কাজী জহিরুল ইসলাম
সাজ্জাদ বিপ্লব নব্বুইয়ের দশকের কবি। এই দশকের কবিদের নিয়ে আলোচনা করা খুব জটিল ও বিপদজনক। কারণ এই দশকের কবিরা বহু বিচিত্রগামী, তাদের সমষ্টিগত একটি চরিত্র এখনো স্থির হয়নি। তবে, এই যে বহু বিচিত্রগামী, এটিও একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই দশকের নাটকে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং কবিতায় ব্রাত্য রাইসু নতুন একটি বাংলা ভাষা তৈরি করার চেষ্টা করলেন। তারা শত বছরের প্রমিত বাংলাকে ঝেটিয়ে বিদায় করে মানুষের অনানুষ্ঠানিক কথোপকথনের ভাষাকে সাহিত্যে প্রতিস্থাপনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। নতুনত্বের একটা ঘ্রাণ আছে, সেই ঘ্রাণে তরুণেরা কিছুকাল মাতাল ছিলেন বৈ কি কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ধারায় সাহিত্য করতে একটি বৃহৎ গোষ্ঠী এগিয়ে আসেননি। আসলে নাটকে এবং কথাসাহিত্যে নতুন এই ভাষা কিছুটা মাটি পেলেও কবিতায় তা মোটেও দাঁড়াতে পারেনি।
রবীন্দ্র বলয় থেকে বেরিয়ে এসে ত্রিশের দশকের কবিরা যে নতুন কাব্যভাষা তৈরি করেছিলেন সেই ধারাতেই এগুচ্ছিল বাংলা কবিতা, এই প্রথম নব্বুইয়ের দশকের কবিরা, এই প্রমিত ভাষা মানি না, এখন উত্তরাধুনিক কবিতা লিখতে হবে, ইত্যাদি কথা বলতে শুরু করেন।
তারা বুঝে কিংবা না বুঝে উত্তরাধুনিক কবিতার ধারণাকে কাব্যবোদ্ধাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন। আধুনিকতাকে চ্যলেঞ্জ করাই আসলে উত্তরাধুনিকতা। বাংলা কবিতার আধুনিকতা মানেই হচ্ছে ইউরোপীয় ধারার কবিতা, কলোনিয়াল শব্দ ও চিন্তার প্রভাব, কাজেই এই প্রভাব মুছে ফেলার নামই হয়ে উঠলো উত্তরাধুনিকতা।
এইসব ডামাডোলের ভেতরে সাজ্জাদ বিপ্লব কোথায়? সাজ্জাদ যে খুব সচেতনভাবে কিংবা স্বভাবসুলভ দক্ষতায় এই স্রোত থেকে দূরে সরে থেকেছেন বা থাকতে পেরেছেন আমার তা মনে হয় না। এই ঢেউ তাকেও নাড়া দিয়েছে। কবিতার মেরুদণ্ড যে ছন্দ তাকে উপেক্ষা করার একটা প্রবণতা সাজ্জাদের কবিতায় দেখা যায়, এই উপেক্ষাটা এমন যে, আমি শিখবো না কিংবা মানবো না এইসব প্রচলিত প্রকরণ। সাজ্জাদের কবিতায় অক্ষরবৃত্তের বিন্যাস গড়ে উঠতে উঠতেই ভেঙে পড়ে। এইসব দেখে মনে হয় তিনি ছন্দের বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত।
সাধারণত ছন্দের ব্যাপারে যারা উদাসীন আমি সেইসব কবিদের কবিতা নিয়ে আলোচনায় অনাগ্রহ প্রকাশ করি কিন্তু সাজ্জাদের কবিতার প্রতি আমার একটা তীব্র আগ্রহ এবং আকর্ষণ আছে। এই যে আমাকে তিনি টানতে পেরেছেন এটিই হচ্ছে নব্বুইয়ের দশকের একটি বড়ো সাফল্য এবং এই সাফল্য সাজ্জাদ বিপ্লবের মতো হাতে গোনা কয়েকজন কবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
সাজ্জাদের কবিতার দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য আমি শনাক্ত করেছি, একটি হচ্ছে গতি, কবিতা যত বড়োই হোক, এই গতি পাঠককে ধরে রাখে এবং শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। তিনি অনুপ্রাস প্রয়োগে বেশ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। অন্ত-আদি অনুপ্রাস নির্মাণের এমন দক্ষতা বাংলা ভাষার কবিদের মধ্যে অল্প কয়েকজনই দেখাতে পেরেছেন। এই ধরণের অনুপ্রাস কবিতাকে গতিশীল করে তোলে। অন্য বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে স্বতস্ফুর্ততা। তার কবিতায় আরোপিত কোনো বিষয় বা ভাবনা নেই, এমনকি কবিতাটিকে প্রায়শই অপরিকল্পিত মনে হয়। যেন লিখতে লিখতে যেদিকে যেতে চেয়েছে কবিতা তিনি কোনো ধরণের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করে কবিতাকে ঠিক সেদিকেই যেতে দিয়েছেন। এর ভালো মন্দ দুটো দিকই আছে। আমি মনে করি কোনো কোনো কবির এমনই হওয়া উচিত, এই পরিকল্পনাহীন স্বতঃস্ফূর্ত পরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে হয়ত বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিতাটি বেরিয়ে আসতে পারে, যখন আমরা বিশ্বাস করি, কবিতা মূলত চর্চায় তৈরি হয় না, এর জন্ম অলৌকিকতায়, অপার্থিব কোনো ভূবনে, স্বতঃস্ফূর্ততায় তা প্রতীয়মান হয়।
সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতায় আমি প্রায়শই ধর্মের উপস্থিতি দেখি, আস্তিক্যবাদ বা বিশ্বাসের উপস্থিতি দেখি। ধর্ম বিশ্বাস মানুষকে প্রশান্তি দেয়, কবিকেও দেয় এবং এর প্রতিফলন তার কবিতায় পড়তেও পারে। কিন্তু কবি যেন তার অন্তরের স্বাভাবিক কৌতুহল দূরে ঠেলে দিয়ে ধর্মহীনতাকে প্রতিপক্ষ মনে না করেন এবং কবিতায় ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে না ওঠেন। কবি সর্বৈব স্বাধীন, তিনি যদি ধর্মের ছবি আঁকেন তা আঁকবেন একান্তই নিজস্ব তুলি দিয়ে বোধের ক্যানভাসে, মৌলিক রঙে।
আজ কবি সাজ্জাদ বিপ্লবের জন্মদিন। আমি জন্মদিনে তাকে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি একটি পরামর্শ দিতে চাই তা হচ্ছে আদি বাংলা কবিতার ছন্দ হচ্ছে মাত্রাবৃত্ত, তিনি যেন অল্প কিছু হলেও শুদ্ধ মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতা লেখেন। তার কবিতার যে বৈশিষ্ট্য আমি শনাক্ত করেছি সেগুলো মাত্রাবৃত্তে আরো বেশি প্রাণ পাবে।
সাজ্জাদ বিপ্লব একজন দক্ষ এবং পরিশ্রমী লিটল ম্যাগ সম্পাদক। বাংলা ভাষায় হাজার হাজার কবি এসেছেন, আসবেন কিন্তু ভালো সাহিত্য সম্পাদক খুব বেশি আসেননি। আমি সাজ্জাদ বিপ্লবকে একজন ভালো সাহিত্য সম্পাদক মনে করি।
শেষ করবার আগে তার একটি কবিতা এখানে তুলে দিচ্ছি, আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে।
মানুষ
…..
এসো, নির্ধারণ করি মানুষের সংজ্ঞা
মনুষ্যত্বের ধারণা ও ধরণ কি কি এবং কত প্রকার হতে পারে
এ নিয়ে আয়োজন করি–
সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-তর্ক-বিতর্ক
কু-তর্কের কথাও কেউ-কেউ
উচ্চারণ করতে পারে, বলতে পারে সুন্দরের কথা, ধর্মের কথা
অধর্মের কথাও বলতে পারেন, সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত নব্য ধার্মিকগণ
ব্লগে-ব্লগে মুক্তচিন্তার নামে ও মোড়কে ধর্মবিদ্বেষের বিষাক্ত ভাইরাস ছড়াতে পারে কোন-কোন শাহবাগী তরুণ
সানিলিওনের মতো ভার্জিনিটি ও নিষ্পাপ দাবী করতে পারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও শাসনযন্ত্র
তবু, আমরা মানুষের শেষ চেহারা দেখতে দাঁড়িয়ে থাকবো নায়াগ্রায়।
৫.৪.১৬
আটলান্টা, জর্জিয়া।
Very good job. Congratulations