তৌফিক জহুর
গত শতাব্দীতে জন্ম নেয়া এবং আমাদের বেড়ে ওঠা, সব কিছুতেই সবুজ প্রাণ ছিলো। আমরা বিকেল হলেই মাঠে ছুটতাম। ফুটবল, ক্রিকেট, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা, কানামাছি কতকিছু খেলতাম। ঘেমেটেমে একশেষ হয়ে মাগরিবের আজানের আগেই বাসায় ফিরতাম, হাতমুখ ধুয়ে বিস্কিট, দুধ কিংবা হরলিকস যাঁর যা সামথ্য খেয়ে পড়তে বসতাম।সকাল হলেই ফজরের নামাজ পড়তে হতো বাধ্যতামূলক। আব্বার সঙ্গে মসজিদে যেতাম কি শীত, কি গ্রীষ্ম। একটা ঐতিহ্যময় পরিবেশে বেড়ে উঠি আমরা। শিকড় চিনেছি সেই কৈশোরে।
আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ে ঈদ আসতো অকল্পনীয় অচিন্তনীয় আনন্দের বার্তা নিয়ে। রোজার ঈদ মানেই একমাস রোজা করা।তারপর পনের রোজার পর থেকে নতুন পোশাক কেনাকাটার জন্য আব্বার সঙ্গে নিউমার্কেটে যাওয়া। একবার গিয়ে হয়তো শার্ট-প্যান্ট কিনলাম।পরেরদিন আবার যেয়ে জুতোমোজা কিনতাম। আমরা তিন ভাইবোন এভাবেই বেড়ে উঠি। কৃত্রিমতা ছিলোনা সেসময়। সাদাকালো টেলিভিশনে ঈদের অনুষ্ঠান ঘোষণা আসতো।খাতায় লিখে রাখতাম কোনদিন কি কি অনুষ্ঠান হবে। সেই সময় একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল ছিলো বিটিভি ( বাংলাদেশ টেলিভিশন)। সরকারি এই একটামাত্র টেলিভিশন চ্যানেলে অত্যন্ত মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান দিয়ে ঈদ উৎসব সাজানো হতো। বাংলাদেশের বিখ্যাত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান “ইত্যাদি” র জনপ্রিয় উপস্থাপক হানিফ সংকেত সাহেব প্রতি ঈদে একটা করে অনুষ্ঠান নির্মাণ করতেন দর্শকদের রুচি ও চাহিদার বিষয় মাথায় রেখে।( এখনো তিনি অবাক সচল)। ছিলেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের নাটক। পর্ব ভিত্তিক সে নাটকের জন্য আমাদের আম্মারা অপেক্ষা করতেন। এছাড়াও থাকতো, হাসির অনুষ্ঠান, যাদু, বাংলা সিনেমা, ছায়াছবির গান, ইংরেজি জনপ্রিয় মুভি। আমাদের বিনোদন, আমাদের সংস্কৃতির পরিবেশ এমন আনন্দে ঠাসা ছিলো।
ঈদের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই গোসল, নতুন পানজাবি- পায়জামা পরে আব্বার সঙ্গে জায়নামাজ নিয়ে ছুটতাম ঈদগাহে। তার আগে আম্মার হাতে তৈরি শুকনা সেমাই, লাচ্চা সেমাই ও পায়েস খেতাম। আম্মার সেই পায়েসের স্বাদ আজো জিহবায় লেগে আছে। আম্মা আব্বারা কেনো সন্তানদের রেখে অনন্তলোকে পাড়ি জমান একাকি। এ কষ্ট ও যন্ত্রণা থেকে নিস্তার নেই শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। ঈদের নামাজ পড়ে ইমাম সাহেবের খুৎবা শুনে মোনাজাত শেষে বাড়ি ফিরতাম। যে রাস্তায় যেতাম, ফিরতাম অন্য রাস্তা ধরে। প্রতিবার এভাবেই আব্বা নিয়ে যেতেন আবার নিয়ে আসতেন। বাড়ি ফিরে আব্বা- আম্মা কে সালাম করতাম। বড়ো ছেলে হিসেবে কিংবা বংশের শেষ প্রদীপ বলেই হয়তো সালামী বোনদের চেয়ে একটু বেশি পেতাম। কখনো বিশটাকা আবার কখনো ত্রিশ টাকা। আশির দশকের মধ্যভাগে বিশ- ত্রিশ টাকা বিশাল একটা ব্যাপার। সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে সাতমাথা, উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরের এডওয়ার্ড পার্ক কিংবা করতোয়া নদীর তীরে আনসার ক্যাম্পের সবুজ গালিচায় গোল হয়ে বসে ঈদের আড্ডা চলতো। তখন বাংলাদেশে সবেমাত্র ভিসিআরের কল্যাণে হিন্দি মুভি আসতে শুরু করেছে। সে সময়ের সুপারহিট হিন্দি মুভি ডিসকো ড্যান্সার, ড্যান্স ড্যান্স আমরা দুটো ঈদে দেখে ফেলি। কি উত্তেজনা আমাদের। মিঠুন চক্রবর্তী নামে একজন বাঙালি নায়ক মুম্বাই মাত করে দিয়েছে এটাও ছিলো আমাদের একটা ঈদের আলোচ্য বিষয়। টিয়াপাখি এতো সবুজ কেনো এটা নিয়ে আমরা তুলকালাম কান্ড করে ফেললাম। পঁচিশ পয়সা দামের আইসক্রিম ছিলো আমাদের ঈদের আশ্চর্য ঠান্ডা ফ্যান্টাসি। দুপুরে বাসায় এসে আম্মার তৈরি পোলাও,মুরগী রোস্ট, খাসির ভুনা কিংবা গরুর ভুনা খেতাম। খাওয়ার পর দুপুরের ঠাঠা রোদে ঘন্টাখানেক বাসাতেই চুপচাপ শুয়ে থাকতাম।সে সময় হাতে থাকতো তিন গোয়েন্দা সিরিজের বই কিংবা ওয়েস্টার্ন কোনো উপন্যাস। এরিক মারিয়া রেমার্কের ” অল কোয়ায়েন্ট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট” উপন্যাস আমি একটা ঈদে পুরোটাই গিলে ফেলেছিলাম। রাহাত খানের বিখ্যাত কিশোর উপন্যাস ” দিলুর গল্প” রোজার ঈদের এক দুপুরে একটানে পড়ে ফেলেছিলাম। বিকেলে আবার আমরা জমায়েত হতাম মালতীনগরের চাঁনমারী ঘাটে। হালিম চাচার বিরাট পুকুর পাড়ে সারি সারি নারিকেল গাছের নিচে বসে শুরু হতো ঈদের বৈকালিক আড্ডা। পাশ দিয়ে করতোয়া নদীর সুরময় বাতাসে শরীরে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতো। বিকেলে অসংখ্য মানুষেরা করতোয়া নদীর তীরে আসতো। বিনোদনের জন্য মুক্ত বাতাসের জন্য মালতীনগরের বাসিন্দারা বিকেলটা কাটাতেন করতোয়া নদীর তীরে। আহা সেই সোনালী বিকেল। একদিকে ঈদের খুশি অন্যদিকে বৈকালিক আড্ডা মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতো। সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা। এবার টেলিভিশনের সামনে বসে অনুষ্ঠান দেখা। আহা সেইসব ঈদের স্মৃতি আমাকে তাড়িত করে ঈদ এলেই। আমি স্মৃতিকাতর হয়ে মুষড়ে পড়ি। এ জীবন এতোটাই ক্ষণিকের, দেখতে দেখতে অর্ধ শতাব্দীর পৃথিবী ভ্রমণ শেষ করে ফেললাম। কিন্তু মনে হলো এইতো সেদিন। আব্বা-আম্মার সঙ্গে সেই সোনালী ঈদ আর কখনোই পাবোনা জানি। কিন্তু স্মৃতির আয়নায় জ্বলজ্বল করে প্রতিনিয়ত। এখন পৃথিবী প্রযুক্তি নির্ভর। কতো ডিভাইস, কতো ড্রোন কতো কি কিন্তু ঈদের সেই আমেজ, সেই আনন্দ এখন আর খুঁজে পাই না। মানুষ এখন যন্ত্র নির্ভর, কৃত্রিম সম্পর্কের জালে আবদ্ধ। অথচ আমরা আমাদের সময়ে যে মায়ার জগৎ এ ছিলাম সেইখানেই আজো রয়ে গেছি। কৈশোরের সেই ঈদ আজো হাতছানি দেয় আমাকে। পেছন ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সূর্য তো হেলে পড়েছে। স্মৃতির আয়নায় এপাশ- ওপাশ করি।
১১/০৪/২০২৪, বৃহস্পতিবার, মোহাম্মদপুর, ঢাকা
ঈদ উল ফিতর