমেও পড়েন। লেখিকা ইসমত চুঘতাঈয়ের সাথে মান্টোর সম্পর্কের কথাও উপন্যাসে এসেছে।
মান্টোর লেখালেখির জীবন শুরু হয় অনুবাদ দিয়ে। ‘মাসাওয়াৎ’ পত্রিকার বারিসাহেব মান্টোকে দিয়ে অনুবাদ করিয়েছিলেন ভিক্টর উগোর উপন্যাস ‘দা লাস্ট ডেইজ অব দা কন্ডেমড্’। ঐ পত্রিকাতে সিনেমার রিভিয়্যুও লেখা শুরু করলেন। ১৯১৯ সালের মার্শাল আইনের দিনগুলোতে একটা সাত বছরের বালকের চোখে দেখা ঘটনা নিয়ে লেখা গল্প ‘তামাশা’ মান্টোর প্রকাশিত প্রথম গল্প। বারি সাহেবের সাথে হিরামন্ডির কোঠিতে যাওয়া শুরু হয় মান্টোর। খুশিয়া, সৌগন্ধিদের গল্প মান্টো এখান থেকেই নিয়েছেন। জীবিকার প্রয়োজন মান্টো কোথাও বেশিদিন থাকতে পারেন নি। মুম্বাইতে এসে ক্রিপ্ট লেখার কাজ শুরু করেছিলেন জোরেশোরে। দিল্লীতেও ছিলেন। দেশভাগের পরে মুম্বাইতে স্ক্রিপ্টের কাজে মান্টোকে আর ডাকা হতো না। অভিমান করে পাকিস্তান চলে গিয়েছিলেন। আর সেখানে ছিল চরম দারিদ্র্য আর কোর্টরুমে হাজিরার পর হাজিরা।মান্টোর দুর্বিনীত জীবন যাপন আর মির্জা গালিবের কাহিনী রবিশংকর বল তাঁর অসামান্য ভঙ্গিতে রচনা করেছেন।
গালিবের ভাগ্য লেখা ছিল ভারতবর্ষে, আগ্রা দিল্লীর রাজপথ মুখরিত হবে তার কবিতা আর গজলে। তাই হয়তো ভাগ্যের সন্ধানে গালিবের পূর্বপুরুষেরা তুরস্ক থেকে ভারতবর্ষে আসে, দাদা পরদাদারা ভারতের বিভিন্ন রাজার অধীনে সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন। গালিবের বাবা আবদুল্লাহ বেগ খান আসফ-উদ-দৌলার বাহিনীতে চাকরি নিয়েছিলেন। স্ত্রী আর তিন সন্তানকে রেখে যুদ্ধের প্রান্তরেই হারিয়ে গিয়েছিলেন আবদুল্লাহ। বাবার স্নেহ গালিবের পাওয়া হয়ে উঠেনি, মাকেও কাছে পাননি খুব একটা। এতিম গালিব আগ্রায় বেড়ে উঠেছিলেন।গালিব, তার ভাই ইউসুফ, বোন ছোটি খানম আর তার মায়ের জায়গা হয় আগ্রার এক মহলে, মায়ের থাকেন সুরক্ষিত জেনানামহলে। মায়ের সাথে দেখা হয় খুবই কম, গালিব মহল থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় নামেন, মানুষের জীবনের গল্পগুলো চোখ দিয়ে পড়তে শুরু করেন।
সৈনিকের মৃত্যুর পর তার তলোয়ারের উত্তরাধিকারী হয় তার পুত্র। কিন্তু আবদুল্লাহ যুদ্ধে কোথায় হারিয়ে গেছে, সে খোঁজ কেউ রাখেনি। গালিবের হাতেও তলোয়ার উঠেনি, তার হাতে উঠেছে কলম, সাথে ঘুড়ি উড়ানো আর দাবা খেলায় হাত পাকালেন। ১১ বছর বয়স থেকেই ‘শের’ লিখতে শুরু করেন তিনি।হিন্দি-উর্দুর পাশাপাশি ফারসি, আরবি শেখার শুরু হয় মহলেই। আব্দুস সামাদের কাছে ফারসি শেখার হাতেখড়ি হয় গালিবের। গালিবের মনে ফারসি ভাষায় রচিত গজলের প্রতি এক বিশেষ টান ছিল। গজলের ভাষা হিসেবে ফারসিকে উর্দুর উপরে রাখতেন গালিব। গজল, কবিতায় আধ্যাত্মিকতা চর্চাও একটি ধারা তখন প্রচলিত ছিল, সেই ধারা তার মধ্যেও লক্ষ্য করা গেছে।গালিবের জীবনে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আসেনি কখনোই। দিল্লীর এক অভিজাত পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করে আগ্রা ছেড়ে দিল্লীতে এলেন গালিব। মুঘল সাম্রাজ্যের তখন আর সেই আভিজাত্য নেই, ইংরেজদের অধিকারে চলে যাচ্ছে সব। দিল্লীতে শ্বশুর ইলাহী বক্স খানের বাড়িতেই থিতু হয়েছিলেন তিনি। স্ত্রী উমরাও বেগমের সাথে বনিবনা হয়েছিল কি? সেখানে রয়ে গেছে এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন। ভৃত্য কাল্লু গালিবের সহচর হয়ে কাটিয়েছে দীর্ঘ সময়, গল্প শুনতে ভীষণরকম পছন্দ করা কাল্লুও এক আশ্চর্য চরিত্র। তার সূত্রে কাহিনীর প্রয়োজনে গল্প শাখা প্রশাখা মেলেছে বিভিন্ন জায়গায়।আসলে কাল্লু কিংবা উমরাও বেগম কেমন চরিত্র ছিল সেই প্রশ্ন ইতিহাসের জন্য রেখে দিয়ে এই উপন্যাস পড়তে নামতে হবে। ‘দোজখনামা’র দুনিয়াতে কাল্লু আর উমরাও বেগম চরিত্র দুইটি গালিবকে জড়িয়ে আছে অদ্ভুতভাবে।
গালিবও ছিলেন অভিজাত জীবনে অভ্যস্ত। মির্জা হওয়ার সুবাদে পালকি চড়ে যাতায়তে অভ্যস্ত ছিলেন। গজল আর কবিতার পাশাপাশি মদ, নারী আর জুয়াতেও আসক্ত হয়ে গিয়েছিলেন গালিব। নিজের বাড়িতেই বসাতেন জুয়ার আসর, দিল্লীর অভিজাত মানুষেরা যোগ দিতেন গালিবের সেই আসরে। তবে আর্থিক অনটনের মুখেও ধারদেনা করে তার দিন চলে যেত। গালিবের কাছে গজল ছিল, একটু পৃষ্ঠপোষকতার দরকার ছিল, মুঘল দরবারে জায়গা হয়নি তার, মুঘল দরবারে জৌলুশ ক্রমান্বয়ে কমে আসছে, ইংরেজদের দয়া দাক্ষিণ্যে টিকে ছিল দিল্লীর দরবার।বিলাসী জীবন গুজরান করতে গিয়ে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েছিলেন আগেই। ইংরেজদের কাছে পাওনার পেনশনের জন্য দেন দরবার করতে হয়েছে, দিল্লী থেকে কলকাতা লম্বা পথ পাড়ি দেওয়ার বিবরণকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অসাধারণ দক্ষতায়। গালিবের চোখ দিয়ে বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য আরেকবার চোখে পড়বে পাঠকদের। তাই ইতিহাস বইয়ের পাতা হয়তো উল্টাতে থাকবে কিন্তু উপন্যাস এগিয়ে যাবে নিজের গতিতে।
এই উপন্যাসের পরতে পরতে গালিবের জীবনের সাথে পাওয়া যায় মান্টোর জীবনের কথাও। সাদাত হাসান মান্টোর জীবনটাও খুব সুখের ছিল না। ছোটবেলায় বাবার কাছেও খুব একটা সহানুভূতি পাননি মান্টো। প্রথম পক্ষের সন্তানদের প্রতি তার মনোযোগ ছিল বেশি, দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান হিসেবে মান্টো ছিলেন অবহেলিত। পাঞ্জাবের লুধিয়ানায় জন্ম মান্টোর, তবে মান্টোর কর্ম আর জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে বম্বে (বর্তমান মুম্বাই) শহর। এই বম্বে শহরেই তার উত্থান। মান্টোর দাবী ছিল বম্বে শহর তার সাথে কথা বলতে পারতো, কান লাগিয়ে তিনি এই শহরের হাসি-কান্নার আওয়াজ শব্দে পরিণত করতে পারতেন।জীবনে উপার্জনের জন্য কম পরিশ্রম করেননি তিনি, সিনেমার স্ক্রিপ্ট কিংবা গল্প লেখা সবই চালিয়ে গেছেন সমান তালে। মান্টোর জীবনে তার স্ত্রী শাফিয়া ছাড়াও এসেছে আরেক নারী ইসমত চুগতাই। মান্টো আর ইসমতের সম্পর্ক নিয়েও অনেক জল ঘোলা হয়েছে, আসলেই কি মান্টো ভালোবাসতেন ইসমতকে? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো মান্টো বাদে কেউ দিতে পারবে না। তবে এই উপন্যাসে রঙিন সাহিত্যিক সম্পর্কের নানান দিক নিয়ে মান্টোর হয়ে কথা বলেছেন লেখক নিজেই। দেশভাগের পর মান্টো তার প্রাণের শহর বম্বে ছেড়ে পাড়ি জমায় পাকিস্তানে। ইসমতের সাথে সম্পর্কে ভাঁটা পড়ে, নতুন দেশ পাকিস্তানে অর্থের অভাবে কষ্টের দিনগুলো কাঁটা হয়ে বিধে পাঠকের মনে। দিনে দিনে মদের আসক্তি বাড়তে থাকে, ফিরতে ইচ্ছে করে বোম্বে কিন্তু যেতে পারেন না, লেখালেখি থেকে যে টাকা আসে তা দিয়ে পরিবার চলে না তাই পারিবারিক জীবনটাও কঠিন হয়ে উঠে তার জন্য।
দোজখনামা উপন্যাসের এমন অদ্ভুত নামের কারণ বই পড়তে শুরু করলেই ধীরে ধীরে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।জীবন তো এক চলমান দোজখেরই দস্তান। ওপারের দোজখ শরীর পোড়ায়, আর জীবনের দোজখ পোড়ায় হৃদয়। মনের ব্যথাকে কবে শরীরের ব্যথা ছাড়াতে পেরেছে? রবিশংকর বলের অসাধারণ সাবলীল এবং শৈল্পিক বর্ণনায় মির্জা গালিব ও সাদাত হাসান মান্টোর জীবনের মধ্য দিয়ে ভারত ইতিহাসের আড়াইশো বছরের দোজখসম দুঃখ উঠে এসেছে এই উপন্যাসে।দুই দেশের দুই কবরে সমাহিত ভিন্ন ভিন্ন শতাব্দীর দুই মহারথী মির্জা আর মান্টোর অসম্ভব আলাপচারিতা এক পরাবাস্তব আবহে উপস্থাপন করেছেন তিনি। কবরে শুয়ে গালিব আর মান্টোর কথোপকথন চলছে এক অদ্ভুত ছন্দময় ধারাবাহিকতায়। মসলিনের বুকে যেমন রেশমের কারুকার্য ফুটে ওঠে, ঠিক তেমনই পৃষ্ঠার ভাঁজে ভাঁজে ঠাসবুননে মান্টো আর গালিবের জীবনের একাকীত্ব, পারিবারিক জীবন ও ব্যক্তিগত দুঃখবোধ তুলে ধরেছেন রবিশংকর। দোজখনামাকে অল্প কথায় যদি বুঝতে চান তবে উপন্যাসের এই লাইন গুলো তুলে ধরা যায় -“মান্টো তাঁর সমস্ত জীবন একটি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন, মির্জা মহম্মদ আসাদুল্লা খান গালিব।মান্টোর মনে হয়েছে মির্জা আর তিনি যেন মুখোমুখি দুটি আয়না। দুই আয়নার ভিতরেই শূন্যতা। দুই শূন্যতা একে অপরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।”
মির্জা গালিব আর সাদাত হাসান মান্টো একই দোজখের দুই ভিন্ন ভিন্ন সময়ের নক্ষত্র।মনোমোহন সুফী গল্প আর কিসসার আড়ালে উর্দু সাহিত্যের দুই দিকপালের জীবন উঠে এসেছে। জীবন তাদের অনেক পুড়িয়েছে, নরক গুলজার দেখিয়েছে, দিল্লীর বুকে কারবালা বইয়ে দিয়েছে। জীবন কখনো কখনো মানুষকে এমন যন্ত্রণা দেয় যা মানুষ তার এক জীবনে সইতে পারে না। তখন সেই জীবন মানুষের কাছে হয়ে যায় দোজখ। সেই দোজখসম হাহাকার সিনায় নিয়ে তারা দুজন শুয়ে আছেন দুই ভিন্নদেশের মাটিতে।অথচ তারা ছিলেন একই প্রতিচ্ছবির মত, মুখোমুখি দুটি আয়না। পৃথিবীর জন্য তারা রেখে গেছেন অমূল্য মণিকান্তের ভান্ডার। কিন্তু জীবদ্দশায় পৃথিবীর মানুষ তাদের কদর বোঝে নি। বোধকরি, পৃথিবীর সকল কবি সাহিত্যিকদের এই একই ভাগ্য, সমাজের যাবতীয় অবহেলায় অগোচরে হারিয়ে নক্ষত্র হয়ে যান তারা।
মির্জা গালিব, গজল-কবিতার জগতে কালের সেরা ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী শায়ের হয়েও যথাযথ সম্মান পাননি মুঘল দরবারে৷ কিভাবে পাবেন, তার লেখার সমঝদারের তো তখনও জন্মই হয়নি। সমসাময়িক কবিদের লেখা যখন আড়ম্বরপূর্ণ, অলঙ্কারে ঠাসা শব্দের জালে কেবল অন্তঃসারশূন্য পোশাকি সৌন্দর্যে আর কৃত্রিম প্রশস্তিতে জর্জরিত, গালিব তখন ছুঁতে চাইতেন জীবনের গভীরতম সত্যকে। সেই সত্যের সাথে মিশে আছে মানুষের প্রগাঢ় অন্ধকার দিক আর চিরন্তন দুঃখবোধ। গালিব শব্দ ভালোবাসতেন, শব্দকে ছেনে রঙ বের করে শব্দের গভীরের সুরকে বের করে আনতেন। তিনি চেয়েছিলেন শুধু শব্দ দিয়ে একটি পৃথিবী রচনা করতে। এমন এক শিল্পী সৃজনক্ষমতার সমঝদারের অভাবে জীবনভর পেয়েছিলেন উপেক্ষা আর অপমান।বড় ভুল সময়ে জন্মেছিলেন গালিব, ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্য তার ঔজ্জ্বল্য হারাতে বসেছে তখন। আগ্রা থেকে যখন শাহজাহানবাদে এসেছিলেন তিনি, দরবার ছিল তার স্বপ্নের জগত। সেই দরবারে স্থান করে নিতে নিতে এত সময় পেরিয়ে যায় যে শব্দরাই গালিবকে ছেড়ে চলে যায়। দেনায় জর্জরিত হয়ে পরিবার নিয়ে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্যই কেবল দরবারের জায়গাটুকু ছিল গালিবের শেষ আশ্রয়। কবিমহলে উপহসিত, যৌবনে ঠাঁই মেলেনি মুঘল দরবারে, নতুন প্রভু ইংরেজরাও কি গালিবের কবিতার সমঝদার নয়। শিল্পীর প্রতি এই অবিচার তো যুগ যুগ ধরে চলে আসা কদর্যতারই আখ্যান।অভিজাত জীবনে অভ্যস্ত গালিব মির্জা হওয়ার সুবাদে পালকি ছাড়া চলতেন না। গজল আর কবিতার পাশাপাশি মদ, নারী আর জুয়াতেও আসক্ত ছিলেন। বিলাসী জীবন গুজরান করতে গিয়ে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েছিলেন আগেই। শেষে পরিবারের ওয়াস্তে ইংরেজদের কাছে পাওনার পেনশনের জন্য দেন দরবার করতে হয়েছে, নিজের পেনশনের জন্য তাঁকে ছুটতে হয় কলকাতাও। সে যাওয়া নিষ্ফল হলেও কলকাতা তাকে যা দিয়েছে তাও কম নয়। নিবিড় সবুজ শ্যামলিমা, নারীর রূপ, ইশক, আমের ভুবনভোলানো স্বাদ। গালিবের চোখে দিল্লী থেকে কলকাতার লম্বা দুরত্ব পাড়ি দেওয়ার পথে বাংলার অপরূপ সৌন্দর্যকে রবিশংকর ফুটিয়ে তুলেছেন অসাধারণ দক্ষতায়।
একই দুর্ভাগ্য বয়ে বেড়িয়েছিলেন মান্টোও, ছোটগল্পের জগতের প্রবাদ পুরুষ, আমাদের আরেক দুঃসময়ের লেখক। অত্যন্ত ক্ষমতাধর এই লেখককে তকমা দেয়া হয়েছিলো ‘অশ্লীল লেখক’ হিসেবে। তাঁর গল্পে বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে সমাজের অন্ধকার জীবনের জটিলতা, মাতাল, পাগল, ভবঘুরে, ও পতিতারা। দূষিত সমাজের নানা কদর্যতাকে সুশীল সমাজে তুলে ধরার কারণে মান্টোর বিরুদ্ধে ছয়বার অশ্লীলতার অভিযোগে মামলা হয়। জীবন তাকে থমকে দিয়েছে বহুবার, আঘাতে কেটেকুটে দিয়েছে, অর্থকষ্টে শিল্পকে বিকিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে হয়েছে রাতের খাবার। তবু শফিয়া মমতাময়ীর সংসারে মন এসেছিল তার। অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন সংসার চালাতে, সিনেমার স্ক্রিপ্ট কিংবা গল্প লেখা সবই চালিয়ে গেছেন সমান তালে। বোম্বের ফিল্মি দুনিয়ায় পোড় খাওয়া মান্টো খুঁজে পেয়েছিলেন বেঁচে থাকার অন্য নেশা। একে একে জীবনে এসেছিল বারিসাব, ইসমত, শাহেদ, শ্যাম, সিতারা, নাসিম, নুরজাহান, হিরামান্ডির অদ্ভুত সব বারবনিতারা, আরো কত শত মুখ। আর এদের ঘিরে দোজখনামায় জমে ওঠে অসংখ্য ‘কিসসা’।
মির্জা গালিবের কাহিনি, পুরো জীবনটাই যার প্রিয়জনের ধ্বংসস্তুপ। পিতৃহীন পরিবারটিকে বড় হতে হয়েছে কালে মহলের এক কোণায়, শৈশব পেরিয়ে গেছে তবু জেনানা মহলের কঠোর পর্দা পেরিয়ে মা’কে ছুঁতে পারেননি। অভিভাবকহীন মির্জা গালিব আগ্রার পথে পথে ঠোকর খেতে খেতে মানুষের জীবনের গল্পগুলো চোখ দিয়ে পড়তে শুরু করেন, জেনে নেন জীবনের রূঢ়তম বাস্তবতাকে। সেই কাঁচা বয়সেই মির্জা লিখলেন অনবদ্য সব গজল। কিন্তু জীবন দয়া করেনি মির্জা গালিবকে। একে একে যাকে জড়িয়ে ধরেছেন তাকেই হারিয়ে ফেলেছেন। মুনিরাবাই, আরিফ, কাল্লু, ফখরুদ্দিন, ফজল-ই-হক, শইফতা, ইউসুফ মির্জা আরো কত প্রিয়জন। শেষ বয়সে এক উমরাও বেগম আর কাল্লু ছাড়া মির্জা গালিবের আর কেউ ছিলেন না।কাল্লু আর উমরাও বেগম চরিত্র দুইটি গালিবকে জড়িয়ে আছে অদ্ভুতভাবে। সারাজীবন খোদার পথে নিজেকে উৎসর্গ করার পরেও জীবন উমরাও বেগমকে অভাব আর সন্তান শূন্য কোল ছাড়া কিছুই দেয়নি। গালিব আর উমরাও বেগমের বৈবাহিক সম্পর্ক হয়তো তাদের নিজেদের কাছেও দুর্বোধ্য ছিল। আটান্ন বছর পেরিয়ে গেল, কেউ কেন যেন কারো জগতে প্রবেশ করলেন না।এই প্রসঙ্গে ‘দোজখনামা’ থেকে বেগম আর গালিবের একটা কথপোকথন স্মরণ করা যাক-জীবনের শুরুর দিকে উমরাও বেগম একদিন জিজ্ঞেস করেছিল-“আপনি কথা বলেন না কেন, মির্জাসাব?”-কী কথা?-আমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে না আপনার?-করে তো,কিন্তু-কী?-তুমি আমার থেকে অনেক দূরে বেগম।-কত দূরে?মির্জা গালিব হাত তুলে আকাশের একটা নক্ষত্রকে দেখালেন।”
‘দোজখনামা’র আনন্দ ও বেদনার কাব্য ছপিয়ে বার বার উঠে এসেছে মান্টো আর ইসমতের প্রেম। স্ত্রী শফিয়ার পরে ইসমতই আরেক নারী যে মান্টোর হৃদয়ে গভীর দাগ কেটেছিলেন। ইসমত চুগতাই এক নিন্দিত ও নন্দিত লেখিকার নাম, সে যুগে এমন এক শক্তিশালি নারীর ক্ষুরধার কলম পুরো ভারতবর্ষে বিরল। সেই ইসমতের প্রতি কি মান্টোর প্রেম না থেকে পারে? এ প্রশ্নের উত্তর একমাত্র মান্টোই দিতে পারবেন। তবে ‘দোজখনামা’য় মান্টোর হয়ে লেখক খুব অদ্ভুত পুতুলখেলায় বুনেছেন মান্টোর আর ইসমতের রসায়ন। ভালোবেসেও এই দু’জনের মিলিত হবার আকাঙ্ক্ষা না থাকার মতো জটিল বিষয়টি রবিশংকর কী সাবলীল ভাবে ব্যাখ্যা করলেন। ইসমতের সাথে কখনো বিবাহিত জীবনের কথা ভাবেননি মান্টো। কেননা বিয়ের শৃঙ্খল ও দায়িত্ব বোধহয় তাদের এই মুগ্ধতার আর বোঝাপড়ার সম্পর্ককে সংসারের নৈমিত্তিক টানাপোড়ন, অবহেলা আর অযত্নে পানসে ডালের মতো নিত্য অভ্যাসে পরিণত করতো। মান্টো আর ইসমতের মিলন হয়নি বলেই হয়তো তাদের প্রেমকাহিনি অমর হয়ে গেছে। মুগ্ধতার এই সম্পর্কগুলো বিরহেই সুন্দর, প্রস্ফুটিত, আকাঙ্ক্ষিত।
জীবনের নানা যুদ্ধে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল মান্টো ও মির্জার বাস্তবতা। লেখকের মসৃণ বর্ণনায় ‘দোজখনামা’য় ফুটে ওঠে কীভাবে গোটা জীবনটাই যেন জলন্ত দোজখ হয়ে উঠেছিল মান্টো আর গালিবের। অর্থকষ্ট, নারী আর মদের নেশা এই দুইজনকে চিরে খেয়েছে। তবে বারবধূদের কাছে শুধু আনন্দের জন্যই নয়, ‘কিসসার’ জন্য, ভালোবাসার জন্যও ধরা দিয়েছেন এই দুজন। সোনার গহনায় মোড়ানো পটের বিবিদের ফাঁপা প্রেমের বুলির চেয়ে কোঠাবাড়ির শরীর বেচে খাবার জোটানো মেয়েদের কাছেই যেন তারা খুঁজে পেতেন ইশকের আদিরূপ। সরস হয়ে ওঠতো ঝিমিয়ে পড়া টুকরো টুকরো জীবনের গল্প।
বইয়ের এক পর্যায়ের লেখক আমাদের সত্যিকারের দোজখও দেখিয়েছেন। মান্টোর পক্ষে তখন ১৯৪৭ এর দেশভাগের গল্প শুরু হয়েছে, আর মির্জা গালিবের পক্ষে ১৮৫৭ এর সিপাহী বিদ্রোহ। ইতিহাসের বড় বড় এই রাজনৈতিক দুই পট পরিবর্তনের ঘূর্ণিপাক ভেঙেচুড়ে দিয়েছিল গালিব আর মান্টোকে। মির্জা গালিবের বড় আফসোস, ১৮৫৭ এর পরেও আরো ১২টা বছর তাকে সেই দোজখে বেঁচে থাকতে হয়েছে। চোখের সামনে শাহজাহানবাদের ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে ব্রিটিশরা তাকে উপহার দিয়েছে একটি প্রিয়জনহীন মৃত শহর। অন্যদিকে ১৯৪৭ মান্টোর জীবন থেকে বস্তুত সবই কেড়ে নিয়েছে। দেশভাগের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায় উপমহাদেশের লক্ষ কোটি মানুষ। জীবিকা, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, লেখার জগত আর মানসিক স্থিরতা, সব কিছু হারিয়ে নেশায় বুঁদ হয়ে মুক্তি খোঁজা ছাড়া মান্টোর বোধহয় কিছু করার ছিল না।
সিপাহী যুদ্ধের নির্মম ধ্বংসলীলায় নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন কবি গালিব। কত প্রিয়মুখ রাস্তায় পড়ে রইল, হারিয়ে গেলো শত বছরের সংস্কৃতি, মরুভুমি হয়ে গেল শাহজাহানবাদের সেই রোশনাইয়ে মোড়া মুঘল সাম্রাজ্যের ঐশ্বর্য। মুঘল সাম্রাজ্যের মৃত্যুর সাথে তাঁরও মৃত্যু হয়েছিল, জীবন্মৃতের মতো বেঁচে ছিল কেবল তার রোগে জরায় ভোগা শরীর আর টুকরো স্মৃতির কিছু আকুতি। শব্দ ছেনে সুরের দুনিয়া দেখার চোখে যে পাশবিকতা উনি স্বচক্ষ করেছেন, এরপর আর বেঁচে থাকার কোনো আগ্রহ ছিল না তাঁর। বড় কষ্টে, অভাবে অনটনে, বন্ধুহীন হয়ে বাকি ১২ টা বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। গজল নিয়ে কারো সাথে দুটো কথা বলার জন্য বুকটা ফেটে যেত। কিন্তু তা শোনার মত কোনো বন্ধু তো জীবিত ছিলেন না। এমনকি নিজের মৃত্যুতে শোক করার মতোও আর কেউ ছিলেন না। সন্তানসম কিসসাখোর কাল্লুকে কবরে শুইয়ে দিয়ে এসে নক্ষত্রহীন আকাশের নিচে এক সমুদ্র শূন্যতা বুকে বোঝাই করে মির্জা গালিব তার জীবনের বাকি দিন গুলো অপেক্ষা করে ছিলেন অমোঘ বিদায়ের জন্য। সিপাহী বিদ্রোহের নিষ্ঠুরতা নিয়ে উমরাও বেগমের সাথে মির্জা গালিবের একটা কথপোকথন হৃদয়ে দাগ কাটার মতো।”কেঁদো না বেগম। ব্রিটিশরা দেখলে গুলি করবে। দেশটাকে ওরা মরুভূমি বানাতে চায়, আর তুমি চোখের ভিতরে এত জল লুকিয়ে রেখেছো?”
ওদিকে মান্টো বয়ে বেড়িয়েছেন দেশভাগের ক্ষত। পাশবিক হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী হয়ে কথারা তার ফুটপাতের জমাট বাধা রক্তের সাথে মিশে যেতে গিয়েও যায়নি। বরং সেই দগদগে ক্ষতের ছবি ছুড়ির ফলার মত তার কলম দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন একের পর এক গল্পে। তবে যেন দেশভাগের ফলা মান্টোর বুক একটু বেশিই রক্তাক্ত করে দিয়েছিল। বম্বে যে তার দ্বিতীয় জন্মস্থান। দেশভাগের সময় প্রাণের শহর বম্বে ছেড়ে জীবন বাঁচাতে পাড়ি জমাতে হয়েছে পাকিস্তানে। লাহোরে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বলে তখনো কিছু গড়ে ওঠেনি। মান্টো হারালেন তার চিরচেনা ফিল্মি জগত। শুধু লেখালেখি থেকে যে টাকা আসে তা দিয়ে পরিবার চলে না, তাই পারিবারিক জীবনটাও কঠিন হয়ে ওঠে তার জন্য। অন্যদিকে বম্বে ছাড়ার কারনে ইসমত ভুল বোঝেন মান্টোকে। আর কখনো যোগাযোগ করেননি মান্টোর সাথে। অনেক প্রিয় বন্ধুর সাথে ইসমতকেও হারিয়ে ফেললেন মান্টো। সাথে রয়েছে দেশভাগের উত্যপ্ত স্মৃতি যা ধিকি ধিকি করে আগুন ধরায় মান্টোর বুকে। এক সাথে এত কিছু নিতে পারলেন না তিনি। হতে হলে নেশার দ্বারস্থ। দিনে দিনে মদের আসক্তি বাড়তে থাকে, মদ ছাড়া কলম থেকে শব্দ বের হয় না। মদের জঞ্জাল ধীরে ধীরে গ্রাস করছিল মান্টোর শরীর। আর এরপরের কাহিনি তো ইতিহাসই ভালো বলতে পারবে।
শেষ করার আগে লেখকের ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগ নিয়ে দু’টো কথা না বললেই নয়। কেবল সাবলীলতাই একমাত্র গুণ নয়, তিনি যেন পায়রার বুকের নরমতম পালক দিয়ে পরম যত্নে পাঠকের হৃদয়ে পরশ কেটে গেছেন। উষ্ণতা আর কোমলতার সাথে সাথে পায়রার বুকের কোমল দুঃখটুকুও দুহাতে বাড়িয়ে ধরেছেন, গ্রহণ করবেন কিনা সিদ্ধান্ত আপনার। উপন্যাসের পাতায় পাতায় উর্দু শব্দের প্রসিদ্ধ ব্যবহার যেন আমাদেরকে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিটি ইটের গাথুনির স্পর্শ দেয়। এছাড়াও মান্টো আর গালিবের একে অপরকে ‘মান্টোভাই’ ‘মির্জা সাব’ বলে সম্বোধন করা, কবরের অন্যান্য মৃতদের ‘ভাই’ সম্বোধন করা, সরাসরি পাঠককে ‘দোসর’ সম্বোধনে কথোপকথন, তাতে যেন দোজখনামার চরিত্রগুলো পাঠকের আরো আপন হয়ে ওঠে, একই ঝুলির কাঠপুতলির মতো মর্মস্পর্শী হয়ে ওঠে।‘দোজখনামা’য় এক পরাবাস্তব আবহ আছে, সুফী গল্প আর কিসসার আড়ালে দুই মহারথীর জীবন উঠে এসেছে, ইতিহাসকে অনেক জায়গায় পাশ কাটিয়ে পাঁচিল টপকে গেছেন লেখক।
“ইতিহাস একদিন ধুলো হয়ে যায়, কিসসা বেঁচে থাকে।” মৃতদের পৃথিবীতে ঘুমিয়ে আছেন গালিব আর মান্টো। কিন্তু ইতিহাসের ধুলাবালি ঝেড়ে কিসসারা বেঁচে আছে। এপারের দুনিয়াতে পুড়ে কয়লা হয়ে ওপারের দুনিয়ার জন্য খাঁটি সোনা হয়ে গেছেন তারা। সেই খাঁটি সোনার দুনিয়ায় তাদের জন্নাত কবুল হোক। শান্তির ঘুম ঘুমাক মির্জা মহম্মদ আসাদুল্লা খান গালিব এবং সাদাত হাসান মান্টো। কিসসারা জন্নাতের ফুল হয়ে তাদের হৃদয়ে ধরা দিক।“
প্রত্যেকটা পাতায় পাতায় ইতিহাস কে ধরে রাখা আর তার সাথে একই মাপকাঠিতে সাহিত্যকে লেপে দেওয়ার এক সংমিশ্রণ দেখা যায় খুব কম বইতে। ইতিহাস তো লেখাই যায় কিন্তু তার সাথে স্বপ্ন কে মিশিয়ে এরকম স্বপ্নের ইতিহাস বুনতে সবাই পারে না। এ ভারতবর্ষের ইতিহাস, সেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতন এর সময়কাল থেকে স্বাধীনতার পরবর্তী যুগ পর্যন্ত যে সময়টা তাকে এইভাবে সাহিত্যের রসে ডুবিয়ে পরিবেশন করেছেন রবিশংকর বল। এটা ওনার ক্যারিশমা। আর সেই ইতিহাস বলেছেন কবরে শুয়ে দুই দেশের দুই যুগের দুই প্রবাদপ্রতিম মানুষ – মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিব আর সাদাত হাসান মান্টো। বইটা দোজখ্নামা।
কবরে শুয়ে দুই দেশের ইতিহাস আর তার সাথে তাদের জীবনী কে গল্প করে বলে গেছেন এই দুই মলাটে। বইটা পড়তে পড়তে মনে হয়েছে যদি কখনো না শেষ হয় তাহলে ভালো হোত। তাড়াহুড়ো করে শেষ করার কোনো ইচ্ছে হয় না, মনে হয় দীর্ঘদিন বাদে একটা অবলম্বন পাওয়া গেছে জীবনের রস সংগ্রহের জন্যে। প্রতিদিন একটু একটু করে এই রস জীবনে মিশিয়ে দেওয়াই যায়। কিস্সা শুনতে শুনতে পেরিয়ে যায় সময়ের এক গণ্ডি।প্রত্যেকটা অধ্যায়ে তাদের স্বপ্ন, তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, তাদের সাথে ঘটে চলা মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা, তাদের কাছের মানুষগুলোর তাদের ছেড়ে চলে যাওয়া, প্রতিদিনের জীবনের অপমান, তাদের না পাওয়ার যন্ত্রণা, দুঃখ সব মিলে মিশে গেছে। সেই সঙ্গে সিপাহী বিদ্রোহ আর স্বাধীনতা নামক দুই ভয়ংকর সময়কালের এক ভয়ংকর চিত্র চিত্রিত হয়েছে। গালিব যেখানে মুঘল যুগের শেষ সময় থেকে সিপাহী বিদ্রোহের সময় পর্যন্ত এক দেশ কাল এর পরিচয় দিয়েছেন আর তার সাথে বয়ে চলেছে তার গজল আর শায়রি। মান্টো স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়কালের সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন। সাথে সাথে অনেক বেশি ভাবে উঠে এসেছে যৌনকর্মী দের অবস্থান আর মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তার জীবন যুদ্ধের বর্ণনা।দুই ক্ষতবিক্ষত হৃদয় এর যে কিস্সা এখানে ধরা পড়েছে সেটার যুগলবন্দীতে এই বই হয়ে উঠেছে অমৃত। তবে গালিব এর গজল আর মান্টো বা ইসমত চুঘতাই এর গল্প আগে পড়া থাকলে অনেক ভালোভাবে অনুধাবন করা যায়। দুই দেশের দুই কালের সময়কে এইভাবে পরিবেশন করে শুধু মাত্র আড়াইশো বছরের ইতিহাস ধরে রাখে নি, লেখক সেগুলোকে প্রত্যক্ষ করিয়েছেন এই দুই বিদীর্ণ হৃদয়ের অধিকারীর মধ্যে দিয়ে।
সুন্দর আলোচনা। অভিনন্দন জানাই।