মহসিন হাবিব
রমজান মাসের রোজার শেষ হলে এক ফালি শাওয়াল মাসের চাঁদকে দেখার জন্য হা করে পশ্চিম দিকে তাকিয়ে থাকি গোধূলি লগনে আট থেকে আশি।
ব্যতিক্রম হয়না কারোর…
নতুন জামা কাপড় আর লাচ্ছা,সেমাই আর রকমারি খাবারের মন খুশিতে ভরে যায় বৈকি।
নতুন কাপড় পড়তে গেলেই বুকের ভেতরে ছাত করে আজও!
পুরনো দিনের সেই ঈদের স্মৃতি মনে পড়ে যায়!
তখন আমি খুব ছোট ভাই বোনরা আরো ছোট। তখন রোজা চলছিল ভাদ্র মাসের সময়।
সংসারে অভাব, অভাবের আঁচ আমি একটু আধটু বুঝতে পারতাম ,ভাই-বোনরা ততটা বুঝতো না ওরা এতটাই ছোট ছিল।
মা-বাবা দুজনেই স্থির করলো পাশের বাড়ির এক চাচার কাছে দুই বস্তা ধান ধার নেবে।
বাবা বলল আমার লজ্জা করে ধার চাইতে, মা বলল ঠিক আছে আমি ওদের কাছে চাইবো।
স্বামী-স্ত্রীর এই গোপন কথাগুলি আমি জানালার পাশ থেকে শুনেছিলাম সেদিন।
মা যথারীতি সেই চাচাদের বাড়ি গেল দুই বস্তা ধানের আশায় রোজার মধ্যে সেই ধানে চাল করবে ধান থেকে চাল করে বিক্রি করলে একটু পয়সা বেশি পাওয়া যায়।
সেই চাল বিক্রি করে আমাদের জন্য নতুন জামা কিনে দেবে এই ছিল তাঁদের ইচ্ছা।
সেদিন ওই চাচা বাড়ি ছিল না। পরের দিন বিকালে মা গেলেন ওই চাচার বাড়ি।মাকে বলেছিল তুই এসেছিস ভালো। কিন্তু তোর স্বামী ধার চাইতে এলে আমি ধার দিতাম না ।মা যেহেতু ওই চাচার থেকে বয়সে অনেক ছোট তাই মাকে তুই তুই করে বলতো।
মা ওই চাচার মুখের উপর বলেছিল ,যেখানে আপনি আমার স্বামীকে ফ্যালনা করছেন সেখানে আমি কোন কিছুই নিতে চাই না,রেখে দেন আপনার ধান ।
আমি ছেলে মেয়েদের জামা পরের ঈদে কিনে দেবো!
এমন ধানের আমার দরকার নেই !
মা মুখ নিচু করে যখন বাড়ি এলো আমি তখন উঠোনে খেলছিলাম।
মা আমাদের সবাইকে ঘরের ভিতর ডাকলেন। বাবা চৌকিতে (কাঠের তৈরি এক প্রকার সেকেলের খাট)বসে আছে তিন ভাইবোনকে নিয়ে মা শুধু বললেন এ বছর ঈদের তোদের কোন কিছু কিনে দিতে পারলাম না। তোরা কেউ মন খারাপ করিস না। পরের ঈদে তোদের ভালো জামা কিনে দেবো।
এই বলে আমাদের সান্ত্বনা দিল।
বোন না বুঝেই কেঁদে ফেলল।
আমি বুঝে শুনে বুকের কান্নাটা চোখে ভাসাতে পারলাম না,বুকের তলেই কবর দিলাম।
আর তাকিয়ে থাকলাম বাবার চোখের দিকে…
বুঝতে আমার ভুল হয়নি।
তার দু’চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা নীরব অশ্রু টপ টপ করে তার ছেঁড়া লুঙ্গিতে পড়ছে।
জলন্ত ছবির মত সেই স্মৃতি,ঈদ আসলেই গমগম করে আমার বুকের মাঝে।
তারপর জীবনে কত ঈদ পেরিয়ে গেছে !
ঈদ আসলেই শুধু মনে পড়ে যায় সেবারের ঈদের কথা!
দুনিয়া জুড়ে এমন স্মৃতি বিজড়িত কত ঘরে ঘরে আজ বিরাজ করে তার হিসাব নেই।
শওয়াল মাসের চাঁদ শুধু সাক্ষী জানা-অজানা স্মৃতি গুলোর।
ঈদের চাঁদ নিমেষের মধ্যে মিলিয়ে যায় দূর আকাশে মুছে দিয়ে যায় সে সব স্মৃতি।
…….
কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
দুঃখ-কষ্ট ভরা জীবনের অনুভূতি।
ঈদের এ স্মৃতি অপরিচিত নয় এ দেশের মানুষের।
Bastab Katha
চমৎকার উপস্থাপন