spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যহিলসাইডের আড্ডায় লরেন্স, জয়েস, খৈয়াম

লিখেছেন : কাজী জহিরুল ইসলাম

হিলসাইডের আড্ডায় লরেন্স, জয়েস, খৈয়াম

কাজী জহিরুল ইসলাম 

পরিকল্পিত আড্ডা গড়ে তুলতে হলে দায়িত্ব নিতে হয়, দিন ক্ষণ স্থান ঠিক করে সেই খবর জানাতে হয় এবং যথাসময়ে নিজে উপস্থিত থাকতে হয়। এইসব সাংগঠনিক কাজে আজকাল আগ্রহ পাই না। তার চেয়ে বরং এ-ই ভালো, দুজনের আড্ডাই চলুক। আজ বিকেলেও হিলসাইডের সেই রেস্টুরেন্টেই বসেছিলাম। সৈয়দ কামরুল এবং আমার সঙ্গে আরো দুয়েকজন বিচ্ছিন্ন কিন্তু উৎসুক আড্ডাবাজ ছিলেন। লক্ষ করে দেখেছি রেস্টুরেন্টের বিক্রয়কর্মী হিজাব পরা ফর্শা মুখের নারী এবং আরো অন্তত দুজন অতিথি কান খাড়া করে আমাদের আলোচনা শুনছিলেন। এতে একটা উপকার হয়েছে।  সাধারণত আমাদের মতো আড্ডাবাজ অতিথিদের, যারা এক কাপ চা আর একটা সিঙ্গারা বা ডালপুরি নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে, তাদের রেস্টুরেন্ট-অলারা ভালো চোখে দেখে না। ভালো চোখে যে দেখে না তা কোনো গোপন বিষয় নয়, মাথার ওপরে, রেস্টুরেন্টের দেয়ালেই তা লেখা আছে ‘চায়ের কাস্টমার ১৫ মিনিটের বেশি বসে থাকবেন না’। কিন্তু আমাদের প্রতি নারী কর্মীটি বেশ প্রসন্ন। যথেষ্ঠ গুরুত্ব দিয়ে কথা বলেন এবং হাসিমুখে সেবা প্রদান করেন। শুধু তাই না আমরা কত ঘন্টা বসে থাকলাম সেটা কোনো বিষয়ই না। আমাদের আলোচনায় হয়ত কিছুটা আলো থাকে, যা একটু হলেও চারপাশ আলোকিত করে।

ডিএইচ লরেন্সের বিখ্যাত এবং আলোচিত উপন্যাস লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার এর চলচ্চিত্রায়ন করেছেন ফরাসী পরিচালক লরে ডি ক্লেখমু তুনে। এবং তিনি নিজেই লেডি চ্যাটার্লিজ বা কোনি চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। লর্ড ক্লিফোর্ড যুদ্ধে পা হারান। কোমরের নিচের অংশ প্যারালাইজড হয়ে যায়। সেই সঙ্গে তিনি যৌন-ক্ষমতাও হারান। তার সুন্দরী, যৌনাবেদনময়ী, যুবতী স্ত্রীকে একদিন তিনিই বলেন সম্পত্তির উত্তরাধিকার দরকার। তার স্ত্রী যদি অন্য কোনো পুরুষের সন্তান ধারণ করেন তিনি অখুশি হবেন না। এবং তিনি সন্তানের পিতা কে তা কখনো জানতে চাইবেন না। ক্লিফোর্ডেরই কর্মচারী গেইমকিপার অলিভার সুদর্শন যুবক। কোনির তাকে ভালো লাগে। এস্টেটের জীব-জন্তু দেখাশোনা করে যে ব্যক্তি তাকে গেইমকিপার বলে। মূল ভবনের অদূরে অলিভারের বাড়ি। হাঁটতে হাঁটতে একদিন সেখানে চলে যায় কোনি। তখন অলিভার নগ্ন হয়ে স্নান করছিল। কোনি ভেতরে ঢোকে। সেই বাড়ির একটি শেলফে বেশ কিছু বই পায়। সেসব বইয়ের মধ্যে জেমস জয়েসের বইও ছিল। কোনি জেমস জয়েসের ভক্ত। বই পড়ার অজুহাতে রোজ সেখানে যায় কোনি এবং একদিন অলিভারের সঙ্গে মিলিত হয়। প্রভূর স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়ে অলিভার ভয় পায়, ঘাবড়ে যায় কিন্তু ক্রমশ তারা বন্য হয়ে ওঠে। সিনেমায় খোলামেলা সেইসব যৌন দৃশ্য দেখানো হয়। বৃষ্টির মধ্যে নগ্ন হয়ে অরণ্য জুড়ে তাদের ছোটাছুটি স্বর্গোদ্যানের ইভ এবং এডামের কথাই মনে করিয়ে দেয়। কোনি গর্ভবতী হয় ঠিকই এবং তা ক্লিফোর্ড জানতেও পারে। কিন্তু অলিভার এবং কোনির মধ্যে গড়ে ওঠে গভীর, নিখাদ প্রেম। শেষ পর্যন্ত ক্লিফোর্ডের কাছে বিবাহবিচ্ছেদ চায় কোনি এবং স্কটল্যান্ডে গিয়ে চাকরিচ্যুত অলিভারকে খুঁজে বের করে।

জেমস জয়েসের বইয়ের প্রসঙ্গ উঠতেই আমরা জুরিখে চলে যাই। তার বিখ্যাত উপন্যাস “ইউলিসিস” আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। বহুমাত্রিক লেখক হাসনাত আবদুল হাই ইউলিসিস পড়ার জন্য সদরঘাট থেকে স্টিমারে চড়ে খুলনায় গিয়েছিলেন। খুলনায় তিনি নামেননি, একই স্টিমারের ফিরতি যাত্রায় খুলনা থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন। আসা-যাওয়ায় ৬ দিন লেগেছিল। এই সময়ের মধ্যে তিনি ইউলিসিস পড়েছেন। এই পাঠ অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি একটি বই লিখেছেন, “নদীপথে ইউলিসিস”। আমার সঙ্গে সাক্ষাতে হাসনাত ভাই বলেছেন, বুঝলে, উইলিসিস এতো কঠিন একটি বই, এর রস আস্বাদন করার জন্য নির্জনতা এবং নিবিষ্টতা দরকার। তাই আমি ঠিক করেছিলাম ঢাকা-খুলনা স্টিমার ভ্রমণটাই উপযুক্ত হবে এবং যথেষ্ঠ সময়ও পাওয়া যাবে।

ইউলিসিসের কথা উঠলে হোমারের অডিসির কথা আসবেই। অডিসি এবং ইউলিসিস দুটি গ্রন্থের মিল, অমিলগুলো বিশ্লেষণ করছিলেন সৈয়দ কামরুল। বিশ্বসাহিত্যে আমার পড়াশোনা খুব সামান্য। এ-বিষয়ে সৈয়দ কামরুল একজন সুপণ্ডিত মানুষ। তার পড়াশোনার ব্যাপ্তি অনেক। যৎসামান্য যাও পড়েছি তার মতো করে সেসব আমি মনেও রাখতে পারি না। সুতরাং বিশ্বসাহিত্যের প্রসঙ্গে কথা উঠলে আমি বরং বলার চেয়ে শোনায়ই অধিক মনোযোগ দিই। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম ইউলিসিস এবং অডিসির চরিত্রগুলোর বিশ্লেষণ। 

সুফি এবং আধ্যাত্মিক দর্শনের পথ ধরে আমরা পারস্যে পৌঁছে যাই। কদিন আগেই কাজী নজরুল ইসলামের অনুবাদে ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত পড়ছিলাম। ১১ শতকের কবি ওমর খৈয়াম সম্পর্কে বাঙালি পাঠকদের মনে একটি বিভ্রান্তি আছে। আমরা মনে করি ওমর খৈয়াম বুঝি সুরা এবং সাকি নিয়েই মত্ত ছিলেন। গ্রন্থটির ভূমিকায় কাজী নজরুল ইসলাম ওমর খৈয়ামের যে পরিচয় দিয়েছেন তা আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল তার সম্পর্কে আরো একটু জেনে নেবার। ১০৪৮ সালের ১৮ মে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন মূলত একজন দার্শনিক, জ্যোতির্বিদ, গনিতবিদ এবং কবি। তিনিই প্রথম ফার্সিভাসীদের জন্য একটি সৌরপঞ্জিকা “জালালী ক্যালেন্ডার” প্রবর্তন করেন, পরে যেটি ইরানিয়ান ক্যালেন্ডার বা নওরোজ ক্যালেন্ডার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। গণিতের কিউবিক ইকুয়েশন তিনি উদ্ভাবন করেছেন। ওমর খৈয়াম একজন মহাকাশবিজ্ঞানীও ছিলেন। নজরুল বলেন, “ওমরের কাব্যে শারাব-সাকির ছড়াছড়ি থাকলেও তিনি জীবনে ছিলেন আশ্চর্য রকমের সংযমী। তার কবিতায় যেমন ভাবের প্রগাঢ়তা, অথচ সংযমের আঁটসাট বাঁধুনী, তার জীবনও ছিল তেমনি।” খৈয়াম সম্পর্কে নজরুল আরো বলেন, ” শারাব-সাকির স্বপ্নই দেখেছেন তাদের ভোগ করে যেতে পারেননি। ভোগ-তৃপ্ত মনে এমন আগুন জ্বলে না।”

ওমর খৈয়ামের একটি রুবাইয়াতের উদ্ধৃতি দিয়েই আজকের আড্ডার গল্পটি শেষ করছি। “মসজিদের অযোগ্য আমি, গির্জার আমি শত্রু প্রায়/ ওগো প্রভূ, কোন মাটিতে করলে সৃজন এই আমায়?/ সংশয়াত্মা সাধু কিংবা ঘৃণ্য নগর-নারীর তুল/ নাহি স্বর্গের আশা আমার, শাস্তি নাহি এই ধরায়।”

হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৯ ডিসেম্বর ২০২২।

আরও পড়তে পারেন

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

এ্যাডঃমনিরুল ইসলাম মনু on গুচ্ছ কবিতা : বেনজীন খান
পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা