সাজ্জাদ বিপ্লব বন্ধুবরেষু
মুহম্মদ মতিউল্লাহ্
সুদূর এক আমন্ত্রণ ধ্বনি বেজে ওঠে
শিল্পের সমীপে প্রণত প্রহর থেকে থেকে
আমন্ত্রণ ধ্বনি বলছে—
অলোকরঞ্জন, আল মাহমুদ, গালিব-হাফিজ
এবং সার্বভৌম রবীন্দ্রনাথ…
আপনার অস্তিত্ব ছুঁয়ে এইসব শিল্পিত ভুবন
প্রতিদিন দ্বিতীয় প্রকৃতি হয়ে উঠল।
আমাদের মুগ্ধতা, বিস্ময়ের জাগরণ…
একটি সুসম্পাদিত বিশ্বায়ন শাদা পৃষ্ঠায় দুলে উঠল
আকাশের শামিয়ানা হয়ে
এবং বাংলা ভাষার জায়মান বর্ণমালা ভোররাত্রির
স্বপ্নের ভেতর অঙ্গুরীয় হয়ে প্রীতি বিনিময় করছে
সেখানে উজ্জ্বল ওই আপনার দীপ্ত কররেখাগুলি।
…….
সাজ্জাদ বিপ্লব ও তার কবিতা
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
সাজ্জাদ বিপ্লব নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের দ্বিতীয়ার্ধে তার আগমন। থাকেন আমেরিকায়। জিয়ো-পোয়েটিক্স, কবির বর্তমান, স্থানিকতা তার কবিতায় দুর্নিরীক্ষ্য নয়। তাতে কবিতা স্বভাবিকতায় পাঠকের অভিজ্ঞতাকে নতুনত্ব দেয়। যতোটুকু পড়েছি মনে হয়েছে, সাজ্জাদের কবিতা মৃদু সুর ও স্বরের কবিতা। একটা প্রশান্তি যেন ঘিরে রাখে ভাব ও ভাষায়। তার ভাষা বৃষ্টির পড়ার শব্দের মত খুব ধীরে আন্দোলিত হয়। তার বলার মধ্যে কোনো জোর নেই, যেন খুব সহজেই তার অন্তরের তলদেশ থেকে উঠে আসছে কবিতার থরো থরো ধ্বনি। সারাদিনের কোলাহল মুখর সময় পার করে এক টুকরো জলাশয়ের দিকে ফিরে আসা– যেখানে পাঠক জলের আয়নায় নিজের শান্ত বিম্বটুকু যেন দেখতে পায়। সাজ্জাদের এটি শক্তি, তার সিগনেচার মার্ক। স্বভাবে রোমান্টিক, কিন্তু ভাব ও চিন্তার স্বচ্ছতা তার কবিতাকে করেছে আকর্ষণীয়।
সাজ্জাদের সম্প্রতি তিনটি কবিতার বই বেরিয়েছে। আমি কারো শত্রু নই(২০১৬), দাঁড়িয়ে আছেন গীন্সবার্গ(২০২৭), আমার হাঁসগুলি কবিতা পাড়ে(২০২৩)।‘
‘আমি কারো শত্রু নই’ বইতে সাজ্জাদকে দেখা যায় নিজের অস্তিত্ব বিষয়ে নিজেকে প্রশ্ন করতে, একটা চাপা টেনশনে নিজেকে রক্তাক্ত করতে। স্বদেশ ছেড়ে নতুন দেশে সেটেল্ড হওয়ার মধ্যে যে একটা আনন্দ ও দুঃখবোধ যুগপৎ কাজ করে এইটা তার এই বইয়ের বেশির ভাগ কবিতার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। প্রথম কবিতা ‘বেঁচে আছি’ থেকে শুরু করে, জন্মদিন, লাইফ, আমি কারো শত্রু নই, ছায়া, মায়া ইত্যাদি কবিতায় তার একটা চাপা অভিমান, কষ্ট ও নিজের সাথে নিজের লড়াইয়ের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। কবিতাগুলি সরল কিন্তু গভীর সংবাদ নিয়ে যেন তার সময় ও প্রতিবেশকে জাহির করে।
দ্বিতীয় কবিতার বই ‘দাঁড়িয়ে আছেন, গীন্সবার্গ’ আমেরিকার বাঙালি কবিদেরকে উৎসর্গ করা হয়েছে। ‘নিউ ইয়র্ক’ কবিতা দিয়ে শুরু যেখানে একটা প্রাশান্তির ছাপ ও ভাষা লক্ষ্য করি। আমরা যারা বিদেশে বাস করি প্রথম শকের পর ধীরে ধীরে আমরা সেটেল্ড হই, নিজেকে ফিরে পাই। ‘দাঁড়িয়ে আছেন গীন্সবার্গ’ কবিতায় আমেরিকান কবি গীন্সবার্গের ছায়া টের পাওয়া যায়। একটা পরাবাস্তব দৃশ্য নিয়ে গীন্সবার্গ এসে হাজির হোন। সাথে সাথে বাংলাদেশের কবি শহীদ কাদরীও। এই বইতে জিয়ো পোয়েটিক্সের রঙ ও রেখায় কবিতা যেন কথা বলছে। ব্যাটারি পার্ক, এলিস আইল্যাণ্ড, তুমি কি এখন (আটলান্টার জন্য হাহাকার) ইত্যাদি কবিতায় সাজ্জাদ দেশের আয়নায় যেন বিদেশের মাটিতে প্রশান্তির গীত গাইছেন। ঘরকুনো বাঙালি কবি আজ বিশ্ব পরিব্রাজকের রঙিন চশমা চোখে সুন্দর ও কল্যাণের বন্দনা করে বেড়ান। সাথে সাথে এক টুকরো বাংলাদেশ কবির সাথে নিজকে ছড়িয়ে দেয়। ‘অন্য কবিতা’ নামক কবিতায় পাই আধুনিক কবিতার সমালোচনা। পরীক্ষা নিরীক্ষার নামে কবিতাকে বোধগম্যতার বাইরে পাঠানোর যে অভিযোগ আমরা মাঝে মাঝে শুনতে পাই তাই যেন এখানে প্রতিধ্বনিত। ‘স্বদেশ’ এই কবিতা বইয়ের একটা মর্মস্পর্শী কবিতা। ‘এক টুকরো দেশ যেনো তোমার শরীরে জড়িয়ে যার প্রতিটি পথ-ঘাট চেনা’ এই বাক্য বিদেশে বসবাসকারী সর্ব লোকের প্রাণের কথা। স্মৃতিজাগানিয়া এই কবিতা যেন এক টুকরো স্বদেশ।
‘আমার হাঁসগুলি কবিতা পাড়ে’ কবিতার বইয়ে কবিতার টোন, ভাষা পরিবর্তনের আবছা ইংগিত পাওয়া যায়। এইটা প্রকাশিত হয়েছে সাজ্জাদের বিশ্বাসী তথা ইসলামিক ঐতিহ্যের ধারায় নিজেকে দাঁড় করার কারণে। ‘যেসাস’ ‘আলোর ইশকুল’ এই দুটি কবিতায় আধুনিকতা ও ঐতিহ্য নান্দনিকভাবে ফুটে উঠেছে। আর একটা লক্ষণীয় বিষয় সাজ্জাদ এই বইতে বাঙ্গালি কবিদেরকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন । আল মাহমুদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, বিনয় মজুমদার, শামসুর রাহমান, মণীন্দ্র গুপ্ত, ভূমেন্দ্র গুহ, বেলাল চৌধুরী, মলয় রায় চৌধুরী, জীবানানন্দ দাশ ইত্যাদিকে নিয়ে তার স্বপ্ন, আশা, তার ইচ্ছার মালা গেঁথেছেন। বিষয়টা অভিনব মনে হলেও, বাংলা আধুনিক কবিতা নির্মাণে যারা অগ্রগণ্য তাদের স্মরণ যেন বাংলা কবিতাকেই লালন ও পালন। আগেই বলেছি, সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতা জটিল নয়, তিনি কবিতা ও কবিতার ভাষা নিয়ে কোনো রকমের পরীক্ষা নিরীক্ষাও করেন না, তবে তার কবিতা সহজের মধ্যে অনেক দূর দিগন্ত-পিয়াসী। ভবিষ্যতে হয়ত তিনি কবিতার সেই অদেখা, সেই মায়াবী ভূবনের আলো আঁধারির দিকে চেতনার আলো ফেলবেন– সেই দিকে তাকিয়ে।
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
২০ এপ্রিল, ২০২৪
…….
প্রখর মেধাদীপ্ত কবি সাজ্জাদ বিপ্লব
নয়ন আহমেদ
সাজ্জাদ বিপ্লব-এর আবির্ভার নব্বই-এর দশকে। প্রখর মেধাদীপ্ত এ কবি বাংলা সাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছেন ইতোমধ্যেই। সূচনালগ্নে সম্পাদনা করেছেন সাহিত্যের ছোটোকাগজ “স্বল্পদৈর্ঘ্য”। এই কাগজটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একদল সাহসী কবি, তারা সাহিত্যে তৈরি করেছেন নিজস্ব বোধ ও ব্যাপ্তির জগৎ। এ কাগজটিকে নব্বই দশকের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য করা হয়।নব্বই দশকের কবিদের নিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য সংকলনও করেছেন তিনি। এটি বহুল সমাদৃত হয়েছে। “নব্বইযের কবিতা : অন্য আকাশ ”– নামের এই কবিতা সংকলনটি তার সুচারু সম্পাদনার পরিচয় বহন করছে। বর্তমানে তিনি উত্তর আমেরিকায় বসবাস করছেন। তার সাথে আছে তার বাংলাদেশ, আবহমান সংস্কৃতি আর কবিতা। “বাংলারিভিউ ” https://banglareview.blog নামে অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করছেন সেখানে বসেই। বাংলাভাষা ও সাহিত্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে নিরন্তর সাধনা করে যাচ্ছেন তিনি।
কবিতার একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে এ যাবৎ ৪টি বই প্রকাশ পেয়েছে তার। লিখে চলেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক সহ অন্যান্য অনলাইন পত্রিকা ও প্রিন্টিং মিডিয়ায়। তার ২০১৬-এ প্রকাশিত কবিতার বই “ তুমি ছাড়া আমার কোনো বসন্ত নেই”। এই গ্রন্থের উপজীব্য প্রেম। কিন্তু তা বহুরৈখিক ভাবনার অধীশ্বরা। দৃশ্যমান ভাবের বর্ণমালা তার কবিতা। যাপিত জীবনের নির্যাস তার কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছে। গ্রন্থটিতে ২৬টি কবিতা রয়েছে। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩২। কবিতাগুলোর শিরোনাম নেই। আমার অভিমত– শিরোনাম থাকলে বিষয় ও ভাবনার পূর্ণাঙ্গতা পেতো। এটি কাব্যরীতি-–একটি পরিচ্ছন্ন শিল্পিত রূপের স্মারক।
কবিতা মূলত আত্মচরিত, আত্মনির্মিতি এবং তারই মধ্য দিয়ে বিশ্ববোধের দর্শন মেলে। “আমি”– এর রূপকে এই বোধ নির্মিত হয়। ব্যক্তি আমি-ই তখন বিশ্বজগতের অস্তিত্বের প্রতিরূপে প্রকাশ পায়। ব্যক্তির মধ্যেই জীবনের সব সম্ভাবনা ফুটে ওঠে– ব্যক্তি ছাড়া বিশ্ব অর্থহীন। সাজ্জাদ বিপ্লব বলেন–
“আমাকে হারালে থাকে না কিছুই
না স্বপ্ন না চিত্রকল্প
থাকে না পৃথিবীর প্রাচীন মুদ্রা
থাকবে না কোন প্রত্ন পাথর
কালো অক্ষর
অদৃশ্য
দৃশ্যমান সব ভাবের বর্ণমালা
চিত্রকলা
এমন কি
তোমারও ছলাকলা”
প্রেমের কবিতাগুলোতে সাজ্জাদ বিপ্লব পরিচিত দৃশ্যপট থেকে শব্দ চয়ন করে একটা সম্পূর্ণতা দেবার চেষ্টা করেছেন। নর-নারীর সম্পর্ক চিরকালের-দাম্পত্য সম্পর্কের ভিত্তিই হলো বিশ্বাস, পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ততা। সেটা হারালে জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, অর্থহীনতায় পর্যবসিত হয়। তার ভাষাচিত্র অঙ্কণ করেছেন এভাবে–
“সেই বিশ্বাসই যদি এখন
হারিয়ে যায় পৃথিবী থেকে
কি আর থাকবে, বলো?
আমরা হারাবো অপরিসীম
আনন্দ, ভালোবাসা, আদব-লেহাজ,
সন্তান- সন্তুতি
সম্পর্ক, আলো, আশা, রঙ ও জীবন”।
হৃদয়ের পরিচর্যা করলেই হৃদয় পাওয়া যায়, পৃথিবী শান্তিময় হয়ে ওঠে। সে শান্তি শুরু হয় গার্হস্থ্য জীবন থেকে, আর ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর সর্বত্র। কবি গৃহগত জীবনের প্রতি আসক্তি ও অনুরাগ প্রকাশ করেছেন। প্রেয়সীর প্রতি মমত্বের বন্ধন নির্মাণ করেছেন। এ হলো চিরন্তন প্রীতি ও শুভ্রবোধ। কবি একেই মান্য করেছেন কবিতায়। তার জন্য একটি সহজ অথচ হৃদয়জ অনবদ্য ভাষা ব্যবহার করেছেন। একটু নমুনা দেই–
“সবুজ ঢেড়সের মতো
তাজা ও সতেজ
এই হৃদয়
মোটেও সহজলভ্য নয়
পাবে না দোকানে
রাস্তার মোড়ে
কিম্বা বিলাসবহুল ভিলায়”।
…..…
“তুমি বলতে ফ্রিজের কথা
সুসজ্জিত কিচেনে
এই একটিমাত্র যায়গা
যেখানে তুমি রান্না করে
আবার রান্না না করেও গুছিয়ে
রাখতে তোমার উপকরণ ও ব্যঞ্জণ…
…কিন্তু, আমি যে তোমাতে পাগল”।
সাজ্জাদ বিপ্লব তার পাঠককে নিয়ে যান প্রাত্যহিকতার অভ্যাস ও অভ্যস্ততায়। জীবনকে তিনি সহজ ও স্বাভাবিকরূপে পেতে চান। তার কবিতা এই স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ-বিজ্ঞানে পূর্ণ। কোমল ও মধুর, গীতল ও প্রাণস্পর্শী তার ভাষা–এ যেন এক নিবিড় প্রার্থনা। এখানেই সাজ্জাদ-এর ব্যক্তিভাষা তৈরি হয়েছে। তার কাব্যভাষা ব্যতিক্রমী–আলাদা। তিনি স্বাক্ষর রেখে চলেছেন প্রেমের মধ্য দিয়ে স্বস্তি ও আস্থার পৃথিবী নির্মাণে–একটি মানবিক জগৎ সৃষ্টির উল্লাসে। একটি পূর্ণাঙ্গ কবিতা দিয়ে এই আলোচনা ইতি টানছি–
“রুয়ে দিলাম
আমার ভালোবাসা
তোমার জমিনে
পত্র-পুষ্প-পল্লবে
ভরে যাক
এ রঙিন গ্রহ
দ্রোহ থেকে প্রেমে
আমাদের জীবন-যৌবন
ওঠে যেনো ঘেমে”।
–এই কবিতাটি আমাদের জীবনের পূর্ণতার কথা বলে। সাজ্জাদ বিপ্লব-এই ভাষারই নির্মাতা, জীবনশিল্পী।
………
রচনাকাল : ২০১৬
শুভ জন্মদিন, প্রিয় কবি।
বাংলাভাষা ও সাহিত্যে আপনার অবদান অক্ষয় হোক।
আমাদের বন্ধুত্ব অটুট থাকুক।
আমিন।