খেদ
এই মেঠোপথ
এই বেড়াধার
এই ঘেঁটুফুল–গন্ধ চিনি
কতকাল সেই হুহু বাতাস
গায় মাখিনি গায় মাখিনি !
এই এঁদোপাড়
এই পুকুরের
এই পানাবন–কলমি চিনি
কতকাল সেই মনোহরণ
গায় মাখিনি গায় মাখিনি !
এই মেজো বউ
এই ঠাকুরাল
এই কাকিমার–সোহাগ চিনি
কতকাল সেই জমজমে রং
গায় মাখিনি গায় মাখিনি !
এই পাড়াগাঁয়
এই সবুজের
এই রাখালের গাইকে চিনি
কতকাল সেই উত্তেজনা
গায় মাখিনি গায় মাখিনি !
এই সোঁদাময়,
আদাড়বাদাড়
এই পরাপর সবাই চিনি
কেন যে ছাই এতাবৎকাল
গায় মাখিনি গায় মাখিনি !
আলোকমালা
মা যে আমার চিনের প্রাচীর
বিঘ্নবিহীন জীবনতারা
আমাজনের ইচ্ছেখুশি
নির্মীয়মাণ স্রোতের ধারা।
মা যে আমার দূর গগনে
ভাস-মালিকা মেঘের কুচি
দিনদুপুরে নিদাঘ রাতে
হিমালয়ের শুভ্র শুচি।
মা যে আমার কাঠপুতুলি
ছেলেবেলার খেলনাবাটি
আগলে রাখা স্বপ্নময়ী
নিঙড়ানো রং সোঁদামাটি।
মা যে আমার স্মৃতির পাতা
মন্দ-ভালো আদরমাখা
গাছ-শিকড়ে সঞ্জীবনী
শরীর জুড়ে সবুজ আঁকা।
মা যে আমার ইষ্টসাধন
দূর অদূরে আলোকমালা
রূপকথাপুর যাদুর ছোঁয়া
একফালি চাঁদ সোনার থালা।
দুধের পাতা আকাশ নীল
শব্দ সাজাই বাক্য গড়ি
যোজন করি অন্ত্যমিল
কিন্তু বাপু ছড়া কোথায়
দুধের পাতা আকাশ নীল।
অচিনচেনা জিয়নকাঠি
সাঁঝ বিকেলে দীর্ঘ চিল
ছড়ার খাতা মেঘ সিঁদুরে
দরজাতে দেয় আটকে খিল।
সোনারকাঠি হীরকমাখা
পেঁজা তুলোর স্বপ্নঝিল
ছড়ার ডানা বিস্ফারিত
ভূতের পোনা মারলো ঢিল।
শব্দে ছিল নজরদারি
ছন্দপতন গোঁজামিল
স্বীকার করি এই ছড়াটাই
হয়নি সহজ অনাবিল।
মস্তকে তাই রাগান্বিত
যেই দিয়েছি মস্ত কিল
এই রে ছড়া ওই দেখো না
পালায় ভেঙে আস্ত গ্রিল।
খাতার পাতায় বিউটিফুল
আঁকতে পারি গোলকধাঁধা
আঁকতে পারি অচিনপুর–
আমার মামার মাসির ছেলে
আঁকতে পারে গানের সুর।
আঁকতে পারি উজানভাটি
আঁকতে পারি ডুমুর ফুল–
ছোটো দাদুর পিসশাশুড়ি
আঁকতো ভালো মনের ভুল।
আঁকতে পারি হুকুম কড়া
আঁকতে পারি বাঘের দুধ–
ঠাকুরদাদার মেজো কাকা
এঁকে ফেলতো সরল সুদ।
আঁকতে পারি গরহাজিরা
আঁকতে পারি ঝিকির ঝিক–
দিদির বড়ো ছেলের মেয়ে
আঁকতে পারে কোনটা ঠিক।
আঁকতে পারি ফন্দিফিকির
আঁকতে পারি চক্ষুশূল–
আজ এঁকেছি খাতার পাতায়
একটা ভালো বিউটিফুল।
খোশমেজাজ
আগের মতো পারছি কোথায়
আগের মতো পারি না
তার মানে এই বলছি তোমায়
নির্বিবাদে হারি না।
ফর্ম পড়েছে, পড়ে সবার
এখন বড়ো পারি না
তবে আমার উচ্চে মাথা
ধার কারও তাই ধারি না।
যাই যেখানে হায় বেমালুম
বুঝতে পারি, পারি না
তবু আমার টগবগে মন
মিথ্যে নজর কাড়ি না।
নিজের আছে খুব পরিজ্ঞান
হয়তো কিছু পারি না
আমায় যারা মন্দ বলে
কথায় তাদের মারি না।
এই ছড়াটির ফলশ্রুতি
পারি, ঈষৎ পারি না
সেই কারণে যত্রতত্র
নিজের লেখা ছাড়ি না।
নাই তাতে কী
ছোটো ছোটো জায়গা ভালো
যেমন হলো
জলপাই,
ছুটি পেলেই যাই সেখানে
কারণ কিছু
বল পাই।
নামের মজা থাকলেও বা
লোকের কিন্তু
ঢল নাই,
লম্বা খাড়া ঊর্ধ্বমুখী
এক্কেবারে
তল নাই।
জানলে সবাই খুশি হবে
নোংরা কোনো
দল নাই,
ধারে কাছে আয়েশ করে
ছড়া পড়ার
হল নাই।
এতগুলো ‘নাই’ তাতে কী
ছুটির বড়ো
ফল পাই,
গল্প শুনে মন খারাপের
কারণ হলে,
চল যাই।
এই ফাগুনে
অশোক ফুলে রঙ ধরেছে
উপছে পড়ে
আকড়কাঁটা ;
সইছে না মন, একলা যাব
তাই দিয়েছি
সটান হাঁটা।
হিমঝুরিরা পাখনা দোলায়
কুরছি-কুসুম
হৃদয় কোণে ;
আকাশ-বাতাস গন্ধে বিভোর
ভিতর শুধু
প্রহর গোনে।
মণিমালা-শাল-মহুয়া
ঘোড়ানিমের
সঙ্গে আসে ;
একফালি রোদ ছন্দ জড়ায়
আবির রঙা
সবুজ ঘাসে।
দেবদারু আর স্বর্ণশিমূল
পাখিফুলে
আবেশ মাখে
গাব-গামারি-ক্যামেলিয়া
বসন্তের-ই
চিত্র আঁকে।
সব ছাপিয়ে এই ফাগুনে
রুদ্রপলাশ
বিছায় ডানা
রঙের খেলায় আজকে কোনো
নেই বেড়াজাল
নিষেধ মানা।
রূপকথা
তেপান্তরের মাঠটি কোথায়
খুব খুঁজেছি দেশান্তরে
কেউ বলেনি খবর কোনো
ডিগবাজি খাই একলা ঘরে।
পাইনি দেখা রুপোরকাঠি
সোনারকাঠি জাদুর খেলা
কী মোহময় দিন কেটেছে
চুম্বকীয় কিশোরবেলা।
জলপরি আর মেঘের পরি
রহস্যময় সবার কাছে
পক্ষিরাজের ঘোড়া তেমন
ঘোর কুয়াশায় উড়কি নাচে।
হাট্টিমাটিম কোন্ প্রাণী রে
ডিম পেড়ে যায় মাঠেঘাটে
সেই অজানার হদিশ পেতে
সূর্য কখন গেছে পাটে।
চাঁদকে কেন বলবো মামা
কেমন যেন গন্ডগুলে
কে তাহলে চাঁদের বুড়ি
বলুন না গো একটু খুলে।।
ইতিহাস ঘেঁটে
১।।
পড়েছিলুম ইতিহাসে
বাবরের এক ভায়রা ছিল।
তার বাড়িতে হাজার কুড়ি
নানা জাতের পায়রা ছিল।
উঠোন জুড়ে তাদের জন্য
তিন শতাধিক গামলা ছিল।
সন্ধে-সকাল এই কাজে আর
সুটেড-বুটেড আমলা ছিল।
২।।
মধ্যযুগে আরেক রাজার
মস্ত বড়ো বাজার ছিল।
সেই বাজারে গোরু কিনলে
ছাগলছানা মাগনা ছিল।
অবাক হবার কিচ্ছুটি নেই
এসব কিন্তু সত্যি ছিল।
রাজা-রানির খাসমহলে
খুন্তি-হাতার ব্যবসা ছিল।
৩।।
ঘাঁটলে পাতা ইতিহাসের
মশলা চিকেন কারি ছিল।
এখন যা যা ঘটছে দেখি
তার চেয়ে বরং বেশি-ই ছিল।
যেমন বলি, এই খবরটি—
ঘনঘটায় জমাট ছিল
শেরশাহের এক পুত্র না কি
বলিউডের বাদশা ছিল।
বুঝেশুনে
‘অলস’ বললে সোজাসাপটা
কেউ বলে না দিচ্ছে গালি
তার মানে কি সবাই এসে
নাচবে এবং দেবে তালি !
তবে ‘বোকারাম’-টাম বললে
রাগ হয় কিঞ্চিৎ, বুঝতে পারি
সেই কারণে যখন তখন
এমন কথায় বিপদ ভারি !
আবার ‘দুরন্ত’ বললে সেই
চিকচিকে দাঁত ছড়ায় জ্যোতি
কিছু কিছু শব্দ আছে
এক্কেবারে বাড়তি গতি !
‘ধূর্ত’ বলাতে আছে দোষ
বিবর্ণ দেখে মুখ, মানি
কড়া একটু ভাষণ হলে
তাল পাকানো হবে জানি !
‘যাচ্ছেতাই’ও তেমনই এক
মনের ভিতর আঘাত লাগে
উচিত বটে শব্দ মাপা
কাউকে কিছু বলার আগে।
হাননান আহসান,পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
পরিচিতি
হাননান আহসান (Hannan Ahsan) একাধারে শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একটি পরিচিত নাম। তিনি ১ এপ্রিল ১৯৬৩ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য স্তরের ছড়া উৎসবের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। পাশাপাশি বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠন ও লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। ‘দৈনিক বসুমতী পত্রিকা’ (শিলিগুড়ি) ও ‘যুগান্তর’- এর মতো নামি পত্রিকায় দক্ষতার সঙ্গে উপ-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ‘কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান’ এর সহকারি সম্পাদকের দায়িত্বও দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছেন। তাঁর প্রথম ছড়ার বই ‘ছড়ার গাড়ি’(১৯৮৭)। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘কিলিমাঞ্জারোর ভূত’(২০০৫)। শিশুসাহিত্য পরিষদ পদক, একতারা সাহিত্য পুরস্কার, সামসুল হক পুরস্কার, প্রেমেন্দ্র মিত্র স্মৃতি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পদক, কবি জসীম উদদীন সাহিত্য পুরস্কার সহ অনেকগুলি পুরস্কার পেয়েছেন কবি। সম্পাদনা করেছেন প্রশাখা, ছড়া দিলেম ছড়িয়ে, কিশোরসঙ্গী, আলপথ পত্রিকা। বর্তমানে সম্পাদনা করেন ‘অজগর’ ছোটোদের পত্রিকাটি। যুক্ত রয়েছেন ‘সুখবর’ দৈনিক সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় বিভাগে। এই পত্রিকার ‘কৈশোর’ বিভাগটি তিনি সম্পাদনা করেন। পশ্চিমবঙ্গে দৈনিক কাগজগুলির মধ্যে ছোটোদের এই বিভাগটি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। নানারকম ফিল্ডে কাজ করলেও পরবর্তিকালে পুরোপুরি শিশুসাহিত্যে মনোনিবেশ করেন হাননান আহসান। এখনো পর্যন্ত তার ছোটোদের ছড়া-কবিতার বই ১৩ খানা। গল্প, সম্পাদনা ও অন্যান্য প্রায় ৮০টির উপর গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। এতকিছু লিখলেও ছোটোদের ছড়া নিয়ে তিনি বেশি ভাবেন। লেখেনও। একটু অন্যরকম, অন্য স্বাদের তার ছড়া।
সুপ্রিয় হাননান আহসান, আমাদের হাননান দার কবিতা এবং তার রিভিউ পড়লাম, এবং খুব আনন্দ পেলাম।
খুব ভাল লাগল প্রতিটি ছড়া।
পৃথা চট্টোপাধ্যায়
খেল,আলোক মালা, দুধের পাতা আকাশ নীল, পাতায় পাতায় বিউটিফুল, খোশ মেজাজ, নাই তাতে কী, এই ফাগুনে, রূপকথা, ইতিহাস ঘেঁটে, বুঝেশুনে ইত্যাদি সমস্ত ছড়াগুলোই পড়লাম। প্রতিটি ছড়াই নিজস্বতায় অনন্য। ছড়াকারকে অভিনন্দন ও আশীর্বাদ।
এই ছন্দবদ্ধ কবিতাগুলো ফেসবুক-এ আগেও একটা একটা করে পৃথক পৃথক দিনে কবি নিজেই প্রকাশ করেছেন। বারবার পড়েছি । প্রতিদিনের এই চলতি শব্দ গুলো আমায় কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে নিয়ে গিয়েছিল। শুধুমাত্র অসাধারণ ,অনবদ্য বা অপূর্ব বললেও, মন কিছুতেই তৃপ্ত হচ্ছিল না। মনে হয়েছিল এই কবিতা গূলোর দীপ্তি/প্রভা আমায় অবশ করে দিচ্ছে।তাই কোন প্রতিক্রিয়া দেওয়া থেকে বিরত থেকেছি। আজ পুস্তিকা আকারে আন্তর্জাল প্রকাশনা পুনরায় পাঠ করলাম। আবার সেই একই ঘোর লেগে গেল। মূক হয়ে গেলাম। শুধু একটাই যূক্তশব্দ অস্ফুটে মুখ থেকে বের হল— ” অসাধ্যসাধন “