আবু তাহের সরফরাজ
[কথাচ্ছলে কথা : বাংলা গদ্যসাহিত্য তখন হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলতে শুরু করেছে। দুজন কীর্তিমান পুরুষ লেখনির মাধ্যমে এই যাত্রাকে গন্তব্যের পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন। একজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, আরেকজন অক্ষয়কুমার দত্ত। গদ্যসাহিত্য দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র সাধারণ মানুষের ভেতর রুচি তৈরি করতে চেয়েছিলেন। আর অক্ষয়কুমার লেখালেখি করেছেন বিজ্ঞান ও দর্শনকে সাধারণ মানুষের বোঝার উপযোগী করে তুলতে। মানুষের চিন্তার জগৎকে সমৃদ্ধ করতে অক্ষরকুমার দত্ত কলম চালিয়েছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। খ্যাতির মোহ নয়, সৃষ্টির আনন্দই ছিল তার প্রেরণা।
বাংলা গদ্যসাহিত্যের শিশুবেলায় আরও অনেক লেখক ছিলেন, কিন্তু এই দুজনের মতো কীর্তির স্বাক্ষর আর কেউ তেমনভাবে রেখে যেতে পারেননি। এ কারণে আজকের সময়ে এসে তারা বিস্মৃত হয়ে গেছেন। দুঃখের কথা, তাদের সঙ্গে অক্ষয়কুমার দত্তও এখন বিস্মৃতির গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছেন। তার নাম সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, সাহিত্যের পাঠকও সেইভাবে জানেন না। অথচ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সাধারণ মানুষের ভেতর বেশ পরিচিত।
অক্ষয়কুমার দত্তকে জানা মানে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান ও দর্শনের যাত্রাকে জেনে নেয়া। তার জীবনী লিখেছেন অনেক লেখক। কিন্তু সেসব এখন আর খুঁজে পাওয় যায় না। কীর্তিমান এই মানুষটাকে আজকের প্রজন্মের কাছে পরিচিত করে তুলতে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। তার সম্পর্কে যেখানে যে তথ্য পেয়েছি, সেসব তথ্যের ওপর ভাষাচিত্র বসিয়ে কাহিনিতে রূপদান করেছি। এখানে অক্ষয়কুমার দত্ত একজন চরিত্র। কিছুটা কল্পনা আর কিছুটা তথ্যচিত্রের আভাসে আমি সেই চরিত্র আঁকতে চেষ্টা করেছি। এতে যে অক্ষয়কুমারকে পাওয়া যাবে তার সাথে রক্তমাংসের অক্ষয়কুমারের পুরোপুরি মিল রয়েছে।–আবু তাহের সরফরাজ]
১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুলাই। শনিবার। শুক্লপক্ষ পঞ্চমী তিথি। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার নবদ্বীপের চুপী গ্রাম। খিদিরপুরের টলিজ নলার কুতঘাটের কশিয়ার ও দারোগা পীতম্বর দত্তর বাড়ি। বাড়ির পেছনদিকে বাঁশবাগানের মাথার ওপর ঝকঝক করছে গোলগাল চাঁদ। ফিনফিনে জ্যোছনায় চারদিক আলোকিত। গভীর রাত। রাতের সুনসান নীরবতা ভেঙে হঠাৎ কেঁদে উঠল একটি নবজাতক।
ধাত্রী সুখেনের মা তুলতুলে শিশুটিকে ত্যানায় পেঁচিয়ে রেখে দিল দয়াময়ী দেবীর বুকের পাশে। এরপর দরজা খুলে বেরিয়ে এলো বাইরে। উঠোনে লেবু গাছটার নিচে বসে বসে ছটফট করছিলেন পীতম্বর দত্ত।
বাবু বাবু, আপনার ছেলে হয়িছে। এক্কেবারে ওই চান্দের গায়ের রঙ। এই বলে একগাল হাসি দিল সুখেনের মা। পীতম্বর পকেট থেকে বের করে বেশ কিছু বকশিস তার হাতে তুলে দিলেন। এরপর ছুটে গেলেন ভেতর ঘরের দিকে।
এই ছুটে চলা দেখে কে বলবে, তিনি দারোগা! বরং, পোশাকের ভেতরের মানুষটা একটা শিশু। মানুষের উপকার করতে পারলে তার খুব ভালো লাগত। সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন। লোকজনও তাকে পছন্দ করতো। তার পূর্বপুরুষ দূর্গাদাস দত্ত বসবাস করতেন টাকির কাছাকাছি গন্ধর্বপুরে। দূর্গাদাসের পুত্র শিবরাম। তার পুত্র রাজবল্লভ ও রমাবল্লভ। রাজবল্লভ বর্ধমান রাজবাড়ির কর্মচারী ছিলেন। তিনি গন্ধর্বপুর ছেড়ে চুপীতে এসে বসবাস করতে শুরু করেন। তার ছিল চার পুত্র। রামলাল, কৃষ্ণরাম, রাধাকান্ত ও রামশরণ। রামশরণের পাঁচ পুত্র। এরা হলেন: পদ্মলোচন, কাশীনাথ, চূড়ামণি, পীতম্বর ও কীর্তিচন্দ্র।
পীতম্বর দত্ত আর দয়াময়ী দেবী পুত্রের নাম রাখলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। দয়াময়ী দেবীর বাবার বাড়ি কৃষ্ণনগরের কাছাকাছি ইটলে গ্রামে। তার পিতার নাম রামদুলাল গুহ। তিনি এসে দেখে গেলেন আদরের নাতিকে। অক্ষর যেন বাবা-মায়ের চোখের মনি। সবসময় কোলে-কাঁখে। এভাবেই বড় হতে লাগল অক্ষয়। ভারি শান্ত, সুবোধ একটা ছেলে। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল পাঁচ বছর। বয়স হয়ে গেল। একরাতে অক্ষয়কে বুকের ওপর নাচাচ্ছিলেন পীতম্বর। আর ইতিউতি কত যে কথা! অক্ষয়ের কচি মুখে ফুটছে কত যে বুলি! সেসব বুলির বেশিরভাগেরই নেই মাথামুণ্ডু। পীতম্বর বললেন, শুনছ বউ, খোকাকে তো এবার অক্ষর চেনানো শুরু করা দরকার। দেখেছো, কী রকম বুলি এখন বলতে পারে।
দয়াময়ী বললেন, আমিও তাই ভাবছিলাম গো। তুমি তো আর সময় পাও না। আমি না হয় অক্ষরটা চিনিয়ে দেব। কিন্তু আমি ভাবছি, পাকাপাকিভাবে একজন মাস্টার বাড়িতে রাখা যায় কিনা।
পীতম্বর বললেন, তাহলে তো খুব ভালো হয়। মাস্টার আমাদের বাড়িতেই থাকলেন। আর খোকাকে পড়ালেন। ঠিকাছে, কাল দেখি কী করা যায়। একটু খোঁজ-খবর করতে হবে।
খোঁজ-খবর করে পীতম্বর তিন দিন পর বাড়িতে নিয়ে এলেন গুরুচরণ সরকারকে। ভারি সাদাসিদে লোক এই গুরুচরণ। ছাত্রের গায়ে বেত মারা তো দূরের কথা, কখনো বকাঝকাও করতেন না। সুন্দরভাবে পড়া বুঝিয়ে দিতেন। না বুঝলে বারবার বুঝিয়ে দিতেন।
দিন কেটে যেতে লাগল। বাবা-মায়ের উদার স্নেহ আর মাস্টারের উদার শিক্ষা গেঁথে যেতে লাগল বালক অক্ষয়ের হৃদয়পটে। ভবিষ্যৎ জীবনে তার চরিত্রের এই দিকটি বিশেষভাবে ফুটে ওঠে।
গৃহশিক্ষকের কাছে বালক অক্ষয়ের প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হলো। কিন্তু এরপর? কোথায় পড়াবেন ছেলেকে? ভাবনায় পড়লেন পীতম্বর দত্ত। বর্তমানে আমরা যে রকম ইংরেজি ভাষা শেখায় বিশেষ গুরুত্ব দিই, তখনকার সময়ে ফারসি ভাষা শেখায় সে রকম গুরুত্ব দেয়া হতো। অভিজাত পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের ফারসি ভাষায় বিশেষভাবে দক্ষ করে তুলতেন। এর কারণ হচ্ছে, সে সময় ফারসি ভাষায় সব রকমের রাজকার্য পরিচালিত হতো। বিচারালয়েও ফারসি ভাষা ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে ইংরেজি জানা না থাকলে যেরকম চাকরি পাওয়া মুশকিল হয়ে ওঠে, সেরকম তখনকার দিনে ফারসি জানা না থাকলে কোথাও তেমন সুবিধে হতো না। অক্ষয়কে ফারসি ভাষায় দক্ষ করে তুলতে পারেন এরকম একজন শিক্ষক খুঁজে বের করলেন পীতম্বর। ভদ্রলোকের নাম মুনশি আমিরউদ্দিন। তিনি রোজ একবেলা বাড়িতে এসে অক্ষয়কে ফারসি ভাষা শেখাতে লাগলেন। ফারসি ভাষাটা আমিরউদ্দিনের বেশ দখলে ছিল। লেখাপড়ায় বিশেষ আগ্রহ দেখে তিনি ছাত্র অক্ষয়কে তার ফারসির ভাণ্ডার ঢেলে দিলেন। আর অক্ষয়ও মনোযোগ দিয়ে ওস্তাদের কাছ থেকে ফারসি শিখতে লাগল। ওস্তাদ যে পড়া দিয়ে যেতেন, বাড়িতে একা একা বসে অক্ষয় তা চর্চা করতো।
মাঝে মাঝে পীতরম্বর এসে মুনশির কাছে ছেলের লেখাপড়ার খোঁজ-খবর করতেন। দাড়ির ভেতর আঙুল চালিয়ে মুনশি জবাব দিতেন, সে আপনি ভাববেন না বাবু। ছেলে আপনার একখান রত্ন। অনেক ছেলেকেই তো ফারসি পড়াই। কিন্তু এতটা মনোযোগ আর কারো ভেতর আমি দেখিনি। শুধু মনোযোগই বা বলছি কেন! খুব সহজেই অক্ষয় পড়া বুঝে যায়। এমন খোলা মাথা এই শিক্ষকতার জীবনে খুব একটা চোখে আমার পড়েনি।
মুনশির কথা শুনে বেজায় খুশি হন পীতম্বর। কিন্তু এত অল্পতে খুশি হয়ে ছেড়ে দিলে তো চলবে না। অক্ষয়কে যে সংস্কৃত ভাষাটাও শিখিয়ে-পড়িয়ে দিতে হবে। সংস্কৃত হচ্ছে দেবভাষা। এ ভাষা জানা না থাকলে হিন্দু শাস্ত্রের মর্ম সে কিভাবে উদ্ধার করবে? কিন্তু কোথায় শেখাবেন সংস্কৃত? খবর পেলেন, গোপিনাথ ভট্টাচার্য তর্কালঙ্কার টোল খুলেছেন। সেখানে তিনি ছাত্রদের সংস্কৃত শেখান। টোল হচ্ছে পাঠশালা। যেখানে সংস্কৃত ব্যাকরণ ও সংস্কৃত ভাষায় লেখা বইপত্র পড়ানো হয়। পীতম্বর দত্ত একদিন সেই টোলে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তর্কালঙ্কারকে বললেন ছেলের কথা। শুনে তর্কালঙ্কার বললেন, সে আর এমন কি! এখানে কত ছাত্রকেই তো আমি সংস্কৃত শেখাচ্ছি। আপনার ছেলেও না হয় এদের সঙ্গে সংস্কৃত শিখবে। নিয়ে আসুন তাকে। আমি ভর্তি করে নেব।
টোল থেকে ফিরে বাড়িতেই ঢুকতেই তিনি অক্ষয়ের পড়ার শব্দ শুনতে পেলেন। কী একটা ফারসি কবিতা সে সুর করে পড়ছে। আনন্দে বুকটা ভরে উঠল পীতম্বরের। মনে মনে ভগবানের কাছে তিনি অক্ষয়ের জন্য প্রার্থনা করলেন। এই ছেলেটাকে নিয়ে তার যে অনেক আশা।
রাত্রে দয়াময়ী দেবীর সাথে অক্ষয়ের টোলে ভর্তির বিষয়ে তিনি আলাপ করলেন। দয়াময়ী বললেন, সে তো ভালো কথা। ছেলে ফারসি শিখছে। এবার না হয় সংস্কৃতটা শিখে ফেলুক। আর লেখাপড়ায় তো আমাদের অক্ষয় খুবই ভালো। সহজে পড়াও বুঝে যায়। কিন্তু গোপিনাথ তর্কালঙ্কারের টোল তো বেশ কিছুটা দূরে। আমার অতটুকু ছেলে, একা একা কি পারবে যেতে?
এই হলো জ্বালা! স্ত্রীর কথা শুনে পীতম্বর একটু বিরক্ত হলেন। বললেন, অতটুক আর কোথায় দেখছ তুমি। এই তো সাত বছরে পড়ল আমাদের খোকা। নিজের ভালো-মন্দ সে এখন বুঝতে পারে। ও ঠিকই পারবে টোলে একা একা যেতে-আসতে। ওসব তুমি ভেবো না।
পর দিন অক্ষয়কে সঙ্গে নিয়ে পীতম্বর চললেন তর্কালঙ্কারের টোলে। অক্ষয় ভর্তি হয়ে গেল সেখানে। শুরু হলো তার সংস্কৃত ভাষা শেখা। অল্প কয়েক দিনেই তর্কালঙ্কার বুঝে গেলেন, আর দশটা ছেলের মতো নয় নতুন এই ছেলেটি। অল্পতেই সে পড়া বুঝে যায়। বারবার বুঝিয়ে বলতে হয় না। খুশি হলেন তর্কালঙ্কার। মেধাবী এই ছাত্রের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতেন তিনি।
মুনশি আমিরউদ্দিন একদিন পীতম্বরকে বললেন, অক্ষয়ের ফারসি ভাষা শেখার পাট মোটামুটি শেষ। আমার কাছে ফারসির যে ভাণ্ডার ছিল, সবটা উজার করে দিয়েছি অক্ষয়কে। ওকে আর কিছু আমার দেয়ার নেই।
বিদায় নিলেন মুনশি। যাবার সময় অক্ষয়ের মাথায় হাত রেখে তিনি দোয়া করলেন। পীতম্বরকে বললেন, ছেলেটাকে দেখে রাখবেন বাবু। এ ছেলের তুখোড় মেধা। বড় হলে নিশ্চয়ই বেশ নাম করবে।
দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল একটি বছর। একদিন টোল থেকে বাড়িতে ফিরে অক্ষয় দেখল, মোহনদা এসেছেন। ভারি খুশি হলো অক্ষয়। কাশিনাথ জ্যাঠার ছেলে মোহনদা। জ্যাঠা মারা যাবার পর মোহনদাকে বাবা তাদের বাড়িতে নিয়ে আসেন। এরপর লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেন। এসব অবশ্য অনেক আগের কথা। অক্ষয় যখন খুব ছোট, মোহনদা তখন চাকরি পেয়ে তাদের বাড়ি ছেড়ে যান। সে সময়ের কথা খুব আবছাভাবে মনে আছে অক্ষয়ের। মোহনদা এখন খিদিরপুরে থাকেন। তিনি এখন সুপ্রিম কোর্টের মাস্টার অফিসের বড়বাবু। অনেক দিন পর বেড়াতে এলেন মোহনদা।
অক্ষয়কে দেখতে পেয়েই তিনি বলে উঠলেন, সে কী রে অক্ষয়, তুই তো বেশ বড় হয়ে গেছিস রে! টোল থেকে ফিরলি বুঝি? আয় তো দেখি, এদিকে আয়।
খাটের ওপর পা তুলে বসে আছেন মোহনদা। পাশে বাবা। অক্ষয় এগিয়ে গেলে তার মাথার চুলে আঙুল চালিয়ে মোহনদা বললেন, আমাদের অক্ষয় তাহলে এখন সংস্কৃত শেখে! এ তো সুখের কথা। জেঠুর কাছে শুনলাম, তুই নাকি ফারসি ভাষাও শিখে ফেলেছিস? আামকে শেখ সাদির কবিতা শোনাবি?
অক্ষয় মাথা নাড়ল। বলল, তুমি কি আজ থাকবে মোহনদা?
হ্যাঁ রে। কতদিন পর এলাম, বল তো? অন্তত একটা দিন না থেকে ক্যামনে যাই! তোদের জন্য কি আমার মন পোড়ে না ভেবেছিস?
বাবা বললেন, তা তুই ছুটিছাটায় এলেই তো পারিস মোহন। তোর জেঠিমা তো তোর কথা খুব বলে।
অক্ষয়কে ছেড়ে মোহনদা বললেন, সে কী আর ইচ্ছে করে না জেঠু। জেঠিমা যে আমার নিজেরই মা। আমি আর অক্ষয় কি তার কাছে আলাদা কেউ? কিন্তু কী করব বলো? কোর্ট-কাছারির কাজ, চাইলেও সময় করে উঠতে পারি না। কোর্টের বন্ধের দিনেও কাগজপত্রে ডুবে থাকতে হয়। সে বেজায় ঝক্কির চাকরি!
দয়াময়ী দেবী এলেন। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বললেন, হ্যাঁ রে মোহন, শুধু কথাই কি বলবি? চানটান করে নে বাছা। কূয়োপাড়ে জল তুলে রেখেছি। যা তো অক্ষয়, তোর দাদাকে একখানা গামছা এনে দে।
বিকেলবেলা মোহনদার সঙ্গে হাঁটতে বের হলো অক্ষয়। হাঁটতে হাঁটতে তিনি জিগেশ করলেন, হ্যাঁ রে অক্ষয়, সংস্কৃত ক্যামন শিখছিস রে?
অক্ষয় ঘাড় নাড়ল, তা তো শিখছিই। পণ্ডিত মশাই বেশ যত্ন নিয়ে পড়ান। জানো মোহনদা, এখন আমি সংস্কৃত ব্যাকরণের খুঁটিনাটি সব জানি। কালীদাশের শকুন্তলা পড়তে পারি। পড়েছ তুমি ওটা?
আমি তো সংস্কৃত শিখিনি রে বোকা। ক্যামনে পড়ব! আচ্ছা যা, তুই যখন শিখেছিস তাহলে আমার আর শেখায় কাজ নেই। তুই বরং আমাকে শকুন্তলা থেকে পড়ে শোনাস। কিরে, শোনাবি তো?
তা তো শোনাবো। কিন্তু তুমি তো কাল সকালেই খিদিরপুর চলে যাবে। শোনাবো আর কখন?
কেন, খিদিরপুর গিয়ে শোনাবি। তুইও তো আমার সঙ্গে খিদিরপুর যাচ্ছিস।
অবাক হলো অক্ষয়। আমিও যাব তোমার সঙ্গে? কী করব ওখানে গিয়ে? বাবাকে বলেছ?
হ্যাঁ, জেঠুর সঙ্গে সে আলাপ আমি করে রেখেছি। এখানে লেখাপড়া যা শেখার ছিল তা তোর প্রায় শেষ। তোকে এবার ইংরেজি ভাষাটা শিখতে হবে। জানিস তো, এটা ইংরেজদের রাজত্ব। সামনের দিনগুলোয় ইংরেজি ভাষা না জানলে তুই বড় কিছু হতে পারবি না। তোকে নিয়ে জেঠুর অনেক আশা। তাই তোকে খিদিরপুর নিয়ে গিয়ে ইংরেজি শেখাবো। যাবি না আমার সঙ্গে?
কথা বলে না অক্ষয়। কী রকম যেন লাগে তার। বাবা-মাকে ছেড়ে সেই খিদিরপুর গিয়ে তাকে এখন থেকে থাকতে হবে! একটু মন খারাপ হয়ে গেল।
তার ভাবখানা যেন বুঝলেন মোহনদা। পিঠে হাত দিয়ে বললেন, ভাবিস না অক্ষয়। মাসে মাসে বাড়িতে এসে দু’দিন বেড়িয়ে যাবি। সারা জীবন ঘরে বসে থাকলে কি কারও চলে? কত বড় এই পৃথিবী। এই জগৎটাকে যে জানতে হবে। আর তার জন্য লেখাপড়া করতে হবে। বইয়ের পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে জ্ঞান। সেই জ্ঞান তোকে অর্জন করতে হবে। তুই ফারসি শিখেছিস, সংস্কৃত শিখেছিস। এবার ইংরেজিটা শিখে নিতে পারলে তোর চলার পথটা যে সহজ হবে খোকা। অত ভাবাভাবির কিছু নেই। থাকবি তো আমার কাছে। আমি কি তোকে কম ভালোবাসি?
কথা বলতে বলতে তারা নদীর পাড়ে গিয়ে পৌঁছল। নদীর ওপর মস্ত থালার মতো গোলগাল টকটকে লাল সূর্য ঝুলে রয়েছে। রক্তের মতো সেই লাল আভা নদীর পানিতে যেন কেউ গুলিয়ে দিয়েছে। পানির ওপর দিয়ে কয়েকটা বক উড়ছে। কখনো ঠোকড় দিচ্ছে পানিতে। দূরে একটা স্টিমার চোখে পড়ে।
ঘাসের ওপর বসতে বসতে মোহনদা বললেন, আয়, এখানে একটু বসি। কী সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে দেখেছিস!
অক্ষয় বসলো। মোহনদা তাকে খিদিরপুরের গল্প শোনালেন। কী কী আছে সেখানে, সেসব কথা। কোর্টে তাকে কী কী কাজ করতে হয়, সেসব কথাও দু’চারটে শুনিয়ে দিলেন।
সন্ধের মুখে তারা বাড়ি ফিরল। পীতম্বর বারান্দায় বসে হুঁকো টানছিলেন। সামনে টিমটিমে আলো ছড়িয়ে হারিকেন জ্বলছে। কুয়োতলা থেকে হাতমুখ ধুয়ে মোহন এসে বসলো জ্যাঠার কাছে। অক্ষয় গেল মায়ের কাছে। দয়াময়ী দেবী রান্নাঘরে ছিলেন। পাঁঠার মাংস রাঁধছিলেন। ছেলেকে দেখে জিগেশ করলেন, মোহন কোথায় রে?
অক্ষয় জবাব দিল, বাবার সঙ্গে বসে গল্প করছে।
কোথায় কোথায় ঘুরে এলি তোরা?
নদীর পাড়ে গেছিলাম। আচ্ছা মা, কাল সকালে মোহনদার সঙ্গে নাকি আমি খিদিরপুর যাচ্ছি?
খুন্তি নাড়তে নাড়তে দয়াময়ী বললেন, কেন, তোর যেতে ইচ্ছে করছে না? মোহন তোকে ইংরেজি পাঠশালায় ভর্তি করিয়ে দেবে। তুই ইংরেজি শিখবি। তোর বাবারও সে রকম ইচ্ছে? আমাদের এখানে তো ইংরেজি শেখার তেমন কোনো সুযোগ নেই।
মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে আঁচলের নিচে অক্ষয় মুখ লুকালো। ভেজা ভেজা গলায় বলল, তোমার জন্য খুব মন খারাপ করবে। আর বাবার জন্যও।
খুন্তি রেখে দয়াময়ী তার পাগল ছেলেটার কপালে চুমু খেয়ে বললেন, সে আবার কী কথা খোকা! লেখাপড়া শিখতে গিয়ে বাড়ির জন্য কেউ মন খারাপ করে? বোকা ছেলে! এখন যা, তোর বইখাতা জামাকাপড় সব গুছিয়ে রাখ।
রাত্রে খেতে বসে বাবা বললেন, হ্যাঁ রে মোহন, খোকাকে যে নিয়ে চললি তা কোথায় কার কাছে পড়াবি ঠিক করেছিস?
খেতে খেতে মোহনদা জবাব দিলেন, সে আমি ঠিক করে রেখেছি জেঠু। জয়কৃষ্ণ সরকার ও গঙ্গানারায়ণ সরকার খিদিরপুরের খুব নামডাকঅলা ইংরেজির শিক্ষক। তাদের কারো কাছে অক্ষয়কে পড়াবো। এসব নিয়ে আপনি ভাববেন না। কখন কী করতে হবে, সেসব আমার ওপর ছেড়ে দিন। মনে করুন যে, আজ থেকে আমিই ওর অভিভাবক। বাবা মারা যাওয়ার পর আপনি যেরকমভাবে আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, আদর-স্নেহ দিয়ে তৈরি করে দিয়েছেন, আমিও অক্ষয়কে সেভাবেই বড় করে তুলব।
দয়াময়ী বললেন, সে ভরসাতেই ওইটুকু ছেলেকে তোমার হাতে ছেড়ে দিচ্ছি মোহন। আমরা জানি, তুমি ওকে ঠিকঠাক দেখে রাখতে পারবে। আরেকটু মাংস দিই মোহন? কিছুই তো প্রায় খেলে না?
না-না জেঠিমা। অনেক খেয়েছি। কতদিন পর আপনার হাতের রান্না খাচ্ছি, বলুন তো? আর খাওয়ার কথা কি আমাকে বলতে হয়? কি রে অক্ষয়, মনভরে মায়ের রান্না খেয়ে নে। ওখানে গিয়ে কিন্তু এই অমৃত আর পাবি না।
মুখে লোকমা তুলে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো অক্ষয়। তার চোখে জল এসে যাচ্ছে।
পরদিন শেষবিকেলে বাকসো-পেটরা নিয়ে মোহনের সঙ্গে খিদিরপুর পৌঁছল অক্ষয়। নতুন জায়গা। নতুন লোকজন। কিন্তু তেমন ভালো লাগছিল না তার। বারবার বাড়ির কথা মনে পড়ছিল। মা এখন কি করছেন? আর বাবা? তার জন্য তাদেরও নিশ্চয়ই মন খারাপ লাগছে!
তার মনের ভাব টের পেলেন মোহনদা। বললেন, কি রে, বাড়ির জন্য মনখারাপ করছে?
অক্ষয় জবাব দ্যায় না। ঘাড় নাড়ে শুধু।
মোহনদা বললেন, ভাবিস না। দেখবি, কিছু দিন যেতে না যেতেই মনখারাপ ভাবটা অনেক কমে আসবে। এখন নে, হাতমুখ ধুয়ে আয়। ততক্ষণে আমি খাবার সাজিয়ে ফেলছি।
আসবার সময় দয়াময়ী দেবী পাঁঠার মাংস আর কয়েকটা রুটি পোটলায় দিয়ে দিয়েছিলেন। মোহন সেগুলো বের করে গরম করে ফেলল। হাত-মুখ ধুয়ে এলো অক্ষয়। একফাঁকে মোহনও ঘুরে এলো কূয়োতলা। এরপর তারা খেতে বসলো।
খেতে খেতে মোহন বলল, খাওয়া হয়ে গেলে ঘুমিয়ে পড়তে হবে, বুঝলি! শরীরে তেমন জুৎ পাচ্ছি না। তোরও নিশ্চয়ই ক্লান্তি লাগছে। টানা ঘুম দিয়ে সকালে উঠে দেখবি, দারুণ ঝরঝরে লাগছে নিজেকে।
খাওয়া হয়ে গেলে কূয়োতলা গিয়ে বাসনপত্র ধুয়ে নিয়ে এলো মোহন। অক্ষয় খাটে শুয়ে সিলিংয়ের দিকে চেয়ে ছিল। তার পাশে শুয়ে পড়ল মোহন। কি রে, ঘুম আসছে না?
এই তো, ঘুমোচ্ছি। বলে পাশ ফিরে শুলো অক্ষয়। মোহন গায়ের ওপর কাঁথা টেনে নিল।
পরদিন কোর্ট থেকে বাড়ি ফেরার পথে জয়কৃষ্ণ সরকারের সঙ্গে দ্যাখা করল মোহন। বাড়িতে কয়েকজন ছাত্রকে রোজ দু’বেলা ইংরেজি শেখান তিনি। মোহন তাকে অনুরোধ করল, কোনো একটা ব্যাচে অক্ষয়কে ভর্তি করে নিতে। কয়কৃষ্ণ রাজি হলেন। তাকে নমস্কার জানিয়ে মোহন হাসিমুখে বাড়ি ফিরল।
জানলার কাছে বসে দূরে চেয়ে ছিল অক্ষয়। মোহনের ডাকে মুখ ফিরিয়ে তাকালো।
কি রে, মনখারাপ করে চুপচাপ বসে আছিস যে বড়! আচ্ছা যাক, শোন, তোর মন ভালো হয়ে যাবে। তোর ইংরেজি শেখার ব্যবস্থা করে এলাম। জয়কৃষ্ণ সরকারের কাছে প্রতিদিন বিকেলে পড়তে যাবি। আমি একটু আগে কথা বলে এলাম। কী, এবার খুশি তো?
তিনি কোথায় পড়ান?
সেসব তোকে ভাবতে হবে না। কাল বিকেলে আমিই তোকে তার কাছে নিয়ে যাব। তখন চিনে আসিস। এখন ওঠ তো।
কোথায়?
সেই তো সারাটা দিন ঘরে শুয়েবসে কাটিয়ে দিলি। এখন চল একটু বেড়িয়ে আসি। যাবি?
খাট থেকে নামতে নামতে অক্ষয় জবাব দিল, চলো।
মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে জয়কৃষ্ণ সরকার ছাত্রদের পড়ান। প্রথমদিকে অক্ষয়ের ভেতর একটু জড়তা থাকলেও ধীরে ধীরে সেটা সে কাটিয়ে উঠল। এখানে যারা পড়তে আসে তারা প্রত্যেকেই অভিজাত পরিবারের। তাদের ঠাটবাটই আলাদা। সাহেবি পোশাক-আশাক। আর সে সাধারণ পোশাকের সাধারণ ঘরের এক ছেলে। এমনিতে অবশ্যি কারো সঙ্গে সে তেমন কথাটথা বলতো না। মাস্টার যা পড়াতেন, তার মনোযোগ থাকতো সেদিকে। ছুটির পর একা একা বাড়ির পথে হাঁটা ধরতো। ছাত্রদের কেউ কেউ জোট বেঁধে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাসি-তামাশা করতো। একদিন তার পিছু নিল এক ছাত্র। জিগেশ করল, তুমি কি কারো সঙ্গে মিশতে পারো না, নাকি?
অক্ষয় জবাব দিল, কেন?
ছেলেটি বলল, কারো সাথেই তো তুমি তেমন কথা বলো না। তোমার বাড়ি কোথায়?
চুপীতে।
ওমা, সে তো মেলা দূর। তুমি অতদূর থেকে এখানে পড়তে আসো?
বিরক্ত হলো অক্ষয়। বলল, তা কেন হবে? আমি তো এখানেই থাকি। আমার দাদার সঙ্গে।
তোমার দাদা কি করেন?
উনি সুপ্রিম কোর্টের মাস্টার অফিসের বড়বাবু। উনার নাম হরমোহন দত্ত।
ছেলেটি বলল, সেই যে যিনি তোমাকে মাস্টার মশায়ের কাছে দিয়ে গেছিলেন, উনিই তো?
অক্ষয় ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ।
তোমার দাদা তো বেশ বড় চাকরি করেন তাহলে। তা তুমি এরকম সাধারণ জামা-কাপড় পরো কেন? আমাদের মতো সাহেবি পোশাক পরতে পারো না?
ওসব আমার ইচ্ছে করে না। আমি ইংরেজি শিখছি সাহেব হতে নয়, ভাষাটা জানার জন্যে। ইংরেজি ভাষায় কত ভালো ভালো বই লেখা হয়, জানো?
ছেলেটি ঘাড় নাড়ল। মনে হলো, তার সঙ্গে কথা বলার আর আগ্রহ পেল না। হাতের বই দোলাতে দোলাতে অন্যদিকে হাঁটা ধরল।
(চলবে…)
মনে হচ্ছে একটি উপন্যাস হয়ে উঠছে। পড়তে আরাম লাগছে, জানতেও পারছি অক্ষয়কুমার দত্তকে।
সরল বয়ান,সাবলীল গতি।তথ্যবহুল আলোচনা।অসাধারণ হয়েছে।
খুব ঘরোয়া ভাবে মুখের ভাষায় সহজ সাবলীল অক্ষয় কুমার দত্তের জীবনকথা গতি পেয়েছে। লেখাটির মধ্যে আকর্ষণ আছে।জীবনের উত্তাপ আছে। নিষ্ঠা ও বাস্তবতায় এক ধরনের ভালোলাগা ছড়ানো আছে।
বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান এক গদ্যকার, এক সমাজ সংস্কারক, এক শিক্ষাবিদকে আলোকিত করার প্রয়াসে তাঁর জীবনধারাকে তুলে ধরার যে আয়োজন হয়েছে এই লেখাটিতে, তা খুবই আশাব্যঞ্জক বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে। চিরাচরিত ধারায় এই লেখাটিতে পাণ্ডিত্যের প্রতিফলন ঘটানোর প্রচেষ্টা নেই, বরং সহজ সাবলীল কথন ভঙ্গিতে এক মহাজীবনকে উপস্থিত করার মরমিয়া স্পর্শটি অনুভব করলাম।
এত সুন্দর লেখাটি বারবার পড়ে ফেললাম।
সত্যকে গল্পে রূপান্তর করে উপস্থাপন। স্রোতের মতো সাবলীল ভাষা আর ভাবনার সচ্ছলতায় সম্মিলনে পাণ্ডিত্বের কচকচানি এড়িয়ে উপভোগ্য হয়ে পরিবেশনা।
ভালো লেখা। ধন্যবাদ।
ভালো লেখা। সরফরাজ ভাইকে ধন্যবাদ।